| 26 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১৭) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 1মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-১৭।


পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় টলস্টয়বাদ  প্রচার করেছিলেন। তিনি একসময়ের লিও টলস্টয়ের সহকর্মী এবং টলস্টয়বাদের মূল প্রচারক মস্কোর ভাডিমির ছের্টক’ভর দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই জন্যই শিক্ষকতার চাকরি বাদ দিয়ে  টলস্টয়বাদের নীতি প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। নাডিয়া প’পভনার ঘরেও সুবিধা পেলেই সেই কথাগুলি তিনি বলতেন। টলস্টয়বাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি রাশিয়ান ইতিহাসের ভূমিকা পেতেছিলেন। তিনি বলেছিলেন – এখন কত বছর হল? পনেরো বছর? ১৯১৭ সনের অক্টোবর বিপ্লবের পরে আমরা এখন আমাদের শহরের শীত প্রাসাদের কিছুটা অন্তত দেখতে পারছি। সেইটুকু দেখলেই সম্পূর্ণ রাজমহলটা কতটা জাঁকজমক এবং তাতে বাস করা জার এবং তাদের পরিবার কী ধরনের বিলাসী জীবন যাপন করত সে কথা কল্পনা করতে পারি।’

তিনি জারিনা ক্যাথারিনের কথাই নয়,জাররাওকীভাবে আমোদ-প্রমোদ উপভোগ করে বাস করতেন- তার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন সেই সময়ে উগ্র শীতে চারপাশের বরফের মধ্যে ছোট ছোট কাঠের এক একটি ঝুপড়িতে ছিন্ন বস্ত্রে কাল কাটানো নিঃকিন ভূমি দাসদের কথা, সঙ্গে বলেছিলেন শীতে কাতর হয়ে অনেক ভূমিদাসের মৃত্যু হওয়ার কথা। তিনি আরও বলেছিলেন কীভাবে রাশিয়ার বিচারালয়ের ধনী আমলা অফিসাররা স্বাস্থ্যবান মানুষগুলিকে দর্শনীয় সাজ পোশাক পরিয়ে গ্রামের অলিতে গলিতে সারি  পেতে অভিনেতার মতো দাঁড় করিয়ে কাচের জানালা থাকা শ্লেজ  গাড়িতে উঠে যাওয়া জার আর তার পরিবারের কাছে চাষীদের ভুয়া ছবি তুলে ধরেছিলেন– সেই জন্যই যে সাধারণ প্রজা দুরবস্থার কিছু অজুহাত দেখালেও জার এবং তার পরিবার থেকে অনুকম্পার পরিবর্তে নিষ্ঠুর শাস্তি ভুগে  ছিল– সে কথাও তিনি বলেছিলেন। আর সঙ্গে বলেছিলেন কীভাবে  আমলা অফিসারদের জোর জুলুমে নিঃকিনরা ভূমি এবং উৎপাদিত শস্যের জন্য দুর্বহ করের গুরুভার বইতে হয়েছিল। 

এই সমস্ত বলে উঠে পিটার যেলেনক’ভ মহাশয়  বলেছিলেন–’ সেই সময় কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন বাদ দিয়ে টলস্টয় ককেশাসে থাকা দাদা নিকোলাইয়ের প্রেরণায় সৈন্যদলের যোগদান করে পরে অবসর  নিয়ে যখন ২৮ বছর বয়সে ১৮৫৬ সনে জন্মস্থান ইয়াস্নায়া পলিয়ানার নিজ প্রাসাদে একেবারে ফিরে এসেছিলেন, তখন থেকেই তিনি কাউন্ট হলেও ভূমি দাসদের মুক্ত করার জন্য নানা প্রকারের চেষ্টা করে গিয়েছিলেন।’

টলস্টয় ভূমিদাসদের নামমাত্র চুক্তিতে চাষ করার জন্য ঘর তৈরি করার জন্য কাঠের যোগান দেওয়ার কথা, পড়াশোনার জন্য পাঠশালা স্থাপন করার কথাও যেলেনকভ বলেছিলেন। সঙ্গে বলেছিলেন শিক্ষামূলক পত্রিকা’ ইয়াস্নয়া পলিয়ানা ‘ প্রকাশ করার কথা ।

টলস্টয়ের  স্মৃতি পিটার যেলেনকভ মহাশয়কে সবসময় আপ্লুত করে তুলেছিল। তিনি এরকম একজন মানুষের কথা ইতিহাসের পাতায় পাননি যে উনিশ শতকের রাশিয়ার ভূমিদাস এবং নিঃকিন কৃষকদের কথা এত আন্তরিকতার সঙ্গে চিন্তা করেছিলেন, আর  এককভাবেই ওদের উন্নতির জন্য চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। পিটার যেলেনক’ভ বলে গিয়েছিলেন বিয়াল্লিশ  বছর বয়সেই টলস্টয়কে  আধ্যাত্বিক ক্লান্তি অবসাদগ্রস্ত করে তোলার কথা। এই সময় থেকে আত্মানুসন্ধানের জন্যই স্বার্থান্বেষী শোষণকর্তা, সামাজিক- সরকারি ধর্ম এবং শাসক শ্রেণীর  সমালোচনাকে তিনি লেখার মূল বিষয় হিসেবে বেছে নেবার কথা। আরও বলেছিলেন জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে কয়েকটি বিদ্রোহী প্রজা হত্যা করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচানোর জন্য টলস্টয় তৃতীয় আলেকজান্ডারের  কাছে চিঠি লেখার কথা। এই চিঠিতে কোনো লাভ হয়নি যদিও তিনি বিবেকের তাড়নায় কাজগুলি করে গিয়েছিলেন। তিন বছরের জন্য রিয়াজন প্রদেশে  ছাউনি পেতে অনাহারে ভোগা কৃষকদের খাবার জিনিস বিলিয়ে আর্তের সেবা করেছিলেন। তারপরেও টুলা প্রদেশে অনাহারে ভোগা কৃষকদের জন্য একই ধরনের সেবার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে সাধারণ কৃষকদের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে তিনি’ লজ্জা ‘নামের একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১৬) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী


এই সমস্ত কথা যেলেনক’ভ মহাশয় সুবিধা পেলেই মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করে বলতেন। বলেছিলেন টলস্টয়ের  গির্জার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে আক্রমণ করার কথা ।টলস্টয় নাকি লিখেছিলেন যে প্রতিষ্ঠানের একমাত্র প্রশংসনীয় দিকটি হল লোভ সম্বরণের অনুশীলন এবং কারও অপকার না করা নিরীহ প্রার্থনা সমূহ। কিন্তু অনেক ধন বিনিময় করা প্রতিষ্ঠানটি নিরীহ মানুষ গুলিকে দৈহিক পরিশ্রমের সুবিধা দিয়ে কয়েকবার খাওয়ার ব্যবস্থা  করে না কেন বলে তিনি  প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি গির্জার ধার্মিক প্রতিষ্ঠানে জড়িত লোকদের লালিত-পালিত হওয়া এক এক জন সাধূপুরুষ বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং এই কার্যগুলির  জন্যই তিনি গির্জার গোড়া প্রতিষ্ঠানগুলির রোষে পড়েছিলেন। টলস্টয় ক্রিমিয়ার গাছপ্রাতে সুস্বাস্থ্যের জন্য থাকার সময়ও নিরীহ  মানুষদের  ইচ্ছা এবং প্রয়োজন গুলি দমন করে রাখা শক্তিগুলিকে ধুলায় মিটিয়ে দেওয়ার জন্য, সঙ্গে ব্যক্তিগত ভূমিস্বত্ব বাতিল করার জন্য আহ্বান জানিয়ে জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে চিঠি লেখার কথা পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় বর্ণনা করেছিলেন। আরও বলেছিলেন মৃত্যুর দুই বছর আগেই মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লেখার কথা । প্রবন্ধটার  নাম দিয়েছিলেন’আমি চুপ করে থাকতে পারি না’ 

কথা বলার সময় পিটার যেলেনক’ভ  মহাশয়ের অনেক কথা মনে পড়ছিল । মনে পড়ছিল ১৯১০ সনের নভেম্বর মাসে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে অষ্টাপভ নামের একটি অপরিচিত ছোট স্টেশনে টলস্টয়ের  মৃত্যু হওয়ার কথা । আর মনে পড়ছিল সেই শেষ রেলযাত্রাতেও তাঁর সহযাত্রীদের মধ্যে টলস্টয়বাদ প্রচার করার কথা।তাঁর মৃত্যুতে  লেনিন লিখেছিলেন – টলস্টয় আমাদের সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা তুলে ধরেছেন এবং এটা করতে গিয়ে তিনি এমন পটুতার সঙ্গে শিল্পকলা কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন যে  তাঁর সমস্ত রচনাই পৃথিবীর মহান সাহিত্যের শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হল।’

কথাগুলি বলে বলে পিটার যেলেনক’ভ বলেছিলেন–’ এখন এরকম মনে হয় তাঁর  এই প্রভাব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে এবং রাশিয়ার রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনের ভূতপূর্ব পরিবর্তন আনায় অবদান যুগিয়েছিল নাকি?’

পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় প্রশ্নটির উত্তর দেননি। কেননা এই প্রশ্নের উত্তরটা প্রকৃত টলস্টয়বাদ নয় । তথাপি জারের শাসন শোষণ  এবং অত্যাচারের পরে অক্টোবরের বিপ্লবে শ্রমিক এবং জনতার হাতে শাসনভার অসলপুর থেকে রাশিয়ার বেশির ভাগ জনগণের প্রিয় হয়ে ওঠা লেনিনের  কথা বাদ দিয়ে তিনি যে টলস্টয়বাদ প্রচার করতে পারবেন না সেই বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। সেই জন্য তার ভূমিকা শুরু করার জন্য দ্বিতীয় নিকোলাসের  গির্জা এবং জমিদারদের অনুমোদিত স্বেচ্ছাচারিত্ব,১৮৬১ সন থেকে মুক্ত হওয়া ভূমি দাসদের কোনো উন্নতি না হওয়া অবস্থা ঔদ্যোগিক বিকাশেও আর্থিক এবং রাজনৈতিক ভেদভাবের সৃষ্টির দ্বারা ধীরে ধীরে নতুন সমস্যার উদ্ভব হওয়ার  কথা বলতে শুরু করেছিলেন। ১৯০৪ সনে জাপানের হাতে যুদ্ধে পরাজিত হওয়া, তার পরের বছর ডিসেম্ব্রিস্টদের বিদ্রোহের কথা,১৯১৪ সন থেকে রাশিয়া মহাযুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ার কথা এবং ১৯১৫ সনের শেষের দিকে জারিনা আলেকজান্ডারের হাতে শাসন ভার ছেড়ে দিয়ে নিকোলাস যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার কথা তিনি বলেছিলেন। জানিনা অসুস্থ পুত্রকে ভালো করার স্বপ্নে অর্ধশিক্ষিত রাসপুটিনের উপরে আস্থা রেখে তার পরামর্শ মতে দুর্বল এবং অদক্ষ মানুষকে মন্ত্রী পদে বসিয়ে দেশের অবস্থা শোচনীয় করে তোলায় ১৯১৬ সনের শেষে গুণী লোক কয়েকজন রেস পুটিনকে হত্যা করার কথা তিনি বলেছিলেন। এবং–

যেলেনক’ভ মহাশয় বলে যাচ্ছিলেন–’ পরবর্তী বছরের প্রথম মাস থেকেই শ্রমিক এবং নাগরিকের ক্ষোভ প্রদর্শন ধর্মঘটের দ্বারা দেশে নানা ধরনের অশান্তি বৃদ্ধি পেতে লাগল। ডুমার সভাপতি যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা নিকোলাসের কাছে খবর পাঠালেন যদিও  তিনি গুরুত্ব দিলেন না। খবর পাঠানোর কুড়ি দিন পরে নিকোলাস সিংহাসনচ্যুত হলেন। ফেব্রুয়ারি মাসের এই বিদ্রোহের কয়েকদিন পরে পনেরো মার্চ নিকোলাসকে সপরিবারে বন্দি করা হল এবং এর সঙ্গে জারদের ৩০০ বছরের শাসনের অন্ত পড়ল। এর এক মাস পরেই সুইজারল্যান্ডে থাকা লেনিন পেট্রোগ্রাডে উপস্থিত হলেন।১৯১৭ সনের অক্টোবর মাসের ২৫ তারিখের সকাল থেকে বলসেভিকদের পেট্রোগ্ৰাড দখলের অভিযান আরম্ভ হয় এবং পরের দিন সকালে রেড আর্মি উইন্টার প‍্যালেস নিজের দখলে নিয়ে এল। ট্রটস্কির নেতৃত্বে মেনশেভিকদের হোয়াইট আর্মির’ সঙ্গে গৃহযুদ্ধ করে সমগ্র রাশিয়ার দখলে আনার জন্য রেড আর্মির আরও তিন বছর সময় লাগল। ‘

অহরহ কথা বলতে থাকা পিটার যেলেনকভ মহাশয়ের  সেদিন ক্লান্ত লাগছিল । তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আধপাকা দীর্ঘ দাড়িতে হাত বোলাতে শুরু করেছিলেন । ঘরটির কোণে দাঁড়িয়ে কথা শুনতে থাকা নাডিয়া  অন‍্যকে দেওয়ার আগে মানুষটার সামনে এক কাপ গরম কফি এগিয়ে দিয়েছিল। মানুষটা নাডিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করেছিল–’ কমরেড লেনিন তিনটি লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন– শান্তি, রুটি আর ভূমি ।তাঁর শ্লোগান ছিল – সোভিয়েতদের হাতে চাই সমস্ত শক্তি। আমাদের কমিউনিস্ট জনতার সমাজতান্ত্রিক সরকার হল। আমাদের সংবিধান হল। ধর্ম চর্চায় বাধা এসে পড়ল।’

তিনি বলে যাচ্ছিলেন–’ নীতি অনুসারে শ্রমিককে কারখানা এবং চাষীদের সামাজিকভাবে পাম চালাতে দেওয়া হল। কিন্তু উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট নিম্নগামী হয়ে পড়ল।১৯২১-২২ সনে অনাহার এবং বিভিন্ন রোগে মানুষ মরতে শুরু করল। তাই ধনতন্ত্রের উপকরণ নিয়ে নতুন অর্থনীতি প্রবর্তন করে ব্যক্তিগত খন্ডের ব্যবসা বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া হল। উৎপাদন বৃদ্ধি পেল এবং অর্থনীতির কিছুটা পরিবর্তন হল। ইতিমধ্যে ১৯২৪ সনে  জানুয়ারিতে লেনিনের মৃত্যু হল। কমরেড স্তালিন নেতা হলেন। তিনি অন্য নেতাদের অপসারিত করতে লাগলেন।১৯২৭ সনে ট্রটস্কিকেও দল থেকে বহিষ্কার করাই নয়, দেশ থেকেও নির্বাসিত করলেন। ১৯২৮ সন থেকে স্টালিন আগের নীতি বাদ দিয়ে পাঁচ বছরের পরিকল্পনা আরম্ভ করলেন । ইতিমধ্যেই এই পরিকল্পনার চার বছর পূর্ণ হল এবং সামরিক শক্তিতে জোর জুলুম প্রয়োগ করে আমাদের সমাজ এবং আর্থিক গাঁথনিতে অনেক তোলপাড় সৃষ্টি করলেন। আমরা এক সময়ে জারের স্বেচ্ছাচারিতার বিরোধ করে সাম্যবাদী সরকার স্থাপন করেছিলাম। কিন্তু গত কয়েকবছর থেকে আমরা যেন একটা স্বেচ্ছাচারিতার–।’ 

আবেগে কিছু একটা বলতে গিয়ে পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় থমকে রইলেন । তিনি নাকটা মুছলেন এবং তারপরই দীর্ঘ দাড়িতে হাত বুলিয়ে প্রতিটি শব্দে জোর দিয়ে দিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলেন – কিন্তু আমাদের টলস্টয় বাদের নীতি আলাদা। এর মতে আমাদের ভগবানকে বিশ্বাস করা উচিত, প্রভু যিশুর নীতিজ্ঞান মেনে চলতে হয়, কিন্তু তার ঐশ্বরিক শক্তির কথা স্বীকার করা উচিত নয়।’

তিনি পুনরায় বললেন–’ টলস্টয়বাদের মূল মন্ত্র বাইবেল গ্রন্থের সেন্ট মেথিউর থেকে নেওয়া । তাতে লেখা মন্ত্রটির নীতি ব্যাখ্যা করে টলস্টয় বলেছেন যে – পাপ অসৎ আর দুষ্কর্মের  প্রতি নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ করবে । এই নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধটাই অহিংস প্রতিরোধ। টলস্টয়বাদ সামরিক শক্তি থাকা সমস্ত সরকারকে নিষ্ঠুর বলে অভিহিত করে । যুদ্ধের অবসান চায় এবং সৈন্য সামন্ত অপ্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করে ।’

‘কিন্তু’– তিনি বললেন–’ দেশের বর্তমানের জোরজুলুমে অনুভব হয় আমরা যেন সামরিক শক্তির অধীনে বাস করছি।’

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় বললেন–’ সরল ভাষায় বলতে গেলে টলস্টয়বাদ এই ধরনের– তুমি হত্যা কর না। এমনকি হত্যা বন্ধ করার জন্যও হত্যা কর না। আমাদের পৃথিবীতে যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই তুমি গ্রহণ করবে। একে অসুখী  করার জন্য তুমি কিছুই করবে না। এখানে যতটুকু পাপ আছে, দুষ্কর্ম আছে, তার জন্য আত্মদগ্ধ হবার জন্য তুমি প্রস্তুত থাকবে। কেননা স্বর্গের সাম্রাজ্যটি তোমার আমার হৃদয়ের মধ্যে আছে।’

পিটার যেলেনকভ মহাশয় সেদিন পর্যন্ত তাঁর ব্যাখ্যা সেখানেই সমাপ্ত করেছিলেন।তাঁর কথাশুনে  ঘরটিতে থাকা সবাই নীরব হয়ে পড়েছিল। সঙ্গে মহান লেখকের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এসেছিল। 

পিটার যেলেনকভ মহাশয় একদিন নাডিয়ার জন্য টলস্টয়ের কয়েকটি বই নিয়ে এসেছিল।তাঁর সঙ্গে একদিন  ভিক্টর একছুর্স্কি নামের চল্লিশ বছরের একজন মানুষও এসেছিল।তাঁর মুখেও দাড়ি ছিল, কিন্তু পিটার যেলেনক’ভ মহাশয়ের মতো দীর্ঘ এবং আধা পাকা দাড়ি ছিল না। তাঁর দাড়ি ছিল রঙ্গীণ। তাঁর ঘি রঙের চুল এবং আকাশী রংয়ের গভীর চোখ জোড়া নাডিয়াকে দেখে মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। নাডিয়া লজ্জা পেয়েছিল। কিন্তু মানুষটার চোখে ছিল সপ্রশংস নির্মল চাহনি। তাকে পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় একজন চিত্রকর বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। যাবার সময় তিনি নাডিয়াকে বলেছিলেন–’ তুমি অতি সুন্দরী যুবতী। লাইলাক ফুলের মধ্যে একদিন তোমার একটি ছবি আঁকব।’

নাডিয়ার বড় মজা লেগেছিল । কিন্তু দাদা মিখাইলের বন্ধু লিঅ’নিড এডলার – তার মুখে ভালো-খারাপ ছাড়া আর কোনো কথা বের হয় না। ভিক্টর একছুরস্কির মতো সেও যদি তাকে  সুন্দরী বলে বলত।

একদিন যেলেনক’ভ মহাশয়ের  সঙ্গে মোচ থাকা অন্য একজন মানুষ এল।তাঁর নাম ভাডিমির ভেলিক্স এবং তিনি নাকি একজন সমাজকর্মী। তিনি মস্কো শহর থেকে এসেছেন। পিটার যেলেনক’ভ সেদিন অন্যদিনের মতো টলস্টয়ের রচনা এবং তার তাৎপর্য বিষয়ে বলতে গিয়ে আগের কথাই পুনরায় উল্লেখ করেছিলেন–’ ভূমিদাস এবং নিরীহ মানুষের বিষয়ে টলস্টয়ের  মতো চিন্তা করা এবং কোনো রুশ মানুষের কথা আমি জানিনা।’

সেই কথায় আপত্তি করে ভাডিমির ভেলিস্কই বলেছিলেন–’ আমি অন্য একজন মানুষের কথা জানি– তিনি পিটার ক্রপটকিন। প্রায় দশ এগারো  বছর আগের কথা।১৯২১ সনের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখটা ছিল মস্কোর বড় শীতলতম দিন। সেই দিনই ৭৮ বছর বয়সে যে ক্রপটকিনের  মৃত্যু হয়েছিল সে কথা নিশ্চয় আপনারা জানেন। দু’ঘণ্টা ধরে পায়ে হেঁটে তাকে নিয়ে মস্কোর আশেপাশের একটি কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ছাত্র প্রতিনিধি, বিজ্ঞানী, শ্রমিক নেতা, সামাজিক নেতা প্রত্যেকেই ভাষণ দিয়েছিল। এমনকি কমিউনিস্ট দলের প্রতিনিধি এবং আমাদের টলস্টয়বাদী দলের প্রতিনিধিও ছিল। আমিও ছিলাম সেখানে।’

পিটার যেলেনক’ভ বললেন – আমি ক্রপটকিনের কথা জানি। তিনি একজন নৈরাজ্যবাদী- অরাজকতাবাদী ব্যক্তি।’

‘ হ্যাঁ, এটা সত্যি।’– ভাডিমির ভেলিস্কই বলেছিলেন–’ কিন্তু সেদিন কবরস্থানের ভাযণ  থেকে এরকম ধারনা হল যেন তিনি টলস্টয়বাদের আদর্শে বেঁচে ছিলেন।’

মানুষটা বলছিলেন –’ ক্রপটকিন বারো বছর বয়সে রাজকুমার উপাধি বিসর্জন দিয়েছিলেন । ১৮৬১ সনে যখন তাঁর উনিশ  বছর বয়স, তখন ভূমিদাস প্রথা উঠে যাওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯১৭ সনে জার সিংহাসনচ্যুত হওয়ার পরে মনের আনন্দে তিনি নির্বাসন থেকে এসে আমাদের দেশে পৌঁছেছিলেন । কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবের পরে তিনি বিপ্লবের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি পেয়ে মস্কোর আশেপাশে অঞ্চলের একটি বাগানে সাধারণ একটি কাঠের ঘরে থাকতে শুরু করেছিলেন।’

পিটার যেলেনকভ কথাগুলি জানে। তিনি আরও জানান যে ক্রপটকিন যুবক অবস্থায় মিলিটারি চাকরিতে ঢোকার সময় স্ব-ইচ্ছায়  সাইবেরিয়াতে চাকরি নিয়েছিলেন যাতে কয়েদি এবং নির্বাসিত মানুষগুলির সংস্কার আনতে পারেন। তার পরই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ঢুকে বৈজ্ঞানিক ধ‍্যান ধারণার গবেষণা আরম্ভ  করেছিলেন।তাঁর নৈরাজ্যবাদের তাত্ত্বিক চিন্তাধারার জন্য তাকে রাজদ্রোহী সাজিয়ে পিটার এবং পল দুর্গে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। দু’বছর পরে তিনি পলায়ন করেন এবং অক্টোবর বিপ্লবের পরে দেশে আসার আগে চল্লিশ বছর ইউরোপে নির্বাসিত জীবন যাপন করেছিলেন।

পিটার যেলেনক’ভ বললেন –’ হ্যাঁ, আপনার কথা হতে পারে, তিনি হয়তো টলস্টয়বাদ নিয়ে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু টলস্টয়’– তিনি বললেন–’ টলস্টয়  সমস্ত কাজ এবং রচনাতেই স্নেহ– ভালোবাসা এবং প্রেম অফুরন্ত ভাবে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি’ যেখানেই প্রেম সেখানেই ভগবান’ এর মতো গল্প রচনা করেছিলেন।তাঁর মতে জীবনের মূলনীতিই হল প্রেম। এই ধরনের নিখুঁত প্রেম শিশুদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। টলস্টয় বলেছিলেন– কোনো গ্রন্থ রচনা করে থাকার সময় গ্রন্থটির মূল ভাবের প্রতি লেখকের এই ধরনের নিখুঁত প্রেম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অটুট থাকা আবশ্যক। এর কোনো ব্যতিক্রম হওয়া উচিত নয়। তখনই তার গ্রন্থটি মহৎ গ্রন্থের সারিতে উন্নীত হওয়ার  সম্ভাবনা থাকে।’

পিটার যেলেনক’ভ  মহাশয় বললেন–’ টলস্টয়ের এই কথাগুলি তাঁর সেক্রেটারি পেট্রভস্কি লিখে রেখেছিলেন বলে অনেকে ভুল করে, আসলে তাঁর পত্নী সোফিয়া টলস্টয় লিখে রেখেছিলেন।’

প্রত্যেকেই তাঁর দিকে আগ্রহের সঙ্গে চেয়ে থাকায় পিটার যেলেনক’ভ বললেন– টলস্টয় অবিরতভাবে’ যুদ্ধ এবং শান্তি’ লেখার সময় অমানুষিক ধৈর্যের সঙ্গে পান্ডুলিপিটি সাতবার শুদ্ধ করেছিলেন এবং সোফিয়া হাজার হাজার পৃষ্ঠার প্রতিলিপি আগ্রহের সঙ্গে করেছিলেন।’

তিনি পুনরায় বললেন–’ সেই উপন্যাসে টলস্টয় মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে সামাজিক মূল্যবোধ বিশ্লেষণ করেতাঁর দেশের প্রতি থাকা গভীর ভালোবাসা রূপায়িত করে তুলেছিলেন।’

পিটার যেলেনকভ মহাশয় পুনরায় বললেন–’ টলস্টয় আন্না কারেনিনা’ রচনা করার সময় তার মূল ভাবধারাটা ছিল পরিবারের প্রতি থাকা প্রেম ভালোবাসা।’

‘ সে যাই হোক না কেন’– তিনি পুনরায় বলেছিলেন– দেশের প্রতিই হোক বা পরিবারের প্রতিই হোক, টলস্টয়ের  বিষয়বস্তু ছিল প্রেম-ভালোবাসা। তাই তিনি ভূমিদাস এবং নিরীহ জনতার বিষয়েও চিন্তা করেছিলেন। এই দুটি উপন্যাস রচনার পরে,বিশেষ করে ‘ যুদ্ধ ও শান্তি’ রচনার পরে আধ্যাত্বিক ক্লান্তি টলস্টয়কে অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছিল।’

পিটার যেলেনক’ভের মনে পড়েছিল এর প্রায় ১৪  বছর পরে টলস্টয় ‘আমি কিসে বিশ্বাস করি ‘ নামের পুথি ছাপিয়ে নিজের দর্শন প্রকাশ করার কথা‌। তার প্রায় নয় বছর পরে ১৮৯৩ সনে তিনি প্রকাশ করেছিলেন’ ভগবানের  সাম্রাজ্য তোমার হৃদয়ে আছে’ নামের পুস্তকটি।’ দুষ্কর্মের প্রতি নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ’ এর বিষয় নিয়ে তিনি পুস্তক রচনা করেছিলেন। প্রথম অধ্যায়ে ঙ্কিছু ছোট ছোট খ্রিস্টান দলের মধ্যে ও থাকা এই দর্শন আমেরিকার লয়ড গ্যারিসনের উদ্ধৃতি এবং ১৮৩৮ সনে বোস্টনে হওয়া শান্তির সমারোহে বুঝিয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া ম‍্যাসাসুয়েটসের অদিন বেলের ধর্ম শিক্ষার অনেক কথা তিনি  উল্লেখ করেছিলেন । মেথিউতে (৫:৩৯) উদ্ধৃত নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের ব্যাখ্যা তাতে দেওয়া হয়েছিল।

পিটার যেলেনকভ মহাশয়ের পুস্তকের অন্যান্য অধ্যায়ে মূল বিষয়বস্তু নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের বিষয়ে অন্যের সমালোচনা, ধার্মিক, নাস্তিক, বৈজ্ঞানিকের বিভ্রান্তি, ভিন্নমত, গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রত্যেকের জন্য এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে শেষের দ্বাদশ অধ্যায়ে মানবতার সেবাই হচ্ছে জীবনের অর্থ বলে লেখা কথাটা মনে পড়ছিল। পুস্তকটির শেষ পৃষ্ঠায় ম্যাথিউর (৬:৩৩) উল্লেখ করে লিখেছিলেন: ভগবানের সাম্রাজ্য এবং প্রকৃত সত্য পথের সন্ধান করা উচিত এবং সেই প্রক্রিয়াতেই আমরা অনেক গুণের অধিকারী হতে পারব। সেই পৃষ্ঠাতে লোকর (১৭,২০,২১) উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি সমাপ্তি টেনেছিলেনঃ বাহ্যিক আবরণ আমাদের  তার সাম্রাজ্যের কাছে নিয়ে যায় না, কেননা ভগবানের সাম্রাজ্য আমাদের হৃদয়ে রয়েছে।

কথাগুলি মনে পড়ায় সমবেত মানুষ গুলির দিকে তাকিয়ে পিটার যেলেনকভ বলেছিলেন–’ এর পর  থেকে তিনি সাধারণ কৃষকের মতো সাজ পোশাক পরতে শুরু করেছিলেন, ধূমপান করা ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং সঙ্গে মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন।তাঁর নিজের সমস্ত সম্পত্তি জনসাধারণকে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পত্নী সোফিয়া সেটা করায় বাধা প্রদান করেছিলেন। টলস্টয়ের ধ্যান-ধারনা এবং কার্য পরিবারের  সকলকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল । কিন্তু তিনি নিজের বিশ্বাসে অটুট ছিলেন এবং ইয়াতস্নানা পলিয়ানার প্রসাদের আরাম তাঁর ন্যায্য নয় বলে জনসাধারণের মধ্যে থাকার জন্য মৃত্যুর চার দিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ‘

‘ আর এভাবেই’– পিটার যেলেনকভ বলেছিলেন–’ তাঁর জীবনের মধ্যভাগ থেকে শেষ পর্যন্ত টলস্টয় বাদের আদর্শ নিয়ে বেঁচে ছিলেন।’

‘ এই টলস্টয়বাদীদের  ছোট দলটি’– তিনি বলেছিলেন–’ গঠন করেছিল তার চেয়ে ২৬ বছরের ছোট ভাডিমির সের্টকভ। টলস্টয়ের বয়স তখন ৫৫ বছর, তখন সের্টকভের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়েছিল এবং খুব তাড়াতাড়ি টলস্টয়ের ধার্মিক দর্শনের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে তার নিকট বন্ধু এবং সমাজকর্মী হয়ে পড়েছিলেন । তিনি টলস্টয়ের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয় নিজেও দীর্ঘ দাড়ি মোচ রাখতে শুরু করেন । টাক মাথার তাকেও  টলস্টয়ের  মতো দার্শনিক বলে মনে হতো । দেশের অন্যান্য নৈরাজ্যবাদীর মতো  সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস না করে টলস্টয়ের ‘ আত্মশুদ্ধির বিপ্লব’এ সের্টকভ মনে প্রানে আস্থা রেখেছিলেন। তাই টলস্টয়বাদীর দল গঠন করে এসেই ধার্মিক আদর্শ প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু এখন–।’

কিছুক্ষণ দাড়িয়ে পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় বললেন – এখন টলস্টয়ের  মৃত্যুর ২২ বছর পরে– সেই ভাবধারা এবং আদর্শ কিছুটা চাপা পড়েছে। আমরা সেই ধারাটিকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক আবহাওয়ার জন্য পুনরায় প্রচার করতে শুরু করেছি।’

তিনি পুনরায় টলস্টয়বাদের বিষয়ে বলতে শুরু করলেন–’ পাপ, অসৎ এবং দুষ্কর্মের প্রতি নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ করবে। কাউকে হত্যা কর না। এমনকি হত্যা বন্ধ করার জন্যও হত্যা  করবে না । আমাদের পৃথিবীকে অসুখী করার জন্য কিছু কর না । এখানে যত টুকু পাপ আছে দুষ্কর্ম আছে , তার জন্য অগ্নিদগ্ধ হওয়ার জন্য তুমি প্রস্তুত থাকবে। কেননা ভগবানের সাম্রাজ্যটি আমাদের হৃদয়ে আছে।’

এই কথাগুলি শুনলেই নাডিয়ার  বড় ভালো লাগত। কিন্তু সেদিন ডিমভ এবং গ্রেভিলভের কাছ থেকে এসে সে যখন দেখেছিল ঘরের গভীর পরিবেশের মধ্যে কদাচিৎ প্রবেশ করা সমন’ভ মুচি প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ঘরের একপাশে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ভেতরের চেয়ারগুলিতে অপরিচিত অতিথি দুজনের সঙ্গে পিটার যেলেনক’ভ,ভাডিমির ভেলিস্ক,মিখাইল এবং লিঅ’নিড বসে আছে, সঙ্গে পিটার যেলেনক’ভমহাশয়ের হাতে  থাকা সরকারি কাগজটা তিনি বারবার পড়ছেন এবং সঙ্গে চুপ করে বসে থাকা অন্যান্যদের মাঝখান থেকে মিখাইল দুবার কুঁজো মুচিটার কাছের মানুষ দুটোর দিকে মাথা ঘুরিয়ে চিন্তান্বিত ভাবে তাকাচ্ছে, তখন সে উপলব্ধি করল সমনভ মুচির কাছে থাকা মানুষ দুটিকে নিয়ে ওরা প্রত্যেকেই হয়তো গভীর সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত