১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১
আমরা ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড রাজারবাগ থেকে চলে এসেছি মগবাজার পাগলাপীরের গলির একটি ভাড়া বাসায়। ব্ল্যাক আউট চলছে। কোনো বাড়িতে তিল পরিমাণ আলো দেখলেই সেই দিক লক্ষ্য করে পাকিস্তানি আর্মিরা গুলি করে। এমনকি মাঝে মাঝে বিভিন্ন বাড়িতে হামলা করে। সারা বাড়ির যত ভেন্টিলেটর, কাঁচের জানালা সব পেপার অথবা কালো কাগজ দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। রাত হলে কবরের নিরবতা নেমে আসতো প্রতিটি বাড়িতে। ঘরের ভেতরে খুব সাবধানে এমন ভাবে কাজ করতাম যেন বাইরে থেকে বোঝা না যায়। সেই তখন থেকেই আমার অন্ধকারে ভয়। ৩ ডিসেম্বর থেকে আমাদের মত গুহার ইঁদুরদের মধ্যে একটু প্রাণ চাঞ্চল্য শুরু হলো। একটু দরজা খুলে দেখার চেষ্টা করি আকাশে বোমারু বিমানের বম্বিং।ভাইয়েরা ছাদে উঠে নিয়ে আসতো নানারকম লিফলেট। সেখানে লিখা থাকতো ভয় পেয়ো না আমরা আসছি দেশ শত্রুমুক্ত করে। স্বাধীনতা আমাদের হাতের মুঠোয়।
১৬ ডিসেম্বরেও মা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গরম কাপড়, টাকা আর ঔষধ গুছিয়ে রাখছিল কেউ এলে পাঠিয়ে দেবে। বেশ ঠান্ডাও পড়ে গিয়েছিল সেবার। ৪টা থেকে ৪-৩০৷ এই সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা তার রাইফেল উঁচু করে “জয় বাংলা, জয় বাংলা” বলে চিৎকার করতে করতে আমাদের বাসায় এসেই ঠাস ঠাস করে গুলি ছুড়ছে আর বলছে খালাম্মা আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। ওর নাম আতিক। ওরই জামা কাপড়, টাকা ঔষধ এগুলো নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ও যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে জয় বাংলা, জয় বাংলা বলে চলে যেতে যেতে বললো আমরা সবাই আবার আসবো। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। মায়ের মুখ থেকে শুধু একটি শব্দ বের হলো “আমার আলতু?”
মগবাজার রেললাইন দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা লাইন দিয়ে হাত উপরে তুলে যাচ্ছে। ওদের বেল্ট খোলা, ব্যাজ নেই,রাইফেল নেই। ওরা সারেন্ডার করেছে আমাদের মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর কাছে।কিন্তু তখনও দূর থেকে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছিল। মুক্তির আনন্দে যে যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। তবুও মনের আশংকা কাটে না আমার। মনে হয় এই বুঝি দলেবলে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমাদের দেখে ওদের চোখ মুখ ভয়ংকর হিংস্র হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিলনা ওদের। ওরা বন্দি, ওরা যুদ্ধে আমাদের কাছে হেরে গেছে।
মাকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। আলতু আলতু বলে বিলাপ করছে আর ভাইদের বলছে “আমার আলতুকে খুঁজে এনে দে। ও নিশ্চয়ই ৩৭০ রাজারবাগে আমাদের না পেয়ে চলে যাবে। আমি রাজারবাগের বাসায় অপেক্ষা করি। তোরা ক্যান্টনমেন্ট, জেলখানা, সব হাসপাতালে, ড্রাম ফ্যাক্টরি, রমনা থানা এসব জায়গায় খোঁজ কর।”
ভাইয়েরা সব ভাগে ভাগে বেরিয়ে গেল ভাইয়ার খোঁজে। তার কিছুক্ষণ পরেই বাসার সামনে একটা খোলা জিপ এসে থামলো। জিপ থেকে অস্ত্র সহ চার পাঁচ জন যুবক লাফিয়ে নেমেই আকাশের দিকে রাইফেলের নল উঁচিয়ে ফায়ার করলো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল তাই মুখগুলো চিনতে পারছিলাম না।সবার চুল প্রায় কাঁধ ছুঁইছুঁই। দাড়ি গোঁফ দিয়ে মুখ ঢেকে গেছে। শাহাদাত ভাই, ফতে আলী, আলম ভাই, চুল্লু ভাই আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা দেশ স্বাধীন করে ফিরে এসেছে। শাহাদাত ভাই ঝিনু আপাকে আর মাকে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে কাঁদছে আর গোঙাচ্ছে “আমি যদি আলতাফ ভাইকে যুদ্ধের সাথে না জড়াতাম তাহলে এত বড় ক্ষতি হতনা। আলতাফ ভাইয়ের এই পরিনতির জন্য আমিই দায়ী।” ছোট্ট শাওনের দিকে কেউ তাকাতে পারছিল না। হঠাৎ ভূত দেখার মত চমকে উঠি আমি মা, ঝিনু আপা!সামাদ! আব্দুর সামাদ! বেঁচে আছে! ও কবে ছাড়া পেল! কবে মেলাঘর গেল? শাহাদাত ভাইরা কী জানেনা ও যে ভাইয়াকে পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে? এমনকি অস্ত্র গোলা বারুদের ট্রাংক দুটো পাশের বাসার লেবু গাছের নীচে মাটির তলায় পুঁতে রাখা হয়েছিল সেটাও দেখিয়ে দিয়েছে।এই বিশ্বাসঘাতক কে কেন আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। সামাদ মা’র পা ধরতে গেলে মা ছিটকে সরে যায়। ঝিনু আপার কাছে গিয়ে বলে “ভাবি আমাকে মাফ করে দেন। আমার বউ বাচ্চাদের কথা ভেবে আমি পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে সব স্বীকার করেছি। আমি ওদের টর্চার আর সহ্য করতে পারি নাই।” ঝিনু আপা শুধু বললো “শুধু আপনার বউ বাচ্চাদের কথাই ভাবলেন, আলতাফ মাহমুদের বউ বাচ্চা ছিলনা?”
পরে জেনেছিলাম সামাদ মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে রাজসাক্ষী হয়েছিল। চুল্লু ভাই জেলে ছিলেন। তাকে জেলখানা থেকে বরণ করে আনার জন্য শাহাদাত ভাইরা গিয়েছিলেন।সেখানে সামাদকে দেখে তাকেও জেলখানা থেকে বরণ করে আনা হয়। পরবর্তী কালে তাকে বীর প্রতিক খেতাব দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানি আর্মির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কোনো শাস্তিতো দূরের কথা বরং তাকে পুরস্কৃত করা হয় এই খেতাব দিয়ে। ভুলতো আমাদের ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরই হয়ে গেছে। বিজয়ের সাথে সাথে সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম পরাজয়ও আমরা বহন করছি। যার ভয়াবহ পরিণতি এখন প্রত্যক্ষ করছি প্রতিনিয়ত।

মার্চ ২১, ১৯৫৭ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সাত ভাই বোনদের মধ্যে তিনি সবার ছোট ছিলেন। তার পিতা মেহতের বিল্লাহ কমলাপুরে একজন গায়ক হিসেবে কাজ করতেন। শিমুল পাচঁ বছর বয়স থেকে গান শুরু করেন। তিনি রেডিও এবং টেলিভিশনে গান পরিবেশন করতেন এবং কচি কাঁচার মেলা নামক একটি শিশুদের গানের অনুষ্ঠানে তিনি গান গায়তে যান।[২] তিনি ওস্তাদ হেলাল উদ্দিন, পি সি গোমেজ, আলতাপ মাহমুদ এবং আব্দুল লতিফ থেকে শাস্ত্রীয় এবং বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত গানের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি শিশুশিল্পী হিসাবে মঞ্চে অভিনয় ও সঙ্গীত জীবন শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে শিশুশিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৪ সালে তঃকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনের সম্প্রচারের প্রথম দিন শিশুশিল্পী হিসাবে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা থিয়েটাওে যোগ দেন এবং এ পর্যন্ত তিনি ঢাকা থিয়েটারের ৩৪টি নাটকে অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক, কোরিওগ্রাফার এবং পোশাক পরিকল্পনা, সহযোগী নির্দেশক ও পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজ করেছেন। ১৯৮১ সালে গ্রাম থিয়েটার আন্দোলনকে সংগঠিত করতে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। শৈশব থেকে শিমূল ইউসুফ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত এবং গণসঙ্গীতে ওস্তাদ হেলাল উদ্দিন, পিসি গোমেজ, ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ, ওস্তাদ ইমামউদ্দীন এবং সুধীন দাসের কাছে দীর্ঘদিন তালিম নেন। তিনি আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যানিকেতন থেকে সঙ্গীতে ডিপ্লোমা লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়েছেন।
মঞ্চের ৩৩টি নাটকের ষোল শতাধিক মঞ্চায়নে সফল অভিনয় করেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক: মুনতাসীর, কসাই, চর কাঁকড়া, শকুন্তলা, ফণীমনসা, কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাতহদাই, চাকা, একাত্তরের পালা, যৈবতীকন্যার মন, মার্চেন্ট অব ভেনিস, বনপাংশুল, প্রাচ্য, বিনোদিনী, ধাবমান, নষ্টনীড়, দ্য টেম্পেস্ট সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তার একক অভিনয়ের নাটক ‘বিনোদিনী’ বিশ্বনাট্য অলিম্পিকস ও আন্তর্জাতিক মনোড্রামা উৎসবে মঞ্চস্থ হয় এবং ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।
টেলিভিশন নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ঘরোয়া, পোস্টমাস্টার, গ্রন্থিকগণ কহে, নির্বাসন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত ১৬টি চলচ্চিত্রে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা ও কণ্ঠ দান করেন। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘ঘুড্ডি’, ‘গেরিলা’ ইত্যাদি।
গণসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত এবং লালনের গান নিয়ে শিমূল ইউসুফের ৫টি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে।
শিমূল ইউসুফ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য: ১৯৬৫ সালে পাকিস্কানের শিশুশিল্পী হিসাবে প্রেসিডেন্ট পদক, লোকনাট্যদল পদক, বাচসাস পদক, মোহাম্মদ জাকারিয়া পদক, রুদ্র পদক, নুরুন্নাহার সামাদ পদক, আরণ্যক দীপুস্মৃতি পদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার পদক, কালচারাল রিপোর্টার্স ইউনিটি পদক, মানবজমিন পাঠকজরিপ এবং কচিকাচা মেলার আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। বাঙলা অভিনয়রীতি বিকাশে এবং শুদ্ধ সঙ্গীতচর্চায় তার অবদানের জন্য কবি বেগম সুফিয়া কামাল ও নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনকর্তৃক তিনি ‘মঞ্চকুসুম’ উপাধিতে ভূষিত হন।