| 26 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২০)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

আমার ক্লাস শুরু হতে এখনো বেশ কিছুদিন বাকি।

অনেকদিন পরে কিছুটা উদ্বেগবিহীন অবস্থায় সময় কাটছে। কলেজে ঢোকার পর থেকেই আর সামনে পেছনে তাকাইনি। বই আর আমার চশমা আঁটা দুই চোখের মাঝখানে অন্য কোনোকিছুকেই আসতে দিইনি।

মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এই চশমা নিয়ে ছোটমামা নানারকম মজা করছে। ‘এ্যাই নীরা…তুই তো আগে থেকেই একখানা চশমা বাগিয়ে নিয়েছিস রে! এখন মেডিক্যালে পড়তে গিয়ে তোর এই চশমার পাওয়ার কোথায় গিয়ে ঠেকবে ভাবতে পেরেছিস? আমি তো তোর ভবিষ্যত চেহারা চিন্তা করতেই ভয় পাচ্ছি! আমার দুইজন আঁতেল বন্ধু ডাক্তার হইছে। ওদের কাছে গল্প শুনছি, প্রফ না ফ্রফ কী একটা নাকি দিতে হয়। সেটার আগের দিন সবাই মগে মগে পানি ঢালে মাথায়। কী সর্বনাশ! আচ্ছা তুই আমাকে বল, এমন জায়গায় পড়ার কী দরকার বাপু? সুস্থ মানুষ কি এমনি এমনি মাথায় পানি ঢালে?’

আমি হাসতে হাসতে বলেছি, ‘ছোটমামা, মগে মগে পানি ঢালাটাও ডাক্তারি পড়ার অপরিহার্য বিষয়। ওটা তুমি বুঝবে না, বাদ দাও!’

হঠাৎ করে পড়ালেখা থেকে সাময়িক লম্বা একটা বিরতি পেয়ে কেমন জানি শূন্য শূন্য লাগছে। মনে হচ্ছে কী নাই…কী যেন নাই! এখন আমি কী করি? কী ভীষণ একটা হতাশা পেয়ে বসলো! প্রথম কিছুদিন গল্পের বই নিয়ে বসতে চেষ্টা করলাম। সুনেত্রা দেখি মাঝে মাঝে পড়ালেখা থেকে বিরতি নিয়ে ইয়া মোটা মোটা কী সব বই পড়ে। জিজ্ঞেস করতে বললো, গল্পের বই। ওর কাছ থেকে চিকন সাইজের দুইটা বই নিলাম। খুব মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে একপাশে রেখে দিলাম।

গল্পের বই পড়ার তেমন একটা অভ্যাস আমার কোনোকালেই ছিল না। স্বাভাবিক কোনো পরিবারে জন্ম নিলে হয়ত আমিও গল্পের বইয়ের পোকা হতাম। পড়ার বইয়ের নীচে লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তাম। রাত জেগে প্রেমের উপন্যাস পড়ে আকুল নয়নে কেঁদে ভাসাতাম।

কিন্তু সেসবের কিছুই হয়নি। দিনরাত খিটখিট খিটখিট লেগে থাকা পরিবারে গল্পের বইয়ের বিলাসিতাকে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে আমার। কে জানে হয়ত একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে! মিথ্যে গল্পের সাজানো বাসরে আমার সম্ভাবনাগুলোকে জলাঞ্জলী দিইনি আমি।

সময় কাটানোর জন্য আর কোনো উপাদানও খুঁজে পাচ্ছি না। প্রত্যেকেই যার যার মতো ব্যস্ত। সুরমাও আজকাল তেমন একটা আমার কাছাকাছি ভেড়ে না। আমি এর কারণ বের করতে যাই না। হয়ত কোনো কারণে একটা দূরত্ব বজায় রাখছে। এইচএসসির রেজাল্টের পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে আমাদের দুজনকে তুলনার দাঁড়িপাল্লায় দাঁড় করিয়ে বহুত ওজন করা হয়েছে। যে যখন যেভাবে পেরেছে, ওজন করে নিয়েছে। সুরমার দিকে বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে সপ্রশংস চোখে তাকিয়েছে। সেইসব অপমানের তেজ সুরমার গায়ে জ্বালা ধরাবে না, এতটা আশা করা হয়ত বোকামি।


 আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১৯)


সুমনের কথাটা মাথায় ছিল না। কেন সেদিন ফোনে ওমন করে দেখা করতে চাইলো, এটা সাময়িক একটু কুটকুট করছিল মাথার মধ্যে। পরে এটা সেটা করার ফাঁকে ভুলে গেছি।

গল্পের বইগুলোকে একপাশে সরিয়ে রেখেই ভাবলাম, কী জন্য ওভাবে বলছিল…একটু দেখা করে জেনেই আসি। যদিও বিপদের গন্ধও পাচ্ছিলাম ষোলআনা। আমার এভাবে সুমনের সাথে দেখা করতে যাওয়াটা সুরমা যদি পছন্দ না করে! যদিও আমি বলেকয়ে যাবো না, তবু যদি কোনোভাবে জানতে পেরে যায়! কেন একা একা ওর ফিয়ান্সের সাথে দেখা করতে গেলাম, এই নিয়ে যদি কৈফিয়ত তলব করে বসে?

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই রেডি হলাম। ওভাবে বললো যখন, না গিয়ে উপায় নেই। বোঝাই যাচ্ছে, সুরমা আবার কিছু একটা ঘোঁট পাকিয়েছে এবং প্রেমের ঘটক হিসেবে সেটা আমাকেই মিটমাট করে আসতে হবে। সুখে থাকতে কেন যে ভূতে কিলাতে গিয়েছিল আমাকে!

অসময়ে আমাকে বাইরের জামা পরতে দেখে সুরমাই প্রশ্নটা করলো, ‘কীরে এই সময় কোথায় যাচ্ছিস?’

আমি মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেলাম। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। তবু মনের ভাবকে যথাসম্ভব চেপে রেখে বললাম, ‘টুকটাক কিছু কেনাকাটা আছে। যাই একটু ঘুরে আসি। তোর কিছু লাগবে?’

সুরমা চোখ ঘুরিয়ে আমাকে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর আগের সেই রসিকতার সুর গলায় ঢেলে বললো, ‘তুই দেখি আজকাল মার্কেটেও যাওয়া আসা করিস! বাহ! ধীরে ধীরে কিন্তু বেশ উন্নতি হচ্ছে তোর! এভাবেই লেগে থাক।’ বলেই অকারণে একটা চোখ মেরে দিলো। আমি শান্তমুখে টিপ্পনী হজম করলাম।

বাসার বাইরে গিয়ে একটা রিক্সা নিলাম। চমৎকার আবহাওয়া বাইরে। শরতের মেঘমুক্ত আকাশ। হাল্কা একটা বাতাস বইছে। বাতাসে মন কেমন করা সুবাস। আমার মনটাও অকারণেই উদাস হয়ে গেল।

সুরমার সাথে একসাথে কলেজে যাওয়ার সেই দিনগুলো মনে পড়ে গেল। রিক্সার হুড খুলে এলোমেলো বাতাসে চুল আর ওড়না উড়িয়ে দুজনে গল্প করতাম। পাশ দিয়ে পার হওয়া রিক্সা থেকে সতর্কবাণী ভেসে আসতো, ‘এ্যাই এ্যাই আপারা…ওড়না সামলান! চাকায় বেঁধে যাবে দ্যাখেন!’ সুরমা মুখ ঝামটানি দিয়ে বলতো, ‘ওড়না আমাদের…চিন্তাও আমাদের। আমাদের ওপরে ছাইড়া দ্যান ভাই!’

হেঁটে যাওয়া পথচারীরা অবাক মুগ্ধতায় আমাদের দুজনকে দেখতে দেখতে যেত। কেউ বা পেছন ফিরেও তাকিয়ে থাকতো। সুরমা তাদের দিকে তাকিয়ে হয় ফিক করে একটা হাসি দিতো নয়তো দুম করে চোখ মেরে দিতো। যারা দেখতো, তাদের তো তখন খাবি খাওয়ার জোগাড়! কতদিন নিষেধ করেছি ওমন না করতে। সুমনা শুনলে তো! বলতো, ‘আহা! এত মন দিয়ে আমাদের দেখছে, একটু অভিবাদন জানাবো না?’

দুজন তরুণীকে গল্পরত অবস্থায় দেখাটাও বুঝি অন্যরকম এক আনন্দের বিষয়! অবশ্য আমার চেয়ে সুরমাই ছিল বেশিরভাগের লক্ষ্যবস্তু। হাত পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে সুরমার সেই ননস্টপ বকবকানি! আমি বিরক্ত হতে হতে মুগ্ধ হয়ে যেতাম।

মনে হতো, আমি কেন এত মজা করে গল্প করতে জানি না! এত রসিয়ে রসিয়ে গল্পের আঁশ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে তাতে নুন ঝাল মশলা মেশাতে পারি না। ওর কত ভক্ত! সবাই কত মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শোনে! অথচ আমি কেমন জানি নিরামিষ! এত রসকষহীন মানুষকে কি কেউ পছন্দ করে?

এই অল্প সময়েই অনেক কিছু বদলে গেল। আজকে আমার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সুরমা ঐ কথাগুলো কী মনে করে বললো কে জানে! ও কি বোঝাতে চাইছে, এক মাঘে শীত যায় না? এখন খুব তারিফ কুড়াচ্ছো তো? কুড়াও… আমারও দিন আসবে দেখো!

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই। সুরমার মজা করার প্রবণতাটাকে আগে যতটা ভালো লাগতো, এখন ঠিক ততটাই বিরক্ত লাগে। জানি না কেন!

পথে যেতে যেতে সুমনকে ফোন দিলাম। ‘হ্যালো সুমন…আমি তোমাকে না জানিয়েই বের হয়ে গেলাম। তুমি কি এখন দেখা করতে পারবে?’

সুমন উত্তর দিতে এক সেকেন্ড সময়ও নিলো না। ‘নিশ্চয়ই পারবো, তুমি কোথায় আছো? কোথায় দেখা করতে চাও বলো?’

আমি এই শহরের তেমন বেশি জায়গা চিনি না। তাই বেশি ভাবনাচিন্তা না করেই বললাম, ‘আমাদের কলেজেই এসো।’

‘দশ মিনিটের মধ্যে আসছি!’

ছোট জেলা শহরগুলোতে এখনো ট্রাফিক জ্যামের উপদ্রব কম। আমরা কুড়ি মিনিট পরে কলেজের ক্যাফেটেরিয়ায় মুখোমুখি হলাম।

সুমনকে দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। এই ছেলেটাই দেড় বছর আগে আমাদের কলেজের নাটকে হিরোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিল… সেটা কে বলবে এখন? কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টি! মোটেও ভালো লাগলো না আমার। কথা বলার সময় দেখলাম চোখের দৃষ্টি কেমন অস্থিরভাবে ওঠানামা করছে। খাবারের অর্ডার দিতে যখন বয়কে ডাকলো, আমি অবাক হয়ে দেখলাম, কণ্ঠস্বরও একই উচ্চতায় অবস্থান করছে না। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খাবে? লাচ্ছি অর্ডার করি? নাকি কফি খাবে?’

আমার খুব খারাপ লাগছিল সুমনকে দেখে। বিষণ্ন মুখে বললাম, ‘একটা কিছু দিলেই হবে সুমন। তুমি অস্থির হইও না।’

দু’গ্লাস লাচ্ছির কথা বলে সুমন হঠাৎই কথা খুঁজে না পেয়ে একেবারে চুপ হয়ে গেল। আমিও ওর অবস্থা দেখে কিছু বলতে পারছিলাম না। একসময় নীরবতা ভেঙে আমিই জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুমন…তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?’

সুমন হাসলো। কেমন যেন বিকৃত দেখালো সেই হাসিমুখ। আমি অবাক চোখে সুমনের এই রূপান্তর দেখছি আর মনের মধ্যে যোগ বিয়োগ মিলিয়ে চলেছি। সুমন বললো, ‘কেন সুরমা তোমাকে কিছুই বলে না? তোমরা দুজন তো খুব ক্লোজ ছিলে!’

‘কী বলবে? কই…কিছুই তো বলেনি আমাকে!’

সুমন ভাঙা গলায় বললো, ‘সুরমা ইদানিং আমাকে এভোয়েড করছে নীরা। ইদানিং না…বেশ আগে থেকেই। এইচএসসি পরীক্ষার আগে প্রতিদিন কথা হতো আমাদের। ওকে রোজ সন্ধাবেলা ফোন না দিলে আমি পড়তে বসতে পারতাম না। পরীক্ষার পর থেকেই ও কেমন জানি অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করলো। নিজে থেকে ফোন তো দিতোই না, আমি দিলেও কথা বলতে চাইতো না। কেমন যেন মুখ ঝাংটানি দিয়ে কথা বলতো। বারে বারে ফোন দিই কেন…এমন কথা বলতো। আমি আর পারছিলাম না। ওর সাথে দেখা করতে চেয়েছি কতদিন! অনেক অনুনয় বিনয় করে একবার দেখা করতে পেরেছিলাম। তখন…তুমি জানো ওর সাথে কে ছিল?’

আমি কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। জানি উত্তরটা সুমনই দিবে। আমি অবাক হয়ে সুমনের কথা শুনছিলাম।

‘ওর সাথে ছিল বিপ্লব! সেই বিপ্লব! মনে আছে তোমার? তোমাকে ডিসটার্ব করতো যে বিপ্লব! ওকে নিয়ে সুরমা আমার সাথে দেখা করতে এসেছে! দুজনের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিলো, সম্পর্কটা ম্যালাদূর গড়িয়েছেও ওদের! সেদিন কোনো কথাই বলতে পারিনি আমি। বিপ্লবের সামনে আমি কী বলবো ওকে?

পরে ফোনে জানতে চেয়েছিলাম, এমন কেন করলো আমার সাথে? উত্তরে বলেছে, এটা ওর জীবন। ওর নাকি আমাকে আর ভালো লাগছে না। কাজেই আমি যেন ওকে আর ডিসটার্ব না করি!

নীরা…আমি দুঃখিত…এই কথাগুলো তোমাকে বলে আমি হয়ত তোমার মনে শুধু শুধু কষ্টই দিলাম। তুমি এসবের কিছুই জানো না…আমি বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম হয়ত সুরমা বলেছে তোমাকে। আমি এখন কী করবো বলতে পারো নীরা?’

সুমন অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি স্তব্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। একটু আগে সুমন যে কথাগুলো বললো, তা এখনো ঠিক ভালোভাবে আমার মাথায় প্রবেশ করেনি।

আমি কি সবকিছু ঠিকঠাক শুনেছি?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত