Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ধারাবাহিক বধূ পাঁচালি: সে নহি নহি । শকুন্তলা চৌধুরী

Reading Time: 4 minutes

‘ঘরাণা’ শব্দটার উৎপত্তি আসলে ‘ঘর’ থেকে। আগেকার দিনে শিষ্যরা গুরুর ঘরে, অর্থাৎ বাড়ীতে থেকে শিল্পচর্চা করতেন বা শিখতেন, এবং গুরুর ঘরের অংশ হয়ে যেতেন।পরবর্তী কালে সেই গুরু ঘরাণার নামেই তারা শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতেন যুগ পরম্পরায়। প্রতিটি ঘরাণার থাকতো নিজস্ব স্টাইল। আজ আর গুরুর আশ্রম নেই, ঘরে থেকে শিক্ষালাভও নেই—কিন্তু স্টাইল তো আছে! নিজের ভূমিকায় স্বনামধন্য প্রতিটি শিল্পীরই আছে, বা ছিলো, নিজস্ব স্টাইল। নিজস্ব ‘ঘরাণা’। মৃণাল সেনেরও ছিলো। মৃণাল সেনের ঘরাণা বলতে কি বোঝায় বা বোঝাত, এ’ নিয়ে বোধহয় একটা বই লেখা যায়। প্রচুর লেখা হয়েছে ওনার ছবি এবং ওনাকে নিয়ে, আরো হবে। আমি শুধু স্বল্প পরিসরে দু’একটা কথা বলবো—ওনার ঘরাণা নিয়ে এবং ঘরণী নিয়ে, কারণ ঘরণী ছাড়া ঘরাণা টিকে থাকতে পারে না….পারতো না।

মৃণাল সেন ছবি করতে নেমেছিলেন একটা বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে। এবং সেই রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি তাঁর ছিলো আপোসহীন আনুগত্য। চলচ্চিত্রকে তিনি মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে, সেই মতাদর্শকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন ঘরে ঘরে। তিনি ছিলেন স্বঘোষিত ‘প্রাইভেট মার্কসিস্ট’। আপোসহীন কাজের জন্য পৃথিবী খুব কঠিন জায়গা—বলা বাহুল্য যে মৃণাল সেনের এই কাজটাও সোজা ছিলো না। সোজা ছিলো না বললে খুব কম বলা হবে—আসলে কাজটা অত্যন্ত কঠিন ছিলো। এতোটাই কঠিন, যে একসময়ে হাল ছেড়ে ডুবে যেতে চেয়েছিলেন তিনি—ভেসে থাকার মতো শক্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন না শরীরে বা মনে। কিন্তু তিনি ভেসে থাকলেন—তাঁকে ভাসিয়ে রাখলেন ঘর ও ঘরণী, এক সন্তানের জননী গীতা সেন। ডুবতে দিলেন না। নৌকোও বদলাতে বললেন না। শুধু শক্ত হাতে হাল ধরে রইলেন তিনি নিজে। ভাগ্যিস্! তাই আমরা একদিন পেলাম ‘ভুবন সোম’, ‘আকালের সন্ধানে’র মতো ছবি।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


দ্বিজেন সোম এবং হাসি সোমের কন্যা গীতা সোমের জন্ম হয়েছিলো উত্তরপাড়ায়, ১৯৩০ সালের ৩০শে অক্টোবর। বাবা ছিলেন স্বাধীনতা-সংগ্রামী। জেলে থাকাকালীন তিনি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন এবং কারামুক্তির কিছুদিনের মধ্যেই স্ত্রী ও তিন সন্তানকে রেখে মারা যান। জ্যেষ্ঠা কন্যা, ১৫ বছরের গীতার ওপর এসে পড়ে সংসারের ভার—বন্ধ হয়ে যায় তার স্কুলে যাওয়া। শুরু হয় জীবনের সঙ্গে আপোষ আর সংগ্রামের খেলা। কখনো সামান্য রোজগার, কখনো আত্মীয়পরিজনের বদান্যতা—এইভাবে হোঁচট খেতে খেতে চলতে থাকে সংসার।

একসময় গীতা যোগ দেন আই পি টি এ-তে। শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়।

আই পি টি এ আন্দোলনের সঙ্গে সর্বতোভাবে জড়িয়ে পড়ার পর, গীতা অংশ নেন বিজন ভট্টাচার্য এবং ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত বহু নাটকে। ঋত্বিকের প্রথম ছবি ‘নাগরিক’-এও অভিনয় করেন গীতা। এই অভিনয়ের সূত্র ধরেই মৃণাল সেনের সঙ্গে আলাপ হয় গীতা সোমের। মৃণাল সেনের লেখা চিত্রনাট্যের ওপরে তৈরী ‘দু ধারা’ ছবিটির মুখ্য চরিত্রে ছিলেন গীতা। আলাপ পরিণত হলো প্রেমে, এবং শেষে বিবাহবন্ধনে। ১৯৫৩ সালের ১০ই মার্চ, গীতা সোম হলেন গীতা সেন।

মৃণাল সেনের মতাদর্শের সঙ্গে গীতার ছিলো অঙ্গাঙ্গী মিল—তাই দেরী হলো না ‘ঘরাণা’ গড়ে উঠতে। কিন্তু সেই ঘরাণাকে বাঁচিয়ে রাখার মতো রসদ কই? অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে শুরু হয়েছিলো মৃণাল-গীতার যৌথ জীবন। দু’জনের কারুরই কোনো বাঁধা রোজগার নেই—একদিন পার করে পরেরদিনে পা রাখাটাই তখন একমাত্র চিন্তা। পায়ের চটি ছিঁড়ে গেলে, আরেকটা কেনার মতো পয়সা নেই হাতে।

নিজের নিষ্ঠায় অটল মৃণাল সেনের প্রথম ছবি তৈরী হলো ১৯৫৫-তে (মুক্তি পেলো ১৯৫৬-তে), কিন্তু সংসারে স্বাচ্ছল্য এলো না। একমাত্র সন্তান কুণালের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই অভিনয়ে সাময়িক ভাবে ইতি টেনেছেন গীতা—তাঁর প্রধান কাজ তখন শিশুটিকে মানুষ করা এবং অগোছালো মৃণালের সৃষ্টি ও সঙ্গে সংসারের নৌকাটিকে ভাসিয়ে রাখা। কাজটা ছিলো প্রায় অসাধ্যসাধন। গীতার অসম্ভব মনের জোর, বাস্তববুদ্ধি আর তাঁর পিসতুতো দাদা অভিনেতা অনুপকুমারের আর্থিক সাহায্য না থাকলে, হয়তো ভরাডুবিই হতো। কিন্তু তা হলো না—নৌকো ভেসে রইলো। পূজোয় নতুন জামা কিনতে পারতেন না, একটি সন্দেশ এনে ছেলেকে দিয়ে গুঁড়োগুলো চেখে দেখতেন ছেলের বাবা—তবু নৌকোটুকু ভেসে রইলো।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি, কুণাল যখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র, তখন আবার অভিনয় শুরু করলেন গীতা। যোগ দিলেন উৎপল দত্তের নাটকের দলে। পরবর্তী পাঁচবছরে, মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত উৎপল দত্তের প্রায় সবক’টি নাটকেরই মুখ্যচরিত্রে ছিলেন গীতা—‘কল্লোল’, ‘মিড্ সামার নাইটস্ ড্রিম’, ‘ওথেলো’, ‘তীর’। নকশাল আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে তৈরী ‘তীর’ নাটকটি ১৯৬৯-১৯৭০-এ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপরে গীতা আর থিয়েটারে অভিনয় করেননি। সিনেমা করার বহু প্রস্তাব এসেছিলো তাঁর কাছে, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে তিনি সেগুলো গ্রহণ করেননি।


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক বধূ পাঁচালি: ভালোবাসা কারে কয় । শকুন্তলা চৌধুরী


ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছে মৃণাল সেনের ছবি ‘ভুবন সোম’ (১৯৬৯), যেটি জাতীয় পর্যায়ে চলচ্চিত্রকার হিসাবে তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছে। এরপরে অন্তত ছবির প্রযোজক পাওয়ার জন্য মৃণাল সেনকে আর হয়রান হতে হয়নি। গীতা ঠাট্টা করে স্বামীকে বলতেন – “দুই ‘সোম’ (গীতা সোম এবং ভুবন সোম) তোমাকে বাঁচিয়ে দিলো!”

মৃণাল সেনের পরবর্তী ছবি ‘কলকাতা ৭১’-এর সূত্র ধরে, বহুদিন বাদে আবার সিনেমাতে অভিনয় করলেন গীতা। এবং পরপর গীতা তখন অভিনয় করে গেলেন মৃণাল সেনের বেশ কয়েকটি ছবিতে—‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯), ‘আকালের সন্ধানে’ (১৯৮০), ‘চালচিত্র’ (১৯৮১), ‘খারিজ’ (১৯৮২), ‘খণ্ডহর’ (১৯৮৩), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৯১)। এছাড়াও গীতা অভিনয় করলেন শ্যাম বেনেগালের ছবি ‘আরোহন’-এ (১৯৮২)।

গীতা সেনের অভিনয় ছিলো অত্যন্ত পরিমিত এবং সংযত—‘নাটকীয়তা’ দোষে একেবারেই দুষ্ট নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা, চরিত্রটিকে তিনি আদ্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারতেন। খুব বেশী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি তিনি—করলে হয়তো তাঁর প্রতিভার আরও কিছু স্বাক্ষর জমা থাকতো পরবর্তীকালের মূল্যায়নের জন্য।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সত্যজিৎ রায় একবার তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন – “গীতা হচ্ছে মৃণালের ‘এ্যাসেট’।” কথাটাকে বোধহয় সর্বতোভাবে বিশ্বাস করতেন স্বয়ং মৃণাল সেন। গীতা সেনের মতামতের ওপর মৃণাল সেনের ছিলো অগাধ আস্থা এবং শ্রদ্ধা। মৃণাল সেনের প্রতিটি চিত্রনাট্যের প্রথম শ্রোতা এবং সমালোচক ছিলেন গীতা সেন—বহু চিত্রনাট্য বর্জিত হয়েছে এবং বহু কথোপকথন পরিবর্তিত হয়েছে গীতার মতামত অনুযায়ী। পরবর্তীকালে গীতার এই কাজে সঙ্গী থাকতেন পুত্র কুণাল, যাঁর মতে ‘গীতা সেনের অভিনয় এবং (মধ্যবিত্ত পরিবারের) পটভূমিকা সম্বন্ধে একটা ষষ্ঠ চেতনা ছিলো, যেটা তাঁর স্বামী অত্যন্ত মূল্যবান বলে জানতেন।’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের জগত থেকে সরে এসেছিলেন গীতা সেন, কিন্তু মৃণাল সেনের সবক’টি ছবিতেই শেষপর্যন্ত (২০০২) সাহায্য করে গেছেন তিনি—পর্দার পেছন থেকে।

মৃণাল সেনের ‘ঘরাণা’কে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছিলেন ঘরণী গীতা। ‘সম্পদে বিপদে’ পাশে থেকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন নিজেকে, অর্জন করেছিলেন মৃণাল সেনের মত ব্যক্তিত্বের অকুন্ঠ শ্রদ্ধা। একে অপরের পরিপূরক এই দম্পতির জীবনে আঁধারের খেলা চলেছে অনেকদিন, তবু ‘ঘরাণা’র আদর্শ থেকে তাঁরা সরে আসেননি। ৭০-এর দশকের পর থেকে তাঁদের জীবনে এসেছে স্থিতি। সঙ্গে এসেছে সম্মান আর পুরস্কারের আলো—জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক। অনেক সংগ্রামর পর, পরিপূর্ণতার আস্বাদ এসেছিলো তাঁদের দীর্ঘ যৌথ জীবনে।…
অবশেষে এলো ‘খেলা ভাঙার খেলা’, পড়লো যবনিকা। ‘মার্কসিস্ট’রা যদিও এইসব ভাবালুতায় বিশ্বাস করেন না, তবু তাঁদের জীবন দেখলে বলতে ইচ্ছে হয় যে তাঁরা ‘মুগ্ধ-ললিত অশ্রুগলিত গীতে…স্বর্গখেলনা’ গড়তে পৃথিবীতে আসেননি। কিছু যেন সৃষ্টি করতে এসেছিলেন, আর যখন সেই কাজ সম্পূর্ণ হলো তখন বিশ্রামের কাল শেষ করে হংসমিথুন হয়ে তাঁরা আবার উড়ে গেলেন—পেরিয়ে গেলেন দিগন্ত। ২০১৭-তে গেলেন গীতা সেন, ২০১৮-তে মৃণাল সেন।

 

 

 

তথ্যঋণ: ডঃ কুণাল সেন

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>