| 9 অক্টোবর 2024
Categories
ধারাবাহিক নারী

ধারাবাহিক বধূ পাঁচালি: ভালোবাসা কারে কয় । শকুন্তলা চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

“তুমি কি কেবলই ছবি…..” নিজের হাতে আঁকা, তেলরঙের ছবিতে ফুটে ওঠা স্বামীর অবয়বের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রশ্ন করেন জ্যোতি, জ্যোতি চৌধুরী। চব্বিশ পরগণার সুভাষগ্রামের গিরিজাভূষণ ভট্টাচার্য এবং মহামায়া ভট্টাচার্যের একমাত্র জীবিতা কন্যা। বাল্যকালে নানা দুর্যোগ, দুর্ভোগ, ব্যাধিতে সবকটি ভাইবোনকে হারিয়েও, ‘বিধির আশিসে অমৃতের টীকা’ পরে যিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। অসীম প্রাণশক্তির জোরে ৯০ পার করে যিনি আজও জীবিতা। যাঁর হাতের অপরূপ তুলির টানে ছবিরা কথা বলে ওঠে, প্রাণ পায়—যদিও তার সবটাই প্রায় থেকে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।

জ্যোতি চৌধুরী—বিখ্যাত গীতিকার এবং সুরকার সলিল চৌধুরীর বিবাহিতা স্ত্রী।

জ্যোতির পিসতুতো দাদাদের বন্ধু ছিলেন সলিল। আসামের চা-বাগানের পরিবেশ ছেড়ে, সলিল এবং তাঁর দাদা সুনীল তখন এসে রয়েছেন মামাবাড়ীতে—ডায়মণ্ড হারবারের কাছে চব্বিশ পরগণার কোদালিয়ায়। সলিল পড়াশোনা ছাড়াও করতেন নাটক, বাজাতেন বাঁশী। ঘোর শ্যামবর্ণ, গভীর টানা টানা চোখের এই ছেলেটিকে ‘মদনমোহন কৃষ্ণ’ নাম দিয়েছিলেন পাড়ার বর্ষীয়সীরা—যেমন তাঁর মুখের হাসি, তেমন মিষ্টি কথা, তেমন বাঁশীর সুর। তাঁর নাটক দেখেও মুগ্ধ পাড়া-প্রতিবেশীরা। এমনই এক নাটক দেখতে গিয়ে, ফ্রক-পরা জ্যোতি প্রথম দেখেছিলেন সলিলকে।

তারপর দেখা হতে লাগলো প্রায়ই। কোদালিয়া এবং সুভাষগ্রাম হচ্ছে পাশাপাশি। সলিলের সঙ্গে জ্যোতির সোনাদা’র ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। অতএব দাদার বাড়ীতেও আসতে লাগলেন সলিল মাঝে মাঝে। কোনো এক বর্ষার দিনে সেখানে জ্যোতিও উপস্থিত ছিলেন। ‘কেমনে বাঁধিয়া গেলো নয়নে নয়ন’—দু’জনেই হয়ে গেলেন মুগ্ধ।

বনবন ছন্দে ঘুরে চলা দুনিয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে সলিল তখন উদ্দাম। বঙ্গবাসী কলেজে পড়াশোনার সঙ্গে চলছে সঙ্গীতচর্চা, কবিতা ও গান লেখা—যোগদান করেছেন আই পি টি এ-তে। কিন্তু ঠাণ্ডা স্বভাবের জ্যোতির কাছে যেন বাঁধা পড়ে গেলেন অশান্ত সলিল। জ্যোতির ধীরস্বরে বলা কথা, জ্যোতির বেড়াল-কুকুর-বেজি যত পুষ্যিরা—সব যেন তাঁকে টেনে ধরলো এক অদৃশ্য সুতোর টানে। বাইরের উত্তাল সমুদ্রে ভেসে গিয়েও, সলিল বারবার ফিরে আসেন স্বল্পভাষী জ্যোতির কাছে। পড়ে শোনান নিজের লেখা গান, জ্যোতি চুপচাপ শোনেন—কখনো বা নীচু স্বরে মতামত দ্যান।

ইতিমধ্যে স্কুলের গণ্ডী পার হয়ে কলেজে ঢুকলেন জ্যোতি—বংশে তিনিই প্রথম কলেজে যান।

জ্যোতির আঁকার হাত অসম্ভব ভালো—তাই লজিকের সঙ্গে বোটানি নিয়েছেন। অনায়াসে খাতার পাতায় তিনি ফুটিয়ে তোলেন গাছ-পাতার ছবি। জ্যোতিকে আর্ট কলেজে ঢুকতে পরামর্শ দ্যান সলিল। তখন প্রায়ই ভবানীপুরে জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ীতে থাকতেন জ্যোতি। সলিলও তখন কলকাতায়।

বয়সে সলিল জ্যোতির চেয়ে বছর চার-পাঁচেকের বড়ো ছিলেন—প্রাইভেট টিউটর হিসাবে জ্যোতিকে কিছুদিন লজিকও পড়িয়েছিলেন তিনি। ফর্সা চন্দনের মতো গায়ের রঙ, শান্ত দু’টি চোখ আর বই-তুলি হাতে জ্যোতিকে মনে হতো যেন সরস্বতী প্রতিমা। সলিল বাঁধা পড়ে গেলেন।

শুরু হলো শুভ্র ফুলের মতো শীতল সুগন্ধি এক ঘরোয়া প্রেমের গল্প—যা সময়ের সঙ্গে এগোতে এগোতে, হঠাৎ একদিন বাইরের জগতের সাজানো আলোর ঝলকানিতে বাসী ফুলের মতো শুকিয়ে গেলো।

কম্যুনিস্ট পার্টি এবং আই পি টি এ-র সূত্রে সলিলকে একসময় ‘আণ্ডারগ্রাউণ্ডে’ চলে যেতে হয়।

লুকিয়ে লুকিয়ে চলে আদানপ্রদান। জ্যোতি আড়াল থেকে ছুঁয়ে থাকেন সলিলকে, দিয়ে যান সমর্থন।

কিন্তু বাড়ীর সমর্থন মেলে না। স্বচ্ছল ব্রাক্ষণ পরিবারের সুন্দরী কন্যার জন্য, পার্টি করে জেলে যাওয়া কায়স্থ-সন্তান সলিল চৌধুরী একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। এমনকি সলিলের লেখা এবং সুর দেওয়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলার গানে যখন বাংলা উত্তাল হয়ে উঠলো, তখনও না।

শেষপর্যন্ত সলিল আর জ্যোতি নিজেরাই বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সলিল তখন বাংলা ছবিতে সুর দিতে আরম্ভ করেছেন।

শান্ত স্বভাবের জ্যোতির মনে এতটুকু দ্বিধা ছিলো না পিতৃগৃহ ছেড়ে এসে সলিলকে বরণ করে নিতে।

১৯৫২ সালে হিন্দুমতে বিবাহ করলেন তাঁরা—জ্যোতির বাপের বাড়ীর লোকেরা অনুপস্থিত থাকলেও, উপস্থিত রইলেন অন্য আত্মীয়রা। রইলেন বন্ধুবান্ধব—হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অপরেশ লাহিড়ী, আরো অনেকে।

বিয়ে হয়ে গেলো, জ্যোতি এসে উঠলেন শ্বশুরবাড়ী।

বৌভাতের দিন সলিল বম্বে থেকে ডাক পেলেন—বিমল রায় তাঁর ‘রিকশাওয়ালা’ কাহিনীটির ওপর ভিত্তি করে বানাতে চান ‘দো বিঘা জমিন’, সলিলকে বম্বে যেতে হবে।

ততদিনে ব্যক্তিগত মতবিরোধের জন্য আই পি টি এ এবং কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে সরে এসেছেন সলিল।

বিমল রায়ের ডাক সলিলের জন্য খুলে দিলো নতুন দরজা—সম্মুখে উন্মুক্ত পৃথিবী।

বম্বে-কলকাতা ছোটাছুটি করে দিন কাটে। ক্রমশ সলিলের গান এবং তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ছে বম্বে থেকে সারা দেশে। জ্যোতি তখন কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্রী—তাঁর আঁকা দেখে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে একেবারে দ্বিতীয় বছরে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে জন্ম নেয় সলিল ও জ্যোতির প্রথম সন্তান অলকা। কিছুদিনের মধ্যেই বছরখানেকের অলকাকে নিয়ে জ্যোতিও অবশেষে পাড়ি দিলেন বম্বে—অসমাপ্ত রয়ে গেলো আর্টকলেজের শিক্ষা। বম্বেতে সংসার পাতলেন সলিল-জ্যোতি। একে একে এলো আরো দুই সন্তান—তুলিকা এবং লিপিকা। জ্যোতি তখন পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েছেন সংসারে, রং-তুলি সব তাকে তোলা।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সলিল ইতিমধ্যে একের পর এক অনবদ্য সুর সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। ১৯৫৭ সালে, রুমাদেবীর সঙ্গে মিলে সলিল তৈরী করলেন ‘বম্বে ইয়ুথ কয়্যার’। ১৯৫৮ সালে ‘মধুমতী’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার পেলেন সলিল। লোকের মুখে মুখে ফেরে তখন তাঁর গান। বান্দ্রায় সলিল চৌধুরীর বাংলো সারাদিন গমগম করে লোকে। বেশীরভাগই চিত্রজগতের, কিছু হচ্ছে কলকাতা থেকে পেশার সন্ধানে আসা বাপের বাড়ীর এবং শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব যাঁদের সাদরে আশ্রয় দিয়েছেন সলিল এবং জ্যোতি। শুধু গান লেখা এবং সুর দেওয়া নয়, বাদ্যযন্ত্র এবং সঙ্গীত নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা-তাত্ত্বিক আলোচনায় ভরে থাকে প্রতিটি দিন আর রাত। সঙ্গীতচর্চ্চার তীর্থক্ষেত্র হয়ে ওঠে বান্দ্রার বাংলো। এছাড়াও গান করা এবং গান শেখার আর্জি নিয়ে আশেপাশে ঘোরেন বেশ কিছু ঝকঝকে, উদ্যমী এবং উচ্চাকাঙ্খী তরুণ-তরুণী। কাউকেই ফেরান না সলিল-জ্যোতি। সলিল ডুবে থাকেন কর্মযজ্ঞে আর জ্যোতি দু’হাতে সামলে রাখেন সেই বিস্তৃত সংসার আর সঙ্গীতজগতের সেই বিরল প্রতিভাটিকে। সঙ্গে চলতে থাকে তিনটি শিশুকে বড়ো করে তোলা, তাদের স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেওয়া।

যদিও নিজে গান করতেন না, কিন্তু জ্যোতি গান ভালবাসতেন। লেখালিখি সাহিত্যও ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। বান্দ্রার বাংলোর আলোচনার আসর তাঁর দিগন্ত করলো আরও প্রসারিত। সলিলের সব উদ্যমকে সর্বতোভাবে আগলে রাখার চেষ্টা করে চলতেন জ্যোতি— স্টুডিয়ো তৈরী থেকে শুরু করে নিত্যনতুন গানের সরঞ্জাম কেনা, সব। জ্যোতির প্রায় ৮০ ভরি সোনার গয়না ছিলো, যা তিনি সলিলের হাতে তুলে দ্যান তাঁর কাজের সাহায্যার্থে। পূর্ণ উদ্যমে চলে কাজ। প্রতিদিনই থাকে কিছু অতিথি, যাঁরা রাত্রেও খেয়ে যান। জ্যোতি রান্না করতে খুব ভালোবাসতেন—দু’টি কাজের লোক নিয়ে, আনন্দের সঙ্গে তিনি অতিথিসেবা করে যান।

আর জ্যোতির নিজের আঁকাআঁকি? বাটিকের কাজ? আর্ট কলেজের বান্ধবীরা? পেশাদার শিল্পী হওয়া? সময় কোথায় সেসব ভাবার! এক সংসারে থেকে দু’জন যদি স্বপ্ন দেখেন, তাহলে বাস্তবকে সামলাবে কে?….সুতরাং পেশাদার শিল্পী হওয়া আর হলো না জ্যোতির, যদিও ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে অপূর্ব সব ছবি এঁকে গেছেন তিনি সারাজীবন ধরে। কিন্তু সেই প্রতিভা না হয়েছে অর্থকরী, না যশবাহী।

তাই নিয়ে জ্যোতি অবশ্য আর কথা তোলেন না। কি নিয়েই বা কথা তোলেন তিনি? শান্তভাবে জীবনের সবকিছু মানিয়ে নিতেই অভ্যস্ত জ্যোতি—চিরদিন। চারদিকের পরিবর্তনশীল জগতের মধ্যে থেকেও, তিনি যেন এক ধৈর্যের প্রতিমূর্তি—অপরিবর্তিত, অচঞ্চল। কিন্তু চারপাশের সব কিছু যখন দ্রুত পাল্টে যায়, তখন অপরিবর্তিত থাকাটাই কি বেঠিক? জ্যোতির ভুলটা কি সেখানেই হয়েছিলো?

সলিলের জগত তখন দ্রুত পরিবর্তনশীল। হিন্দী চিত্রজগতের গ্ল্যামার এবং উদ্দাম জীবনযাত্রার শরিক হয়ে পড়েছেন তখন তিনি। ব্যস্ত, কর্মবহুল জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে অসংযত অবসরযাপন। যে শান্ত বাতিঘরের আলোটি একদিন উদ্দাম সমুদ্র থেকে তাঁকে টেনে এনেছিলো, তাঁর চেয়ে অনেক জোরালো চোখ-ধাঁধানো আলোরা যেন আজ হাতছানি দিয়ে সলিলকে ডাকে…..বলে ‘বন্দরের কাল হলো শেষ’!

অনেকদিন থেকেই একটু একটু করে নানা কথা কানে আসছিলো জ্যোতির। চেনা-পরিচিতরা সাবধান করছিলেন তাঁকে। কিন্তু জ্যোতির শান্ত বিশ্বাসী মনে সহজে কিছু রেখাপাত করে না। সলিল তখন খ্যাতির শিখরে, আশেপাশে ঘুরছে বসন্তের কোকিলের মতো ‘শুভাকাঙ্খী’রা। মধুর খোঁজে মৌমাছির আসাও অস্বাভাবিক নয়! সলিলের চারপাশে চিরদিনই মেয়েরা ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু সব শেষে তো সলিল তাঁর কাছেই ফিরে এসেছেন বরাবর! তাহলে আজ জ্যোতি কেন শুধু শুধু তাঁকে সন্দেহ করতে যাবেন! আশপাশে ঘিরে থাকা বন্ধু-ছাত্রছাত্রী-পরিচিতদেরই বা কেন ‘অবিশ্বাসী’ ভাবতে যাবেন! ….তবুও বিশ্বাসের বাঁধ ভাঙে মাঝে মাঝে, চোখেও পড়ে কিছু কিছু। একদিন বম্বে এয়ারপোর্ট থেকে সলিলকে তুলে আনতে গেলেন জ্যোতি, চমকে দেবেন বলে সলিলকে আগে কিছু বললেন না। কিন্তু চমকে গেলেন নিজেই—সলিল প্লেন থেকে নামছেন সঙ্গিনীকে নিয়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন জ্যোতি।

১৯৬০-১৯৬১ সালের পর অবশ্য আর কিছু চাপা রইলো না। সলিলের বাড়ী ফেরায় পড়তে লাগলো ছেদ—কখনো একদিন অনুপস্থিত, কখনো বা টানা কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকেন বান্দ্রার বাড়ী এবং সংসার থেকে। আবার যখন বাড়ী আসেন, তখন অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে মেতে ওঠেন মেয়েদের নিয়ে—যেন সবই খুব স্বাভাবিক। এদিকে ক্রমশঃ সলিলের মদ্যপানের মাত্রা যায় বেড়ে। জ্যোতি বাধ্য হন মুখ খুলতে, প্রশ্ন করতে। কথায় কথায় বেধে ওঠে কলহ।…..

অবশেষে ১৯৬৫ সালে, পাকাপাকিভাবেই বম্বেতে দ্বিতীয় সংসার পেতে বসলেন সলিল—দিল্লীর আর্মি কোয়ার্টার্স থেকে আসা, কুড়ি বছরের ছোট, ঝকঝকে স্মার্ট বম্বে ইয়ুথ ক্যয়ারের এক গায়িকার সঙ্গে। পুরোনো সংসারে আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। অলকার বয়স তখন বারো, বাকীরা আরো ছোট—তারা অনুভব করে একটা অদৃশ্য চাপ, বুঝে উঠতে পারে না তাদের কি করণীয়। সলিলের পিতা তখন পরলোকগত, কিন্তু মা এবং অন্য আত্মীয়রা বর্তমান। যে শ্বশুরবাড়ী একদিন জ্যোতিকে সাদরে বরণ করে ঘরে তুলেছিলো, সেই শ্বশুরবাড়ীতে আজ সলিলের সঙ্গে পা রাখলেন অন্য কেউ। সলিলের মতামতই প্রধান সেখানে—বাকী সবাই দ্রষ্টা। জ্যোতি একা আর কি করতে পারেন?

আঘাত পেলেও, জ্যোতি কিন্তু ভেঙে পড়লেন না—মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত করলেন। হিন্দু বিবাহ আইন সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ছিলো পরিস্কার। খার অঞ্চলের এক উকিলের সঙ্গে গিয়ে বারদুয়েক কথাও বলেছিলেন জ্যোতি—কিন্তু শেষপর্যন্ত আইনগত বিবাহবিচ্ছেদের পথে তিনি গেলেন না। কেন, সেটা বলা মুস্কিল। মেয়েদের কথা ভেবে? সংসারের মুখ চেয়ে? না, সেই শুভ্র ফুলের মতো প্রথম প্রেমের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে? এর উত্তর অজানা, কিন্তু বাস্তবে নিজের ভেতরেই হজম করে নিলেন জ্যোতি পুরো ঘটনাটা। তাঁর গভীর দীঘির মতো শান্ত ব্যক্তিত্বে কোনো আঘাত দাঁড়াতে পারলো না—ক্ষণিক বুদ্বুদ কেটে ডুবে গেলো অতলে। মেয়েদের আঁকড়ে ধরলেন তিনি, আর রইলো তাঁর তুলি-ক্যানভাস। বিমল রায়ের স্ত্রী, বহুদিনের পুরোনো বন্ধু মনোবীণা রায়, পাশে এসে বসেন—জ্যোতিকে বলেন মন শক্ত করতে, বলেন আবার ছবি আঁকতে। তাই করেন জ্যোতি। খুব মন খারাপ লাগলে তুলি নিয়ে বসেন, বাটিকের কাজ করেন, নয়তো করেন রান্না।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


জ্যোতির হাতে কখনো টাকা আসে, কখনো আসে না। পথ চলতে কখনো হয়তো বম্বের কোথাও দেখা হয়ে যায় সলিল আর তাঁর নতুন সংসারের সঙ্গে। কখনো বা শুনতে পান যে পাড়াতেই এক চিত্রপরিচালকের বাড়ী এসেছিলেন সলিল। যেন অপরাধী তিনি নিজেই, এইভাবে ক্রমশ নিজেকে চার দেওয়ালের মধ্যে গুটিয়ে আনতে থাকেন জ্যোতি। তাঁর নিজের উপায়হীনতা, পেশাহীনতা কি তখন তাঁকে প্রতিপদে কাঁটার মতো বিঁধেছিলো? হাতে তখন তাঁর প্রায় কিছুই নেই, সম্বল শুধু বান্দ্রার বাংলো—যেটা একসময় স্ত্রী জ্যোতির নামে কিনেছিলেন সলিল চৌধুরী। সলিলের কাছে টাকার আর্জি করেন আর ‘মেয়েদের স্বাবলম্বী হতেই হবে’—এই মন্ত্র সামনে রেখে এগিয়ে চলেন জ্যোতি। এই মন্ত্র থেকে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হননি, একবারও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেননি, যতদিন না অলকা-তুলিকা-লিপিকা স্বাবলম্বী হয়ে মাথা তুলে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো।

বান্দ্রার বাড়ী ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সলিলের জীবনেও আস্তে আস্তে শুরু হলো নানা সমস্যা। তাঁর সুর দেওয়া বেশ কয়েকটি ছবি চললো না। অতিরিক্ত মদ্যপান এবং সাংসারিক জটিলতা প্রভাব ফেলতে লাগলো তাঁর পেশাগত জীবনে। জমে উঠলো ঋণ। ট্যাক্স বাকী পড়লো। নিলামে উঠলো বান্দ্রার বাংলো। বাংলো চলে গেলো, পরিবর্তে নতুন অধিকর্তারা জ্যোতিকে দিলেন বান্দ্রার পশ্চিমাঞ্চলে একটি ছোট ফ্ল্যাট। তিনকন্যাকে নিয়ে ফ্ল্যাটে উঠে গেলেন জ্যোতি—সেটা ছিলো ১৯৬৭ সাল।

তার পরবর্তী কয়েকটা বছর সলিলের জীবনে ছিলো ধারাবাহিক সঙ্ঘর্ষের—কখনো সফল, কখনো বিফল, এইভাবেই হিন্দী ছবির জগতে আরো কয়েক বছর তিনি নিজের স্থান বজায় রাখলেন। কিছু ভুল বোঝাবুঝির দরুণ, হেমন্ত-সলিল জুটি ভেঙে পড়লো। ১৯৭১ সালের ‘আনন্দ’ ছবিটিতে, মুকেশ গাইলেন সলিলের সুর দেওয়া গান—‘কঁহি দূর যব দিন ঢল যায়ে’; যার বাংলাটি ছিলো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ১৯৬৫ সালের সুপারহিট ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’। যদিও ‘আনন্দ’-এর আরেকটি গান ‘না জিয়া লাগে না’, যেটির সুরও ছিলো সলিলের আরেকটি বাংলা গানে, গাইলেন লতা মঙ্গেশকর—যিনি বাংলা গানটিও গেয়েছিলেন।

পেশাগত টানাপোড়েন বেড়েই চললো। ১৯৭৫ সালের ‘ছোটি সি বাত’ ছবিটিই অনেকের মতে ছিলো সলিলের শেষ ব্যবসায়িকভাবে সফল হিন্দী ছবি। প্রতিযোগিতা বেড়ে উঠছে তখন হিন্দী চিত্রজগতে—আসছেন নতুন সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালকরা, চাহিদা বাড়ছে ‘অন্যরকম’ সুরের। বম্বের সেই ‘গলা-কাটা’ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লেন সলিল। ১৯৭৯ সালে, পাকাপাকিভাবে বম্বের পাট গুটিয়ে, তিনি কলকাতায় চলে গেলেন তাঁর নতুন সংসার নিয়ে। উঠলেন লোয়ার সার্কুলার রোড়ের আকাশদীপে, এক পরিচিত বন্ধুর ফ্ল্যাটে।

সুর নিয়ে সলিলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিন্তু বন্ধ হলো না। বাংলা এবং দক্ষিণী ছবি ছাড়াও, বহু ভারতীয় ভাষায় তৈরী হলো তাঁর গান—সৃষ্টি থেমে রইলো না। তৈরী হলো ছোটদের গান। সঙ্গে রইলো লাইভ প্রোগ্রাম, বাংলা ছবিতে সুর দেওয়া। নতুন কিছু করার অবিরাম তাড়নায় ঘুরপাক খেতে লাগলো তাঁর সৃজনশীল মন। নিজের জীবনী লিখলেন—‘জীবন উজ্জীবন’। ‘সেন্টার ফর মিউজিকাল রিসার্চ’ খুললেন। কিন্তু ঠিক তেমন করে যেন আর সবকিছু সুরে বাজলো না। কলকাতার বেহালাতে একটা স্টুডিয়ো করেছিলেন, ‘সাউন্ড অন্ সাউন্ড’—সেটাও একসময় বন্ধ হয়ে গেলো। লেগে থাকে অশান্তি। ‘না…..মন লাগে না…..এ’ জীবনে কিছু যেন ভালো লাগে না….না’!

আর জ্যোতি? তরঙ্গহীন জীবনদীঘিতে তিনি নতুন করে আর কোনো আন্দোলন আসতে দিতে নারাজ।

সব খবরই তিনি পান। শুনেছেন যে সলিল আত্মজীবনী লিখেছেন—সেখানে জ্যোতি বা তাঁর কন্যাদের কোনো উল্লেখ নেই। শুনেছেন কলকাতায় সলিলের নতুন জীবনের কথা—যেখানে তাঁর কোনো স্থান নেই। সলিলের কলকাতায় চলে যাওয়া তাঁর মনে একটা তাৎক্ষণিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও, তিনি যেন খানিকটা শান্তিও পেয়েছেন। বম্বের নাতিবৃহৎ বাঙালী সমাজে, তিনটি অল্পবয়সী সন্তানকে সামলাতে সামলাতে, প্রতিপদে বিড়ম্বিত লজ্জিত হওয়ার চেয়ে বোধহয় এই ভাল—‘….দুই কিনারে দুই তরণী…’।

মেয়েরাও এখন বড়ো হয়ে উঠেছে, সবাই স্বাবলম্বী। কোনোভাবেই সলিলের নতুন সংসারের সঙ্গে কোনো বৈষয়িক টানাপোড়েনে নিজেদের জড়াতে চান না জ্যোতি বা তাঁর সন্তানরা। তাই এই দূরত্বই ভালো।…….

আশির দশকে যখন কলকাতার সংসার ছেড়ে ক্লান্ত সলিল আবার থাকতে এলেন জ্যোতির কাছে, বম্বের ফ্ল্যাটে, তখনও এক উদাসীন নম্র দূরত্বে নিজেকে সরিয়ে রাখলেন জ্যোতি। তিনি যেন জানতেন যে সলিলের জীবনে এই টানাপোড়েন শেষ হওয়ার নয়—বৃথা আন্দোলিত হয়ে লাভ নেই। হলোও তাই, কিছুদিন বাদে সলিল আবার ফিরে গেলেন কলকাতায়। জ্যোতি সরে রইলেন তাঁর বৈরাগ্যের সীমানায়।…..

আর তারপর….যখন সত্যিই সলিলের জীবনের বেলা শেষ হয়ে এলো, ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, অবিচলিত পায়ে তিন মেয়েকে নিয়ে কলকাতার নার্সিংহোমে এলেন জ্যোতি। কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই তাঁর—সাংবাদিকদের এড়িয়ে, নিজের অধিকারে ভেতরে ঢুকে, স্বামীকে শেষ দেখা দেখে এলেন তিনি। এইটুকুর অপেক্ষাতেই যেন দেহের খাঁচায় আটকে ছিলো সলিলের আত্মা—মুক্তি হলো এবারে…..’ফুরালো রঙের খেলা’, পাখী উড়ে গেলো। জ্যোতি শান্ত পায়ে ফিরে গেলেন তাঁর বম্বের ফ্ল্যাটে। যেখানে ঘরের একটি দেওয়াল জুড়ে তিনি সাজিয়ে রেখেছেন সলিলের ছবি, আর সলিলের সব পুরস্কারের কাটিং, ফ্রেমে বন্দী করে। মেয়েরা বলে – “মা তো অন্য পূজো করে না, এই মায়ের মন্দির।” সেই মন্দিরেই সলিল যেন রয়ে গেছেন জ্যোতির একান্ত কাছাকাছি……বোধহয় রয়ে যাবেন চিরকাল। 

তথ্যঋণ: ডঃ অলকা নানজাপ্পা

2 thoughts on “ধারাবাহিক বধূ পাঁচালি: ভালোবাসা কারে কয় । শকুন্তলা চৌধুরী

  1. এই লেখাটি শুধু জরুরিই,আবশ্যিক ছিল। উইকিপিডিয়া খুললে শ্রদ্ধেয় সলিল চৌধুরী সম্পর্কে যা যা জানতে পারা যায়, সে সব অর্ধসত্য। অথচ জানবারও কোনো প্রামাণ্য উপায় ছিল না।

    আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেন।মাননীয় জ্যোতি চৌধুরীর আঁকা ছবি যদি দেখার সুযোগ হয় ,নিজেকে ধন্য মনে করব।
    আমি ‘পরবাস’ পত্রিকায় কয়েক মাস হল ,কিছু গল্প লিখেছি।আশাকরি আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই আরও আলাপ হবে।

    হীরক সেনগুপ্ত

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত