| 28 নভেম্বর 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৩২-৩৪)

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট

বিপ্লব আমাকে আগামীকালই দেখা করতে বলেছে।

আমি সাহস করে পুলিশস্টেশনে আর ফোন দিতে যাইনি। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেদিনের ব্যর্থ অভিযানের পর পুলিশ অফিসারও আমাকে আর ফোন দেয়নি বা আমার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি।

মাঝখান থেকে বিপ্লবের এই ফোনটা আমাকে আচ্ছামত ফাঁসিয়ে দিয়ে গেল। এখন দেখা করে বিপ্লব আদৌ আমার কোনো উপকার করবে কী না বুঝতে পারছি না। পুলিশ ওর আস্তানায় হামলা চালিয়ে সব তছনছ করে ছেড়ে দিয়েছে। অন্য আরেক আস্তানার সন্ধান করতে হয়েছে তাকে। অর্থাৎ নাকানিচুবানি ভালোই খেয়েছে বিপ্লব। আর ওর মতো এমন হীনচরিত্রের একটি ছেলে এত ধরা খাওয়ার পরে আমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবে সেটাও আমার মন কোনোভাবেই মানতে চাইছে না।

সারাটা সন্ধ্যা আর রাত মনমরা হয়ে নিজের ঘরে বসে রইলাম। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছি না। কেমন যেন অবশ অবশ একটা অনুভূতি হচ্ছে। বুঝতে পারছি নয়ন কাজের ফাঁকে আড়ে আড়ে আমাকে এসে দেখে যাচ্ছে। বেচারা ভয় পেয়েছে। আমি চাইলেও কিছু খুলে বলতে পারছি না।সব মিলিয়ে দমবন্ধকর একটা পরিস্থিতি।

পরদিন বেলা দশটার দিকে দেখা করার সময় দিয়েছে বিপ্লব। আমার সকাল নয়টা থেকে ক্লাস। এই মানসিক পরিস্থিতিতে ক্লাসে যাওয়া আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। কাজেই কালকেও ক্লাস মিস যাচ্ছে। জানি না এভাবে আর কতদিন মিস যাবে! কলেজ থেকে কোনো ওয়ার্নিং কিংবা শোকজ না চলে আসে আমার নামে!

প্রায় নির্ঘুম একটা রাত কাটালাম।

অনেক রাত অব্দি জেগে থেকে প্রায় শেষ রাতের দিকে চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল। সকাল আটটার সময় নানীর ডাক শুনে ঘুম ভেঙেছে। আর ঘুম ভাঙতেই ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ্যা…ক’টা বাজে নানী? দশটা বেজে গেছে? আমাকে ডাক দাওনি কেন?’

নানী অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বিস্ময় নিয়েই বললো, ‘দশটা তো বাজেনি বুবু! আটটা বাজে। তুই তো বুবু এত বেলা অব্দি ঘুমাস না…তাই ডাক দিলাম। ভাবলাম তোর ক্লাস আছে বোধহয়। এখনো উঠলি না কেন! শরীর খারাপ লাগছে বুবু?’

আমি একটু ধাতস্থ হয়ে নিয়ে যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘ওহ্‌ না নানী। শরীর ঠিক আছে। আসলে গতকাল রাতে ঘুম আসতে দেরি হচ্ছিলো। ম্যালা রাতে ঘুম এসেছে…তাই জাগনা পাইনি। খুব ভালো করেছো ডেকে দিয়ে। হ্যাঁ… ক্লাস আছে তো! যাই দেরি হয়ে গেল!’

নানী একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না। আমি খুব ভয়ে ভয়ে নানীকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছি। নানীর প্রশ্নবাণের মুখোমুখি হতে কিছুতেই ইচ্ছে করছে না এখন!

খুব একটা ব্যস্ততার ভাব করে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। বের হয়ে অবশ্য নানীকে আর দেখলাম না। মনে মনে স্বস্তির একটা হাঁফ ছাড়লাম। ভেতরে ঝড় বইছে। সেই ঝড়কে উপেক্ষা করে অজানা ঝড়কে সামলানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।

খুব সাদামাটা একটা থ্রিপিস বেছে নিলাম। রঙটা একেবারে ম্যাড়ম্যাড়ে। যেমন তেমন করে এক বেণীতে চুলগুলোকে আটকালাম। চোখ মুখ ঠোঁটের দিকে ফিরেও তাকালাম না। খুব যেন কুৎসিত লাগে নিজেকে আজ, মনে মনে সেটাই চাইছিলাম!

কেন? কারণ আমার মন বলছে, বিপ্লবের আজ একটা বদ মতলব আছে।

হাতের কাছে মোবাইল ফোনটা পড়ে আছে। পুলিশ অফিসারকে একটা কল দেওয়ার জন্য হাতটা নিশপিশ করছে। কিন্তু দিতে পারছি না। আজ কিছুতেই এই কাজ করা যাবে না। ক্রুদ্ধ শেয়াল সিংহে রূপ নিতে পারে। আর এখন নয়নের ভবিষ্যতকে পাল্লায় রেখেছে শয়তানটা। একেবারে মিথ্যে হুমকি দিচ্ছে…এমনটা কেন যেন ভাবতে পারছি না আমি!

নাস্তা খেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু না খেলে নানীর সন্দেহটা আরো জোরদার হবে ভেবে খেয়ে নিলাম। তারপর ঝট করে বের হয়ে গেলাম। খুব ইচ্ছে করছিল নানীকে বলি, ‘নানী একটু দোয়া পড়ে দিবে?’

যাদের সুস্থ একটা জীবন থাকে, বাবা-মা থাকার মতো করে থাকে…তাদের মায়েরা নিশ্চয়ই সন্তানের জন্য অনেক শুভকামনা আর দোয়া সঞ্চয় করে রাখে। কিন্তু আমরা তো হতভাগা। ওসব দোয়া আর শুভকামনা আমাদের কপালে আর কই জুটেছে?

বাইরে বের হয়ে মনটা কী কারণে যেন আচমকা ভালো হয়ে গেল। এমনটা হওয়ার কথা নয় মোটেও। অন্তত আজকের দিনে তো নয়ই! এদিকে সেদিকে তাকিয়ে কারণটা বুঝতে চেষ্টা করলাম। একবার মনে হলো, হয়ত টেনশনের অবসান হতে যাচ্ছে ভেবে ভারমুক্ত লাগছে। এটা আমার সবসময় হয়। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে টেনশনে বেশ কিছুদিন দুনিয়ার সবকিছু অসহ্য মনে হয়। একবার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলেই ধুপ করে টেনশন মরে যায়। সম্ভবত শুরু হওয়ার আগ পর্যন্তই ভীতিটা জোরালোভাবে কাজ করে।

অবশ্য আজকের ওয়েদারটাও কারণ হতে পারে। বেশ কিছুদিনের ছাতিফাটা গরমের পরে আজ বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। হাওয়াটাতে ঠান্ডা একটা আমেজ মিশে আছে। আশেপাশে কোথাও কি বৃষ্টি হচ্ছে?

একটা রিক্সা নিলাম। রিক্সায় উঠলেই সুরমার কথা মনে পড়ে। মনে পড়াটাকে এড়াতে পারি না কিছুতেই। মনে মনে বললাম,

‘স্বপ্ন নয়…শান্তি নয়…ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়,

আমি তারে পারি না এড়াতে!

সে আমার হাত রাখে হাতে…’

একা একা রিক্সায় উঠে যা কখনো করি না, আজকে তাই করলাম। রিক্সার হুডটা নামিয়ে দিলাম। লোকজন দেখবে দেখুক! মাঝে মাঝে বেপরোয়া হতে মন চায়। ধুকপুকে পুঁটি মাছের জান নিয়ে তো অনেক বাঁচলাম! আমার কি কখনো প্রাণখুলে বাঁচতে ইচ্ছে করে না?

কলেজের কাছাকাছি আসতেই ভয়টা কোত্থেকে যেন আবার ফিরে এলো। বিপ্লব কি সত্যি সত্যিই আসবে? এতটা সাহস কি ওর হবে?

কলেজ আজকে খোলা। আমি একটা ব্যাপার ভেবে স্বস্তি পাচ্ছি যে, বিপ্লব ছুটির দিনটাকে বেছে নেয়নি। ছুটির দিনে ফাঁকা কলেজে ওর সাথে দেখা করতে হলে আমি ভয়েই আধমরা হয়ে যেতাম।

হাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরিটার কাছে এলাম। দোতলা প্যাঁচানো সিঁড়ীটা উঠে গিয়ে যেখানে থেমেছে, সেটার রেলিং ঘেঁষে একটা পলাশের গাছ। তার নীচেই কলেজের শহীদ মিনারটা। ফাগুনে পলাশ ঝরে শহীদ মিনারের বেদির ওপর পড়ে থাকে। প্রকৃতি যেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একান্ত নিজের মতো করে শ্রদ্ধার্ঘ জানায়। আমি আনমনে কখন যেন সেই বেদিটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। কলেজে পড়ার সময় মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে থাকতাম। বান্ধবীরা তুমুল হৈ চৈ করে গল্প করতো। আমি চুপচাপ ওদের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা তারুণ্য দেখতাম।

কলেজ ছেড়েছি সেই কবে! মাঝখানে বেশকিছু বছর পার হয়ে গেল। খুব ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার পদধ্বনি শুনতে পাই। এভাবেই আস্তে আস্তে যৌবন বেরিয়ে যাবে অবাধ্য চঞ্চল হাতের মুঠো গলে।

‘কই হারাইয়া গ্যালা? আছো তো এই দুনিয়ায়?’ পরিচিত কণ্ঠস্বরটা শুনে আঁতকে পেছন ফিরে তাকালাম। ভয়ানক এক দুঃস্বপ্নের মতো বিপ্লব এসে দাঁড়িয়েছে কখন জানি। মুখে সেই গা জ্বালানো ফিচেল হাসিটা!

‘কী গো! কেমন আছো? আমি তো ভাবছিলাম আইজও বুঝি পুলিশ ফোর্স নিয়া আসবা! একা আসছো খুব ভালো করছো। তা না হইলে…আচ্ছা…সে যাক! বাদ দেই এইগুলান প্যাঁচাল। কদ্দিন পরে দ্যাখা হইলো! চলো কিছু খাওয়া দাওয়া করোন যাক!’

বিপ্লব সবসময়ই এমন অশিক্ষিতের মতো নোংরা একটা ভাষায় কথা বলে। আমি বেশকিছুদিন ভেবেছি, বিপ্লবের কি মা-বাবা নেই? নাকি ওরও আমার মতোই দশা! কুপথে যাওয়ার জন্য লাইসেন্স হাতে ছিল হয়ত!

আমি মনের রাগ মনেই চেপে রেখে বললাম, ‘আমি কিছু খাবো না। কী বলবা তাড়াতাড়ি বলো। আমার ক্লাস আছে!’

‘আরে হবু ডাক্তারনী! ক্লাসে আজ আর যাওন যাইবো না! এদ্দিন পরে পাইছি তোমারে! এট্টু গপশপ করুম না তাই কি হয়? চিন্তা করো দ্যাখি…তুমি এখন কত্ত বড় জায়গায় পড়ালেখা করো! আর আমি হইলাম গিয়া চামচিকা! পুলিশের দাবড়ানির ওপ্রে থাকি! আমি কি এখন চাইলেই তোমার দেখা পামু গো সুন্দরী?’

আমি একটু শক্ত গলাতেই বললাম, ‘এসব ফালতু কথা বাদ দাও বিপ্লব! বলো তুমি কি সুরমাকে ছাড়ানোর ব্যাপারে কোনো হেল্প করতে পারবা নাকি? ও এমন একটা বিপদে পড়েছে। আর তুমি কি নিশ্চিন্তে ঘোরাঘুরি করছো! ও তো একা একা কিছু করেনি। হয়ত জেনেবুঝেও করেনি। ওকে বিপদে ফেলে তুমি এত আরামে থাকো কীভাবে?’

বিপ্লবের চেহারাতে এতক্ষণ একটা তেল চুকচুকে ভাব জ্বলজ্বল করছিল। এই কথা শুনেই ছ্যাঁত করে ফুঁসে উঠলো যেন। হিসহিসে গলায় বললো, ‘হ! তোমার বোনডাতো এক্কেরে দুধে ধোয়া তুলসী পাতা! তুমি জানো এই ছেমড়ি আমার কাছ থেইকা কত ট্যাকা নিছে? আমার ট্যাকায় ফূর্তি করতো, স্টাইল দ্যাখাইয়া ঘুইরা বেড়াইতো…আর আমার এট্টু কাম কইরা দিব না? সে ভালোমতোই জানতো কী সাপ্লাই দিতাছে! অক্ষন নেকি পান্তাবুড়ি সাইজা কিছু হইব না বুঝলা?’

আমার মুখে আর কথা আসছে না। বিপ্লব পালের গোদাদের খবর দিবে এমনটা বলেছিল। সেই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবো ভাবছি। কিন্তু আমি মুখ খোলার আগেই বিপ্লব একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ‘বাদ দাও’ একটা ভাব করলো। তারপর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মোবাইল বের করে পটাপট আমাদের দুইজনের বেশ কয়েকটা সেলফি তুলে ফেললো।

আমি বিস্ময়ে হতবাক। রাগ করতেও ভুলে গেছি পুরোপুরি! তোতলাতে তোতলাতে বললাম,

‘এ…এ…এইটা কী করলা তুমি? আমার ছবি তুললা কেন?’

আমার কথাকে পাত্তা না দিয়েই বিপ্লব মোবাইল টিপে কী যেন করতে লাগলো। আমার ইচ্ছে করছে ওর হাত থেকে এক টানে মোবাইলটা ছিনিয়ে নিই। রাগে গজরাতে গজরাতে বললাম, ‘এ্যাই কী করছো তুমি? আমার ছবি দিয়ে কী করছো?’

বিপ্লব দাঁত কেলিয়ে বললো, ‘আরে! এত ভয় পাইলে চলে? আমি তোমার ছবি কাউরে পাঠাইতাছি না! আমি খুব যত্ন কইরা আমার ফেসবুকের বুকের মইধ্যে রাইখা দিলাম! মনটা খারাপ হইলে মাঝে মইধ্যে দেখমু আর বড় বড় নিঃশ্বাস ছাইড়া গান গামু… বন্ধু যখন জামাই লইয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া রঙ্গ কইরা হাঁইটা যায়…বুকটা ফাইট্টা যায়!’

আমার মাথায় তখন আগুন চড়েছে। রাগে দিশা হারিয়ে ফেললাম পুরোপুরি। ওর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করে দিলাম। আশেপাশে কেউ দেখছে কী না… কিছু আমার হুঁশ নাই। এই ছবি আমাকে ডিলিট করতেই হবে! বিপ্লবের ফোনে ফেসবুকে আমার ছবি কেন থাকবে?

বিপ্লব হাসতে হাসতে বললো,’আরে সুন্দরী! ডরাইও না। অনলি মি কইরা রাখছি। এত ডরাও ক্যান? সম্মান হারাইবার এত্ত ডর? তাইলে আমার সম্মানে হাত দিছিলা কুন বিবেচনায়? পুলিশ নিয়া আমারে ডর দেখাইতে আইছিলা ক্যান?’

আমার কানে কোনো কথাই ঢুকছে না। আমি কেমন জানি উন্মাদ হয়ে গেছি। বিপ্লব কোন উদ্দেশ্যে আমার ছবি তুললো! নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব মাথায় ঘুরছে শয়তানটার!

এইরকম একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই আচমকা চারপাশ থেকে সমস্বরের একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম।

‘হ্যান্ডস আপ! খবরদার বিপ্লব! একটুও নড়াচড়া করা যাবে না! নড়লেই গুলি করে দিব!’

আমার হুঁশ ফিরলো। তাকিয়ে দেখি সাদাপোশাকে কয়েকজন পুলিশ কখন জানি আমাদের চারপাশে এসে দাড়িয়েছে। আমার পরিচিত সেই অফিসারকেও দেখতে পেলাম। এরা কীভাবে খবর পেল? আমি তো কাউকে কিছু বলিনি!

বিপ্লবের হাতে হাতকড়া পড়াতে পড়াতে পুলিশ অফিসার এক ফাঁকে আমাকে বললো, ‘আপনার এত রিস্ক নেওয়া উচিত হয়নি। আপনি সরে দাঁড়ান!’

আমি বুঝতে পারলাম পুলিশ বিপ্লবকে ছেড়ে আমাকেই ফলো করতে শুরু করেছিল। আমাকে ফলো করেই বিপ্লবকে ধরার কাজ সমাধা করেছে পুলিশ।

আশেপাশে তখন সিনেমা দেখার জন্য অনেকগুলো উৎসুক মুখ দাঁড়িয়ে গেছে। প্রত্যেকের চোখমুখ ছানাবড়া।

বিপ্লব এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে টানতে টানতে যখন বড় পাজেরো গাড়িটাতে তোলা হলো, আমি শুনতে পেলাম ওর হিংস্র কণ্ঠস্বর,

‘কাজটা খুবই খারাপ হইলো সুন্দরী! এর পরিণাম কিন্তু খুব কাছেই আছে!’

(৩৩)

বিপ্লবকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরও আমি সেই জায়গায় নিস্পন্দের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ওর শেষের কথাগুলো আমার ভেতরে যেন সাঁড়াশি দিয়ে আঘাত হানছে। বিপ্লব কি ফাঁকা আওয়াজ করার মতো ছেলে? মনে তো হয় না! আমি যে পুলিশে খবর দিইনি, পুলিশ যে নিজে নিজেই সেখানে এসে হাজির হয়ে গেছে… সে কথা ওকে বলার ফুরসতটাও তো মিললো না! অবশ্য বললেই বা বিশ্বাস করছে কে?

আশেপাশে উৎসুক ছেলেমেয়ের ভিড় আরেকটু বেড়েছে। আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ছেলেটাকে পুলিশ তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেল…এটা ওদের মধ্যে খুব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।নিজেদের মধ্যে তুমুল বেগে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে সবাই। একজন একটা বলছে, আরেকজন সেটাকে খণ্ডন করছে। প্রত্যেকেই ভীষণ উত্তেজিত। কয়েকজন মেয়ে অতি উৎসাহী হয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। একটু ইতঃস্তত মুখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপু কী হয়েছে? আপনার বয়ফ্রেণ্ডকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল কেন?’

আমার কানমাথা গরম হয়ে গেল বিপ্লবকে বয়ফ্রেণ্ড বলায়। গম্ভীর মুখে ‘ও আমার বয়ফ্রেণ্ড না’ এই কয়েকটা শব্দ বলেই দ্রুত সেই জায়গা ছেড়ে গেলাম। কারণ বুঝতে পারছিলাম, কৌতুহলের কামড় বড় সাংঘাতিক। একটু পরেই নানারকম গুজব ঝড়ের বেগে বাতাসে ছড়িয়ে পড়বে। গুজবের তোড়ে আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সবাই।  আমার মুখ থেকে কিছুমিছু শুনে তাতে রঙ বেরঙের পর্দা চড়ানো হবে। বেশিকিছু হওয়ার আগেই কেটে পড়া ভালো!

রিক্সা নিয়ে বাসায় ফেরার পথ ধরলাম। যদিও খুব বেশি সময় থাকতে হয়নি এখানে। এখনো কলেজে গেলে দিব্যি কয়েকটা ক্লাস ধরতে পারবো। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে না, আমি অন্য কিছু করতে পারবো। শরীরের কাঁপুনিটা কেন যেন থামতেই চাইছে না!

বাসায় গিয়েও শান্তি নাই। নানী একেবারে পিছে লেগে গেল। কেন ক্লাসে গেলাম না…কী হয়েছে আমার…মুখ এত শুকনো কেন…ইত্যাদি ইত্যাদি শত প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে লাগলাম। আমি মাথাধরার ভান করে বললাম, ‘নানী প্লিজ, এত চিন্তা করো না তো শুধু শুধু! খুব মাথা ধরেছে। তাই ক্লাস না করে বাসায় ফিরে এলাম!’

নানী তবুও পিছ ছাড়ে না। ‘মাথা ধরেছে তাইলে কলেজে গেলি ক্যান? এই গেলি আর এই কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথাব্যথায় কাহিল হয়ে পড়লি? কী হইছে ঠিক করে বল আমাকে! বলবি না?’

আমি এবারে রাগ দেখালাম। ‘আচ্ছা তাহলে তুমি আমাকে ছাড়বে না! বাসায় এসেছি বলে এত রাগ হচ্ছে তোমার? বেশ তাহলে আবার কলেজে যাচ্ছি দাঁড়াও! ক্লাস করে এসে তোমাকে শান্তি দেই!’

অবশেষে নানী ক্ষান্ত দিলো। কিন্তু ঘর ছাড়ার সময়েও বুঝতে পারলাম, নানীর চোখেমুখে এক ঝাঁক জিজ্ঞাসা জ্বলজ্বল করছে। নানী আমার কথা মোটেও বিশ্বাস করেনি।

সুনেত্রা সম্ভবত কলেজে গেছে। ঘরে আর কেউ নেই। আমি ঘরের দরজার ছিটকিনিটা টেনে দিলাম। তারপর দড়াম করে বিছানায় ওপরে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। মাথার ওপরে বন বন করে ফ্যান ঘুরছে। আমার মাথার মধ্যেও চিন্তারা দ্রুতবেগে ঘুরপাক খাচ্ছে। কী হলো, কেন হলো কিছুই এখনো বুঝতে পারছি না। আমি তো কাউকে কিছু বুঝতেই দিলাম না! তবুও পুলিশ অকুস্থলে পৌঁছে গেল! কীভাবে টের পেল সবকিছু?

খুবই প্রাসঙ্গিক ভাবে ঠিক এই সময়েই পুলিশ অফিসারের ফোনটা পেলাম। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার আগেই আমি রিসিভ করলাম ফোনটা।

ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম, ‘আপনি এত বড় রিস্ক কোন আক্কেলে নিলেন? আপনার যদি কিছু হয়ে যেত! এই বিষয়টা ভাবলেন না একবারও? বিপ্লব কী পরিমাণ ডেঞ্জারাস একটি ছেলে সম্ভবত এখনো আপনি তার হদিস পাননি! আপনার কাজিন ধরা পড়ার অনেক আগে থেকেই আমরা বিপ্লবের কার্যকলাপের পেছনে জোঁকের মতো লেগে আছি। তার নাগাল না পেলেও তার সুকীর্তির বহুত নমুনা ম্যালা আগে থেকেই আমাদের হাতে চলে এসেছে!…’

আমি অবাক হয়ে পুলিশ অফিসারের কথা শুনছিলাম। কথা শেষ হওয়ার আগেই বললাম, কিন্তু বিপ্লবের নামটাও তো আপনারা জানতেন না! আমিই আপনাদের কাছে ওর ব্যাপারে বলেছি!’

‘সেটা আপনি মনে করছেন। বাস্তবতা তা নয়। শহরের ড্রাগ ডিলারদের উৎপাত প্রচুর বেড়ে যাওয়াতে আমাদের গোপন মিশন বেশ আগে থেকেই কাজ শুরু করেছে। শহরের স্কুল কলেজের তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে এরা খুব সহজে সুকৌশলে পৌঁছে যাচ্ছে। পুলিশের অনেক ইনফরমার থাকে, জানেন তো? সেরকম ইনফর্মাররা স্কুল কলেজের গেটের আশেপাশে বহুদিন ধরে নিজেদের নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে। এক ছুটকো সাপ্লাইয়ারের কাছ থেকেই প্রথম এই বিপ্লবের নামটা জানতে পারি আমরা।

ওর গতিবিধির দিকে সবে কড়া নজরদারি শুরু করেছিলাম। হয়ত কিছুদিনের মধ্যে ধরেও ফেলতাম ব্যাটাকে। আর কিছু প্রমাণ হাতে এলেই বিপ্লবের আস্তানায় পুলিশ ঢুকত। ওর দু’একজন গুরুরও সন্ধান পেয়ে গিয়েছিলাম। সব কয়টাকে একসাথে ধরা যেত। কিন্তু তার আগেই সুরমা ধরা পড়ায় কেসটা একেবারে চোপাট হয়ে গেল! বিপ্লব আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা সুড়ুত করে গর্তে ঢুকে পড়লো।

হয়ত গর্ত থেকে তাদেরকে বের করতে ভালোই বেগ পেতে হতো পুলিশকে। কিন্তু আপনার কাছে আসা বিপ্লবের ফোনকলটা আচমকা আমাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিলো!’

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। এসবের কিছুই জানতাম না আগে। পুলিশ আমাকে ভালোরকম অন্ধকারে ফেলে রেখে আমাকে দিয়ে কাজ আদায় করে নিচ্ছিলো! অথচ আমি বিন্দুবিসর্গও টের পাইনি!

বললাম, ‘কিন্তু আজকে আপনারা কীভাবে জানতে পারলেন? সেখানে পৌঁছালেন কীভাবে?’

‘কীভাবে আবার? বিপ্লব যেদিন আমাদের হাত থেকে ফস্কে পালালো, সেদিনই তো আপনার মোবাইলে অন্য নাম্বার থেকে ফোন করেছিল সে! সেই ফোনকল রেকর্ড করা হয়েছিল। লোকেশন ট্রেস করতে পারলেও আমরা আর সেই পথে এগুলাম না। বরং ভিন্ন পথে এগুতে লাগলাম। বিপ্লব যেহেতু আপনার ওপরে রেগেছে কাজেই সে কোনো না কোনোভাবে আপনার সাথে দেখা করেই ছাড়তো! কাজেই আমরা পরবর্তী ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলাম।

কিন্তু একদিন যাওয়ার পরেও যখন বিপ্লব ফোন দিলো না, তখন বুঝতে পারলাম সে অন্য চাল চেলেছে। আপনার নীরবতাও সেই ধারণাকে সত্যিতে রূপ দিলো। তারপর আর কী? বিপ্লবকে ছেড়ে আপনার গতিবিধির দিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখা শুরু হলো। আজকে আপনি যখন মেডিক্যাল কলেজে না গিয়ে আপনার পুরনো কলেজে গেলেন, তখনই আমাদের ইনফর্মার আমাদেরকে বিষয়টা জানায়। বুঝতে পারি, এখন সেখানে আমাদের পুরো ফোর্স নিয়ে থাকা দরকার। তবে অবশ্যই সাদা পোষাকে!

তবে একটা কথা। আপনি এত বড় রিস্ক না নিলেও পারতেন। আর আপনার এই নীরবতারই বা কী কারণ? পুলিশকে কেন কিছু জানাননি?’

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সত্যিটাই বললাম, ‘বিপ্লব আমার ভাইকে এসবে ফাঁসানোর হুমকি দিয়েছে।’

‘এসবে মানে? ড্রাগ দেওয়া নেওয়ায়?’

‘না মানে… ওকে কোনোভাবে ড্রাগ আসক্ত করে ফেলার হুমকি দিয়েছে বিপ্লব। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম অফিসার। রিস্কটা না নিয়ে আমার আর কোনো পথ খোলা ছিল না। আপনাদের জানিয়ে দিলে বিপ্লব যদি আমার ভাইয়ের ক্ষতি করে…সেজন্যই আমি লুকাতে বাধ্য হয়েছি!’

‘হুম…এমন সম্ভাবনা অবশ্য মাথায় আসেনি। একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার। আপনার দিকে নজর রাখতে গিয়ে এই বিষয়টা আমাদের ইনফর্মার জানিয়েছে। আপনার মামাতো ভাইয়ের কাছে যেসব ছেলেরা আসা যাওয়া করে তাদের বেশিরভাগই ড্রাগ এ্যাডিক্ট…এবং আপনার কাজিনও পুরোপুরি ড্রাগে আসক্ত হয়ে পড়ছে। নানারকম আজেবাজে জায়গাতেও সে এই বয়সে আসা যাওয়া শুরু করেছে। এসব কি আপনারা জানেন? আপনার মামা জানেন? না জানলে বিষয়টা তাদেরকে জানানো জরুরি!’

আমি ঘাড় টানটান করে বসে রইলাম। এই খবরের সত্যতা জানাটাই তো এতদিন বাকি ছিল! এবারে তাহলে আমি মুখ খুলতে পারি। এবার যদি সুজন অস্বীকার করে, পুলিশের রেফারেন্স দেওয়া যেতেই পারে!

আমি বললাম, ‘ আপনাদের ধন্যবাদ সময়মত উপস্থিত হওয়ার জন্য। সিনেমার পুলিশের মতো দেরি করেননি। ইয়ে…বিপ্লব আমার একটা ছবি তুলেছে। জানি না সেটা দিয়ে কিছু করবে কী না!

‘বিপ্লব আর কিছু করার হালে থাকলে তো! তাকে এখন উদম ক্যালানি দেওয়া হচ্ছে! হাড় হাড্ডি ভবিষ্যতে জায়গামত থাকলে তবেই না ওসব নিয়ে কিছু করার কথা ভাববে! আর চিন্তার কোনোই কারণ নেই। হাজতীদেরকে মোবাইল ফোন রাখতে দেওয়া হয় না। বিপ্লবের ফোন এখন আমাদের হেফাজতে। সেটা এখন আমাদের হয়ে অনেক কাজ করবে! ওর গুরুদের ধরতে হবে না?’

আমি একটু ইতঃস্তত করে বললাম, ‘একটা কথা বলার ছিল। বিপ্লবকে ধরার সাথে যে আমি এভাবে জড়িত ছিলাম, দয়া করে এই কথাটা আমার মামা বা অন্য কারো কাছে বলবেন না। আমি এই বিষয়টা ভুলে যেতে চাই।

পুলিশ অফিসার সংক্ষেপে শুধু বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি না চাইলে কাউকে কিছু বলা হবে না।’

আমি বাথরুমে গিয়ে মুখেচোখে পানির ঝাপ্টা দিলাম। কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিলাম। তারপর নয়ন আর সুজনের ঘরে একবার উঁকি মারলাম। নয়ন স্কুলে। সুজন ঘরে নেই। আমি এদিকে ওদিকে কিছুক্ষণ খুঁজলাম ওকে। তারপর রান্নাঘরে উঁকি দিলাম। দুই মামী আর নানী রান্নাঘরে কাজ করছে। মামারা কেউওই বাসায় নেই। দুজনেই যার যার কর্মস্থলে। আমি অনেক সাহস জড়ো করে তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘আমি খুব জরুরি কথা বলবো। মন দিয়ে শুনো তোমরা। মামারা এখন বাসাতে নেই। আগে তোমাদের কাছে বলছি। তোমরা ঠিক মনে করলে মামাদের বলে দিও।’

তিনজনই গভীর বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি ছোটমামীর দিকে তাকালাম। ছোটমামীর ভ্রুদুটো কুঁচকে আছে। আমি নাকমুখ বন্ধ করে বললাম, ‘মামী, তোমরা কি জানো, সুজন কোথায় যায়… কাদের সাথে মেশে?’

ছোটমামী রুক্ষ্ণ গলায় বললো, ‘তার মানে? কী বলতে চাও তুমি?’

ছোটমামীর কণ্ঠস্বরটা আজ একেবারে কর্কশ শোনালো। আমি যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললাম, ‘যা বলছি সেটাই বলতে চাই। সুজনের চলাফেরার দিকে নজর রাখা দরকার। ও কোথায় যাচ্ছে কাদের সাথে মিশছে কী করছে…এসব দিকে কেউ কি খোঁজ খবর করছে? সামনের মাসে ওর এসএসসি পরীক্ষা। অথচ সেই ব্যাপারে ওর কি কোনো মাথাব্যথা আছে?’

ছোটমামী যেন বিস্ময়ে এবারে কথা বলতেও ভুলে গেছে। নানী আর বড়মামী হাঁ করে আমাকে দেখছে। ছোটমামী আবার কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় নানী বলে উঠলো, ‘কেন তুই কি কিছু দেখছিস কিংবা শুনছিস যে এইকথা বলছিস?’

‘হ্যাঁ…সুজন খারাপ ছেলেপেলের সাথে মিশে ড্রাগ নিচ্ছে। ও মোটেও পড়াশুনা করে না। খুব বাজে কিছু বন্ধু জুটিয়েছে। আর…’

‘তোমার এত্ত বড় সাহস! আমার ছেলেরে নিয়া তুমি এইসব কথা বলো! যত বড় মুখ না তত বড় কথা! নিজের ভাইরে তো সুপথে আনতে পারতাছো না এখন আসছো আমার ছেলের নামে বদনাম দিতে! তোমার ভাই যে আমার টাকা চুরি করছে সেই কথা জানো তুমি?’ ছোটমামী একেবারে বারুদের মতো ফুঁসে উঠে বললো।

ঘরের মধ্যে বুঝি বাজ পড়েছে। নানী আর বড়মামী স্তম্ভিত হয়ে গেছে ছোটমামীর মুখে এসব কথা শুনে।

আমি তৎক্ষণাৎ সময় নষ্ট না করে বললাম, ‘ছোটমামী, আপনি নয়নকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবেন না! নয়ন আপনার টাকা সরায়নি। টাকা সরিয়েছে সুজন। আর সেটা ঐ ড্রাগ সেবন করার জন্যই। আপনি আমার ভাইয়ের নামে মিথ্যে অপবাদ দেওয়া বন্ধ করে নিজের ছেলের দিকে মন দেন। দেখেন সে কী করছে!’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে আমি হাঁফাতে লাগলাম।

ছোটমামী ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো গর্জে উঠে বললো, ‘তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে যে তুমি এত বড় কথা বলো সুজনকে নিয়ে?’

আমার হঠাৎ কেমন যেন জেদ হলো। আমিও উলটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বললাম, ‘আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে যে আপনি নয়নের নামে আজেবাজে কথা বলেন? শুধু আজকে থেকে না, সেই টাকা চুরির দিন থেকেই আপনি নয়নকে সন্দেহ করে আসছেন। অথচ আমার ভাইটা এই ব্যাপারে কিছুই জানে না!’

এইসময় নানী হস্তক্ষেপ করলো। ‘এই নীরা থাম। তুই বল, এত নিশ্চিত হয়ে তুই সুজনের কথা কীভাবে বলছিস? সত্যিই তো… তোর হাতে কি প্রমাণ আছে কোনো?’

‘হ্যাঁ প্রমাণ আছে। পুলিশ আমাদের বাসার দিকে নজর লাগিয়ে রেখেছিল। সুরমার ব্যাপারে খবরাখবর জানার জন্য ইনফর্মার লাগানো আছে। সেই ইনফর্মার সুজনের ব্যাপারে বলেছে। বিশ্বাস না হয়, মামাদেরকে পুলিশস্টেশনে পাঠালেই সব খোলাশা হয়ে যাবে! আমি সুরমার খোঁজ নেওয়ার জন্য একবার পুলিশস্টেশনে গেছিলাম। সেইখানেই জানতে পারছি।’

পিনপতন নিস্তব্ধতা যেন নেমে এলো রান্নাঘরে।

ছোটমামী ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। বড়মামী সেদিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরলো। নানী কিছুক্ষণ মুহ্যমান থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এ্যাই নীরা তোর মামাদের ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বল। আজকেই এর একটা ফয়সালা হবে!’

 


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৩১)


 

(৩৪)

সেদিন প্রায় সারাদিন বাসাতে একটা ঝড় বয়ে গেল।

যত সহজে সত্যিটাকে সবার সামনে উন্মুক্ত করে দেওয়া গেছে, তত সহজে সত্যিটাকে কেউই মেনে নিতে পারল না। একটা ভালোরকম হুলুস্থূল পড়ে গেল।

আমারদুই মামাকে ফোন দিতে বলার পরও বসে আছি দেখে নানী আরেকবার তাগিদ দিলো। ‘কীরে, তোকে না বললাম তোর মামাদের খবর দিতে! তুই বসে আছিস কেন?’

আমি তখন আড়ে আড়ে ছোটমামীকে দেখছি। ঝোঁকের মাথায় অনেকখানি সাহজ জড়ো করে সত্যিটাকে উগরে দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু এখন সত্যিই খুব খারাপ লাগছে। ছোটমামী থেকে থেকেই হিস্টিরিয়া রোগীর মতো আচরণ করছে। কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস টেনে বললো, ‘না না…এগুলো সব মিথ্যা কথা! আমার সুজন এমন কাজ করতে পারে না! ও আমার আলমারি থেকে টাকা চুরি করতে পারে না! সুজন খারাপ জিনিস খাচ্ছে! কক্ষনো না…আমি বিশ্বাস করি না!’

তারপর আচমকা শরীরটাকে টানটান করে ফেলে চোখমুখ কেমন যেন উল্টিয়ে ফেললো। নানী আর বড়মামী দুজনেই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমার এই জায়গা ছেড়ে যেতে সাহস হচ্ছে না। ঝোঁকের মাথায় কোনো ভুল করে ফেললাম না তো!

নানী এর মধ্যেও আমাকে একই তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। ‘হাঁ করে দেখছিস কী? শিগগির ফোন দিয়ে আসতে বল তোর মামাদের!’

আমি আবার সাহস করে বললাম, ‘নানী, আমি অন্যায় করে ফেলেছি। আমার উচিত হয়নি ছোটমামীকে এই কথা বলা। মাফ করে দাও আমাকে। এখন কাউকে ফোন দেওয়ার দরকার নাই। দেখছো না ছোটমামী কেমন করছে! একটু স্বাভাবিক হোক আগে। পরে ঠান্ডা মাথায় মামাদের সাথে কথা বলে ঠিক করতে হবে!’

নানী ধমক দিলো এবার। ‘নীরা, সবসময় এত বেশি বোঝা ভালো নয়! তোর ছোটমামীর কিচ্ছু হয়নি। সব ঠিক আছে। যা করতে বললাম করবি নাকি আমাকেই করতে হবে?’

ছোটমামী তখন ভুল বকতে শুরু করে দিয়েছে। আমার রীতিমত ভয় ধরে গেল। না জানি কী একটা বিপদ বাঁধিয়ে বসলাম!

এর মধ্যেই কোন এক ফাঁকে নানী নিজে গিয়েই ফোন করে দিয়েছে মামাদের।

নানীর মধ্যে কীসের যেন একটা রাগ দেখতে পাচ্ছি আজকে। নাকি ওটাকে জেদ বলে? ছোটমামী সেই তখন থেকেই বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে আছে। নানীর সেদিকে বিশেষ যেন মাথাব্যথা নেই। মাঝে মাঝে গিয়ে ধরছে, গা ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে…এই পর্যন্তই। কিন্তু যে দৃষ্টিতে নানী ছোটমামীর দিকে তাকাচ্ছে, সেই দৃষ্টির ভাষা খুব বেশি অস্পষ্ট নয়। বুঝতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না।

আমার মনে আছে, সুরমা যেদিন ধরা পড়েছিল সেদিন নানী বড়মামীকে কী বলেছিল। কথাগুলো আজও কানে ভাসে আমার।

‘সন্তানকে জন্ম দেওয়া মানে হচ্ছে, সাধ করে দায়িত্বের বোঝা কাঁধে চাপিয়ে নেওয়া। সেই বোঝাকে মাঝরাস্তায় ফেলে আসারকিংবা মনের ভুলে সেটাকে ভুলে থাকার কোনো সুযোগ নেই। একে জায়গামত পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব থেকে বাবা-মায়ের কোনো নিষ্কৃতি নেই!সুরমা একদিনে আজকের অবস্থানে আসেনি। একটু একটু করে সীমালঙ্ঘনের যোগফল হলো আজকের এই পরিণতি। কাজেই সেই পরিণতির সম্পূর্ণ দায়ভার সুরমার একার হতে যাবে কেন?’

আজ ছোটমামীর দিকে নানীর তীর্যক দৃষ্টিপাত দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না, আজকেও নানী লম্বাচওড়া আরেকটা বক্তৃতা দিতে যাচ্ছে! মামারা বাসায় আসার পরে আমার সেই কথার সত্যতা মিললো।

দুই মামাই কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। নানী দুই মামাকেই ফোন করে শুধু বলেছে, ‘বাসায় দরকার আছে, শিগগির বাসায় আয়।’ ওপাশ থেকে মামারা সম্ভবত কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছিল। নানী কাউকেই কোনো কথা বলার সুযোগ দেয়নি। দুটো বাক্য বলেই ফোন ছেড়ে দিয়েছে।

বড়মামা এসে পড়েছে আগেভাগে। এখন বাসায় জরুরি তলব মানেই হচ্ছে সুরমাকে নিয়ে নতুন কোনো টেনশনের কারণ ঘটা। যদিও যা ঘটার ছিল তা আগেই ঘটে গেছে, কিন্তু তবুও মনের মধ্যে সারাক্ষণ ধুকপুকে একটা টেনশন কাজ করে সবার। এই বুঝি পুলিশ ফোন দিয়ে কিছু একটা বললো…কেসের হয়ত শিগগিরই দফারফা হয়ে যাবে… অথবা উকিল সাহেব নতুন কোনো দুঃসংবাদ নিয়ে অপেক্ষা করছে! ইত্যাদি ইত্যাদি!

ছোটমামার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। সকলের উপস্থিতিতে আজকের বিষয়টা তোলা হবে। একজন এলে তো কাজ হবে না। আর তাছাড়া যার সন্তানের খবর, তার উপস্থিত থাকাটা বেশি জরুরি।

বড়মামা বাসায় এসে বুঝতে পারলো ঘটনাঅন্যকিছু, সুরমার ব্যাপার নয়। তবে কেউই মুখ খুলছে না দেখে বড়মামাও আর জোরাজুরি না করে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো।

বড়মামাকে দেখে খুব খারাপ লাগলো আমার। মানুষটা ভেতরে ভেতরে কেমন ক্ষয়ে যাচ্ছে! তবু জোর করে নিজের শক্তভাবটাকে বজায় রাখে সবার কাছে।

ছোটমামা ফিরলো আরো প্রায় আধাঘণ্টা পর। এই আধাঘণ্টায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। ছোটমামীকে তার ঘরে এনে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। মামীর অস্থিরতা আরও বেড়ে গেছে। আমি একবার প্রেশারটা চেক করার জন্য কাছে যেতেই বড়মামী হাতের ইশারায় আমাকে সরে যেতে বললো। ফিসফিস করে বললো, ‘তুই এখন ওর কাছে যাস না। আরও অস্থির হয়ে পড়বে! রাগ করে কিছু করেও বসতে পারে। দূরে থাক নীরা।’

আমি ত্রস্ত মুখে সরে এলাম। বড়মামা সবকিছু দেখে শুনে একবার শুধু মুখ গোমড়া করে বলেছে, ‘বাসায় কী হচ্ছে, কেউ কি বলবা আমাকে?’

নানী উত্তরে বলেছে, ‘এই বাসায় সার্কাস হইতেছে এখন। সার্কাসের কারখানা বানাইছি সবাই মিলে। সার্কাস তো দেখতেই হবে দুই দিন পর পর!’

খুবই ধোঁয়াশা উত্তর। বড়মামা আর একটাও কথা না বলে ধম মেরে বসে থাকে।

ছোটমামা ঘরে ঢুকলো হাল্কা মেজাজে। তার ভাবভঙ্গিতে তেমন কোনো উদ্বেগ নেই। ছোটমামা প্রায়ই একটা কথা বলে। ‘সব পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে পারাটা মস্ত একটা গুণ। নিজের মধ্যে গুণটাকে রপ্ত করার চেষ্টা করছি।’

আজকে দেখা যাবে, ছোটমামা কতটা রপ্ত করতে পারলো এই গুণ! নানী ছোটমামকে ঘরে ঢুকতে দেখেই একেবারে হামলে পড়লো। নানীর এই মূর্তি আমি আগে কখনো দেখিনি। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে নানী একেবারে কঠিনভাবে চড়াও হলো ছোটমামার ওপরে।‘কী বাসায় এলি তাহলে? কত ব্যস্ত মানুষ তোরা! এত ব্যস্ততা যে, একটা মোটে ছেলের খবরাখবর নেওয়ার সময়টাও নাই তোদের!’

ছোটমামা ততক্ষণে বিপদের আঁচ ভালোভাবেই টের পেয়েছে। নানী উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে চললো, ‘ছেলে কোথায় যাচ্ছে, কাদের সাথে মিশছে, কী করছে…খবর রাখিস কিছু? ঐ শোন নীরার কাছ থেকে শোন। ও পুলিশের কাছ থেকে কী শুনেছে কান পেতে শোন!’

পুলিশের কথা শুনে দুই মামাই সচকিত হয়ে উঠলো। জিজ্ঞাসু মুখে তাকালো আমার দিকে। আমি ভীষণরকম অপ্রস্তুত মুখে আগের কথাগুলোই বয়ান করে গেলাম। সুজনের টাকা নেওয়ার কথাটাও বাদ দিলাম না।

ছোটমামা সব কথা শুনে মাথা নিচু করে বসে পড়লো। ছোটমামী তখন দিব্যি সুস্থভাবে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে। ছোটমামার কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, ‘এ্যাই তুমি কেন চুপ করে থাকলা? বলো তোমার ভাগ্নি এসব মিথ্যা কথা বলছে? বানায়ে বানায়ে আমার ছেলের নামে অপবাদ দিচ্ছে বলছো না কেন তুমি?’

ছোটমামা ঝ্যাত করে উঠলো, ‘নীরা কেন মিথ্যা বলতে যাবে তোমার ছেলের নামে?’

‘বলবে কারণ…কারণ…টাকা নিয়েছে ওর ভাই নয়ন!’

ছোটমামা এবারে ক্রুদ্ধ গলায় বলে উঠলো, ‘মাথাটাথা ঠিক আছে তো তোমার? নাকি সেইটাকে সেরদরে বেঁচে দিছো? নয়ন তোমার টাকা নেয়নি। সুজনই টাকা নিয়েছে!’

উপস্থিত সকলে এই কথা শুনে ঝট করে ছোটমামার মুখের দিকে ফিরে তাকালো। ছোটমামী আবার মুখ খোলার আগেই এবারে নানী প্রশ্ন করলো, ‘তুই ক্যামনে জানলি যে সুজন টাকা নিছে?’

‘জানছি…কারণ সুজন…সুজন আমারে বলছিল!’

‘তোরে বলছিল মানে? কী বলতেছিস বুঝেশুনে বলতেছিস তো?’ নানী একেবারে গর্জে উঠলো। ছোটমামী আর একটাও কথা না বলে একেবারে চুপ মেরে গেছে। হয়ত বুঝে গেছে আর কিছু বলা নিরর্থক। হাওয়া অন্যদিকে ঘুরে গেছে!

ছোটমামা মাথা নিচু করে বললো, ‘ইয়ে…আমি বুঝতে পেরেছিলাম সুজন টাকাটা নিয়েছে। তাই ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, টাকা দিয়ে কী করেছে। বকাঝকা করিনি। কারণ মনে হয়েছিল এতে আরো খারাপ হবে। সুজন বলেছিল, ওর বন্ধুরা সবাই দামি কেডস ব্যাট এসব নিয়ে খেলতে যায়। তাই ওরও দেখে কিনতে ইচ্ছে করে! আমাদের কাছে বললে হয়ত দিব না…এজন্য…’

‘এজন্য বাপ-মায়ের আলমারি খুলে চুরি করেছে! বাহ বাহ! তুই পরে দেখেছিস সুজন ব্যাট কেডস এসব কিনেছে কী না?’

‘জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছে, খোঁজ করছে কোনটা ভালো। দেখেশুনে কিনবে। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। টাকা চুরি করে ভুল করেছে, এটা বুঝিয়ে বলেছি আমি। আমার কাছে মিনতি করে বলেছে যেন কাউকে কিছু না বলি। ওর মাকে বলতে বার বার নিষেধ করেছে!’

‘বাহ রে বাবু! এই না হলে তোর বুদ্ধি! কিন্ত তোর ছেলের বুদ্ধি তো আর তোর মতো হাঁটুর নিচে গড়ায় না। এই বয়সেই সে অনেক উঁচু বুদ্ধিধারী মানুষ হয়ে উঠেছে! আর তোর বউ যে নয়নের ঘাড়ে এই টাকা চুরির দায় চাপিয়ে দিয়েছে সেই খবর জানিস কিছু? মা-বাপের স্নেহ মমতা না পেয়ে ছেলেমেয়ে দুটো আমার কাছে এসেছে। এইভাবে তাদেরকে খাতিরদারি করলি তোরা?’

নানীর গনগনে রাগ এবারে উষ্ণ বারিধারার মতো বিকশিত হলো। ছোটমামা আগুন চোখে ছোটমামীর দিকে তাকালো। আমি একেবারে কুঁকড়ে গেলাম। কথাবার্তা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। অথচ আমার উদ্দেশ্য এটা নয়। নয়নের ঘাড় থেকে চুরির অপবাদ দূর করার চেয়েও এখন সুজনের ড্রাগ নেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আমি বেশি চিন্তিত। নানীকে বললাম, ‘নানী, ওসব কথা থাক এখন। আসল কথাটা নিয়ে আমাদের এখন ভাবা দরকার।’

নানী এবারে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুই চুপ কর নীরা! সবকিছুই আসল ব্যাপার। এখানে কোনোটাই কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না! তোদের নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, তাও আবার আমি বেঁচে থাকতেই! যখন চোখ বুজবো তখন কী হবে তাহলে?’

সবাই চুপ করে থাকলো। ছোটমামা মাঝেমাঝেই মামীর দিকে দৃষ্টির অগ্নুৎপাত ঘটাচ্ছেন। নানীই আবার বললো, তবে এবারে কিছুটা শান্ত গলায় ‘সুজন তোর সেই কেডস কেনার টাকায় ড্রাগ কিনে খাচ্ছে! যা গিয়ে খবর নে! নিজের জীবন নিয়ে তো মাথাই ঘামাসনি কোনোদিন, এবারে ছেলের জীবনটা ভেসে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাগে যা! আজ নীরা না বললে তো আরো কতদিন পরে তোদের ঘুম ভাঙত কে জানে! যা আর দেরি করিস না। সুজনের সামনের মাসে এসএসসি। ছেলেটা পড়াশুনার নাম করে কোথায় গিয়ে বসে আছে খবর নে শিগগির। সুজনকে যদি ফেরাতে না পারিস, তাহলে আমি এবারে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাবো। তখন তোরা বাসায় বসে বসে শুয়েবসে আরাম করিস! কেউ আর কোনোদিন তোদের জ্বালাতে আসবে না!’

নানী কথাগুলো বলতে বলতে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। এতক্ষণের চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা অবশেষে বুঝি বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। নিঃশেষিত গলায় নানী বললো, ‘কী ভেবেছিলাম, আর কী হচ্ছে এসব! নাতি নাতনীর এইসব দুর্দশা দেখার জন্যই কি এতদিন পর্যন্ত আমাকে বাঁচায়ে রাখছো গো আল্লাহ্‌!

আমি কাছে গিয়ে নানীর কাঁধটা চেপে ধরে গালে গাল ঠেকালাম। ভারী গলায় বললাম, ‘তুমি কোত্থাও যাওয়ার কথা বলবা না নানী। তুমি এমন কথা বললে আমিই দূরে চলে যাবো!’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত