| 26 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১২)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সুরমা একদিন কলেজের গ্যাপে আমার সাথে দেখা করলো।

ও কমার্স নিয়েছে, আমি সায়েন্স। দুজনেই একই কলেজে ভর্তি হয়েছি। জেলা শহরের নামকরা কলেজ। আকার আকৃতিতে বেশ বড়। সায়েন্স ফ্যাকাল্টি একদিকে, কমার্স আর আর্টস ফ্যাকাল্টি পুরো উল্টাদিকে। দুজনেরই প্রায় সারাদিন ক্লাস থাকে। আমার প্র্যাক্টিকাল থাকে বিকেলে। আর সকালবেলার পুরোটা ক্লাসেই কেটে যায়।

সুরমা বলে, ওদেরও নাকি চিড়াচ্যাপ্টা রুটিং। দম ফেলারও ফুরসত নেই।

রুটিং টাইট হতে পারে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সুরমা সারাদিন মন দিয়ে ক্লাসে বসে থাকবে, এইটা কেন যেন আমার ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। কী করতে পারে, সেটাও অল্পবিস্তর আন্দাজ করতে পারি। সকালবেলা দুজনে তো একসাথে আসি। রিক্সায় বসে দুনিয়ার আলটপকা গল্প শোনায় সুরমা। ছোট জেলা শহরটা সকালবেলাতে তখন সবে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। দুজন তরুণীর যৌবনবেলার গল্প শুনতে শহরটারও নিশ্চয়ই ভালো লাগে খুব।

 

আমি হাসিমুখে সুরমার বকবকানি হজম করি। ইদানিং অবাক হয়ে লক্ষ করছি, ওর গল্পগুলো বেশ টানছে আমাকে। কোন চৌধুরীপাড়ার শেখ আব্দুর রহিমের মেজ ছেলের কী কারণে ঠ্যাঙানি খাওয়া দরকার, সেই গুরুতর রহস্যের গল্প শুনতে আজকাল বেশ ভালো লাগছে আমার। নিজেও মাঝে মাঝে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে গল্পে গতি ধরে রাখছি। অবশ্য আমি কিছু না বললেও কিছুমাত্র অসুবিধা নেই। সুরমার গল্পের ইঞ্জিন কখনো বন্ধ হয় না। সেখানে চব্বিশঘন্টা মোবিল পেট্রোল কে ভরে রাখে আল্লাহ মালুম।

দুজনের আবার দেখা হয় সেই এক্কেবারে বিকেলে। মাঝখানে কেউ কারো মুখ দেখার সময় পাই না। লেডিস কমনরুমে অন্তত দু’একবার তো ঢুঁ মারতেই হয়! বাথরুমে যেতে হয়। সেখানেও সুরমার টিকির সন্ধানও পাই না। ওদের ক্লাসের দু’একজন মেয়েকে মুখে চিনি। কিন্তু তাদের সাথে আলাপ হয়নি কখনো। তাই ‘সুরমা কোথায়’ এটা জিজ্ঞেস করতে কেমন যেন বাঁধো বাঁধো ঠেকে।

 

বিকেলে রিক্সায় উঠে সুরমাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করি, ‘কীরে কী করলি সারাদিন?’

সুরমার চটপট উত্তর, ‘কলেজে তো ফুচকা বিক্রি হয়। তেলেভাজা, ঘিয়ের রাবড়ি, ছোলামুড়ি…কত কী পাওয়া যায় দেখিসনি? সারাদিন মজা করে খেলাম। তুই কী করলিরে?’

আমি এই উত্তরে প্রথমটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। সে কী কথা? কলেজে এসব কবে থেকে বিক্রি করা শুরু করলো? দেখিনি তো! আর সুরমা সারাদিন ধরে এসব খেয়েই পার করে দিচ্ছে…কী বলছে এসব?


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১১)

পরক্ষণেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে এক নিমেষে সত্যিটা বুঝতে পারি। মজা করছে ছেমড়ি! আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে হাসতে সুরমা বলে, ‘কী রে গাধী! কিছুই মাথায় ঢুকে না তাই না? এখন কি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলি যে, এসব কোথায় পাওয়া যায়! তুইও খাবি তাইলে…তাই না? বেশি পড়লে না এমন গাধীই হতে হয়। এজন্যই তো আমি বেশি পড়ালেখা করে মাথাটাকে জ্যাম করে ফেলছি না। ভবিষ্যতে কত গুরুতর সব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে! এখনই জ্যাম বেঁধে বসে থাকলে হবে?’

আমি কথার মারপ্যাঁচে খাবি খেতে খেতে বলি, ‘আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম! এবার বল…সারাদিন কী কী করিস কলেজে? খবরদার…মজা করবি না। সবসময় মজা ভাল্লাগে না!’

‘আরে আজব! কী করবো আবার? যে কাজে এসেছি সেই কাজই করছি! ক্লাস করছি সারাদিন!’

আমি মুখ ভেটকে বললাম, ‘তুই সারাদিন ক্লাস করিস…এটা কেন যেন ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না!’

সুরমা এবারে সিরিয়াস মুখ বানিয়ে বলে, ‘আয়নাতে সারাদিনে একবার নিজের মুখ দেখার সময় পাই না। বাথরুমে যাওয়ার ব্রেক পাই না! খালি ক্লাস আর ক্লাস। মনে করছিলাম, কমার্সে আসছি হয়ত ঘুমায়ে ঘুমায়ে ক্লাস টাইম পার করতে পারবো। কীসের কী! এত অংকের প্যাঁচে পড়বো কে জানতো? আবেদা জোবেদার সূত্র বুঝতে বুঝতে জান পেরেশান হয়ে গেল! আর তুই বলিস ক্লাস করি সেটা মনে হয় না! আমার ক্লাসগুলো তুই করে দে তাইলে…আমি শুয়ে বসে দিন পার করি!’

আমিও নাছোড়বান্দার মতো সুরমাকে জ্বালাতে চাইলাম। ভ্রু উঁচিয়ে বললাম, ‘হুউউম…আমি ক্লাস করে দিলে কি আর তুই শুয়ে বসে থাকবি! কত রোমিও ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে… জুলিয়েটের খোঁজে পাগলপারা হয়ে! তুই কি তাদের দিকে এতদিন না তাকিয়ে বসে আছিস?’

 

সুরমা নড়েচড়ে বসে আমার কথায়।

যেন এতক্ষণে একটা কথা বলার টপিক পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে বলে, ‘এই তো! এতক্ষণে তুই আমার মনের মতো একটা কথা বলছিস! আহা! আশেপাশে কত সব হ্যাণ্ডসাম ছেলেছোকরা রে! আমাদের এই শহরের ছেলেগুলা কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে। আচ্ছা তোর কেমন ছেলে পছন্দ বলতো? আমার বেশি ভালো লাগে লম্বা ছেলে। তবে ছেলেদের গায়ের ফর্সা রঙটা কিন্তু এক্কেরে ভালো লাগে না আমার। কেমন যেন গলাছিলা মুরগির মতো লাগে দেখতে! ছেলেদের গায়ের রঙ হবে শ্যামলা।

মাথায় থাকবে উস্কোখুস্কো চুল। সেই চুলে চিরুনি দেওয়া নিষেধ! উঁহু আমি কিন্তু আমার বরের মাথায় চিরুনি দিতে দিব না। এই চুক্তি আগেভাগেই করে নিতে হবে। তিনি যদি আমার সাথে এক হাঁড়ি চুক্তি করে নিতে পারেন…তাহলে আমি করবো না কেন? তো যাই হোক যা বলছিলাম, আর চোখগুলাই হচ্ছে ছেলেদের আসল এ্যাসেট বুঝলি? এরা মনে করে যে, মেয়েদের চোখই খালি সুন্দর হতে হয়। এটা একেবারে ভুল ধারণা! মেয়েদের তো সবকিছুই এ্যাসেট…না না…হাসির কথা না! একটা সুন্দর মেয়ের মুখের সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে ভালো লাগবে দেখিস। কিন্তু ছেলেদের সুন্দর হতে হয় চোখ! কথাবলা চোখ! এই কথাবলা চোখ যার আছে, তার আর অন্যকিছু না থাকলেও নো প্রব্লেম। তবে হাইটটা কম না হলেই ভালো হয়।

 

সবকিছু মিলিয়ে বুঝলি, আমাদের সেকশনের বল্টুটা খারাপ ছিল না। হাইট মেরেকেটে পাঁচ ফুট দশ। মাথার চুলগুলোও বেশ উস্কোখুস্কো। আমি তো এইটুকু দেখেই পটে গেছিলাম। কিন্তু যেই না চোখ থেকে চশমাটা খুললো খাইলাম একটা টাশকি! বিড়ালের মতো কুতকুতে চোখ। দেখেই মনে হয়…এখনই মিউ করে একটা ডাক ছাড়বে! স্বপনটা আবার এদিক দিয়ে খাসা ছিল বুঝলি? কিন্তু ব্যাটা এক্কেরে বাঁইটা! এইটার সাথে ঘুরতে বের হইলে হিল পরতে পারবো না! এত টাইট চয়েজ থাকলে কীভাবে হবে? তবে আরো কয়েকটাকে…’

 

আমি হাই তুলতে তুলতে এই ফিরিস্তি শুনতে থাকি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমার কাছে কিন্তু খারাপ লাগে না। এক সময় আমিও নানারকম যোগ বিয়োগ শুরু করে দিই মনে মনে। যখন হিসাবটা বেশ শক্তভাবে মাথার মধ্যে গেঁথে বসে, তখনই ইলেক্ট্রিক শক খাই। সুরমার সাথে থেকে থেকে আমিও কি শেষমেষ ছেলেদের ব্যবচ্ছেদ শুরু করে দিব নাকি? এ তো দেখছি মহাবিপদ!

 

কী যেন বলছিলাম! ওহ হ্যাঁ… মনে পড়েছে! বলছিলাম সুরমা একদিন ক্লাসের গ্যাপে আমার সাথে দেখা করতে এলো। আমি বসে ছিলাম আমাদের ফিজিক্সের গ্যালারি রুমটাতে। বাসা থেকে বড়মামী পাটিসাপটা পিঠা বানিয়ে দিয়েছিল। সেটাই বসে বসে খাচ্ছিলাম। নেক্সট ক্লাসটা পাশের বিল্ডিংএই। তাই আর হেঁটে হেঁটে অতদূরে কমনরুমে গেলাম না।

হঠাৎ দেখি সুড়ুত করে সুরমার মুখটা যেন উঁকি দিচ্ছে। আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। সুরমা তো আমার ক্লাসে কখনো আসেনি আগে! ওকেই কি দেখলাম? চোখ কচলে নিয়ে আরেকবার তাকিয়ে দেখি, হ্যাঁ তিনিই! আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। চোখেমুখে প্রশ্ন তুলে যেন জানতে চাইলো, ‘কী রে দিছি না চমকায়ে!’

 

আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, ‘কীরে তুই তোর মহামূল্যবান হিসাবনিকাশ বাদ দিয়ে আমার ক্লাসে এসেছিস কেন?’

সুরমা আমার প্রশ্নের দিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ না দিয়ে সামনে ইশারা করে বললো, ‘তোদের ক্লাসের…এই বস্তু?’

আমার মতো আরো অনেকেই ফিজিক্স ক্লাসরুমে বসে এটা ওটা করছিল। পরের ক্লাসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সবাই। আমি সুরমার ইশারামাফিক তাকিয়ে দেখি, ও আমাদের ক্লাসের সুমনের দিকে ইঙ্গিত করছে। গোবেচারা গোছের ভালো ছাত্র সুমন। তবে দেখতে শুনতে দারুণ স্মার্ট। আমি ঝট করে সুমনার পরিসংখ্যানটা মিলিয়ে নিতে গিয়ে দেখি…আরিব্বাস! এক্কেবারে মিলে গেছে খাপে খাপ!’

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত