| 26 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১১)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সুরমার দশা অনেকটা ছোটোমামার মতোই। লেখাপড়াতে মোটেও মনোযোগ নেই!

দিনরাত মোবাইলে কথা বলতে পারলে আর আড্ডা মারতে পারলে মহাখুশি। এইটা পেলে সারাদিন খেতে না দিলেও কোনো অসুবিধা নাই। কথা বলতে পারলেই ও ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে যায়। এমন বাচাল মেয়ে আমি অন্তত জীবনে দেখিনি!

তবে একই সাথে ভীষণ মজার মেয়ে সুরমা। সেন্স অফ হিউমার প্রবল। কথার ভাঁজে ভাঁজে এমন এমন মজার কথা জুড়ে দেয় যে, হাসতে হাসতে আমার দম বের হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়।ওর পাল্লায় পড়ে দিনে দিনে আমিও খুব গল্পবাজ হয়ে উঠছি।

 

মামা-মামী থেকে শুরু করে নানী পর্যন্ত সুরমার বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত। মেয়েটা যে মোটেও পড়তে চায় না, এই খবর তাদের কাছে পুরনো নয়। কথাবার্তায় বুঝতে পেরেছি, স্কুলে মাঝে মাঝে পরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য বড়মামাকে তদবির পর্যন্ত করতে হয়েছে। বড়মামার মতো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষের জন্য এটা চরম লজ্জার বিষয়। প্রতিবার সুরমাকে কানে ধরে উঠবস করিয়েছেন। নিজেও সম্ভবত মনে মনে উঠবস করেছেন যে, এই কাজ আর করবেন না। কিন্তু তার গুণধর মেয়ে বুঝলে তো কাজই হতো!

বড়মামা তার মেয়েদের লেখাপড়ার দিকে খুবই মনোযোগী। তার কথা হচ্ছে… মেয়েরা পরবর্তীতে চাকরিবাকরি করুক বা না করুক, লেখাপড়া না করে বসে থাকবে কেন? মেয়েদের ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করাটাকেওতিনি খুব পছন্দ করেন।

 

তার খুব ইচ্ছা ছিল সুবর্ণা আপাকে মেডিক্যালে পড়ানোর। আপা পড়ালেখাতেও খুব ভালো ছিল। ভালো কোনো টিউশনি না পেয়েও পাবলিক পরীক্ষাগুলোকে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হয়ে দেখা দিলো একটা খুব ভালো বিয়ের প্রস্তাব। একেবারে আচমকাই প্রস্তাবটা চলে এলো। ছেলে দেশের বাইরে থাকে। ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, ভালো সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করে। পাড়ার ছেলে, কাজেই বেশি ভাবনাচিন্তা করার কিছু ছিল না। ছেলেকে ছোটবেলা থেকেই চোখের সামনে বড় হতে দেখা। পাড়ার গর্ব বলা চলে। সেই ছেলের মা আচমকা হুট করেই একদিন সুবর্ণা আপাকে পুত্রবধু হিসেবে চেয়ে বসে। বড়মামা তবু গাঁইগুঁই করছিল। সুবর্ণা আপারও পড়ালেখার দিকেই ঝোঁকটা বেশি ছিল।


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১০)

কিন্তু নানী একেবারে গাঁট হয়ে বসে গেলেন যে, এই সন্মন্ধ যাতে কিছুতেই হাতছাড়া না হয়। এত ভালো ছেলে কি রাস্তাঘাটে পাওয়া যায়? এমন ছেলের জন্য নাকি তপস্যা করতে হয়। মামীরও সায় ছিল। আর ছোটমামার তো আলাদা কোনো মতামত নেই। সবাই যেখানে হ্যাঁ বলে দিবে, সেখানে নাকি তার না বলার কোনো সুযোগই নেই!

 

অগত্যা বিয়ে হয়ে গেল সুবর্ণা আপার। আপা এখন স্বামীর সাথে মেলবোর্ণে। সেখানে কী করছে…পড়ালেখার পরিকল্পনা করছে কী না এসব একদিন সুরমাকে জিজ্ঞেস করলাম। সুরমা আমার কানে কানে বললো, ‘আপাতত পরিবার পরিকল্পনা করছে। আর অন্য কোনো পরিকল্পনার সময় বের করতে পারছে না। এই কাজেই যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করতে হয় কী না! তাছাড়া কত পরিশ্রমেরও তো বিষয়!’

আমার কান মাথা গরম হয়ে গেল! এমন মেয়ে! মুখে কিছুই আটকায় না। নিজের ছয় বছরের বড়বোনকে নিয়ে কেমন মন্তব্য! আমি কিছু বলবো না বলবো করেও জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘তুই কীভাবে জানলি যে পরিবার পরিকল্পনা করছে? তোকে কিছু বলেছে নাকি?’

সুবর্ণা বিজ্ঞের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, ‘আমাকে কি তোর মতো গাঁড়ল মনে করেছিস? মাঝে মাঝে ভিডিওকলে চেহারা দেখায়। বুঝলি, একেবারে খুল্লাম খুল্লা ভাবভঙ্গি। দুলাভাই পাশেই দাঁড়ায়ে থাকে। আপা পারলে কথা বলতে বলতে তার গায়ের ওপরে হেলে পড়ে! আহারে! কী প্রেম! এত প্রেমের সাগরে কি এখন পড়াশুনার ঢেউ উঠবে?’

আমি ভয়ানক ভয় পেয়ে চুপ করে যাই। বাবারে বাবা! যে ডেয়ারিং মেয়ে! কথাবার্তা আর বেশিদূর চালিয়ে কাজ নেই! কী বলতে কী বলে বসবে কে জানে!

 

সুরমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীরে তোর ভাবনাচিন্তা কী? তুইও কি খুব তাড়াতাড়িই সুবর্ণা আপার দলে ভিড়তে যাচ্ছিস নাকি?’

সুরমা আমার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘পাগল! এত তাড়াতাড়ি আমি পরিবার পরিকল্পনার ফাঁদে পা দিব? এখনো ডালে ডালে ঘুরে মধুই খেলাম না! এখনই ফিক্সড ডালে বসতে বলছিস! ডালের শাখাপ্রশাখা ছড়াক। আমার পাখনাগুলো আরো রূপালী সোনালী হোক…আমোদ তো এখনো শুরুই হয়নি!’

কীসের মধ্যে কী? আমি একেবারে আঁতকে উঠলাম। নাহ্‌! এই মেয়ের তো ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না! পড়ালেখার নামে একেবারে লবডঙ্কা। বই হাতে নিয়ে ছুঁয়েও দেখে না। আবার বলছে কী না ডালে ডালে ঘুরে বেড়াবে! কী সর্বনাশ!

 

আমাকে কিছুদিন আগে কয়েকজন ছেলের নাম্বার এনে দিয়ে বলেছে, ‘প্রত্যেকটাই হ্যাণ্ডসাম। বাজায়ে দেখি। কার সাথে ঘুরেটুরে বেড়ালে ভালো লাগবে। তোর লাগলে বলিস!’

মেয়েদের কলেজ থেকে কিছু দূরেই একটা ছেলেদের কলেজ আছে। ছোট জেলা শহরে এই যুগেও ছেলেমেয়েদের মধ্যে ফ্রি মিক্সিং এর সুযোগটা কম। তাই দুই পক্ষই পরষ্পরের ব্যাপারে অতি আগ্রহ বোধ করে এবং সেই আগ্রহের বহিঃপ্রকাশটা ঘটে বিভিন্নভাবে। পছন্দের কারো সাথে কানেক্টেড হতে চাইলে মোবাইল নাম্বার চালাচালি একটা বহিঃপ্রকাশ। আরো কত উপায় যে আছে…সব একটু একটু করে জানছি। সুরমা মাঝে মাঝে সব কথা আবার আমার সাথে শেয়ারও করতে চায় না। কিছুদূর বলে চোখমুখ সরু করে বলে, ‘নাহ্‌! তোকে এভাবে সবকিছু বলে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না! তুই আবার বাবাকে বলে দিবি! শেষে একটা লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যাবে বাসায়!’

 

আমি বলি, ‘এমন কাজ করছিস কেন, যা শুনলে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যাবে?’

সুরমা চোখমুখের ভঙ্গিমা করে বলে, ‘তাহলে কী করবো ম্যাডাম? খালি আপনার মতো মুখের সামনে বই ঝুলিয়ে বসে থাকবো? আমার এত পড়তে ভালো লাগে না! এত পড়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার উকিল ব্যারিস্টার কিছুই হবো না! বড়পার মতো বিয়েশাদীও করবো না এত তাড়াতাড়ি। আরে! সবে তো বসন্তের শুরু! কী মধুর বাতাস বইছে! গাছে গাছে কত কোকিল বসে কুহু কুহু করছে! তুই এসবের কী বুঝবি? এই বয়সেই তো মোটা এক চশমা বাগিয়ে বসেছিস!’

 

আমি মুখে কিছু বলিনি। কিন্তু মনে মনে আতংকিত হয়েছি। সুরমা যা করছে, তা এখন পর্যন্ত মজা লাগলেও কতদিন মজার পর্যায়ে থাকবে বুঝতে পারছি না। পড়ালেখা করতে একেবারেই ইচ্ছা না থাকলে বিয়েশাদির চিন্তা শুরু করে দিক। মামা মামীকে বললেই হয়। ছেলে দেখতে শুরু করে দিবে। সবাইকে দিয়ে যে পড়াশুনা হয় না, এ’কথা একদম ঠিক। কিন্তু ছেলেদের সাথে এসব ঠাট্টা তামাশা করতে করতে পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে বলতে পারে?

আবার মাঝে মাঝে নিজের দিকেও তাকাই। সুরমা যা বলছে আমার সম্পর্কে, তা তো একেবারে মিথ্যেও নয়! অল্পবয়সেই কেমন আন্টি হয়ে গেছি আমি! আমার বয়সী ছেলেরাও তো আমাকে দেখে সালাম দিয়ে বসবে। ‘স্লামালাইকুম আন্টি! ভালো আছেন? আপনার কাছে একটা নোট চাইতে এসেছিলাম। আপনার কি একটু সময় হবে কথা বলার?’

 

মনে মনে হাসি। আবার এটাও মাঝে মাঝে চিন্তা করি, এই যে গল্প আড্ডা হাসি তামাশা চলছে এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু পা হড়কানোর সুযোগ নেই আমার।

পড়াশুনাতে গাফলতি করলে আজীবন নিজেই পস্তাবো। কারণ আমার জীবনটা তো আর দশটা মেয়ের জীবনের মতো নয়! মামা-মামী নানী যতই করুক, তারা কি আর মা-বাবার মতো আজীবন পাশে থাকবে? যার মা-বাবা বেঁচে নেই, তার জীবনটা আর সবার চেয়ে অন্যরকম। আর যার মা-বাবা বেঁচে থেকেও নেই তার জীবনটা আরো অন্যরকম।

আমি কি চাইলেই আমার জীবনটাকে নিয়ে আরেকবার দাবার ছক সাজাতে পারবো?

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত