| 9 অক্টোবর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা উপন্যাসিকা: সপ্তপর্ণী । অনিন্দিতা মণ্ডল

আনুমানিক পঠনকাল: 39 মিনিট


খৃষ্টীয় পঞ্চম শতকের শুরু। ভারতবর্ষ আবার সংহত এক ভূখণ্ড। রাজশক্তি পুনরায় জনসাধারণকে শান্তির জীবন দিতে উদ্যোগী। যুদ্ধশেষে বিজয়ী রাজা যেমন উৎসবের আনন্দে কাল অতিবাহিত করেন, তেমনই। সঙ্গে আর একটি আনন্দের কারণ ঘটেছে।
উজ্জয়িনীর পশ্চিম নগর দুয়ারের বাইরে তখন সূর্যাস্তের শেষ আলো। নগরীর উৎসব রাত্রি শেষ হয়নি। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তর যোগ্য প্রতিনিধি, বিক্রমাদিত্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও রাজ্ঞী ধ্রুবস্বামিনীর পুত্রলাভ হয়েছে। পক্ষাধিক কাল পাটলিপুত্র এবং উজ্জয়িনী যুগপৎ উৎসবে মগ্ন। সমস্ত দেশ আনন্দে ভাসছে। কতশত বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কতশত দরিদ্রকে পট্টোলী দিয়ে ভুমিদান করা হয়েছে। অনাথ শিশুদের রাজকোষ থেকে ভারবহনের আয়োজন করা হয়েছে। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তর আসমুদ্রহিমাচল সাম্রাজ্য স্থাপনের কারণে বৃহৎ সেনাবাহিনীর কর্মে যুক্ত বহু সৈন্যের বীরগতিলাভের পর থেকে তাদের বিধবা পত্নী ও পরিবারের ভরণপোষণ ব্যবস্থা রাষ্ট্রের। এ সমস্তই রাজ্যবাসীকে খুশি করার জন্যে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের যশ অক্ষুণ্ণ রাখতে। শোকসন্তপ্ত ক্ষুধায় কাতর পরিবারবর্গকে আরাম দিতে। তবুও কোথাও অশান্তির জ্বালা মানুষকে কুরে খায়। এ তার স্বভাব।
নগরী থেকে কয়েক যোজন দূরে একটি গ্রামে তখন দিনশেষের পর গৃহস্থ নিদ্রা গিয়েছে। কৃষক মানুষ অকারণ প্রদীপে তেল দিয়ে তেল অপচয় করে না। তাদের কাজ শুরু হয় সূর্যোদয়েরও আগে। দিনের আলোয় যা করা যায় রাতের আঁধারে তা সম্ভব নয়। বপ্যঘোষবাট নামের এই গ্রামে একটি গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাক। একটি বৃহৎ দীঘির ধারে কয়েকটি মাটির কুটীর ঘিরে একটি মাটির পাঁচিল। একটি ঘরে ক্ষীণ দীপ জ্বলছে। দীপের আলোয় দেখা যাচ্ছে একটি শয্যায় শায়িত এক বৃদ্ধ। তাঁর লোলচর্ম মুখাবয়বে যেন কী আছে। একটি অভিজাত ভাব তাঁর রোগশীর্ণ পাণ্ডুরতাকে ছাপিয়ে জেগে উঠেছে। তিনি মৃত্যুপথযাত্রী। বুকের পাঁজর দীর্ঘ শ্বাসের তালে উঠছে নামছে। যেন বহু কষ্টে শ্বাস পড়ছে। তাঁর ডান হাতটি ধরে বসে আছেন আরেক বৃদ্ধ। তিনি চোখ বন্ধ করে রুগীর নাড়ি অনুভব করছেন। শয্যার সামনে মাটিতে বসে দুটি যুবক। রুগীর পায়ের কাছে এক বৃদ্ধা। নাড়ি অনুভব করতে করতে ধীরে ধীরে নেতিবাচক মাথাটি নাড়লেন কবিরাজ ভট্ট ভবস্বামী। যুবক দুটি হতাশ চোখে দেখলেন। তিনি আস্তে আস্তে বললেন – বৎস বুদুক, তোমাদের পিতার অন্তিমকাল আসন্ন। রাত পেরোবে কিনা বলতে পারি না। তবু ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। ভোরের আগে শবসৎকার আয়োজন সম্ভব নয়। বুদুক নামের যুবকটি মাথা নীচু করল। গ্রামে বিশেষ মানুষ নেই এখন। সবাই গিয়েছে উজ্জয়িনী। দেদার ফুর্তি সেখানে। এই মার্গশীর্ষকালে কেউ নতুন পাকা ধানেও পাহারা রাখেনি। এবারে কর দিতে হবে না। চোরেও নেবে না। তাদেরও এখন বিনিমুল্যে আমোদ। বুদুক কবিরাজের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল – ঠাকুর, আপনি তবে আর কালক্ষেপ করবেন কেন? আপনি বরং গৃহে চলুন। আমি পৌঁছে দিই। ভোর হলে সংবাদ দেবো। অন্য যুবকটি সব শুনেছে। সে কিছু চঞ্চল। কিন্তু শোকে বা দুঃখে নয় বলেই মনে হচ্ছে। অন্য কোনো কারণে অস্থির সে। বুদুক তার দিকে চেয়ে বলল – কুণ্ড, তুমি বরং ঘরে যাও। বিশ্রাম করো। প্রভাতে বিস্তর কাজ আছে। নিদ্রার অভাবে চঞ্চল হয়েছ।
বাস্তবিক এ কদিন তারা সকলেই পিতার জন্যে বিনিদ্র রাত্রি কাটিয়েছে। কিন্তু শুধুই কি নিদ্রার অভাব? কুণ্ড এতকাল যেন কি এক উৎকণ্ঠা চেপে ছিল। তাই যদিও মৃত্যু দুঃখের, মৃত্যু শোকের, তবু কোথাও যেন একটি মুক্তির অনুভব। রুদ্ধশ্বাস গোপনীয়তার থেকে মুক্তি। কুণ্ড টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। চাঁদের আলোয় তার কুটীরটি দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে যেতে যেতে সে শুনতে পেল বৃদ্ধা মাতার একটানা নীচু গলার কান্না।
আপাতত শয্যায় শরীরটি এলিয়ে দিতেই কুণ্ড ঘুমিয়ে পড়ল। এখন মৃদু শীতল বাতাসে আরামে তার চোখ জুড়ে গেলো। কে বলবে কেন আসন্ন পিতৃহারা হবার শোক তাকে মুহ্যমান করছে না? বরং সে যেন মুক্তির আনন্দে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত্রি তখনও শেষ হয়নি। কুণ্ড অদ্ভুত সেই স্বপ্নটি দেখল। এমন দেশ নয় তো! সে এক শ্যামল সবুজ দেশ। চারিদিকে ঘন হয়ে আসা অরণ্যসবুজ। সেই সবুজের মধ্যে তিরতিরে জলের আভাস। কুণ্ড যেন আশ্চর্য। মাঝে মাঝেই এই স্বপ্নটা ঘুরে ফিরে আসে। এ দেশটা কি জলে ভাসে? যত ক্ষেত্র যত অরণ্য সব যেন জলজ। তাদের মুল যেন জলেই প্রোথিত। একটা সোঁদা গন্ধ যেন স্বপ্ন ছাপিয়ে তার নাকে লাগে। দৃশ্য পরিবর্তন হয়। সে দেখতে পায় একটি প্রশস্ত সোপান। ধীরে ধীরে নেমে গিয়েছে নীচে। মাত্র ক’টিই ধাপ। তারপরেই একটি নদী। ঘুম ভেঙে উঠে বসে কুণ্ড অনুভব করল এই একই স্বপ্ন কিছুকাল যাবৎ সে প্রায়ই দেখছে। ওই জলের মধ্যে নেমে যাওয়া সোপানে সে কোমর জল অবধি নেমেছে আর স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা পরিণতি সে আশা করেছে। এখনো স্বপ্নটি অসমাপ্ত।
বাইরে তখন কান্নার শব্দ কিছু তীব্র। মায়ের বিলাপ ছাড়া বাকি কণ্ঠস্বরগুলো কৃত্রিম মনে হল তার। কুণ্ড আচ্ছন্নভাবে শয্যা ছাড়ল। পিতা তবে দেহত্যাগ করলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই সব কিছু বলে গেলেন না। ধীরে ধীরে সে পিতার শয্যার কাছে গেল। রোগপাণ্ডুর মুখখানি যেন শান্তি পেয়েছে। তারপর শয্যার নীচ থেকে একটি থলি টেনে বার করল। থলিতে কিছু কাপড়চোপড় রাখা। আতুর মানুষের সেবার প্রয়োজনে রাখা হয়েছে এমনই মনে হবে। কারো মনে সন্দেহ জাগবে না। কুণ্ড হাত দিয়ে কিছু অনুভব করল। কঠিন কিছু। সে একবার শোকে কাতর মায়ের দিকে চাইল। মা মুখ তুললেন। দৃষ্টিতে এত শোকের মধ্যেও যেন একটি অভয়। পিতা শুধুই নির্দেশ দিয়ে গেলেন। জানিয়ে গেলেন তাঁর মৃত্যুর পর কুণ্ডর কী কর্তব্য।
ক্রমশ বুদুকের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ছে। বুদুকের সাম্প্রতিক কাজকর্ম, গতিবিধি কুণ্ডর মনে ভীতি জাগিয়েছে। ভট্ট ভবস্বামী পিতার জন্য ইদানীং যে ভেষজ ঔষধ ব্যবস্থা করেছিলেন বয়সের কারণে সেটি রাত্রিকালে নিজে প্রয়োগ করতে পারতেন না। কিন্তু সেই তীব্র বিষ অভিজ্ঞ চিকিৎসক বিনা প্রয়োগে যে অচিরে মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে সে কুণ্ড জানত। কিন্তু ঔষধ প্রয়োগের অধিকার বুদুক নিজের হাতে রেখেছিল। সে কুণ্ডর চেয়ে বড়। তার অধিকার বেশি। ভট্ট ভবস্বামী বুদুককে ভালো করে মাত্রা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মাত্রা অনুসারে ঔষধ যতদিনে শেষ হবার কথা, তার পূর্বেই শেষ হয়েছে। তিনি বুদুককে তিরস্কার করেছেন এই বলে যে, অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য ঔষধ। স্নায়ুকে পুনরায় সজাগ করে। এহেন ঔষধ বুদুক যেন এভাবে নষ্ট না করে। তাঁর ধারণা হয়েছিল, বুদুক মাটিতে ফেলে ঔষধ নষ্ট করেছে। এত কম মাত্রা সে ঠিক মাপতে পারেনি। বুদুক নিশ্চিন্ত স্বরে ভট্টবৈদ্যকে বলেছিল—নিশ্চিন্ত থাকুন ভট্ট। আমি মাত্রা দেখে নিয়েছি। কুণ্ড টের পেয়েছে। রাত্রের মাত্রাতেই কারসাজি হতো।
আকাশের গায়ে এখন নীলচে আভা। রাত্রি প্রভাত হতে চলেছে। অনিশ্চিত বিপদের আশঙ্কায় কুণ্ডর বুদ্ধি আচ্ছন্ন হচ্ছে। পিতার কাছে যতবার কুণ্ড জানতে চেয়েছে ততবার পিতা যেন সত্যকে আড়াল করে গিয়েছেন। মনে কী শঙ্কা ছিল কে জানে? অথচ বুদুক যেন জানে আরও কিছু। প্রভাতের দেরি নেই দেখে কুণ্ড কুটীরের বাইরে এলো। কৃষিজীবী গ্রামটি এখন সবে জেগে উঠছে। দু একটি শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে। দূরের বৌদ্ধ সংঘারাম থেকে ঘণ্টার শব্দ এলো। সেই শব্দে কুণ্ডর আচ্ছন্নতা কেটে গেল। যেন আলো দেখতে পেল। সে বেরিয়ে পড়ল। গ্রামের সকলকে সংবাদ দিয়ে শব সৎকারের আয়োজন করতে হবে। সংবাদ দেওয়ার দায়িত্ব তার। কিন্তু তার আগেই সে সেই থলিটি একটি কাপড়ে মুড়ে নিলো। তারপর পা চালিয়ে এগিয়ে গেল সংঘারামের উদ্দেশে।
বুদুক তখন ব্রাহ্মণ ভট্ট ভবস্বামীর নির্দেশ অনুযায়ী সঞ্চিত তিন ঘড়া ঘি এবং কিছু আম কাঠ ও বেল কাঠ একত্র করছে। অদূরে দীঘির পাড়েই সৎকার কার্য সম্পন্ন হবে। গৃহের পরিচারক বর্গ কাঠ বহন করে দীঘির ধারে নিয়ে চলেছে। কিন্তু পাঁচজনে না এলে হবে না। পাঁচজন গাঁয়ের লোকে জানবে দেখবে যে পিতা পশুপতি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বৃদ্ধ যে প্রচুর ভূসম্পত্তি রেখে গিয়েছেন তা দুই পুত্রের মধ্যে বিলি হবে। সবই গাঁয়ের পাঁচজন করবে। বুদুক তাই ধৈর্য ধরছে। কুণ্ড যে সংবাদ দিয়ে সকলকে আহ্বান করে আনতে গিয়েছে তা সে শুনেছে। অকস্মাৎ সংঘারামের প্রবল ঘন্টাধ্বনি কানে আসতেই বিরক্ত বুদুক সামনের পরিচারকটিকে কড়া গলায় বলল – এত দেরি কেন? রোদ উঠে গেলে অসুবিধে হবে যে! কবিরাজ মশাই বলে গিয়েছেন, সৎকারে বিলম্ব হলে পচন ধরবে। উপস্থিত পরিচারকেরা দেহে বিষক্রিয়া লক্ষ করেছে। সম্ভবত রোগই এর কারণ বলে তারা মনে করছে। কিন্তু দেরি হলে বিকৃতি রোধ করা যাবে না। বুদুক অস্থির হয়ে পড়ছে। শুধু দেহ সৎকারে বিলম্ব বলে নয়, হঠাৎ সংঘারামে ঘন্টা কেন? তবে কি স্থবির সুমনগুপ্ত এরই মধ্যে সংবাদ পেয়েছেন? কুণ্ড কি প্রথমে তাকেই সংবাদ দিল? এই আশংকা যে তার হয়নি তা নয়। কুণ্ডর গতিবিধি, ভাগবত ধর্মে তার অনীহা, অধুনা জেগে ওঠা ভাগবত বনাম প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের বিরোধ তার আর কুণ্ডর মধ্যেও বিরোধ সঞ্চার করেছে। অন্তত এমনটাই বিরোধের বাহ্য কারণ। এখন তার আশু কর্তব্য পিতার শবদাহ। সে দ্রুত নির্দেশ দিল–শবদেহ দীঘির ধারে আনা হোক।
ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী।
কুণ্ড দ্রুত পৌঁছেছে সংঘারামে। এখনও প্রভাতের কিরণ আকাশ আলো করেনি। এখন যদি কেউ দুয়ারে করাঘাত করে তা খোলা হবে না। রজনীর শেষপাদ। কুণ্ড তাই দুয়ারে লম্বমান বিরাট ঘন্টাটি বাজিয়ে দিলো। একবার বাজালে আর্ত অতিথি। দু’বার বাজালে চোরের উৎপাত। তিনবার বাজালে কারোর ঘোর বিপদ। কিন্তু ক্রমাগত বাজালে? স্থবির সুমনগুপ্ত গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। তাঁর ধ্যানসমাহিত চেতনায় সজোরে যেন কে ঘা দিলো। কে যেন একটি জল ভরা কলসী উপর থেকে নীচে গড়িয়ে দিলো। সোপানে ক্রমাগত আঘাত পেতে পেতে তা এসে পড়ল অতি নিকটে। স্থবির দ্রুতপদে নেমে এলেন তাঁর কক্ষ থেকে। কে এসেছে? এভাবে অবিচ্ছিন্ন ঘন্টাধ্বনি যে রাষ্ট্রদ্রোহের সংকেত দেয়! ধর্মদ্রোহও অসম্ভব নয়! তাঁর নির্দেশে দ্বার খোলা হতে দেখা গেলো একটি শ্যামবর্ণ যুবক দাঁড়িয়ে। কুণ্ডকে সংঘারামে সকলেই চেনে। অতি সম্প্রতি সে স্থবিরের কাছে ধর্মের শরণ নিয়েছে। সেবিষয়ে তার পিতার বিশেষ আগ্রহ ছিল বলে জানা যায়।
গ্রামের সকলেই জানে, বৃদ্ধ পিতা কিছুকাল যাবৎ পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং থের সুমনকে গৃহে নিমন্ত্রণ করেন। ধর্মকথা শোনার আগ্রহ এমন আতুর মানুষের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। কুণ্ডও সেই আলোচনায় অংশ নেয়। তবে কুণ্ডর অগ্রজটি মোটেই খুশি নয়। সে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য। তবু কুণ্ড অবিচল। এ কারণে স্থবির তাকে কিছু অতিরিক্ত স্নেহ করেন। এখন কুণ্ডের সম্মুখে এসে কিন্তু ভর্ৎসনা করলেন – এমন করে ঘন্টা বাজানোর কারণ? কুণ্ড উত্তর না দিয়ে কাপড়ের মোড়কটি স্থবিরের হাতে তুলে দিলো। তারপর বলল–আপনার ধারণাই সত্য। এই তার প্রমাণ। আপাতত পিতার ন্যায় আমারও প্রাণসংশয়। আমি কোথা যাই? স্থবির কুণ্ডর বাহু আকর্ষণ করে সংঘের ভিতরে টেনে আনলেন। তারপর তাকে নিয়ে গেলেন নিজের কক্ষে। স্বল্পালোকে তিনি কুণ্ডকে দেখলেন। ধীরে ধীরে কাপড়ের মোড়কটি মাটির ভিতরে লুকানো একটি গহ্বরে নিক্ষেপ করে তার মুখটি বন্ধ করলেন। কুণ্ড অবাক হয়ে দেখছিলেন বৃদ্ধ স্থবিরের কি অপরিসীম দৈহিক বল। একা হাতে লুকোনো গর্তটি খুঁড়ে আবার তা ঢেকে নিলেন অত্যন্ত পটু হাতে। অঘ্রানের শীতেও তাঁর দেহে শ্রমজনিত বিন্দু বিন্দু স্বেদ। স্থবির এরপর স্থির কণ্ঠে বললেন–কুণ্ড তুমি পূর্বদিকে যাত্রা করো। তোমার অভীষ্ট পূর্ণ হবে। এখন তোমার হতভাগ্য পিতার শব সৎকার হচ্ছে নিশ্চয়। এখনই তোমাকে কেউ অনুসরণ করবে না। তুমি সংঘে রক্ষিত অশ্ব থেকে একটি নিতে পারো। নিশ্চিন্তে যাও। যেমনটি বলেছি, তথাগতকে স্মরণ করে অগ্রসর হও। তিনি তোমায় রক্ষা করবেন। জানবে এক পূণ্য কর্মে পূণ্য উদ্দেশ্যে তুমি যাত্রা করছ। ধর্মের এক অদ্ভুত যুগসন্ধিতে তোমার ভূমিকাটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এরপর কুণ্ডকে তিনি কিছু গোপন উপদেশ দিলেন। সঙ্গে দিলেন অন্য একটি থলি। অত্যন্ত গোপনে নিয়ে যেতে হবে সেটি। উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কাউকে সেটি দেওয়া চলবে না।
ভোরের আলো ভালো করে ফোটার আগেই কুণ্ড অশ্ব ছুটিয়ে দিলো। গ্রামের সীমানা পেরোবার সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে পিতার চিতার আগুন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পিতার উদ্দেশ্যে নমস্কার জানিয়ে সে গতি দ্রুত করল। স্থবির যখন আশ্বাস দিয়েছেন তখন চিন্তার কারণ নেই। তবু মাত্র বিশ বছরের তরুণ, যে কখনও গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে দূরে যায়নি, যার পরিবারে কেউ যুদ্ধে যায়নি, আজ সে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। প্রত্যাবর্তনের পথ কি খোলা থাকবে? এক অজানা কারণে কুণ্ড কেন যে শঙ্কিত হচ্ছে!



মৃগস্থাপন বিহারের দুয়ারে আজ প্রাতেই গৃহস্থ মানুষের ভিড়। নালন্দা থেকে মৃগস্থাপন আসা এখন সহজ। এই গুপ্তরাজারা তখনও এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। শ্রীগুপ্ত এই বরেন্দ্রভুমিরই একজন স্থানীয় নৃপতি ছিলেন। মহারাজ শ্রীগুপ্ত। লোকে বলে বংশপেশা ছিল আয়ুর্বেদ চর্চা। ক্রমে সেই বেদের ধারাতেই নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিয়েছেন পরবর্তী নৃপতিরা। শ্রীগুপ্ত বৌদ্ধধর্মের প্রতি বড়ই অনুরক্ত ছিলেন। মাত্র কয়েকটি ভুক্তি নিয়ে রাজ্য। তবু নালন্দা থেকে মৃগস্থাপন যেতে সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা চিন্তা করে চব্বিশটি গ্রাম দান করেছিলেন। সেই জমিতে মৃগস্থাপন বিহার নির্মাণ। লোকে এও বলে যে শাক্যমুনি নাকি এই পথ ধরে সমতট পর্যন্ত পরিক্রমণ করেছিলেন। এই পথঘাট তাই পবিত্র। তাঁর ছোঁয়ায় পূত। তাই শ্রীগুপ্তর দানে পথ তৈরি, পান্থশালা নির্মাণ ইত্যাদি সৎকাজ হয়েছিল। বাকি যা উদ্বৃত্ত জমি, তাতে বিহারের আয়ের জন্য চাষবাস চলে। চল্লিশ যোজন পথ প্রজারা গঙ্গার তীর ধরে চলে আসতে পারত। কে বলবে তার আগে এখানে জঙ্গল ছিল? চারিদিকে উর্বর শস্যশ্যামল কৃষিক্ষেত্র। এখন গুপ্ত রাজারা একরাট, সম্রাট, বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করে রাজা মাত্রই ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে সিংহাসন আলো করছেন। তাঁরা এখন হিন্দু পুরাণ রচনায় উৎসাহ প্রদান করেন। বিষ্ণুর অবতারত্বে তাঁদের পূর্ণ বিশ্বাস। আর সেই অবতীর্ণ শক্তির কিছুটা যে তাঁদের মধ্যেও বহমান একথা তাঁরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। তাঁরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি। নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধ ধর্মের চেয়ে আস্তিক হিন্দু ধর্মে তাঁরা আস্থা রেখেছেন। প্রজাপালনে সুবিধে বৈকি। এমন যে সমুদ্রগুপ্ত, আসমুদ্রহিমাচল জয় করে যিনি মৌর্য স্মৃতি ফিরিয়ে আনলেন, তিনিও আপন শৌর্যে তত আস্থা রাখতে পারলেন না। তাঁকে অশ্বমেধ যজ্ঞ করে সেই প্রাচীন বৈদিক অনুষ্ঠানের রীতি পুনঃপ্রবর্তন করতে হলো। দিকে দিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পরল। উত্তরাখণ্ডের হিন্দু প্রজারা আহ্লাদে গলে গেলেন। শুধু এই প্রত্যন্ত রাষ্ট্রগুলি কিছুটা সংশয়ে থাকে। সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য অত্যন্ত উদার। বৌদ্ধ বিহারেও তাঁর দানধ্যান আছে। তবু সংশয় জাগে। রাজার চেয়ে রাজার প্রতিহারীর আস্ফালন বেশি।
মৃগস্থাপন একটি নিবেদন বিহার। বিহারের চারিভিতে চারটি স্তুপ বুদ্ধের দেহের বিভিন্ন অংশের প্রতীক। মাঝে চৈত্য। গোলাকার একটি নিবেদন মঞ্চ। এই মুল অংশটিকে ঘিরে বিহারের বাকি স্থাপত্য। মৃগস্থাপনের আচার্য সঙ্ঘশ্রী সত্যদেব এখন রাজপুত্র জন্মানোর উপলক্ষে প্রার্থনার আয়োজন করেছেন। বহু সাধারণ পৌণ্ড্র ও বারেন্দ্র প্রজা এসেছেন প্রার্থনায় অংশ নিতে।
বিহারের বাইরে অদূরে একটি টিলায় চারজন যুবক বসে। এদের দেখে খুব যে উৎসুক মনে হচ্ছে তা নয়। কিছুটা বিরক্ত ভাব। চারজনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট যে, কপিল, সেই বলল – আর কতক্ষণ এই মিগথাপে বসে থাকবে? বলি ঘরে পৌঁছতে কত সময় লাগবে জানো? দুপুর গড়ালো। পেটে কি ওই চিড়ে ভেজানোই জুটবে? তার রাগত কণ্ঠস্বরে দুজন হেসে উঠল – আমরা ঠিক জানি, তুই এসেছিস সোনার লোভে। সম্রাট যদি কটা দিনার দানের জন্য হুকুম করে থাকেন তবে বেশ হয়। কি বলিস? তা কি আর করা। ছত্তিবনায় ওসব আশা করো না আগেই বলে দিই। সেটি হলো দরিদ্রের আশয়। সবচেয়ে বয়স বেশি যার সেই দামুক নাম্নী যুবকটি গম্ভীর গলায় উপহাস থামিয়ে দিলো। তারপর বলল – চলো দেখি। পথ ধরি। এখানে দানের আশায় কে এসেছে? এখানে সম্রাটের পুত্রের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনায় এসেছিলাম। কপিল হতবাক – এত দূর? হায়! সে তো ছত্তিতে করলেই মিটত। পরিহাসপরায়ণ যুবক দুটি মুচকি হাসল। আহা, দান কি আর ছত্তিতে সম্ভব? কপিল মুখ ভার করে চলতে শুরু করল। সত্যিই সে বড় নিরাশ হয়েছে। এই প্রথম সে এত দূর এসেছে। তার দাদারা আগে মিগথাপে এসেছে। সে এই প্রথম। সে শুনেছিল এরকম শুভ সময়ে নাকি বিহারে আগত মানুষজনকে সম্রাটের পক্ষ থেকে দান করা হয়। এরকম শূন্য হাতে ফিরতে হবে ভাবেনি।
মৃগস্থাপন থেকে সমতট দূর পথ। এতটা আসার কারণ দামুক কিছু বলেনি। তবে মনে মনে সে জানে, প্রধান উদ্দেশ্য রাজকর্মচারীদের নজরে পড়া। তারা একই পরিবারের চারটি ছেলে। পিতা ও পিতৃব্যদের সন্তান। বংশানুক্রমে তারা দারুশিল্পে যুক্ত। কাঠের সঙ্গে বাঁশ ও বেতে তৈরি সামগ্রীও তাদের পণ্য। পাশাপাশি মধু তাদের বনজ সম্পদ। সমতটের ও অঞ্চলে মধুচক্রের প্রাচুর্য আছে। এখন তাদের উদ্দেশ্য সম্রাটের নজরে পড়ে রাজপ্রাসাদ বা রাজকীয় অট্টালিকা মন্দির ইত্যাদিতে কর্মে যুক্ত হতে পারা। গুপ্তরাজারা শিল্প ও সাহিত্যে অনুরাগী। সেখানে ধর্ম তাদের বিচার্য নয়। প্রকৃত গুণীকে তারা যথাযোগ্য সম্মান করেন। কিন্তু আশা পূর্ণ হল না বলেই মনে হয়। যদিও দামুক তাদের হাতে তৈরি বেত ও বাঁশের নানাধরনের ঝুড়ি, কাঠের মূর্তি, ইত্যাদি বিহারে দান করেছে তবু মৃগস্থাপন বিহারের মহাধ্যক্ষ যেন সংকুচিত। রাজকর্মচারী কেউই প্রার্থনায় আসেননি। এমনকি মৃগস্থাপনের দেখাশুনা করেন যে উপরিক মহাশয় তিনিও আসেননি। তিনি নাকি বিহারের অদূরেই চক্রস্বামী বিষ্ণুর মন্দির প্রতিষ্ঠা যজ্ঞে উপস্থিত আছেন। সে যজ্ঞের ধূম চারিদিক আচ্ছন্ন করেছে।
এখন মধ্যাহ্ন। কাকডাকা ভোরে চারজনে বেরিয়েছে। লাল মাটি আর উঁচু রুক্ষ জমি ছাড়িয়ে সমতটের যে অঞ্চল এই চার যুবকের গন্তব্য তা বেশ দূরে। অতএব পথে রাত কাটাতে হবে। ক্রমে বরেন্দ্রভুমির টিলা টিলা অঞ্চলগুলি মিলিয়ে আসছে। মাঝে পড়ছে ঘন বন। ধরিত্রী ক্রমেই সাগরতলের সমান হচ্ছে। নিম্নভূমিতে জলা দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও নিমজ্জিত ভুমি জলস্রোতের আভাস দিচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে এগুলি নদীর জল। যদিও দামুক এর আগে মৃগস্থাপনে এসেছে, কিন্তু এই পর্যন্ত এসে তার পথ যায় গুলিয়ে। জলাভূমি ও অরণ্য প্রতিদিন ঢেকে দেয় পূর্বের পথ। ফলে পথ আন্দাজ করে মনে মনে আঁক কষে এগোতে হয়। তাতেও হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক। এখন বিশাল বিশাল আম ও নারকেলের বৃক্ষ, জলে ডোবা সুন্দরী ও গরানের জঙ্গল আকাশ ঢেকে ফেলেছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। পায়ের পাতা ডোবা জল পেরিয়ে চারজনে ক্রমে বনে প্রবেশ করল। এক জায়গায় একটু ঘাসবন ও বাঁশঝাড় দেখা গেলো। বাঁশঝাড়ের আড়ালে কুটির দেখে কপিল খুশি মনে বলল – দাদা, এখানে গ্রাম আছে নিশ্চয়। চলো খোঁজ করি। চিঁড়ে নয়, আমি একটু গরম মাছভাজা আর ভাত খাবো। কপিল ভুল বলেনি। বাঁশঝাড়ের আড়ালে বেশ কটি পাতার কুটির। তলায় বাঁশের খুঁটি। ওপরে পাতার ঘন বুননে তৈরি গোলাকার ঘর। মাথায় শুকনো পাতার ছাওয়া ঘরের ভিত থেকে দু তিন হাত ওপর পর্যন্ত নেমে এসেছে। বুনোদের বাস। বুনোদেরকে ভয় করে সাধারণ মানুষ। কী কারণে এরা চণ্ডমূর্তি ধারণ করে কেউ বুঝতে পারে না। দামুক স্নেহের চোখে দেখল। ভাইটি সত্যিই বড্ড ছোট। ওকে আনা উচিত হয়নি। তারা না শ্রমণ না বৈরাগী। তাদের চট করে কেউ ভিক্ষা দেবে না। তাও আবার বনের মধ্যে। তার ওপরে মাছ ভাত। এই গ্রাম ছেড়ে এগিয়ে যাওয়াই ঠিক। তবে মানুষের বসতি আছে তাই অরণ্যের বিপদ থেকে তারা দূরে, এই আশ্বাস নিয়ে এগোতে থাকল। একটু ডাঙা অঞ্চল। মাটি নরম আর এঁটেল। কালো মাটির ডাঙা। ঘন গাছের আড়াল সরিয়ে হঠাৎ নজরে এলো একটি ছোট নদী। স্বচ্ছ জলের ধারা। তলায় হলুদ বালি দেখা যা। দামুক সকলকে ওখানেই থামতে বলল।
নদীর পাড়ে বালির চর। চরের ওপরের আকাশ কিছুটা মুক্ত। কিছু নুড়ি পাথর যোগাড় করে চার ভাইয়ে মাটিতে গর্ত করে উনুন বানালো। শুকনো পাতা ও কাঠকুটো খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হলো। এখানে সব বেশ ভিজে ভিজে। তবুও সমতটের বাসিন্দা হবার সুবাদে এরা ঠিক চিনে আনতে পারল কিছু কাঠ ও শুকনো পাতার জ্বালন। রন্ধনের সব আয়োজন প্রায় শেষ। কিন্তু এ কী? ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল দামুকের। সে দেখতে পেল বালির চরে জানোয়ারের পায়ের ছাপ। যে সে নয়, পায়ের পাতার যে চিহ্ন তা হয়তো খানিক পরেই আর থাকবে না। বালির ওপরে এই চিহ্ন তাড়াতাড়ি মুছে যায়। অতএব এ সদ্য জন্মানো চিহ্ন। আর যে জন্তুটির পদচিহ্ন সে মানুষ খায়। হলুদ কালোর ডোরায় উজ্জ্বল ত্বকের সেই সুন্দর প্রাণীটি নিঃশ্বাসের চেয়েও দ্রুতগতিতে শিকার করে। তাহলে কি আশেপাশেই আড়ালে সে লুকিয়ে আছে? নাকি জলপান করে ফিরে গেছে? চকিতে তাই মত বদলাতে হলো। এ নদীতে তবে মাঝে মাঝে বাঘ আসে! বড় ঘাসবন সবে পেরিয়েছে তারা। দামুক ক্ষিপ্র হাতে আগুন জ্বালাতে লাগল। সঙ্গের ঝোলা থেকে মাটির হাঁড়ি বের করে নদীর জলে চাল ধুয়ে চড়িয়ে দিলো উনুনে। আর তারপর তাদের চারপাশ ঘিরে শুকনো কাঠের বৃত্ত তৈরি করল। যদি সন্ধ্যে নেমে আসে তবে আগুন জ্বালাতে হবে। সঙ্গে মহুয়ার তেল আছে। কপিল একটা ছোট্ট গোল জাল বের করে নদীর দিকে যাচ্ছিল। এমন অল্প জলের নদীতে বালি মাছ মেলে। স্বচ্ছ, কাঁচের মতো শরীর। ভারী সুস্বাদু। ভাতের মধ্যে কাঁচা তেল নুন দিয়ে মেখে পাতায় ভরে ফেলে দিলে আঃ, দারুন মধ্যাহ্নভোজন হবে। কিন্তু দামুক বাধা দিলো। নদীতে গিয়ে মাছ ধরা হবে না। লম্বা লম্বা ঘাসবন পেরিয়ে বাঘ আসতে পারে। অগত্যা নদীর পাড়ে জন্মানো শাকপাতা তুলে তাই সেদ্ধ হলো। চার ভাইয়ে খাওয়ার পর বিশ্রাম না নিয়েই পথ চলবে ঠিক হলো। লোকালয় দেখে থামা যাবে। দামুক আর একবার নিজের মনে আঁক কষে নিলো। মোটামুটি দক্ষিণপূর্বে এগোলেই আত্রাই নদীর পাশে পৌঁছে যাবে। খুব সংকীর্ণ চলার পথ একটা দেখা যাচ্ছে। জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে। অর্থাৎ মানুষের আসাযাওয়া আছে নদীতে। হ্যাঁ, তা বনে বুনো মানুষ আছে বৈকি।
নিঝুম সেই সরু পথ ধরে তারা হাঁটতে লাগল। সতর্ক পদে সেই হাঁটা মাঝে মাঝে ক্লান্তি আনছে। লোকালয় পেলে রাতের বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে স্তিমিত একটা খুরের আওয়াজ পেল ওরা। সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে দামুক ঝুলি থেকে তক্ষণ অস্ত্রটি বের করল। ওদের সঙ্গে অবশ্য লোহার ফলা লাগানো বর্শা আছে। সবাই আড়ালে গিয়ে শব্দ লক্ষ করতে লাগল। জন্তুর খুর বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু তেমন তেজী নয় শব্দটা। সেই জন্তুটি যেন ক্লান্ত। তবুও, বুনো মোষকেও তো যথেষ্ট ভয়। হয়ত পথ হারিয়ে ঘুরছে অনেকক্ষণ। তাই ক্লান্ত।
শব্দটা কাছাকাছি আসতেই সকলে আঘাতে উদ্যত হলো। প্রাণ নিয়ে কথা। কে আসে কে জানে! কিন্তু গাছের আড়াল থেকে দেখা গেলো একটি ক্লান্ত অশ্ব। ক্লান্ত বললে কম বলা হয়। বেচারার হয়ত আর এতটুকুও চলার শক্তি নেই। হয়ত এখনই লুটিয়ে পড়বে। তার পিঠে একটি যুবক শরীর। শায়িত। সে মৃত না জীবিত তাও বোঝা যায়না। দামুক অবাক হল। বনে তাকে কেউ আক্রমণ করেনি!
এভাবে এই বনে কাউকে দেখা যাবে তা তারা ভাবেনি। সাজপোশাকে ভিনদেশি মনে হচ্ছে। বেশ চাকচিক্য আছে পোশাকে। দামুকদের মতো দরিদ্র নয় বোঝাই যায়। তবে মনে হয় বেশ কিছুদিন হলো সে পথ আশ্রয় করেছে। পোশাক ময়লা, স্থানে স্থানে ছিঁড়ে গিয়েছে। ঊর্ধ্বাঙ্গে গাছের ডালপালা থেকে আঘাত লেগে ছড়ে গিয়েছে। চোখ বন্ধ। মুখে রাজ্যের কালি। কপিল বলল – দাদা, এ কি বেঁচে আছে? তবে শেষ করি? এ তো শত্রু! দামুক তাড়াতাড়ি হাত দেখাল—কি করে জানলি এ শত্রু? দেখছিস লোকটাকে? বেঁচে আছে কি মরে গেছে তার ঠিক নেই! এরকম মানুষকে কে মারে? চুপ করে দাঁড়া।
বাকি দুইটি ভাই এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার দামুকের নির্দেশে ক্ষিপ্র হাতে ঘোড়াটির বল্গা ধরল। এখানে সাধারণ মানুষের ঘোড়া চড়া তারা বড় একটা দেখে না। পশ্চিম থেকে আসছে নিশ্চয়। পশুটি ক্লান্তির শেষ সীমায়। তার যে জল বা খাদ্যের অভাব ঘটেছে অনেকদিনই, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। বল্গা ধরা মাত্র সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মুখের কষ দিয়ে ফেনা ছড়িয়ে গেল। সকলে ঘোড়ার শুশ্রূষায় জল ছিটোতে লাগল। পাতার হাওয়া দিলো। কিন্তু দামুক জানে, ঘোড়াটির প্রাণ নেই আর। হায় রে। এখানেই এসে তাকে প্রাণত্যাগ করতে হল? সে ভাইদের সাহায্যে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে আনল ভিনদেশি যুবকটিকে। ঘোড়াটিকে বনের ধারে ঠেলে দিল। যুবকটির তখনও দেহে প্রাণ আছে। তবে নাড়ি বড় নিস্তেজ। তার নির্দেশে ভাস্কর, মেজ ভাইটি, ঝুলি থেকে মহুয়ার কলসী বার করে আনল। তারপর যুবকের মুখে ফোঁটায় ফোঁটায় দিতে লাগল। মহুয়া বড় কড়া ওষুধ। রক্তে মিশলে ঠিক চনমনে করে তুলবে। যুবকের গণ্ডদেশে হাল্কা রক্তিমাভা দেখা দিলো।
ইতিমধ্যে পটু হাতে তারা বন থেকে ডালপালা লতা ও বাঁশ যোগাড় করে একটি মাচা বানিয়ে নিয়েছে। তাইতে যুবককে শুইয়ে সকলে মিলে তাকে বহন করে নিয়ে চলল। কপিল জিজ্ঞেস করেছিল – একে চিনি না। নিয়ে যাবো? দামুক স্নেহের চোখে দেখছিল। অসুস্থ আর্ত জীবকে সেবা শুশ্রূষা করতে হয়। কপিলকে অনেক শিক্ষা দিতে হবে। শীল শেখাতে হবে। চলতে চলতে তারা সেই বনের পথকে প্রশ্বস্ত করতে করতে চলল। এতে পরে যারা আসবে সেই সব মানুষের পথ চলার সুবিধে হবে।
সন্ধ্যে হয় হয়। দেখা গেল দামুকের দিশা ঠিক। জঙ্গল শেষ হয়ে আসছে। দূরে গ্রাম দেখা যাচ্ছে। কৃষিক্ষেত্র নজরে পড়ছে। তারা লোকালয়ে এসে পড়েছে। ধানের শীষে দোলা লাগছে। চারজনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। দামুক পল্লীর প্রথম গৃহটিতেই কড়া নাড়ল। ছেঁচা বেড়ার দরজা ঠেলে দেখা গেলো একটি ছোট্ট গোলাকার স্তুপ। সেখানে প্রদীপ জ্বেলে শঙ্খধ্বনি করছে একটি স্ত্রীলোক। হঠাৎ চারটি লোককে একটি মাচা বহন করে দুয়ারে আসতে দেখে সে ভীত হয়ে চিৎকার করে উঠল- কে এলো গো? কে এলো? তার চিৎকারে আশেপাশের প্রায়ান্ধকার গৃহগুলি থেকে অজস্র মানুষ বেরিয়ে এসেছে। একজন কালো লম্বা বলবান লোক এসে সামনে দাঁড়িয়ে ঘটনা বুঝতে চেষ্টা করল। বোঝাই যাচ্ছিল, এরা ঠিক নিষ্ঠুর প্রকৃতির নয়। লোকটি সকলকে শান্ত করে একটি দীপ তুলে মাচায় আলো ফেলল। দেখা গেলো ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলছে সেই ভিনদেশি যুবক। অভিজ্ঞ লোকটি বুঝতে পারল এরা এক আতুরকে বহন করে এনেছে। আশ্রয় চায়। তবে এই চারজনের সঙ্গে ওই শয্যাশায়ী যুবকের চেহারার কোনো মিল নেই। যুবক দরিদ্র নয়। ভিনদেশীও বটে। অতঃপর বাঁশের মাচাটি সেখানে নামানো হল।
দীর্ঘদিন অনিদ্রায় অনাহারে যুবকের এমন অবস্থা। দামুক গ্রামবাসীদের বলল, কেমন করে বনের মধ্যে যুবকের দেখা পেয়েছে তারা। কিন্তু দামুকের কথা সকলে বিশ্বাস করছে বলে মনে হয় না। তারা একে অপহরণ করেনি তো? যুবকের পোশাক আশাক মলিন হলেও ধনী ব্যক্তির পরিচ্ছদ বলে বোঝা যায়।
গ্রামমুখ্য প্রথমে দামুকের পরিচয় নিলো। ছত্তিবনা গ্রামটি আরও পূর্বে। আত্রাই নদী পেরিয়ে যেতে হয়। দামুক জানালো যে সম্রাটের প্রত্যক্ষ অধীন রাজ্যে কর্মের আশায় তারা মৃগস্থাপনে এসেছিল। এর আগেও কয়েকবার এসেছে। এবারে আশা ছিল খুব। সম্রাটের পুত্র হয়েছে। সেই খুশিতে যদি কিছু প্রাপ্তি হয়। সমতটে থেকে ধনী হবার আশা নেই। প্রত্যন্ত রাষ্ট্রে কবে আর সম্রাটের অনুগ্রহ হয়! তাই পাটলি বা উজ্জয়িনীতে কর্মের আশায় তারা মৃগস্থাপনে গিয়েছিল। পুত্রের জন্ম উপলক্ষে কি সম্রাট নতুন কোনো মন্দির বা ভবন প্রতিষ্ঠা করবেন না? তারা চার ভাই, প্রত্যেকেই কাঠ খোদাইয়ে নিপুণ। তাদের হাতের কাজ অনুযায়ী তাদের অবস্থা নয়। তাই কর্মের উদ্দেশ্যে তারা যাত্রা করেছিল। কিন্তু দুঃখের কথা এই, যে রাজপুরুষেরা কেউই বিহারে আসেননি। অথচ আসার কথা শোনা গিয়েছিল। সম্রাটের ভ্রাতুষ্পুত্রই তো বঙ্গ ও বরেন্দ্রভূমের প্রধান। সুতরাং বিহারে তাঁর আসার কথা ছিল। কিন্তু না। তিনি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান অধিকর্তা ও উপরিকের সঙ্গে এই উপলক্ষে নূতন চক্রস্বামী বিষ্ণুর মন্দির স্থাপনে ব্যস্ত। সঙ্ঘশ্রী সত্যদেবের থমথমে মুখটা মনে পড়ে দামুকের। তখন অবশ্য মনে হয়েছিল প্রার্থনার গাম্ভীর্যে মুখ অমন হয়ে রয়েছে। কিন্তু আশপাশ থেকে মৃদু গুঞ্জন, দূরের নতুন মন্দিরের যজ্ঞের ধোঁয়া, সব মিলিয়ে দামুক বুঝেছিল, এ মুখ অপমানিতের মুখ।
শ্রোতা মন দিয়ে শুনছিলেন। বিশ্বাস হলো তাঁর। এই চারটি অল্পবয়সী শিল্পী ভাগ্যান্বেষণে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ নজরে আসতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিধি বাম। তিনি এই গ্রামমণ্ডলীর মুখ্য। আপাতত তিনি বিদেশী যুবকটিকে তাঁর গৃহে নিয়ে চললেন। সঙ্গে দামুক ও তার তিন ভাই। সমস্ত রাত্রি যুবকটি বিকারে আচ্ছন্ন রইল। ঘরে তার সঙ্গে দামুক এবং গৃহকর্তার এক পুত্র রইল। দামুক ক্লান্তিতে গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিল। সেই অবস্থায় তার মনে হলো বহুদূর থেকে ভেসে আসছে কোনও আর্তনাদ। ‘পিতা, পিতা…থের সুমন আমাকে ত্যাগ করবেন না। আমি কিছু চিনি না…চিনি না।’ ঘুমের মধ্যে দামুকের মনে হলো সে কোনও দুঃস্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু গৃহকর্তার পুত্রটি ততক্ষণে জেগে গিয়েছে। সে দেখল, ধীরে ধীরে যুবকের চেতনা ফিরছে। সে পাশ ফিরছে। অর্ধেক চোখ খুলে সে চাইল – জল। যুবকটি ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে কাত করে একটি তামার ঘটি থেকে জল দিলো তার মুখে। জলের শীতলতায় বিদেশী একটু আরাম পেলো। ছেলেটি তখন তার পিঠে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে চলেছে। এই যুবকটিকে দেখে এখন ছেলেটির মনে হলো, এ নিশ্চয় কোনোভাবে পথ হারিয়েছে। বিদেশী মানুষ দিকভ্রান্ত হয়ে এমন ভাবে এদিক পানে এসে পড়েছে। সে দামুককে ডাক দিলো। দামুকের তখনও ঘুমের ঘোর। সে চোখ কচলে জিজ্ঞেস করল – কি? ছেলেটি সরলভাবে বলল – দ্যাখো, এ মনে হয় মিগথাপেই এসেছিল। সেখান থেকে নালন্দা হয়ে পাটলি যেত হয়ত। কিন্তু পথ হারিয়ে দখনে চলে এসেছে। এর সঙ্গে কোনও ঝুলি টুলি পর্যন্ত নেই। দামুক এই মাঝরাতে ছেলেটির এমন কৌতূহল দেখে মনে মনে হাসল। ছেলেমানুষ। বিদেশী লোক দেখে উত্তেজনায় ঘুমোতে পারছে না। কিন্তু ছেলেটি থামছে না। বলছে- ও থের সুমন বলে কাউকে খুব রাগ করে বলছিল, আমাকে ঠেলে দেবেন না। দামুক একটু অবাক হলো। যুবক কথা বলেছে? এ ছেলে ওর ভাষা বুঝল কি করে? তাহলে ভাষা খুব অচেনা নয়? সে উঠে বসল। বাইরে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। কুয়াশার সাদা সর দূরে ধান খেতের ওপরে ছড়িয়ে পড়ছে। ছেলেটির দিকে চেয়ে সে হাসল। তারপর তামার ঘটি থেকে ঢকঢক করে জল খেলো। তারও কাল ধকল কিছু কম হয়নি। একে তো বাঘচরা বনে গিয়ে পড়েছিল। তার ওপরে পথ তৈরি করে আঁক কষে সে এতদূর এসেছে। বনের মধ্যে এই অশ্বারোহী তাকে তো বেশ ভয় পাইয়েছিল। যাই হোক, সে দুর্গত। অতএব ধর্ম অনুযায়ী দামুক তাকে লোকালয় পর্যন্ত বয়ে এনেছে। আর কি চাই? এখন সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। ভোর হলে তারা চার ভাই বরং নিজেদের গন্তব্যের দিকে যাত্রা করবে।
ভোর হতে যাত্রার উদ্যোগ শুরু করেছে দামুক। সে গৃহকর্তাকে প্রণাম জানিয়ে বিদায় চাইল। বলল- এই যুবককে তাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বিশেষ লাভ নেই। তাদের ছত্তি নিঃসন্দেহে এ যুবকের গন্তব্য নয়। সে আরও একটু শরীরে বল পেলে নাহয় নিজের গন্তব্যে যাত্রা করবে। ততদিন গৃহস্বামীর আশ্রয়ে থাকুক। এইসব আলোচনা চলাকালে দাওয়ায় বসে অগ্রহায়ণের মিঠে রোদ্দুর পোহাচ্ছিল যুবক। এদের সব কথা সে যে ভালো বুঝতে পারছিল তা নয়। তবে ছত্তি শব্দটি কানে যেতেই সে লাফিয়ে উঠল। দামুককে অবাক করে সে জানালো ছত্তিই তার গন্তব্য। গৃহস্বামীও আশ্চর্য হয়েছেন। তিনি শান্ত হয়ে যুবককে বসতে বললেন। তারপর তার নামধাম জিজ্ঞেস করলেন।
কুণ্ড, হ্যাঁ এইই নাম যুবকের, জানালো সে ছত্তিবন্না নামে একটি গাঁয়ে যেতে চায়। সে গাঁয়ে একটি ছোট নদী আছে। সেখানে উদ্দক নামে একজনের সঙ্গে তাকে দেখা করতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন। দামুক চমকে উঠেছে। উদ্দক! এ নাম এ যুবক জানলো কি করে? ছত্তি আসলে একটি দ্বীপের মতো। বর্ষায় সেটি জলে ডুবে থাকে। তারপর সেই ডোবা জমিতে ধান চাষ হয়। বড় উর্বর জমি। ছত্তি দুদিক দিয়ে আত্রাই আর বারতোয়া দিয়ে ঘেরা। সে নিশ্চিত হবার জন্য জানতে চাইল- ছত্তির সম্পর্কে তুমি আর কি জানো? কুণ্ড স্বপ্নোত্থিতের মতো বলতে লাগল- একটা ছাতিম গাছ আছে গাঁয়ের মাঝে। সেই জমিটুকু বর্ষায়ও ডোবে না। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সরু একটি স্রোতা। সেখানে সোপান বাঁধানো ঘাট। কোমর জল পর্যন্ত নামা যায় সেই স্রোতায়। সেই ছাতিম গাছের তলায় এসে দুদণ্ড জিরিয়েছিলেন ভগবান তথাগত। সেই পবিত্র ভুমিই আমার গন্তব্য। আমি নির্দিষ্ট কাজে উদ্দকের কাছে এসেছি। দামুক অস্ফুটে বলল- থের উদ্দক। তিনি গোপনে থাকতেই ভালোবাসেন। তোমাকে তাঁর ঠিকানা আমরা বলতে পারব না। তবে এতদূর যখন বলেছ তখন তুমি ছত্তিতে চলো। আমাদের গৃহেই থাকবে। কিন্তু তুমি তো এর আগে বঙ্গ বা সমতটে আসোনি? তবে এত জানলে কি করে? কে বলেছে এসব? কুণ্ড মাথা নত করল। কেঁপে উঠল তার গলা—আমার পিতা মৃত্যুর পূর্বে বলে গিয়েছেন। আরও একজন বলেছেন। তাঁকে চিনবে না। কুণ্ড চুপ করে গেল। উদ্দক উদ্দক। থের সুমনের পত্র তাঁকে উদ্দেশ্য করেই।


যমুনা আজ বেড়ার ওপরে মাটি আর খড়ের সঙ্গে গোবর আর আখের গুড় মিশিয়ে প্রলেপ দিচ্ছিল। দু চারদিন টানা রোদ্দুর পেলে শুকিয়ে শক্ত হয়ে উঠবে। মাটি থেকে তিনহাত উঁচু বেদী করে ঘর তৈরি হয়েছে। বেদীর নীচে লম্বা লম্বা মহুয়া কাঠ পেতে দেওয়া। তার ওপরে মাটি আর শামুক শঙ্খের খোল বেঁটে মণ্ড প্রলেপ দিয়ে মেঝে হয়েছে। সে মেঝে শুকিয়ে শক্ত হয়েছে। তাতে রোজ মহুয়ার তেল দিয়ে ভিজে ন্যাতা দিতে হয়। মসৃণ হবে। তারপর আলপনা দেওয়া চলবে। দেওয়ালেও আলপনা হবে। যমুনা একটা বড় প্যাঁচা পোষে। সাদা প্যাঁচা। সে উঠোনের ধানের গোলার ওপরে বসে থাকে। রাতে ইঁদুর ধরে। যমুনা তাকে খুব ভালোবাসে। আলপনায় তাই একটা প্যাঁচা আঁকার তার খুব ইচ্ছে। এ ছাড়া ধানের শিষ, নদীর জল, মাছ, মহুয়ার কলসী, এইসব আঁকার ইচ্ছে তার। এই নতুন ঘরটা সে নিজে নিজে বেঁধেছে। দামুকের নিজের একটা আলাদা ঘর ছিল না। এতদিন সে নয় ছোট ছিল। এখন তার বুদ্ধি হয়েছে। সে দামুক আর তার জন্য একটা ঘর বেঁধেছে তাই। আজ কিছুদিন দামুক গাঁয়ে নেই। এই অবসরে সে কাজটা সেরেছে। ঘরের কুলুঙ্গিতে একটা কাঠের বুদ্ধমূর্তি রেখেছে ।
কাজ করতে করতেই যমুনা টের পেয়েছে। উঠোনের অন্যদিকে দু’সারি ঘর পেরিয়ে শোরগোল শুনতে পেয়েছে। সে হাতের মাটি সামনে রাখা পাত্রের জলে বেশ করে ধুয়ে ছুটে গেলো বাইরে। গলার আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে যে চারভাই এসে পড়েছে। এত তাড়াতাড়ি! তবে কি কর্ম পেয়েছে? কে জানে! সত্যিই যদি এরা কর্মের জন্য দেশ ছাড়ে তবে তার আর দামুকের এই ঘর দিয়ে কিইবা হবে! আবেগে চোখে জল এসে পড়েছে তার। সে ছুটে গিয়ে দামুককে জড়িয়ে ধরল। তার জানা ছিল না কবে দামুক আর তার ভাইয়েরা ফিরবে। জানলে সে আজ একটু সজ্জা করত। দামুকও যমুনার আলিঙ্গনে স্থির হয়ে রইল। অবশেষে যখন যমুনা জানতে পারল যে এখনই কেউ বিদেশে যাবে না তখন ভারী খুশি হয়ে আঙিনায় ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। তার গানের সুর ক্ষীণ। কিন্তু নাচটি সুন্দর। খানিক পরে শান্ত হয়ে সে লক্ষ করল চার ভাইয়ের সঙ্গে আর একজন এসেছে। অতিথি তো আসেই। কিন্তু এ ভিনদেশী। সে একটু কৌতূহল নিয়ে চেয়ে রইল। তারপর সুর করে তার শ্বশুরকে ডাকতে ডাকতে ভিতরে গেলো।
কুণ্ডকে দামুক অতিথির জন্য নির্দিষ্ট ঘরে রাখেনি। রেখেছে নিজেদের সঙ্গে। কুণ্ড যে ছত্তির কথা, থের উদ্দকের কথা তাকে বলেছে সেকথা সে গোপন রেখেছে। কুণ্ডকেও গোপন রাখতে বলেছে। সময়মত সে থের উদ্দকের ঠিকানা কুণ্ডকে জানাবে বলেছে।
এখন অগ্রহায়ন শেষ। পৌষের শীত নামছে। ধানের গোলার ওপরে বসে প্যাঁচা রাত জাগে। আকাশের তারারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর কুণ্ড মনে মনে বপ্যঘোষবাটের কথা ভাবে। এই গ্রামের সঙ্গে সে গ্রামের কত পার্থক্য! মালবের উঁচুনিচু জমি কিছু রুক্ষ। এমন নরম নয়। সব জমি কর্ষণ উপযোগীও নয়। এছাড়াও তার বুদুকের কথা মনে পড়ছিল। বুদুক তাকে কেন এত বিদ্বেষ করে সে কুণ্ড জানে না। বুদুক বরং পিতার সমস্ত ভূসম্পত্তি ভোগ করতে পারবে। নিরুদ্দিষ্ট উত্তরাধিকারীর কী মূল্য! কিন্তু পিতা কি আরও কিছু গোপন করে গেলেন? বুদুকের কি আরও কোনো প্রত্যাশা ছিল? কুণ্ড অনুভব করে, সে উপসম্পদা নেবে জানতে পেরে হয়ত বুদুক বিরক্ত হয়েছে। বহুবার তাকে বলেছে, তাদের ধর্ম সনাতন ধর্ম। বৌদ্ধধর্ম ধর্মই নয়। সেখানে ঈশ্বর নেই। কুণ্ড উত্তর দেয়নি। পিতার অসুস্থতার জন্য কুণ্ড স্পষ্ট করে জানতে পারল না। এর উত্তর একমাত্র থের সুমন জানেন। কিন্তু তিনি যদি নিজে থেকে না বলেন তবে জানে কার সাধ্য? তিনি শুধু চেয়েছিলেন কুণ্ড সমতটে আসুক। কুণ্ডর নাকি কিছু কর্ম বাকি আছে। সেটির প্রথমাংশ তিনি বলেছেন। উদ্দকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ও থের সুমনের দেওয়া লিপিটি তাঁকে দেওয়া। কিন্তু দ্বিতীয়াংশ বলেননি। সেটি নাকি তথাগত নির্দেশ করবেন।
এখানে কুণ্ডর কর্ম কিছু নেই। অপেক্ষা করা ছাড়া। উদ্দক নাকি নিজেই সংকেত পাঠাবেন। এখন দাওয়ায় বসে গাভীর সদ্যদোয়ানো দুধ আর চালের মণ্ডসেদ্ধ সুবাসিত খেজুরের রস দিয়ে খেতে খেতে আরামে কুণ্ডর চোখ বুজে আসছিল। উঠোনে গোবর জলের ছড়া দিয়ে স্নান সেরে নতুন ঘরে ঢুকছিল যমুনা। কুণ্ড লক্ষ করছিল। ঘরের দেওয়ালে কি সুন্দর চিত্র এঁকেছে যমুনা! চাল বেটে সেই গোলা দিয়ে চিত্র আঁকা। কিন্তু হঠাৎ চন্দনের তীব্র গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এ গন্ধ কোথা থেকে আসছে? যমুনার গায়ে কি চন্দনের গন্ধ? কেমন যেন অবশ ইন্দ্রিয়তাড়িত হয়ে কুণ্ড ছুটে গেলো ঘরটিতে। পেছন থেকে যমুনাকে জড়িয়ে ধরতে যাবে, এমন সময়ে সে দেখল মাটির কুলুঙ্গিতে জীবন্ত বুদ্ধমূর্তি। একহাত পরিমাণ।
ক্ষিপ্র চলনে যমুনাও ঘুরে দাঁড়িয়ে কুণ্ডকে ঠেলে দিয়েছে। সে মাটি আশ্রয় করেছে। কিন্তু সেই অবস্থায় যমুনা দেখল কুণ্ডর চোখ বুদ্ধ মূর্তিটির দিকে স্থির। যেন আবিষ্ট। কুণ্ড যমুনার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল – চন্দনের গন্ধ কোথা থেকে আসছে? তুমি ধুপ জ্বালাও? নাকি চন্দন তেলের দীপ জ্বালাও? এখন আর তার চোখে যমুনার প্রতি আকর্ষণের চিহ্ন নেই। যমুনা এই প্রশ্নে খলখল করে হেসে উঠল। চন্দনের গন্ধ? সে কিরকম? সে জানে না তো? কুণ্ড অবিশ্বাসের চোখে দেখতে দেখতে ভাবল, যমুনা কিছু গোপন করেছে তাকে। একেবারে অপরিচিত মানুষের কাছে গোপন করাই উচিত। আধশোয়া কুণ্ডকে ঘরের মধ্যে রেখে যমুনা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। পুরুষের ছল। কুণ্ড ধীরে ধীরে উঠে বসল। এখন দরজা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ঘরের মেঝেয়। তেল চকচকে মেঝের ওপরে আল্পনার অসম্পূর্ণ চিত্র আঁকা। এক কোণে একটি বাঁশের মাচা। সেখানে শয্যা ও নিত্য ব্যাবহারের বস্ত্রাদি রাখা। কুলুঙ্গির একটিতে কাঠের কাঁকই, তেল ও কুঙ্কুম আলতা রাখা। একটি দর্পণ দুলছে দেওয়ালে। অন্য আরেকটি কুলুঙ্গিতে একটি একহাত কাঠের বুদ্ধমূর্তি। দরজা দিয়ে আলো এসে সরাসরি সেই মূর্তির গায়ে পড়েছে। জীবন্ত মূর্তি যেন। কুণ্ড দেখল তীব্র চন্দন গন্ধে ঘর ভরে গেছে। যমুনা যখন ঘরের মধ্যে ছিল তখনও গন্ধ এতটা তীব্র ছিল না। সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মনে মনে তার স্থির প্রত্যয় হয়েছে, যমুনা চন্দন ব্যবহার করে। কিন্তু একটা কথা সে বুঝতে পারল না। যমুনা চলে যাওয়ার পর গন্ধ তীব্র হলো কেন?
এখন কুণ্ড আবার স্বাভাবিক। সে শরীরে বল ফিরে পেয়েছে। সারাদিন তো বসে সময় কাটে না। সে তাই দামুকের সঙ্গে তার কর্মশালায় কাজ করে। নরম বাঁশ নুইয়ে সে নানারকম আকার দেয়। দামুক তাই দিয়ে অনেক রকম জিনিস তৈরি করে। বেত চিরে রাখে। তাই দিয়ে যমুনা ঝুড়ি টোকা ইত্যাদি তৈরি করে। এছাড়া অবসরে সে আদাড়বাদাড় খেতে বনে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কিছু বলে না। ছত্তি দ্বীপের মতন বলে চট করে বিদেশি কেউ আসে না এখানে। কুণ্ড তাই সকলের চেনা হয়ে উঠেছে। উপরন্তু উজ্জয়িনীর কাছাকাছি থাকার ফলে সে বেশ নাগরিকসুলভ শিক্ষা সহবত জানে। এখানকার লোকেরা তাকে বেশ সমীহ করে। থের সুমন তাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। সময় হলে সব আপনিই ঘটবে। সে নিশ্চিন্ত। শুধু মাঝে মাঝে যমুনা তাকে অস্থির করে। সবার চোখের সামনেই সে দামুকের প্রতি প্রেম নিবেদন করে। কুণ্ডর বড় অস্থির লাগে। ঘরে তার পত্নী এখন একা? নাকি বুদুক তাকে গ্রহণ করেছে? সে জানে না।
আত্রাই আর বারতোয়ার মাঝে ডিমের মতো এই দ্বীপটি বড় বেশিই গাছপালায় ভরা। মাটি ফুঁড়ে যেন শুধু উদ্ভিদ জন্মেই গেছে। একটিও মরেনি। ছত্তির সঙ্গে আত্রাই আর বারতোয়া হয়ে সমতটের বাকি অংশের যোগাযোগ খুব। তাম্রলিপ্তে যে পণ্যবাহী জাহাজ বিদেশের উদ্দেশে যায়, সে জাহাজে দামুক ভাস্করের তৈরি বাঁশ বেত ও কাঠের পণ্যও রওনা হয়। বিদেশী বণিক সেসব কেনে। ইদানীং পূর্বের সমুদ্রপারের দেশগুলি থেকে দারুমূর্তি কেনার খুব চল হয়েছে। দামুকরা চাহিদামতো মূর্তি তৈরি করে ও বণিকের কাছে বিক্রয় করে। ছোট ছোট নৌকায় করে সেই মূর্তির সম্ভার রওনা হয় তাম্রলিপ্তে। আত্রাই আর বারতোয়া সেসব সময়ে পালতোলা নৌকায় ছেয়ে যায়। কেউ বস্ত্র কেউ কস্তুরী কেউ দারুমূর্তি কেউ মহুয়ার তেল কেউ বা গুড় তুলে দেয় নৌকায়। বাণিজ্যের সময় উৎসবের সময়। গৃহিণীরা নদীর ঘাটে ভিড় করে শঙ্খধ্বনি উলুধ্বনি করে। ভারী আনন্দের সময়। কিছুদিন আগে চীনদেশীয় এক বণিকের জন্য দামুক একসঙ্গে পাঁচশত একহাত পরিমাণ বুদ্ধমূর্তি তৈরি করেছিল। তারই একটি যমুনা আবদার করে চেয়ে নিয়েছিল। খুব অদ্ভুতভাবে এই মূর্তিগুলির কাঠ পেয়েছিল দামুক। সেসময় বর্ষা কিছু দীর্ঘ হয়েছিল। ফলে নিমজ্জিত দ্বীপে শুকনো কাঠ প্রয়োজন মতো পাওয়া যাচ্ছিল না। ভিজে কাঠ শুকিয়ে করার মতো সময়ও হাতে নেই। চিন্তিত দামুক সেদিন চুপ করে বসেছিল। এ যাত্রায় আর বুদ্ধমূর্তি তৈরি করে দেওয়া হল না। এমন সময় একটি বালক এসে তার দালানের সামনে মাথা থেকে এক বোঝা উৎকৃষ্ট কাঠ নামিয়ে রাখল। বালকটি পূর্বপরিচিত। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে বালক বলল—উদ্দক পাঠিয়েছে। আরও এনে দেবো। মূর্তি তৈরির কাঠ। উদ্দকের নাম শুনে দামুকের বিষাদ কেটে গেলো। কিন্তু উদ্দক কি করে জানলেন তার কাঠের প্রয়োজন আছে? সময় কম বলে, আর উদ্দককে হাতের কাছে চাইলেই পাওয়া যায় না বলে দামুক তাড়াতাড়ি করে কাঠের বোঝাটি দাওয়ায় টেনে আনল। পরীক্ষা করে দেখল উৎকৃষ্ট এই কাঠের রঙ সোনার মতো। নরম ও সুগন্ধী। সে দ্রুত মূর্তিগুলি তৈরি করতে লাগল।
যেদিন মূর্তিগুলি নৌকায় তোলা হবে সেদিন হঠাত ঘাটে দেখা গেলো ঘন কৃষ্ণবর্ণ দীর্ঘকায়, শ্বেত বস্ত্রে অধমাঙ্গ ঢাকা একজন সাধু নৌকার কাছে দাঁড়িয়ে। নিজে তদারক করে একটি নৌকা বেছে তাইতে মূর্তিগুলি তুলে দিচ্ছেন। দামুক ঘাটে এসে করজোড়ে প্রণাম জানালো- থের উদ্দক! কী সৌভাগ্য আমার! আপনি মূর্তি তুলছেন নৌকায়? উদ্দক নামের সেই সাধু কিন্তু হাসলেন না। বললেন- সৌভাগ্য তোমার নয়। বুদ্ধের মূর্তি বলেই এসেছি। কোনোভাবে যেন মূর্তির একটিও না হারায় বা জলে ডুবে যায়। দামুক মাথা নাড়ল। না, একটিও হারায়নি। সব ঠিক আছে। পাঁচশত একহাত পরিমাণ বুদ্ধ মূর্তি সে নিজে এনে দিয়েছে ঘাটে। কিন্তু উদ্দক স্থির চেয়ে আছেন। হঠাৎ দামুকের মনে পড়ল। একটি মূর্তি সে যমুনাকে দিয়েছে। বড় বায়না করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, উদ্দক এই মূর্তির কাঠ যোগান দিয়েছেন। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এই পণ্যে তাঁরও অধিকার আছে। কিন্তু ত্যাগী সাধু বলে দামুক অত ভাবেনি। সে মাথা নীচু করে বলল, একটি মূর্তি পত্নী যমুনা চেয়ে নিয়েছে। সে ছেলেমানুষ। খেলবে মনে করে চেয়ে নিয়েছে। পুতুলখেলা। উদ্দকের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। পরক্ষণেই স্মিত হাসিতে মুখ ভরে গেলো। যমুনার উদ্দেশে তিনি হাত তুলে স্বস্তিবাচন করলেন। তথাগতর যা ইচ্ছে। দামুক জানে, সে উদ্দককে কৃতজ্ঞতা জানাতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। কারণ চাইলেই উদ্দকের কাছে যাওয়া যায় না। দ্বীপের মধ্যে এক ঘন জঙ্গল আছে। মানুষের বসবাস, লোকালয়, ক্ষেত, এসব আছে ছত্তির পরিধি বরাবর। আত্রাই আর বারতোয়ার তীর ঘেঁষে। মাঝের কিছুটা উঁচু অংশে আছে দুর্ভেদ্য অরণ্য। সেখানে বন্য জন্তুর সঙ্গে নির্ভয়ে বাস করেন উদ্দক। কেউ কেউ ভুল করে যদি মধু সংগ্রহের জন্য ঢুকে পড়ে, তবে দেখতে পায়, উদ্দকের পাশ ঘেঁষে চলেছে দু তিনটি বাঘ। তাদের দেখে মনে হয় না যে তারা দুগ্ধপোষ্য। এই যে কাঠ উদ্দক পাঠিয়েছিলেন, দামুক জানে, সেই বালকটিও উদ্দকের কাছে যায়নি। উদ্দক নিজে তাকে বোঝাটি দিয়ে পাঠিয়েছিলেন দামুকের কাছে। তাই উদ্দকের সান্নিধ্যে এলে সমীহ যত জাগে ভয়ও ততই লাগে। এই বিদেশী যুবকের মুখে উদ্দকের নাম শুনে দামুক তাই চমকে উঠেছিল। উদ্দকের নাম এই যুবক জানলো কি করে? অলৌকিক শক্তি আছে উদ্দকের। এ অঞ্চলে একথা সবাই মানে। হয়ত সেভাবেই কুণ্ড জেনেছে উদ্দকের নাম। কিন্তু তার সঙ্গে সে আরেকটা কথাও বলেছে। ছত্তিতে একটা ছাতিম গাছ আছে। সেটা বর্ষায়ও ডোবে না। সেখানেই সে যেতে চায়। সেকথা তাকে থের সুমন জানিয়েছেন। কে এই থের সুমন সেটা দামুক জানে না। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে তিনি উদ্দক সম্পর্কে বিশেষ সংবাদ রাখেন।
কোনোভাবে উদ্দককে সংবাদ দিতে হবে কি? নাকি তিনি আপনিই টের পাবেন যে উজ্জয়িনী থেকে কুণ্ড এসেছেন তাঁর কাছে? দোলাচলে থাকে দামুক।


শিপ্রার তীরে ছোট পাথরের দেউলটি থেকে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তখন ঘাট বেয়ে নামছিলেন। শিপ্রার ধারা শীতে ক্ষীণ। তাতে স্রোত কম। কিন্তু অত্যন্ত শীতল। ব্রাহ্মণ তামার ঠাট নিয়ে ঘাটে বসেছেন। আচমন শুরু করেছেন, এমন সময়ে একটি পরিচিত কণ্ঠ কানে এলো – আচার্য কি এখন আহ্নিকে বসলেন? কণ্ঠে হাল্কা উপহাসের ছোঁয়া। তিনি বসে বসেই চোখ ফেরালেন- ভট্ট কি সূর্যাস্তের পূর্বেই আচমন সেরে এসেছেন? তির্যক প্রশ্নে আগন্তুকের অট্টহাস্য শোনা গেলো- রসিক ব্রাহ্মণ বটে! কিন্তু প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন কি সমীচীন? ব্রাহ্মণ ততক্ষণে বাম হাতের ওপরে দক্ষিণ হাতটি দিয়ে জল স্পর্শ করছেন। অপবিত্রো পবিত্রো বা, সর্বাবস্থাং গতোহপি বা। ভট্ট আবার উপহাস করলেন। এই তো! যেকোনো অবস্থাতেই পুণ্ডরীকাক্ষকে স্মরণ করলেই তো বেশ পবিত্র হওয়া যায়। তবে আবার আমার আমিষ আচমন নিয়ে ব্যস্ত কেন? বৃদ্ধ উত্তর করলেন না। পূজায় বসে তিনি অন্য কথা বলেন না। ভট্ট তখন দূরে শিপ্রাপারের অপর দেউলটির দিকে চেয়েছিলেন। কালভৈরবের মন্দিরে এখনই ঘন্টা বাদ্য শুরু হবে। এখনই মহাকালের আরতি হবে। তাঁর সখা ও পরমভাগবত মহারাজ বিক্রমাদিত্যের অনুরোধে তিনি রচনা করছেন কুমারসম্ভব কাব্য। মহাকালের কাব্য রচনার অনুরোধ করেছেন পরমভাগবত বৈষ্ণব সম্রাট। কবি ভেবে কূল পান না।
প্রথমে মহারাজ তাঁকে একটি বৈষ্ণবোচিত কাব্যরচনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু মহাকাল তাঁর জীবনকাব্যটি এমন করে রচেছেন যে কৃতজ্ঞতার ভার তিনি ভুলতে পারেন না। তাঁর মন্ত্রতন্ত্র পূজার্চনা তাই সেই শ্মশানচারী দেবাদিদেবের পথ ধরে। তিনি তাই কুমার কার্তিকেয়র জন্মকাহিনী রচনা করবেন বলে স্থির করেছেন। মহারাজ চুপ করে শুনেছেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মে দেবাদিদেবের শৃঙ্গার বর্ণনা কেউ ক্ষমার চোখে দেখবে না। কিন্তু এত বড় সাম্রাজ্যে তাঁর প্রজাদের বিভিন্ন আচার আছে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে। কবিও যে বিশুদ্ধ বেদান্তপন্থী নন তা তো মহারাজ জানেন। তিনি কাউকেই নিরাশ করতে পারেন না।
কয়েক মাস আগের কথা। ভট্ট এই ঘাটে বসেছিলেন। দেখছিলেন, তুলা খণ্ডের মত মেঘ রাশি পূবালী বাতাসে ভর করে উত্তর মুখে ধাইছে। শিপ্রা তীরবর্তী এই প্রাচীন ভগ্নদেউলে মহাকাল মহেশ্বরের আরতি শুরু হলো। সন্ধ্যার ঘন নীল আকাশে ছিন্ন ছিন্ন মেঘমালা যেন মল্লিকা পুষ্পের অর্ঘ্য। নীল আকাশ যেন মহেশ্বরের মতই সেই অর্ঘ্য গ্রহণ করছে। বর্ষার বজ্রধ্বনির মত গম্ভীর ঘন্টানিনাদে আরতি শুরু হলো। শিপ্রার ঘাট হতে পূর্ণকুম্ভ নিয়ে ধীর পদক্ষেপে এক প্রোষিতভতৃকা সোপান বেয়ে উঠছে। ঘাটের একপ্রান্তে সৃষ্টিচিন্তায় মগ্ন স্রষ্টাকে সে দেখতে পেল না। স্রষ্টা অবশ্য ক্ষীণমধ্যা গুরুনিতম্বিনী কমলনালভুজা বিরহিনীকে চকিতে দেখে নিলেন। মুখাবয়ব দৃষ্টিগোচর হল না। তবে আসবার ভঙ্গীতে বিরহ স্পষ্ট। না। এ সেই বধূটি নয় যার স্বামী বাণিজ্যে গিয়েছে। এ মহেশ্বর মন্দিরের পুরোহিত কন্যা। যার সঙ্গে ভট্টর বিশেষ মিত্রতা। কন্যার স্বামী জীবিকা সন্ধানে বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম করে উত্তর দেশে গিয়েছে। মহেশ্বর এক উচ্চ হিমবন্ত পর্বতের গুহায় পূজিত হন সে স্থানে। কিন্তু শীতের প্রাবল্যে সেবক দুর্লভ হয়েছে। দরিদ্র ব্রাহ্মণ অতএব অর্থ উপার্জন করতে গিয়েছে। ফেরবার আশা নেই।
কন্যা এসে সম্মুখে দাঁড়াল। তার দৃষ্টিতে বিষাদ। নিম্নস্বরে বলল, ভট্ট, গণনা করে বলতে পারেন সেই হিমগিরি হতে মহেশ্বর কবে উজ্জয়িনী আসবেন? কবি বুঝতে পারলেন অন্তর্নিহিত প্রশ্নটি। অবনত মস্তকে বললেন, মা, আপনি বিরল তপস্যায় দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছেন। শীঘ্রই মহেশ্বর আসবেন আপনার নিকট। পার্বতীসমা কন্যা অপরূপ ভঙ্গীতে কলস নিয়ে চলে গেলেন। কবি দেখলেন সেই চলনে মন্দাক্রান্তা ছন্দের জন্ম হলো।
মহাকাল মহেশ্বরের মন্দির চত্বরে শেষ সূর্যের অরুণ আলো অন্তর্হিত। আকাশে সপ্তমীর বাঁকা চাঁদ ঈষৎ মেঘে আচ্ছন্ন। সেই আলোকে একটি রজত ভৃঙ্গার নিয়ে পুরোহিত আসলেন। কবির সম্মুখে পাত্রটি স্থাপন করে পাষাণ বেদীতে বসলেন। দুজনের যে অন্তরঙ্গতা আছে তা এই নিস্তব্ধভাবে বসে থাকার মধ্যে প্রকাশ পায়। মৌনতা ভেঙে পুরোহিত প্রথম বললেন, কবিবর মহাকালের প্রসাদ গ্রহণ করুন। কবি হাতে বান্ধুলি পুষ্পের মালাটি জড়াতে জড়াতে মৃদুস্বরে মন্ত্রের মত উচ্চারণ করলেন –

নব বর্ষার জলদের মতো যৌবনবতী অথচ বিষাদভারাক্রান্তা পার্বতী এমন মৃদুমন্দ ছন্দে নদী থেকে উঠে এসেছিলেন। অলক্ষ্যে মহেশ্বর হেসেছেন। বিরহের কাল শেষ হল। বর্ষার বারিপাতের মতোই মিলন উন্মুখ দম্পতি…। কবি বাতাসে ভাসিয়ে রাখলেন তাঁর চিন্তার রেশ।

পুরোহিত উজ্জয়িনীর সমস্ত নাগরিকের ন্যায় কবির কাব্যমুগ্ধ। তিনি কবির চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়। কবির এমন রূপমুগ্ধ উচ্চারণে বিস্মিত ও আহত হলেন। বললেন- কবি, কন্যা মাতৃসমা। তাকে জগজ্জননী বলে পূজা করা চলতে পারে, কিন্তু তার বিরহদশা বর্ণনা, এবং তৎসঞ্জাত রূপের বর্ণনা, কি শোভনীয়? বিশেষত পিতার সম্মুখে? আপনি প্রাজ্ঞ। বয়সের বাধা সরে গিয়েছে কবেই। তাই জানতে চাইছি। মনে করুন, নিছক কৌতুহলাক্রান্ত হয়েছি।
কালিদাস পূর্ণ নয়নে চাইলেন। তন্দ্রাচ্ছন্ন কণ্ঠস্বর। বললেন- ওই শরতের মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ যেন বিরহ শেষের প্রিয়তম। নিদারুণ ঝঞ্ঝাবাতের পর প্রিয়তমর গৃহে আগমন। শিপ্রার কলকল ধ্বনিতে সেই আনন্দের প্রকাশ। দিনান্তের শেষ সূর্য কিরণ যেন প্রিয়ার অভিমানে আহত নেত্রপাত। চন্দ্রকিরণ যেন দেহে শীতল চন্দন লেপ। এই প্রকৃত কাল মিলনের। মিলনের প্রতীক্ষাই সর্বশ্রেষ্ঠ রস। তা থেকে উদ্ভূত কাব্য মনোহর। পার্বতী জননী হবার পূর্বে প্রিয়া। তা বিনা পরম পুরুষের অঙ্ক শূন্য থাকত। এই বিশ্ব নিখিল সৃষ্টিই হতো না। তাই প্রিয়ার দেহের সৌন্দর্য্য বর্ণনা, প্রতি ঋতুতে তার পরিবর্তন বর্ণনা, দেহে কস্তুরি ও চন্দনের আলিম্পন বর্ণনা, সব পবিত্র। এইই আদিরস। দেবী সরস্বতীর বরে এইই আমি বর্ণনা করি। এ বর্ণনা অলৌকিক সেই পর্বতদুহিতার, মানবীর নয় সখা। এক্ষেত্রে কন্যার বাহ্য রূপটি উদ্দীপক মাত্র।
পুরোহিত অধোবদন হলেন। তাঁর দোষ দৃষ্টি! তিনি মহাকালের নিকট মার্জনা প্রার্থনা করলেন।
আজ তাই ভট্টর আগমনে ব্রাহ্মণ কিছু চিন্তান্বিত। সেদিনের লজ্জা এখনও অন্তরে রয়ে গেছে। ভট্ট কিছু উগ্র সাধনা করেন। ব্রাহ্মণের সাত্বিক আচার আচরণ। তাঁর ভট্টকে কিছু অদ্ভুত লাগে। শুদ্ধ বৈদিক আচার বোধ হয় ভট্ট তত মানেন না। কালিদাস আজ স্পষ্ট করবেন বলেই এসেছেন। পুরোহিত যে তাঁর কন্যার রূপবর্ণনা সেদিন ভালো মনে নেননি তা কবি বুঝেছেন। আসলে প্রকৃতির পরম সত্যটি এরা এড়িয়ে চলতে চান। ওদিকে পরম ভট্টারক শ্রীমন আদিত্য যে পূর্বাঞ্চলে তাঁর আধিপত্য চাইছেন সে তো শুধু অসির ঝঙ্কারে নয়! তিনি চাইছেন এই আসমুদ্রহিমাচলবাসী ভারতীয় যেন তাঁকে দেবতার সমান সমীহ করে, ভক্তি করে। আর তার জন্য প্রয়োজন এমন পরিবেশের, যেখানে সর্বধর্মের প্রতিই একটি সহনশীল আবহ থাকে।
এই কারণেই ভট্ট অনুসন্ধান করেছিলেন। উজ্জয়িনীতে বাণিজ্যের কারণে কলিঙ্গ বঙ্গ দবাক সমতট থেকে বহু মানুষ আসেন। তাঁদের কাছ থেকেই ভট্ট জেনেছেন, নিছক হীনযান নয়, কিছু কৌম ধর্মও এখানে প্রকট। বৌদ্ধ ধর্ম বরং ধীরে ধীরে এইসব কৌমাচার আত্মস্থ করছে বেঁচে থাকার তাগিদে। সত্যি বলতে এই যে তিনি তন্ত্রাচার চর্চা করেন, এও তো পূর্বের দান। তাই মহারাজ আদিত্যকে তিনি বলেছিলেন- মহারাজ, সব বৌদ্ধ মন্দিরকেই একাদিক্রমে মহাকাল ও বিষ্ণু মন্দিরে পরিবর্তিত হতে দেবেন না। যে স্থানে যে ধর্মের প্রভাব বেশি সে স্থানে সেই ধর্মকে বিরাজ করতে দিন। কালিদাসের ওষ্ঠপ্রান্তে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। মহারাজ অবশ্য উজ্জয়িনীর আশেপাশে এই পরিবর্তন ঠেকাতে পারেননি। মহাসেনাপতি অমরকরদেব নিজে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। লিচ্ছবি রক্ত তাঁর শরীরে বইছে। একান্তে একদিন কবিকে বলেছিলেন। আজ যে গুপ্ত রাজাদের এমন সম্পদ, সে শুধু লিচ্ছবিদের জন্য। সেই তিনি পর্যন্ত এখানকার ছোট ছোট স্তুপগুলিকে শিব মন্দির হওয়া থেকে আটকাতে পারেননি। উজ্জয়িনীর প্রান্তবাসী গ্রাম, বপ্যঘোষবাটের এমন ক্ষুদ্র যে সংঘারামটি, সেটিও ব্রাহ্মণদের নজরে পড়েছে। এ অঞ্চলে স্থবির সুমনগুপ্ত বৈদগ্ধ্যের কারণে প্রসিদ্ধ। কিন্তু ওই ক্ষুদ্র সংঘারামেই তিনি শান্তিতে থেকেছেন এতকাল। যা শোনা যাচ্ছে, স্থবির হয়ত এতকালের আশ্রয় ত্যাগ করতে চলেছেন। কেউ এও শুনেছেন, স্থবির বলেছেন, বুদ্ধের চরণতলে তাঁর শেষ আশ্রয়। বুদ্ধ স্বয়ং নিয়তি নির্দিষ্ট করেছেন। ভট্টর সঙ্গে থের সুমনের নিভৃতে আলাপ হত। কখনও কখনও বপ্যঘোষের গ্রামে ভট্ট যেতেন। সঙ্ঘারামে অতিথি হয়ে তাঁর সঙ্গে ধর্ম আলোচনা করতেন। কিন্তু এই সংবাদটি যতদূর সম্ভব গোপন আছে। সম্রাট হয়ত তাঁর বৌদ্ধ আচার্যের সঙ্গে এই সখ্য ভালো চোখে না দেখতে পারেন। বৌদ্ধ ধর্মের বজ্রযান শাখা সম্পর্কে তিনি থেরের কাছেই জ্ঞানার্জন করেছেন।
ভট্ট জানেন, ব্রাহ্মণ পুরোহিতটি এখন আনন্দে আছেন। তাঁর কন্যাটি হিমবন্ত সেই পর্বতের সানুদেশে পতির ঘর করছে। উজ্জয়িনীতে কন্যার পতি না এলেও মহেশের নতুন মন্দির তো প্রতিষ্ঠা হয়েই চলেছে।
ভট্ট বর্তমানে ফিরলেন। সংঘারাম দেবতার মন্দিরে পর্যবসিত হতে বেশি দেরি নেই। আপাতত স্থবিরকে সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন। মহামাত্য স্বয়ং তাঁকে স্মরণ করেছেন।
রাত্রির ঘন অন্ধকারে প্রস্তরের প্রাসাদপ্রাচীরের গায়ে দীপালোক অদ্ভুত ভৌতিক ছায়া তৈরি করছে। নিঃশব্দে পা ফেলছেন শীর্ণকায় মুণ্ডিত মস্তক স্থবির। তাঁর পরনের বসন মৃদু শব্দ তুলছে। তিনি চলেছেন, আর তাঁর সম্মুখে দীপহস্তে হেঁটে চলেছেন দুজন প্রহরী। প্রাসাদে এখন বাইরের কেউ নেই। নিভৃত আলাপে মহারাজ আদিত্য, মহামাত্য এবং ভট্ট আছেন। স্থবিরকে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে আনা হয়েছে এখানে। তিনি নিজেই চেয়েছিলেন এহেন গোপনীয়তা। স্থবির ছেড়ে যাবেন এ অঞ্চল। মধ্যভারতে আর থাকবেন না। যাওয়ার আগে শুধু মহারাজকে জানিয়ে যাবেন। কোথায় চলেছেন তিনি এ জানবার অধিকার তো মহারাজের আছেই।
দীপালোকে সুপুরুষ সুন্দর মহারাজের মুখ অন্যরকম দেখায়। তাঁকে যেন কোনও পৌরাণিক দৈত্যের মতন লাগে। স্থবির বিচলিত হন না। মহারাজ অবশ্য মধুর আলাপে আহবান জানান – আসুন স্থবির। আসন গ্রহণ করুন। আমার মহামাত্য আপনার বিশেষ অনুগৃহীত। তাঁর ইচ্ছায় ও সংযোগে আমার পুনরায় মহাপুরুষ দর্শন ঘটল। সুমন দীর্ঘকালের সাধনায় জাগতিক সুখদুঃখের অতীত হয়েছেন। তাঁর ত্যাজ্যগ্রাহ্য নেই। তিনি মহারাজের আহ্বান সম্ভাষণ শুনে মাথা নামিয়ে প্রত্যভিবাদন জানালেন মাত্র। হেন সময়ে মহামাত্য কিছু বললেন, তাঁর স্বর যেন আর্তস্বর মনে হলো। “থের, আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, কোথায়?” সুমন জানেন এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তরে বিপদ আছে। আর্যাবর্তের বাকি অংশের মতো একদিন পূর্বাঞ্চলও একচ্ছত্র ধর্মের ছত্রে আসতে বাধ্য হবে। তিনি কৌশল করলেন – মহামাত্য, আপনি উতলা হবেন না। আমি দৈব নির্দেশে তথাগতর ইচ্ছা পূরণ করছি মাত্র। তাঁর নির্দেশ অনুসারে আমি তাঁর চরণতলে আশ্রয় নেব। মহামাত্য দীর্ঘশ্বাস ফেললেন – আপনার যাত্রাপথে কিছুদূর পর্যন্ত সঙ্গী হতে পারি থের? সুমন হাসলেন – না মহামাত্য। আপনি জ্ঞানী ব্যক্তি। আপনি জানেন নির্বাণের পথে একাকী আরোহণই শ্রেয়।
রাত্রি দুই প্রহর অতিক্রান্ত। নিঃশব্দে সুমন এবং দুই প্রহরী বেরিয়ে আসছেন। হঠাৎ সুমন লক্ষ্য করলেন প্রাসাদপ্রাচীরের বাইরে একটি ছায়া লুকিয়ে পড়ল। কোনও তৃতীয় ব্যক্তি তবে উৎসুক ছিল নিশ্চয়। আর বিলম্ব নয় তবে। যাত্রা শুরু করা যাক। মহারাজকে তবে গন্তব্য জানানো গেল না। নির্জনে বলা যেত, কিন্তু সে সময় আর পেলেন না থের। এখন তথাগত যেখানে নিয়ে যাবেন তাইই গন্তব্য।
সেদিন মহারাজের নিভৃত কক্ষে আলো ছিল না। ভট্ট এসেছেন। মহারাজ মৌন আছেন। ভট্ট কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছেন না। একসময় মহারাজ মুখ তুললেন। ভট্ট দেখলেন মহারাজের চোখের তলা গভীর। মহারাজ জানতে চাইলেন – কি কবি? কাব্য কত দূর? ভট্ট হাসলেন – কাব্য তার গতিতেই অগ্রসর। কিন্তু মহারাজ যেন কিছু অন্যমনা? কক্ষ এমন নিস্তব্ধ যে সুচ পড়ার শব্দ পাওয়া যাবে। ভট্ট অস্বস্তি অনুভব করছেন। হঠাৎ মহারাজ হাততালি দিতেই প্রহরী এগিয়ে এলো। তার হাতে ধরা একটি বন্ধনীর মধ্যে এক যুবক। ভট্ট দেখলেন যুবক যেন অপ্রকৃতিস্থ। মহারাজ গম্ভীর স্বরে বললেন – কবি, এই যুবক গত রাত্রে এখান থেকে ফেরার পথে বিজনে স্থবির সুমনগুপ্তকে হত্যা করেছে। স্থবির জ্ঞানী হয়েও নির্বোধের মতো বিনা পাহারায় যাত্রা করেছিলেন। পথে এই কাণ্ড। এর বক্তব্য স্থবির তার পৈত্রিক ভূসম্পত্তির পট্টোলীটি চুরি করেছেন। সেটিতে স্পষ্টভাবে এদের রাজত্বের সীমানির্দেশ করা আছে। কিন্তু সেটি কোথাও পাওয়া যায়নি। সংঘারামে আছে বলেই এর ধারণা। স্থবির নাকি কিছুতেই কিছু বলতে রাজি হননি। আচ্ছা কবি? একে দেখে তোমার মনে হয় এ কোনও ছোটখাট রাজ্যেরও রাজা? একথায় যুবককে চঞ্চল দেখা গেলো। রাজার নির্দেশে প্রহরী তাকে নিয়ে চলে গেলো। ভট্ট মাথা নাড়লেন। এমনটাই তিনি আশঙ্কা করেছিলেন। স্থবিরেরও আশঙ্কা অমূলক ছিল না। সুমনগুপ্ত এভাবে গোপনে উজ্জয়িনী ত্যাগের সঙ্কল্প কেন করেছিলেন? উন্মাদ মনে হল যুবকটিকে। কিন্তু থের সুমন কী কারণে নিহত হলেন? আদিত্যের সাম্রাজ্যের কোথাও আর কারো রাজত্ব তো থাকার কথা নয়! তাহলে এই হত্যার কারণ কি যুবক গোপন করেছে? তিনি মুখে কিছুই প্রকাশ করলেন না। যুবকের কি গতি হয় কে জানে! মহারাজের বিচার জানার জন্য মহারাজের দিকে চাইলেন। অতঃপর? সেনাপতি বীরসেন আপাতত উদয়গিরির শিব মন্দিরে আছেন। সুতরাং অমরকরদেবের সঙ্গে তাঁর যে কোনোরকম সংঘাত ঘটেছে, আর তার ফলেই স্থবিরের জীবনদীপ নিভে গেলো, এমনটাও ভাবা যাচ্ছে না।
ভট্টর কথামত মহারাজ যুবকটিকে তারই গৃহে নজরবন্দী করেছেন। তার মস্তিস্কের চিকিৎসার জন্য ভবস্বামী ভট্ট আছেন। যুবকটির সদ্য পিতৃবিয়োগ হয়েছে। ভ্রাতা নিরুদ্দেশ হয়েছে। যুবক ভ্রাতার নিরুদ্দেশের কারণ হিসেবে স্থবিরকেই দায়ী করেছে। তাই ভট্ট তাকে গৃহে নজরবন্দী করতে পরামর্শ দিয়েছেন। এদিকে পরম উৎসাহে সংঘারামটি একটি শিব মন্দিরে পরিবর্তিত হতে চলেছে। সেই ভগ্নদেউলের পুরোহিত এখন বপ্যঘোষের নতুন মন্দিরের পুরোহিত হয়ে আসবেন। মহারাজ লক্ষ করেছেন কবি যেন কিছু অখুশি। তিনি জানতে চেয়েছেন – কিছু ভুল হলো? কবি উত্তরে বলেছেন – মহারাজ, সংঘারামে একটি মাতৃকামূর্তি ছিল। সম্ভবত স্থবির সুমন সমতট থেকে এনেছিলেন। মহারাজ বিস্মিত—স্থবির সুমন কি পূর্বদেশের অধিবাসী? ভট্ট মাথা নাড়লেন। এখন আর মহারাজের অজানা নেই। ভট্ট থেরের সঙ্গে আলাপ করতেন। জ্ঞানার্জনই উদ্দেশ্য ছিল। মহারাজ উদার। তিনি প্রসন্ন মনে গ্রহণ করেছেন। ভট্ট বললেন—আমাকে তিনি বলেছিলেন, পূর্বের জনগোষ্ঠীর এমন কিছু দেবী আছেন, গৃহস্থের মঙ্গল যাঁদের একমাত্র কর্ম। এই মাতৃকা মূর্তিটির বাহন একটি সাদা প্যাঁচা। মহারাজ অট্টহাস্য করলেন – বল কি কবি? প্যাঁচা? কবি হাসলেন – হ্যাঁ মহারাজ, একটি সাদা প্যাঁচা। প্যাঁচা শস্য রক্ষা করে। নিশাচর প্রাণী, যারা শস্য খায়, গৃহস্থের ক্ষতি করে, প্যাঁচা সেইসব প্রাণী শিকার করে। তাই এই দেবীকে ওরা পুজা করেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস স্থবির সেই দেবীকে ইষ্ট মানতেন। অনুরোধ এই যে, আপনি এই দেবীমূর্তিটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করার আদেশ দিন। মহাকালের পাশে ওই দেবীও পূজিতা হন, এইটুকুই চাই। মহারাজ আবার গূঢ় হাসলেন – কবি, তুমি যদি আমার মন্ত্রী হতে! কবিও হাসলেন – তবে মহারাজ আমি আমার পরম সুহৃদকে হারাতাম। তারপরই ভট্টর ঠোঁটে হাসির সূক্ষ্ম রেখা দেখা দিলো। “মহারাজ তাম্র পট্টোলীটি উদ্ধার করতে পেরেছে কি খনক?”
ভগ্নদেউলের পুরোহিত এখন নূতন প্রতিষ্ঠিত মহাকাল মন্দিরের পুরোহিত। আজ অভিষেক। একটি মূর্তি স্থাপন করে তাইতে দুধ ঘি মধু দিয়ে অর্চনা করে পুজা শুরু হবে। কবি আজ আমন্ত্রিত। পুরোহিত বলেছেন – আপনার আরাধ্য দেবতার মন্দির। আপনি নিশ্চয় আসবেন। কবি এসেছেন। তিনি দেখছেন একটি বৃহৎ গহ্বরের মধ্য থেকে একটি কষ্টি পাথরের লিঙ্গ উঠে এসেছে। তার পাশেই মহাকালের মূর্তি। একপাশে একটি কুলুঙ্গিতে তামার তৈরি একটি দেবীমূর্তি। স্থবিরের মৃত্যুতে তিনি শোকাচ্ছন্ন হয়েছিলেন। স্থবির ভালো মানুষ ছিলেন। উপস্থিত ভক্তজনকে পুরোহিত স্নানের জল প্রসাদ দিচ্ছেন। কেউ কেউ কুলুঙ্গির দেবীমূর্তির উদ্দেশে প্রণাম জানাচ্ছে। ভট্ট দেখছেন, পুরোহিত তাদের বলছেন ওইটি পার্বতীর একটি রূপ। শিব আর পার্বতী একসঙ্গে অধিষ্ঠান করছেন এখানে। ভট্ট সাক্ষী রইলেন। পূর্বের দেবী এখন জগন্মাতা।



দীপাধারে ঘিয়ের দীপ জ্বলছে। অতি ক্ষুদ্র, চেরা চেরা দুইটি চোখ, অথচ তীব্র দৃষ্টি, চ্যাপ্টা নাক, যার দুটি গর্ত শুধু দেখা যায়, অজস্র রেখায় ভরা মুখাবয়ব, এক বিদেশী ভিক্ষু কাঠের নিচু আসনে পাতা রেখে কিছু লিখে চলেছেন। তাঁর সর্বশরীরে ক্লান্তির সুস্পষ্ট চিহ্ন। তবু ওই ক্ষুদ্র চোখ দুটিতে কি এক দ্যুতি। তিনি লিখে চলেছেন। কি অপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর! তিনি জানতেন মহামানব তথাগতর বাসভুমি ও কর্মভুমি দর্শন বৃথা যাবে না। যদিও বৌদ্ধশাস্ত্রগুলি চীনদেশে নিয়ে যাওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু পাশাপাশি এ এক দারুন অভিজ্ঞতা! সেগুলি লিপিবদ্ধ না করে রাখলে ভবিষ্যতের জন্য কিছুই থাকবে না। তিনি মাথা নীচু করে লিখে চলেছেন।
-অশোক রাজার প্রাসাদের অবশেষ দেখিলে মনে হয় যে উহা মনুষ্যের নির্মাণ নহে। উহা অবশ্যই এক অলৌকিক মহামন্ত্রবলে নির্মিত। দেবতাদের দ্বারা এই প্রাসাদ নির্মিত হইয়াছে। এই পাটলিপুত্র নগরী এক দৈবনগরী। ইহার স্থানে স্থানে বিচরণ কালে তথাগতর করুণাধন্য এই নগরীর প্রতি ধূলিকণার প্রতি শ্রদ্ধায় আপ্লুত হইয়াছি।
তাঁর নিভৃত চর্চার মাঝে একজন বর্ষীয়ান ভিক্ষু এসে দাঁড়ালেন। তিনি ভিক্ষুর সমদেশীয়। নীচু হয়ে বসে অপেক্ষা করতে থাকলেন। শি ফাহ নিজে থেকে সাড়া না দেওয়া পর্যন্ত তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে। একসময় ভিক্ষু মাথা তুললেন। তাঁর চোখে তখনও ঘোর। যা যা দেখেছেন প্রায় সবই তিনি লিখেছেন। এরপর পাটলিপুত্র ছেড়ে যাবেন আরও পূর্বে। যাবার সময় হয়ে এলো। তিনি নীরবে পাতাগুলি কাঠের তক্তায় সুতো দিয়ে বেঁধে তুললেন। সম্মুখে অপেক্ষারত ভিক্ষুর উদ্দেশ্যে বললেন—তাও চিং, কাল প্রত্যুষে যাত্রা করতে হবে। স্বদেশে আমাকে শাক্যবংশীয় বলে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে, ফিরে গিয়ে সেই সম্মানের উপযুক্ত কর্মটি করতে হবে। ভিক্ষু কুমারজীবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে এই বিপুল শাস্ত্রের কথা জানাব। বৌদ্ধ দর্শন যেন অতলান্ত সমুদ্র, তাও। ভিক্ষু শ্রদ্ধানম্র চোখে তাকিয়ে রইলেন। শি ফাহ স্বদেশে এখনই কিংবদন্তী বিশেষ। বুদ্ধভূমিতে তিনিই প্রথম চৈনিক ভিক্ষু। তাঁদের অন্য তিন সহযাত্রীর মধ্যে একজন মাঝপথে কষ্ট সইতে না পেরে ফিরে গিয়েছেন। দু’জন পথে প্রাণ হারিয়েছেন। সেই ভীষণ ক্লেশকর রেশমপথ, সেই তারিম নদীর দক্ষিণে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মতন তাকলামাকান মরুভূমি আর পেরোতে হবে না বলে তাও চিং খুশি। শি ফাহ বলেছেন তাঁরা তাম্রলিপ্তে গিয়ে নৌযোগে চীনে ফিরবেন। হিমালয় দর্শন হবে না। হবে অকুল বারিধি দর্শন। ভিক্ষুটি মাথা নিচু করে প্রণাম জানালেন। তিনি স্বভাবকবি। সাগরের রূপ কল্পনা করে মনে অপার আনন্দ অনুভব করছেন। তাঁর আচার্যের মতন তিনি নির্মোহ হতে পারেননি এখনও। ফাহ আবার যেন কিছু বলতে চাইছেন। তাও চিং অপেক্ষা করছেন। ফাহ বললেন—সাগরেও প্রাণসংশয় হবে তাও। ভয় পেলে চলবে না। তথাগতর এই সম্পদ যেন চীনে পৌছয়। এ কাজ দৈবনির্দিষ্ট। তাও চিং চিন্তিত হলেন। শুধু সৌন্দর্যের কথা ভেবে আনন্দিত হচ্ছিলেন। এখন ফাহ’য়ের কথায় বুঝতে পারলেন, ফাহ ভবিষ্যৎ জেনেছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন – শি ফাহ কি কালই রওনা হবেন? তবে নালন্দার মহাচার্য কটি অশ্ব দিতে চান। এই বিপুল গ্রন্থের ভাণ্ডার বয়ে নিয়ে যেতে হবে। সমুদ্রে অবতরণ না করা পর্যন্ত আমাদের প্রয়োজন হবে। শি একথার উত্তর দিলেন না। তিনি যেন এখনও এক স্বপ্নের মধ্যে। তিনি বললেন – আপাতত আমাদের যাত্রাপথে একটি গুপ্ততীর্থ পড়বে। সেখানে সুগন্ধ সুরভিত তথাগত আমাদের অপেক্ষায় থাকবেন। এর চেয়ে বেশি প্রাপ্তি আর কি থাকতে পারে? সেই গুপ্ত তীর্থটিকে উন্মোচিত করে যেতে হবে। এইটিই এখন উদ্দেশ্য। ভিক্ষু সম্যক বুঝলেন না। সুরভিত তথাগত কী করে কোথা থেকে উদয় হলেন? হলেও, সে নিশ্চয় শি’র মানসিক সৃষ্টি। নচেত এমন কথা তো এতদিনে তিনি শোনেননি। ফাহ সমাহিত বুদ্ধের মতোই প্রদীপের শিখার দিকে তাকিয়ে নিবাত নিষ্কম্প বসেছিলেন। ভিক্ষু বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন – শি ফাহ, আপনি কি সেই স্থানটি নির্ণয় করতে পেরেছেন? ফাহ ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন – নাহ, সে স্থান তিনি জানেন না। তবে তথাগত ঠিক তাঁকে নির্দেশ দেবেন।
অতি প্রত্যুষে পাটলিপুত্র থেকে বেরিয়ে ফাহ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। প্রথমে পূর্বে, তারপর দক্ষিণ পূর্বে যেতে হবে। গন্তব্য তাম্রলিপ্তি। পথিমধ্যে যা যা দর্শন হয় সবই লিপিবদ্ধ করছেন। আশ্চর্য হয়ে দেখছেন যতই অগ্রসর হচ্ছেন ততই ছোট ছোট বৌদ্ধ বিহারের দেখা মিলছে। তারা হয়ত মগধের মতো অমন বড়সড় নয়। তবে সংখ্যায় কম নয়। বিহারগুলির গঠনসৌকর্য, সেখানকার সাধুদের পোশাক, তাঁদের আরাধনার ধরণ, এ সমস্তই ফাহ’কে আশ্চর্য করেছে। উত্তর ও উত্তর পূর্বের চেয়ে এগুলি একেবারেই অন্যরকম। তাঁকে দেখে বিহারের সব শ্রমণ শ্রদ্ধায় মাথা নত করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন পূর্বেই সংবাদ এসেছে। কী অদ্ভুত! কে এমন হাওয়ার গতিতে সংবাদ বয়ে এনেছে। তিনি আসছেন। তাঁর মতন পণ্ডিত সিদ্ধপুরুষ বিরল।
ক্রমে বরেন্দ্রভুমির সীমানায় এসে পড়েছেন। আজ নগরীতে শোরগোল বড়। সম্রাটের পুত্রলাভের কারণে দিকে দিকে সকলে উৎসবে মেতেছে। ভিন ধর্মের আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধ বিহারগুলিতেও পূজার্চনা চলছে। পথশ্রমের ক্লান্তি আরও অধিক হতো, কিন্তু এখন হেমন্তকাল বলেই ফাহ তত শ্রান্ত হননি। তথাগতর করুণা ছাড়া আর কি? হঠাৎই শি ফাহ’র মনে পড়ছে, গৃধ্রকূট পর্বতে যখন তিনি তথাগতকে চাক্ষুষ না করার দুঃখ নিয়ে সুরঙ্গমা সূত্রটি আবৃত্তি করছিলেন, তখনই তাঁকে বাঘ আক্রমণ করে। তথাগতর অপার করুণায় তিনি রক্ষা পান। এ আর কিছুই নয়, স্বদেশে ধর্মগ্রন্থগুলি যে তিনি নিয়ে যেতে পারবেন, এ তারই ইঙ্গিত। নাহলে তাঁর এই নশ্বর দেহের জন্য দুঃখ কি? মৃগস্থাপন বিহারে কয়েকদিনের অবস্থান এখন। বিহারের অধ্যক্ষ শি ফাহ’কে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে আতিথ্য দিয়েছেন। এখন এক পক্ষকাল শি ফাহ এবং তাঁর সঙ্গের পণ্ডিত ভিক্ষুদের সঙ্গে মৃগস্থাপনের স্থবিরদের ধর্মালোচনা চলবে। ফাহ জ্ঞানী। তাঁর বিশুদ্ধ জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হবে বৌদ্ধ ধর্মের নানা অনালোকিত দিক।
সেদিন সন্ধ্যায় এমনই সভা বসেছে বিহারের ছাতে। উন্মুক্ত প্রান্তর ফাহ বড় ভালোবাসেন। আকাশ দেখা যায়। শূন্যতা তাঁর মধ্যে নির্বাণের অনুভুতি জাগায়। আলোচনা চলছে। হঠাৎই ফাহ লক্ষ করলেন এক তরুণকে। কিছু অস্থির। তিনি মিতভাষী। তবু কাছে ডাকলেন। ইশারায় জানতে চাইলেন কী কারণে তরুণ অস্থির। তরুণটির কৃশ কিন্তু শক্ত শরীর, কৃষ্ণবর্ণ ত্বক, ও চ্যাপ্টা নাক। চোখ দুটিতে রক্তিমাভা। এতদিন ফাহ যেমন মানুষ দেখে এসেছেন, এ তার থেকে অন্যরকম। তাঁর দৃষ্টি বুঝে তরুণটি বলল- আমি খাড়িমণ্ডলের মানুষ। তাম্রলিপ্তির কাছেই আমার গ্রাম। ক্ষমা করবেন। আপনার আলোচনায় মনোনিবেশ করতে অসুবিধে হচ্ছে আমার। ফাহ’র পাশে বসে অনর্গল অনুবাদকের কাজ করে চলেছিলেন যে এদেশীয় ভিক্ষু, তিনি ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। কিন্তু ফাহ’র নির্দেশে পরবর্তী কথাগুলোও তাঁকে অনুবাদ করতে হলো।
তরুণ তাঁর আশঙ্কার কথা জানালেন। ফাহ এদেশের সম্রাটের সম্পর্কে তেমন অবহিত নন। তাঁর সে ইচ্ছেও নেই। তিনি দেখেছেন এ দেশের সাধারণ মানুষ সুখে শান্তিতে আছে। তবে? তরুণ এ কী বলছেন? তরুণ বলছেন বৌদ্ধ বিহারগুলি ক্রমাগত হিন্দু মন্দিরে পরিবর্তিত হচ্ছে। এভাবে চললে কিছুকাল পর বৌদ্ধ তীর্থ ও বিহার সব লুপ্ত হয়ে যাবে। এই যে আজ ফাহ এখানে বসে আছেন, এর অদূরেই তো একটি হিন্দু মন্দির, চক্রস্বামী বিষ্ণু দেবতার মন্দির আজ কদিন হলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বয়ং বীরসেন, সম্রাটের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, উপস্থিত ছিলেন। সেই উচ্চকিত উৎসবের প্রকোপে বিহারের শান্ত সমাহিত পরিবেশ ও প্রার্থনা কি ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছে! ফাহ কি জানেন? জানেন কি, মাঝে মাঝে বিহার আক্রান্ত হয়? আজ যে গ্রন্থগুলি তিনি নিয়ে চলেছেন, অদুর ভবিষ্যতে হয়ত এগুলির কোনও নিদর্শনই আর এখানে থাকবে না।
সেদিন রাতের আকাশে মেঘের প্রভাবে তারারা লুকিয়ে পড়েছিল। ফাহ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তথাগতর যা ইচ্ছা। আপাতত তিনি যা ব্যক্ত করেননি, তা হলো, তথাগতর চরণধন্য সেই নিমজ্জিত ভুমি। সেই গুপ্ত তীর্থ তিনি খুঁজে বের করবেন। একদিন ভ্রমণকথা লিখতে লিখতে ফাহ খুব আত্মমগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। সেসময় কেমন এক আবেশে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন তথাগতর উপবিষ্ট এক মূর্তি। একটি বৃক্ষের পাদমূলে বসে আছেন তিনি। তাঁর চরণ দুটি যেন কোনো স্রোতস্বিনীতে নিমজ্জিত। চারপাশে ঘন অরণ্য। ফাহ বুঝেছিলেন, এমন কোনো অরণ্যে তথাগত নিশ্চয় এসেছিলেন। এখন এই তরুণের কথা শুনে মনে হচ্ছে সেই স্থান খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না। কারণ তরুণ তাঁকে বলছে, এরপর ঘন বন আর অসংখ্য নদী পড়বে পথে। কোথাও কোথাও লোকালয় নেই। ফাহ নিশ্চিন্ত হলেন। এ তরুণ তাঁকে পথে সাহায্য করবে। অধ্যক্ষকে জানাবেন তিনি। এই তরুণকে তাঁর চাই। তরুণটি জাতিতে শবর। সমুদ্রের কাছে বাস হওয়ার ফলে এমন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু সমানে সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে সুগঠিত দেহ। সে এতটা পথ অতিক্রম করে বিহারে যোগ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পাণ্ডিত্যে সে এমন স্থান অধিকার করেছে যে, স্বয়ং ফাহ’য়ের আলোচনা সভায় সে উপস্থিত থাকতে পেরেছে। এদেশ ত্যাগ করার আগে সেই পুণ্য ভূমিটি খুঁজে বের করতে হবে। যুবক এই কাজে তাঁর অবলম্বন হবে বলেই ফাহ’য়ের বিশ্বাস।
অধ্যক্ষ বলছিলেন। আসলে মহাযান ধর্মের অনুসারীরা শিবকে তাদের ধর্মে স্থান দিয়েছে। থেরবাদীদের মতো গোঁড়া নয় তারা। এখন এই তরুণ দবাক সমতট বঙ্গের একজন প্রতিনিধি স্বরূপ। খাড়িমণ্ডল ও ঝারিবাটকের সে রাজা। নাম মীনকর। একে প্রত্যন্ত রাষ্ট্র। তার ওপরে অতি দুর্গম স্থান। ফলে গুপ্ত রাজার শাসন এখানে তেমন চলে না। মীনকর ক্রান্তদর্শী। তিনি মহাযানীদের মতন হিন্দু দেবদেবীকে পূর্বের বিহারগুলিতে স্থান দেওয়ার পক্ষে। এমনিতেই এখানকার জনজাতিগুলি যে ধর্ম পালন করে তা বিশুদ্ধ নয়। নানা পার্বণের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন তথাগত। মীনকর তাই ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদি এভাবেও ধর্মরক্ষা করা যায়। সম্রাট ধর্মব্যাপারে উদার। কারো ব্যাক্তিগত ধর্মাচরণে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না। কিন্তু সব রাজকর্মচারী বা সব গুপ্তরাজপুরুষ তাঁর মতো উদার নন।
ফাহ চমকিত হলেন। মীনকরের মতো করে তিনি তো ভাবেননি? তথাগত ধর্ম ব্যপারে কত বিচিত্র পথই না খুলে দিচ্ছেন! তিনি মীনকরের সাথে সহমত হলেন। ধর্ম যেন স্রোতস্বিনী। কালে কালে তার পরিবর্তন অনিবার্য। সেই পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে না পারলে স্রোত বাধা পাবে। পথ হারাবে।


উদ্দক করতলে একটি ক্ষুদ্রাকার সুপারি নিয়ে বসেছিলেন। ছাতিম গাছটার তলে অনেকটা জুড়ে জমি জেগে আছে। কিন্তু সেই জমিকে বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে জল। এবার বন্যায় ভেসে গিয়েছে চারিদিক। কিন্তু ছত্তিবন্নার, মানে সপ্তপর্ণীর এই মাটিটুকু কী এক দৈব বলে কিছুতেই ডোবে না।
এবার ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছে। ছত্তিকে ঘিরে থাকা জলের প্রাচীর যেন কি এক অলৌকিক কারণে তাকে দুর্গের মতন সুরক্ষিত রেখেছে। আজ তিনি অপেক্ষা করছেন দামুকের। উজ্জয়িনী থেকে এক আগন্তুক এসেছে। সে নাকি একটি লিপি সঙ্গে এনেছে। স্থবির সুমনগুপ্ত, যার কথা অমরকরদেব তাঁকে জানিয়েছিলেন, সেই সুমনগুপ্তর স্নেহাস্পদ এই যুবক। বহু কষ্টে সে এসেছে এতদূর পথ। সুমনগুপ্ত নাকি তাঁকে উদ্দকের কাছে পাঠিয়েছেন। দেখা যাক। ছাতিম গাছের তলায় বসে উদ্দক আনমনা হয়ে পড়ছিলেন। মাঝে মাঝে যমুনা আসে এখানে। দামুক জানে না। সে এসে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলে। বলে, তার সাদা প্যাঁচাটা নাকি কথা বলে। সে নাকি বলেছে চন্দনগন্ধ বুদ্ধের বাস এই ছাতিম গাছের তলে। উদ্দক হাসেন। যমুনা দামুকের স্ত্রী বটে, কিন্তু স্বাধীন রমণী। যত্রতত্র যেতে পারে। নিজের ইচ্ছেমত সে এখানে আসে। উদ্দকের প্রতি তার একরকমের আকর্ষণ আছে, উদ্দক বুঝতে পারেন। কিন্তু যমুনা যেমন স্বাধীন উদ্দকও তেমন। যমুনা শুধু স্বাধীন নয় সাহসিনীও বটে। উদ্দকের সঙ্গে মাঝে মাঝে দুটি বাঘ থাকে। উদ্দক দেখেছেন, হিংস্র প্রাণী দুটি তাঁর কাছে আসতে ভালোবাসে। কখনও কখনও লোকালয়ের কেউ যদি এভাবে তাঁকে দেখতে পায়, ভয় পায়। আবার উদ্দকের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করে। তিনি তাই এই গভীর জঙ্গলেই থাকতে ভালোবাসেন। ছাতিম গাছের তলায় এই সরু সোঁতাটায় অনেক জানোয়ার জল খেতে আসে। বাঘও আসে। এই দুটি যেন পোষা তাঁর।
সে এক পূর্ণিমার রাত্রি ছিল। তিনি ছাতিমের একটি মোটা শেকড়ে বসেছিলেন। বনভূমি, নদীর জল, সব চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। কেমন এক মায়ার ঘোর। সেই আলোয় তিনি দেখতে পেলেন এক নারীমূর্তি। প্রথমে মনে হল, সাধনার ফল। ইষ্টদেবী হবেন। কিন্তু নারীটি খিলখিল করে হেসে উঠল। তার হাসিতে মানুষী উপস্থিতি প্রবল। উদ্দক গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন—কে? প্রাণের ভয় নেই? নারী আবার হাসল—আমি যমুনা। ছত্তির দামুক কারিগরের বউ। কিন্তু তুমি থাকতে প্রাণের ভয় হবে কেন? উদ্দক টের পেলেন, এ নারী কুহকিনী। কিন্তু তাঁর সাধনা ভিন্ন। প্রকৃতি সাধন তাঁর পথ নয়। কিন্তু তাঁর প্রতি নারীটির আকর্ষণ প্রবল মনে হচ্ছে। নিরুপায় বোধ হচ্ছে তাঁর। স্খলিত স্বরে তিনি জানতে চাইলেন, এত রাতে এমন জঙ্গলে কেন এসেছ? জানোয়ারের ভয় নেই? নদীতে কুমির কামটও তো আছে। জানো নিশ্চয়। যমুনা এবার নিঃশব্দে হাসল—ভয় করে না আমার। তোমার কাছে আসতে পারব জেনে একটুও ভয় করে না। যমুনা কথা ক’টি বলতে বলতে উদ্দকের খুব কাছে চলে এসেছে। তার নিঃশ্বাস উদ্দকের গায়ে লাগছে। সে একটি হাত তুলে উদ্দকের বুকে রাখতে যাবে, হঠাৎ থেমে গেল। তার মুখ গম্ভীর। উদ্দক চেয়ে দেখলেন কখন নিঃশব্দে বাঘ দুটি সৈনিকের মতো, রক্ষকের মতো তাঁর দু’পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের সবুজ চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। যমুনা যেন ক্ষিপ্ত হল। বাঘের মুখের গ্রাসের মতোই কেউ যেন উদ্দককে বাঘিনীর গ্রাস থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। তারও চোখ জোড়া জ্বলে উঠল।
উদ্দক স্বস্তি পাচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগেই যমুনা তাঁকে কুহক করছিল। এই সঙ্গী দুটি না এলে আজ কী যে হতো! তিনি বললেন—যমুনা ফিরে যাও। আমার কাছে আর এসো না। এরা বড় হিংস্র। তাছাড়া, আমার কাছে আর কেউ আসুক, তা এরা চায় না। তুমি দামুকের কাছে ফিরে যাও। যমুনার চোখ জলে ভরে উঠল। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। উদ্দককে সে যে কতদিন কামনা করেছে! উদ্দক তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন? উদ্দক সান্ত্বনার সুরে বললেন—দুঃখ কোরো না। আমি যেখানেই থাকি না কেন তথাগত তোমার সঙ্গে থাকবেন। এমন কথায় যমুনা মুখ তুলে চাইল। আর ঠিক তখনই একটা সাদা প্যাঁচা তীব্র চিৎকার করে উড়ে গেল। যমুনা ভালো করে চাইল। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় উদ্দককে যেন দেবতা মনে হচ্ছে। বাঘ দুটো যেন তার বাহন। চারিপাশ থেকে এক অজানা সুরভি যমুনাকে আবিষ্ট করে ফেলছে। খানিক আগের সেই দেহের তাড়না যেন শান্ত হয়ে এসেছে। কিন্তু এ কিসের সুবাস? এ কি কস্তুরি? কস্তুরি গন্ধে বাঘ দুটিও যেন চঞ্চল হল। তারা বনের দিকে ফিরছে। উদ্দক এবার যমুনার হাত দুটো ধরলেন—এ চন্দন গন্ধ। তথাগতর সুরভিত আবাসে এসেছ তুমি। আজ বড় আনন্দের রাত। তোমার স্পর্শেই এই ভূমি সুরভিত হল। কত সন্ধান করেছি! বুঝতে চেয়েছি, কোথায় সেই স্থান! তুমি সুভগা।
যমুনা চুপ করে শুনছিল, উদ্দক বলে চলেছেন। তথাগতর চরণ স্পর্শে এখানকার নদী ভূমি বৃক্ষ সব চন্দনের সুবাসে সুবাসিত। আজ পর্যন্ত এই সুরভি কেউ পায়নি। আজ প্রথম। যমুনার যেন কী মনে পড়েছে। সে বলল—দামুক বুদ্ধমূর্তির বরাত পেয়েছে। কিন্তু এদেশে এখন শুকনো কাঠ কই? এবারের বন্যার জল এখনও সরেনি। উদ্দক হাসলেন—আচ্ছা, ঘরে যাও। দামুকের কাজ হবে।
যমুনা ফিরে যাচ্ছে। মিলনেচ্ছা ব্যর্থ হল। উদ্দক যে সাধারণ পুরুষ নন। ফিরে যেতে যেতে সে দেখল, সেই সাদা প্যাঁচাটা তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। হেসে ফেলল সে। উদ্দকের যেমন বাঘ, তার তেমন প্যাঁচা।
এখন ঝোপের মধ্যে খসখস শব্দ উঠছে। ঘন বাঁশের বন ভেদ করে দামুক আসছে। সঙ্গে কুণ্ড। কুণ্ড এমন গভীর বন কখনও দেখেনি। বেশ ভয় করছে তার। এমন গভীর বনে, জলাভূমিতে কুমীর কামট, সাপখোপ থাকবেই। পা কাদায় ডুবে যাচ্ছে। জলে জোঁক দেখা যাচ্ছে। হেলে পড়া বাঁশ ধরে ধরে কোনোরকমে তারা জেগে থাকা জমিতে উঠে এলো। এমন জলে নদীকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। উদ্দক দেখলেন। থের সুমন যেমন বলেছিলেন তেমনই। কুণ্ড এসে প্রণাম জানিয়ে সঙ্গের থলি থেকে বের করে আনল একটি তামার লিপি। তারপর সেটি ধরিয়ে দিলো উদ্দকের হাতে। উদ্দক লিপিটি প্রসারিত করলেন। যেটুকু আলো এসে পড়েছে, তাইতে তিনি দেখতে পেলেন একটি চিত্র। সেই চিত্রে স্পষ্টভাবে আঁকা আছে আত্রাই বারতোয়া আর ছত্তির ত্রিবেণীসঙ্গম। মাঝে একটি গাছের চিত্র। তার তলে একটি বেদী। বেদীতে দুটি চরণ অঙ্কিত। নীচে বিশদভাবে লেখা আছে মহারাজ শ্রীগুপ্ত জনৈক ভুজগসেনকে এই ভূখণ্ড দান করছেন। এমনকি নদীর ঘাট ও ঘাটসংলগ্ন সমস্ত ভুমিই দান করছেন। খিলখণ্ড, অর্থাৎ কৃষিজমি বিনা বাস্তুখণ্ড হিসাবে ওই গাছের চারপাশের বিস্তৃত জমি দান করা হয়েছে। ঘাট থেকে যে অর্থ উপায় হবে তাও ভোগ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
উদ্দক তাকালেন। যুবকের অবয়বে স্পষ্ট যে সে এসেছে রাজধানী উজ্জয়িনীর কাছ থেকে। তিনি বসতে বললেন কুণ্ডকে। তাঁর তীক্ষ্ণ চোখ। কী যেন ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এটির প্রতিলিপিটি কোথায়? কুণ্ড ভাবল খানিক। তারপর বলল- থের সুমনের কাছে। সংঘারামের কক্ষে লুকোনো আছে। উদ্দক হাসলেন। তবে করুণ হাসি। থের সুমন গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন। মীনকর সে সংবাদ দিয়ে গেছে তাঁকে। সে লিপিটি এখন কার হাতে পড়বে কে জানে? আপাতত জানা যাচ্ছে ভুজগসেন এই ভুমির মালিক। কিন্তু তিনি কে? কুণ্ড কি জানে? উদ্দক প্রশ্ন করলেন। কুণ্ড জানে বৈকি! এ ভুমি যে তারই পিতৃপুরুষের! তাইই বাবা এই পট্টোলীটি লুকিয়ে রাখতেন। পাছে কেউ দেখে ফেলে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে মাত্র কটা দিন লাগত। যদিও বুদুক, তার অগ্রজ, অধুনা হিন্দু ধর্মে ঝুঁকেছে। রাজধর্ম কিনা। পিতা যে গোপনে কিছু ঘটাতে চলেছেন সেটা বুদুক বুঝেছিল। এ লিপির কথা কেউ জানত না। পিতা থের সুমনের কাছে সব জানিয়েছিলেন। তাঁর কথামতো এই পট্টোলীটির একটি প্রতিলিপি তৈরি করা হয়। পিতার মৃত্যুর পর সেই প্রতিলিপি থের সুমন সংঘারামে কক্ষে লুকিয়ে রাখেন। আর কুণ্ডকে পাঠিয়ে দেন সুদুর সমতটে। থের উদ্দকের সন্ধানে। উদ্দক বিস্মিত। স্তব্ধবাক। স্থবির সুমনগুপ্তকে তাঁর সংবাদ দিল কে? মীনকর!
সেই সুমন। বাল্যে উদ্দকের সখা ছিল সে। পশুপতিসেনের পিতা যখন উজ্জয়িনীর দিকে রওনা হলেন তখন সঙ্গী হয়েছিল ছত্তির আরও কয়েকজন। পশুপতির পিতা তখন যুবক। ছত্তিতে সেবছর ভয়ংকর বন্যা হয়েছিল। ওদের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ল। জমি গেল ডুবে। আত্রাই বারতোয়া সব কুল ছাপিয়ে মাঝের দ্বীপটিকে ডুবিয়ে নিলো। সুমন তখন কিশোর। সে যাবার আগে বলে গিয়েছিল, একদিন সে ফিরে আসবে। সে এত বছরে একবার মাত্র যোগাযোগ করতে পেরেছিল। মীনকর সেই লিপি এনে দিয়েছিল। সে লিখেছিল, ছত্তি নাকি খুব পবিত্র স্থান। তথাগতর ইচ্ছায় ছত্তি সর্বজনের তীর্থ হবে একদিন।
লিপি যে উদ্দক পেয়েছেন তার প্রমাণস্বরূপ তিনি মীনকরের হাত দিয়ে একটি ধাতুর মাতৃকামূর্তি উপহার পাঠিয়ে ছিলেন সেবার। মীনকরের মুখেই শুনেছিলেন, উজ্জয়িনীর কাছে থের সুমন একটি সংঘারামের অধ্যক্ষ। তিনি সময় হলেই সমতটে ফিরবেন।
কুণ্ড তার দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু এখন আর তার যাওয়ার জায়গা নেই। কোথায় যাবে সে? বপ্যঘোষে ফিরলে বুদুক তার নামে রাজার কাছে নালিশ জানাবে। সে চোর। পরিবারের সম্পদের গোপন নথি চুরি করেছে। কে জানে? হয়ত এ ভূমি সম্রাটের অধিকারে পড়েছে! এতদিন ধরে সে যে উৎসাহ নিয়ে কষ্ট স্বীকার করে এই পর্যন্ত এসেছে তা যেন এক ফুৎকারে অন্ধকার হয়ে গেল। উদ্দক লক্ষ করছেন। এই যুবককে তাঁর চাই। এই ভূখণ্ডের আধিকারিকের উত্তরপুরুষ এই যুবক। তিনি হাত ধরলেন কুণ্ডর। তাকে নিয়ে গেলেন নিজের পাতার ঘরে। তারপর অতি সমাদরে বেড়ে দিলেন ভাত আর তেঁতুলের টক। আগের দিনে রেঁধেছিলেন। পদ্মপাতার ওপরে সেই খাদ্য দেখে কুণ্ড একটু ইতস্তত করছিল। তারপর সে খেতে শুরু করল। উদ্দক হাসলেন- নিত্য যে এমন সুখাদ্য জুটবে তার আশা কম কিন্তু। সুখাদ্য? কুণ্ড ভিতরে ভিতরে চমকে উঠছে। উদ্দক আবার বললেন- থের সুমন ইহজগতে আর নেই। তবে স্বপ্নে তুমি তাঁর দর্শন পেতেই পারো। তোমার অগ্রজ তাঁর হত্যাকারী। কুণ্ড স্থির। উদ্দকের স্বর গভীর- তুমি একটি দানপত্র করবে। সেই দানপত্রে এই ভুমি তুমি বিহারকে দান করবে। তারপর এই বিহারের কর্মাধ্যক্ষ হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করবে। থের সুমনের অন্তিম ইচ্ছানুসারে এখানে একটি বিহার স্থাপন করা হবে। তথাগতর চরণ স্পর্শে ধন্য ছত্তিবনা বিহার। সপ্তপর্ণী বিহার। কুণ্ড যেন আলোর দিশা পাচ্ছে। থের সুমন নেই? ভীষণ শোক উঠলে উঠছে। কিন্তু তার মাঝেও সে সুমনের কল্যানহস্ত অনুভব করতে পারছে।
আজ উদ্দক তাকে নিজের মতো করে ধ্যান শিখিয়েছেন। জানিয়েছেন, এ অঞ্চলে বৌদ্ধমতে সাধনার ধরন ভিন্ন। সেইমত বৌদ্ধতন্ত্রে বলে সাধনা করলে প্রথমে শূন্যতার বোধ হয়, দ্বিতীয়ে বীজমন্ত্রের দর্শন হয়, তৃতীয়ে বীজমন্ত্র থেকে বিম্ব অর্থাত্‍ দেবতার অস্পষ্ট আকার দেখা যায় এবং অবশেষে দেবতার সুস্পষ্ট মূর্তি দর্শন হয়। সে মূর্তি অতি রমনীয়, সর্বাঙ্গসুন্দর, কল্পনার অতীত, স্বর্গীয় বর্ণে রঞ্জিত এবং নানাপ্রকার দিব্য বস্ত্র অলংকার ও অস্ত্রশস্ত্রে শোভিত। একবার দেখলে তা আর জীবনে বিস্মৃত হওয়া যায় না।
কুণ্ড ধ্যানে বসলেই কিন্তু একটি নারীমূর্তি তাকে বিরক্ত করছে। সেটি যমুনার মূর্তি।
শি ফাহ ইয়েন এসে পৌঁছেছেন ছত্তির কাছে। মীনকর তাঁর পথপ্রদর্শক। তাঁর সঙ্গের সমস্ত গ্রন্থরাজি ও মানুষজন অদূরে কোটালিপাটক নামে একটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ জনপদে আশ্রয় নিয়েছে। মীনকর সেই ব্যাবস্থা করেছেন। ছত্তিতে তিনি স্বয়ং ফাহ এবং তাও চিং নামে ফাহ’য়ের সহচরটিকে নিয়ে এসেছেন। ফাহ অবাক হয়ে দেখেছেন, একটি ক্ষুদ্র সরু নৌকা, যার একপ্রান্তে মীনকর বসে দাঁড় বাইছেন, এবং মধ্যে অপেক্ষাকৃত প্রশ্বস্ত অংশে তাঁরা দুজনে বসেছেন। ধীরে ধীরে দুপাশের বনভূমি নৌকার ওপরে ঝুঁকে পড়ছে। মীনকর দক্ষ হাতে ঠেলে দিচ্ছেন সেসব। কখনও জলজ লতা ছিঁড়ে সরিয়ে দিচ্ছেন। মীনকর জানতে চাইলেন- আপনাকে শঙ্কিত করছি না তো? ফাহ স্মিত হাসলেন। মীনকর কি করে জানবে যে তিনি এই গুপ্ত তীর্থের স্বপ্নই বারবার দেখেছেন?
অবশেষে সেই ছাতিম গাছের তলায়। ফাহ দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দুই চোখ যেন কোন সুদূরে। মুখে অদ্ভুত বিভা। এই তো তিনি পেরেছেন! এই সেই ভুমি। এই সেই সপ্তপর্ণী বৃক্ষ। যেখানে এসে তথাগত দুদণ্ড বিশ্রাম নিয়েছিলেন। যেখানে এই মীনকরের পূর্বপুরুষ তাঁকে মাছ ও ভাত আহার করিয়েছিলেন। এই সেই পবিত্র ভুমি, যেখানে বসে তথাগতর দুই পায়ের পাতা জলে ডুবে থাকত। এই তো বিহারের উপযুক্ত স্থান!
এমন সময়ে কয়েকটি মানুষ এসে দাঁড়ালো। তার মধ্যে একজন, ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন, অধমাঙ্গে একটি সুতির বস্ত্র, এসে তাঁকে প্রণাম জানালেন। ফাহ অনুভব করলেন, এইই উদ্দক, যার কথা সারাটি পথ মীনকর বলে এসেছেন। কী নাকি অলৌকিক ক্ষমতা আছে তাঁর। এই গভীর বনে একা থাকেন। বাঘ পর্যন্ত তাঁর পোষ্য প্রাণী! সঙ্গের যুবকটিকে দেখে মনে হচ্ছে ভিন দেশের। তবে তারও নগ্ন শরীর, একটি ধুতি পরনে। ফাহ বুঝতে পারলেন উদ্দক একে উপসম্পদা দিয়েছেন।
ধীরে ধীরে উদ্দক ফাহ’য়ের কাছে ব্যক্ত করলেন সব।
সেদিন ফাহ ইয়েনের উপস্থিতিতে সপ্তপর্ণী বিহারের ভিত্তি স্থাপিত হলো। কর্মাধ্যক্ষ হলো কুণ্ড। উদ্দকের সময় বা সাধ কিছুই নেই। তিনি সাধনায় মগ্ন হবেন। আবার মীনকর ফিরিয়ে নিয়ে চললেন শি ফাহ’কে। তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ। এবার গন্তব্য তাম্রলিপ্তি।
সপ্তপর্ণী বিহারের থেকে দূরে একটি নাতিউচ্চ মাটির দেওয়ালের পারে উদ্দক নিজের কুটীর নির্মাণ করে নিলেন। লোকালয় থেকে দূরে না থাকলে সাধনা অসম্ভব।

উপসংহার
সেদিন ভট্ট কালিদাস মহারাজের নিকটে বসেছিলেন। মহারাজ তীক্ষ্ণ চোখে দেখছেন। কালিদাসের মুখে অল্প হাসি। তিনি বলছেন- মহারাজ, সংঘারামের পট্টোলীটি আমি অমরকরদেবের হাতে দিয়েছি। আর্যমঞ্জুশ্রীকল্পে কিছু সংযোজনের জন্য স্থবির সুমনগুপ্ত আরও কিছু পুঁথির সঙ্গে এটিও রেখে গিয়েছিলেন। অনুমান করলাম, তিনিই যোগ্য ব্যক্তি। বীরসেন এর মুল্য কি বুঝবেন আর? বিক্রমাদিত্যের অধরে গূঢ় হাসি- তবে যে সুমন গুপ্তর হত্যাকারী যুবকটি বলেছিল সেটি ওদের পারিবারিক সম্পদের পট্টোলী? কালিদাস আবার হাসলেন- মহারাজ, ওটি তো পরিবারেরই ছিল! আর নেই। তাছাড়া ওই গভীর বনে, জলে ডোবা জঙ্গলে আপনি কি করতে চান? বাঘে কুমীরে একঘাটে জল খায় সেখানে। মহারাজ স্থির স্বরে বললেন- কবি, তুমি জান না। ওখানে চীনদেশ থেকে আগত বৌদ্ধ ভিক্ষু ফাহ ইয়েন একটি বিহার স্থাপনা করেছেন। তিনি নাকি স্বপ্নে দেখেছেন, তথাগত ওখানে একটি ছাতিম গাছের তলায় বসে বিশ্রাম করেছিলেন। এই পূর্বদেশের লোকেদের তুমি জান না। কালিদাস চোখ কপালে তুললেন- সেকি মহারাজ? আপনি বিস্মৃত হচ্ছেন? এই যে চারিদিকে সকলে বলছে, তথাগত নাকি বিষ্ণুর অবতার, আর আপনি পরম বৈষ্ণব তাঁকে অস্বীকার করেন? মহারাজ অট্টহাস্য করলেন – তোমার সঙ্গে তর্কে পারা অসম্ভব। কালিদাস মাথা ঝুকিয়ে বললেন- মহারাজ আমিও যে কালির দাস। পূর্বদেশেরই লোক। মহারাজ হঠাৎ গম্ভীর হলেন—ভট্ট, পট্টলীটি তুমি কোথায় পেলে? কালিদাস হাসলেন—মহাকালের দান, মহারাজ। নবনির্মিত মন্দিরের গর্ভগৃহে মহাকাল সেটি লুকিয়ে রেখেছিলেন। মহারাজের স্বর তীক্ষ্ণ—কিন্তু তুমি সেকথা জানলে কি করে? কালিদাস যেন কোনো গোপন কথা বলছেন, এমন করে নীচুস্বরে বললেন, মহারাজ স্বপ্ন দেখার অধিকার কি কেবল বৌদ্ধ শ্রমণদের? মহারাজের মুখের হাসিটি লেগে আছে তখনও।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত