Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya separation-last-part

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১৫)

Reading Time: 5 minutes

নয়ন সেদিনের পর থেকেই আমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে।

সারাদিন তো দেখাই হয় না আমাদের। আমি আমার ক্লাস কলেজ এসব নিয়ে পড়ে থাকি। গতমাস থেকে দুজন স্যারের কাছে ব্যাচে প্রাইভেট পড়ছি। নয়ন থাকে স্কুলে। স্কুল থেকে ফিরে পাড়ার মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলায় মেতে থাকে। আমি কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখি, নয়ন মাঠে খেলাধুলা করছে। রাতেই যা একটু সময় হয় দুই ভাই-বোনের দেখা সাক্ষাতের। কিন্তু সেই সময়টুকুও ফুরুৎ করে ফুরিয়ে যায়। পড়াশুনা, খাওয়া দাওয়া, ঘুমানোর প্রস্তুতি…এসব করতে করতেই রাত কাবার।

নয়ন আর সুজন আমাদের পাশের ঘরটাতেই থাকে। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথেই দুজন শব্দ করে পড়তে থাকে। ওদের মিলিত কণ্ঠস্বরে মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যায়। নয়ন এবার ক্লাস সিক্সে, সুজন এইটে। দুজনেই ভীষণ শব্দ করে পড়ে। বড়মামা এই সময়টা আমাদের আর ওদের ঘর সংলগ্ন বারান্দাতে হাঁটাহাঁটি করে। দুজনের কেউ পড়া থামিয়ে একটু লম্বা সময় বসে থাকলেই বড়মামা গলা খাঁকারি দেয়। বিষয়টাতে খুব মজা লাগে আমার।

এখানে আসার পর প্রথমদিকে বড়মামার গলা খাঁকারি প্রায়ই শোনা যেত। সুজনের তারস্বরের আওয়াজ শোনা যেত। ‘এ্যা…তারপর ছাত্রজীবনে অধ্যাবসায়ের গুরুত্ব অসীম…এ্যা…ছাত্রজীবন হলো ভবিষ্যত রচনার অনুশীলনক্ষেত্র…এ্যা…’

নয়ন পড়তো আস্তে আস্তে। তাও বা যেটুকু শব্দ হতো, সুজনের তারস্বরের চিৎকারের কাছে তা ছুটে পালিয়েছিল।

বড়মামা একদিন নয়নকে ডেকে বুঝিয়ে বললেন, ‘অল্পবয়সে শব্দ করে পড়তে হয়, বুঝলিরে ব্যাটা! তাহলে পড়া মনে থাকে। পাঠেও আনন্দ লাগে। একদিন জোরে জোরে পড়ে দ্যাখ। দেখবি পড়ালেখায় কত আনন্দ!’

যুক্তি যেমনই হোক, কিন্তু নয়নের খুব মনে ধরে গেল। সে কী বুঝলো কে জানে, সেদিনের পর থেকে দুজনের সম্মিলিত আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়।বড়মামার হাঁটাহাঁটিও আস্তে আস্তে কমে এসেছে। চোর চুরি না করলে আর পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন কীসে?

আমি শব্দ না করে নয়নদের ঘরের দিকে রওয়ানা দিলাম। বেশকিছুদিন ধরে আমার পড়ালেখায় খুব ক্ষতি হচ্ছে। একেবারেই মন বসাতে পারছি না পড়াশুনায়। এমন চলতে থাকলে সেকেণ্ড ইয়ার ফাইনালে খুব খারাপ করবো। ধীরে ধীরে স্বপ্নের নাগাল থেকে অনেকটা দূরে পিছিয়ে পড়বো। সবই বুঝতে পারি…তবু কেন যে মন লাগাতে পারি না পড়াশুনায়! বারে বারে সেদিন সন্ধাবেলার ঘটনাটা মনে পড়ে। ছোটমামীর উচ্চকিত ইঙ্গিত…নয়ন আর সুজনের বেপরোয়াপনা…নয়নের কিছু একটা লুকাতে চাওয়ার মানসিকতা, সবকিছু মিলিয়ে কিছুই ভালো লাগছে না আজকাল।

নয়নের কতই বা বয়স! এই বয়সে এমন লুকোচুরি তো স্বাভাবিক কিছুকে ইঙ্গিত করছে না! তাহলে কি ছোটমামী যা বলছে তাই ঠিক? নয়ন আসার পরেই সুজনের মধ্যে বেপরোয়াপনা দেখা দিয়েছে? কিন্তু নয়ন এত চালাকচতুর ধূর্ত প্রকৃতির ছেলে হয়ে উঠলো কবে?কই…আমি তো কোনোদিন কিছু টের পেলাম না!

উত্তরগুলো জানার জন্য ছটফট করে মরছিলাম আমি। কিন্তু সবার সামনে ওকে ধরা যাবে না। ধরতে হবে সকলের অগোচরে। সবার সামনে ধরলে ও কিছু তো বলবেই না, উলটো আমাকে আরো এড়িয়ে চলতে শুরু করবে।

ঘর থেকে বেরুবার আগে একবার চারপাশে তাকালাম। সুনেত্রা মন দিয়ে কী যেন আঁকছে। সম্ভবত প্রাক্টিকালের ছবি আঁকছে। সুনেত্রা পড়াশুনায় খুব মনোযোগী। কারো সাথে তেমন বেশি একটা কথাবার্তা বলে না। স্কুল থেকে বাসা…বাসা থেকে স্কুল এটুকুই ওর সীমানা। বিকেলে ছাদে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখি কিছুক্ষণ। দেখা হলে মিষ্টি করে একটা হাসি দেয়।

তবে এমনিতে কথাবার্তা তেমন একটা না বললে সুনেত্রার স্বভাবটা খুব পরোপকারী ধরনের। একবার ওর কাছে ছোট একটা স্কেল চেয়েছিলাম। কী একটা কাজে যেন দরকার পড়েছিল। সুনেত্রা তন্নতন্ন করে সব জায়গাতে খুঁজে যখন কোনো ছোট স্কেল পেল না, নিজে উঠে গিয়ে মোড়ের দোকান থেকে আমাকে কিনে এনে দিল। আমার বারবার করা নিষেধেও কোনো কাজ হয়নি।

সুনেত্রার পাশেই সুরমা বসে আছে। চোখের সামনে একটা বই ধরে রাখা, বইয়ের নীচে মোবাইল। মন দিয়ে মোবাইলের ভেতরে কী যেন দেখছে। দিনদুনিয়ার খবর নাই এই মুহূর্তে। সম্ভবত ফেসবুকে ঢুকেছে। মনে মনে ভাবলাম, যার যা কাজ! করুক যা খুশি! আমার তাতে কী? যার জীবন তাকেই সামলাতে হয়। অন্য কেউ এসে সামলিয়ে দিতে পারে না। আমি এখন আমার ভাইয়ের জীবনে কী ঘটছে সেটা দেখি গিয়ে।

নয়ন আর সুজন জোরে জোরে পড়ছে। আমি ওদের ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই দুজন মুখ তুলে আমাকে দেখলো। নয়নের মুখচোখে একটা অপ্রস্তুত ভাব। সুজন অনেকটা ভাবলেশহীন। আমি কোনোকিছুকেই পাত্তা না দিয়ে হাসিমুখে বললাম, ‘কীরে দুজনে তো একেবারে মেইল গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছিস! কী পড়ছিস রে নয়ন? আগে তো আমার কাছে পড়া বুঝতে আসতি। এখন দেখি কিছুই আর জিজ্ঞেস করিস না!’

নয়ন কিছু বললো না। সুজন একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো, ‘নীরাপা, তুমি জানো নয়ন আজকে স্কুলে একটা ছেলের সাথে মারামারি করেছে। হেডমাস্টার স্যার খুব রাগ করেছিল আজকে। নয়নকে একটা ক্লাসে ক্লাসরুমে ঢুকতে দেয়নি। পুরো সময় স্কুলের বারান্দায় নীল ডাউন করে রেখেছিল।’

আমি ভেতরে ভেতরে চমকালাম। নয়ন বরাবরই শান্তশিষ্ট গোছের ছেলে। স্কুলে এর আগে কখনো মারামারি করেছে বলে কানে আসেনি। আচমকা কী এত পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে ওর জীবনে! আমি কি জানতে খুব বেশি সময় নিয়ে নিচ্ছি?

ভেতর কী ঘটছে, মুখে সেটা বুঝতে দিলাম না। স্বাভাবিক গলায় নয়নকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে রে নয়ন? মারামারি করতে গেলি কেন? কিছু হয়েছে কারো সাথে?’

নয়ন চুপ। মুখটা কেমন যেন থমথম করছে। আমি অবাক চোখে আমার সদ্য অচেনা হয়ে ওঠা ছোটভাইটাকে দেখছি। নয়ন মাথা নিচু করে বসে আছে। সুজন হাতের কনুই দিয়ে ওকে ঠেলতে লাগলো। ‘এ্যাই বল…কী হয়েছে বল নীরাপাকে!’

নয়নের মুখে এখনো কথা নেই। শেষমেষ সুজনই বলে দিলো, ‘নীরাপা আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে না নয়নকে খুব পচা কথা বলেছে!’

আমি ‘যেন কিছুই হয়নি’ এমন ভঙ্গিতে বললাম, ‘তাই নাকি? কী পচা কথা বলেছে শুনি?’

‘বলেছে… তোর মা অন্য একটা লোকের হাত ধরে বের হয়ে গেছে। তোর মা বে…বে…’ সুজন চুপ করে গেল। আর কিছু বলতে পারলো না। শব্দটাও শেষ করতে পারলো না। কিন্তু সেই শব্দের শেষ অক্ষরগুলোকে জুড়ে দিতে আমার একটুও অসুবিধা হলো না।


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১৪)

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। নয়নের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমার ইচ্ছে করছে এক ছুটে এই ঘর থেকে বের হয়ে যাই। পারলাম না বেরুতে। পা দুটো যেন মেঝের সাথে আটকে গেছে। আমার ইচ্ছের চরম বিরোধিতা করে তারা সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।

আমি কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে সুজনকে বললাম, ‘সুজন…আমি একটু নয়নের সাথে কথা বলবো। তুই কিছুক্ষণের জন্য একটু বাইরে যাবি? বড়মামা কিছু বললে আমার কথা বলিস।’

সুজন সাথে সাথে বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার আগে বুদ্ধিমানের মতো দরজাটাও ভিজিয়ে দিয়ে গেল।

আমি একটা চেয়ার নিয়ে নয়নের কাছাকাছি বসলাম। দীর্ঘদিন পরে ভাইটার এত কাছে এলাম আমি। আগের মতো সস্নেহে ওর চুলে আঙুল চালালাম। নয়ন একটু জড়সড় হয়ে সরে গেল। আগের মতো যেন সহজ হতে পারছে না। এটুকু সময়ের ব্যবধানেই ভাইটা আমার অনেক বড় হয়ে গেছে।

আমি কোমল গলায় বললাম, ‘তুই ছেলেটার সাথে মারামারি করতে গেলি কেন? আজেবাজে কথা বলেছে তাতে কী হয়েছে? আমরাও তো মা-বাবার সাথে রাগ করে বাসা থেকে চলে এসেছি। এখন কে তাদের নিয়ে কী বললো, তাতে কী আর এসে যায়?’ মুখে বললাম বটে…কিন্তু নিজেও জানি এসব ছেলেভুলানো কথা বৈ ভিন্ন কিছু নয়। কিছুই যদি না আসবে যাবে তাহলে সুরমার সাথে কেন এখনো সহজ হতে পারছি না আমি?

নয়ন ক্ষুব্ধ গলায় বললো, ‘আমি কি কাউকে কিছু বলতে গেছি? অন্য ক্লাসের ছেলে এসে কেন আমাকে এভাবে খারাপ কথা শুনিয়ে যাবে? হেডমাস্টার স্যার কিছুই শুনলো না! শুধু আমাকে শাস্তি দিলো! আমিই নাকি প্রথমে মেরেছি! কেন মেরেছি সেটা শুনবে না?’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে নয়ন হাঁপাতে লাগলো।

আমি কিছুক্ষণ সময় দিলাম ওকে শান্ত হওয়ার জন্য। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু বড় ক্লাসের ছেলে এসব কথা জানলো কেমন করে?’

‘তা আমি কীভাবে জানবো? সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। নীরাপা আমার আর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না! আমি আর স্কুলে যাবো না!’

‘দূর বোকা! কে কী বললো সেজন্য তুই কেন নিজের পায়ে কুড়াল মারবি? পড়াশুনা না করলে আমরা দুজন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো বল দেখি? মামা মামী নানী সবাই কি আজীবন আমাদের দেখে যেতে পারবে? তুই এমন কথা আর কক্ষনো বলবি না!’

নয়ন কিছু বললো না। কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কেন যেন ভরসা হলো না আমার। মনে মনে ভাবতে বসলাম, স্কুলে এসব কথা রাষ্ট্র হলো কেমন করে? অন্য ছেলেপেলেরাও যদি এসব কথা নিয়ে মেতে যায়, তাহলে তো সত্যিই ঝামেলা হয়ে যাবে!

মনে মনে ঠিক করলাম, বিষয়টা বড়মামাকে জানাতে হবে। স্কুলের টিচারদের সাথে কথা বলে হলেও কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে নয়ন যদি একেবারে বেঁকে বসে… খুব মুশকিল হয়ে যাবে!

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>