| 19 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস প্রবন্ধ

বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যাচার : বিবর্তন ও অনুসন্ধান

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

শুভদীপ বোয়াল

এখনও আমার ঠাকুমা একটি কথা বলেন, “পেটে খেলে পিঠে সয়”। আমার মনে হয় খাদ্যের প্রধান ও আদিম চাহিদাশর্ত ছিল এটাই । তাই সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ খুঁজে এসেছে বলদায়ী খাদ্য যা শরীরে শক্তি যোগায়। যদিও আদিম মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। পরে আগুনের ব্যবহার শিখলে মানুষ খাবার পুড়িয়ে খেতে শুরু করে আর সেই ক্ষণেই মানুষ প্রথম রন্ধনশিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সে অর্থে মানুষ প্রথমে মাংস চেখেছে তারপর নিরামিষ। যদিও এ মতবাদও পরস্পর বিরোধী। বিরোধীপক্ষের দাবী, মানুষ প্রথমে নিরামিষাশী তারপর সে আমিষ চেখেছে। বাইবেলও সেই সাক্ষ্য দিয়েই বলছে আদম ও ইভ তো প্রথমে আপেলই চেখেছিল। যাইহোক আদিম মানুষ কি চেখেছিল সে বিষয়ের বিতর্ক এড়িয়ে বরং বাঙালির প্রাচীন খাদ্য তালিকার সুলুক সন্ধান করা যাক। বাংলা কিন্তু বরাবরই কৃষিপ্রধান অঞ্চল হিসেবেই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে সেটা অঞ্চলের নামের দেখা যাচ্ছে । ‘বাংলা’ (ইংরাজিতে ‘বেঙ্গল’, অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় ‘বেঙ্গলা’) শব্দটির উৎপত্তি ‘বঙ্গাল’ থেকে । ‘বঙ্গ’ নামক জনপদের সঙ্গে ‘আল’ জুড়ে বঙ্গাল শব্দটির উৎপত্তি। ভাঁটির দেশ হবার দরুন প্রচুর বৃষ্টির কারণে এলাকাটি বছরের অনেক সময় জলমগ্ন থাকত। জল আটকানোর তাগিদে আলের বহুল ব্যবহার দেখে এই নাম। গাঙ্গেয় উর্বর পলিমাটির আদর্শ সহাবস্থান বাঙালি জাতিকে কৃষিনির্ভর করে তুলবে সে আর অস্বাভাবিক কোথায় । নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্বে) উল্লেখ করছেন, ‘ইতিহাসের উষাকাল হইতেই ধান্য যে-দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে দেশে প্রধান খাদ্যই হইবে ভাত তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নেই । ভাত-ভক্ষনের এই অভ্যাস ও সংস্কার অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান। ‘তবে ভাত ছাড়াও একটি খাদ্যের প্রাচুর্য্য বাঙালির পরিচয় ও সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে গেছিল এবং বলাবাহুল্য এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলার পরিচয় এই প্রাচীন খাদ্যের নামেই। অপর এই খাদ্যটি হল মাছ এবং সহজভাবেই বাঙালির কাছে যার প্রাপ্তিযোগ হত প্রাচীন বাংলার বিপুল নদী ও তৎযংযুক্ত ও সংলগ্ন জলাভূমি থেকে। বাঙালির আদি শাশ্বত খাদ্য প্যার্টান কিন্তু এই দুটি খাবারকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে । এবার সময়ের সাথে এর সাথে জুড়েছে কিছু নতুন স্বাদ যা ফিউশন করে নতুন পদের নামকরণ হয়েছে । তাই লক্ষ করলে দেখা যাবে সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন পদ যতই সৃষ্টি হোক । তার বেস কিন্তু আদি , ধ্রুব এবং চিরন্তন।

আদিপর্বের খাদ্যাভাস ও আচার

বাঙালির খাদ্যাভাস ও খাদ্যাচারের একটি আদি চিত্র মেলে বাংলার প্রাচীন চর্যায় । সেখানে তৎকালীন দরিদ্র নিম্নবিত্ত কৌম সমাজের যে ছবি মেলে তা বর্ণনা করা হচ্ছে এভাবে, ‘টালত ঘর মোর নাহি পরবেষী । হাঁড়ীতে ভাত নাঁহি নিতি আবেশী’ । চর্যায় মাছের সরাসরি উল্লেখ না পেলেও নৌকার বহুল ব্যবহারের কথা কিন্তু চর্যায় বারবার উঠে এসেছে যা আদি বাংলার খাদ্য তালিকায় মাছের উপস্থিতিকে মান্যতা দেয়। পাশাপাশি সেই সময় দুধের ব্যবহারের বহুল্যতা দেখা যাচ্ছে। যেমন –‘দুহিল দুধ কি বেন্টে যামায়’ কিংবা ‘দুধ মাঝেঁ লড় অচ্ছন্তে ন দেখই’ । আহার্য হিসেবে মাছ-মাংসেরও চল ছিল। সে সময় হরিনের মাংসের প্রতি আসক্তি লক্ষ করা যায়। ফল হিসেবে তেঁতুলের উল্লেখও চর্যায় মিলছে ‘তেন্তলী কুম্ভীরে খা-অ’। চর্যা যে সময় লেখা সেই তৎকালীন বাংলায় তখন সহজিয়া বৌদ্ধের প্রভাব। ধর্মের শিকল আলগা থাকায় উদাসীন সমাজ ব্যবস্থার যে ছবি ধরা পড়ে তা থেকে এই সময়ের খাদ্যভ্যাস ও আচার-বিচার বেশ খানিকটা অনুমান করা যায়। বিজেতা-বিজিত, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য ভেদ-বৈষম্য সমাজে বেশ প্রকটই ছিল। চর্যায় যাদের কথা সবচেয়ে বেশী ফুটে উঠেছে তা হল হতদরিদ্র মানুষের দুর্দশা। তবে খাদ্যাভাস ও খাদ্যাচারের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে চর্যার একটি বিষয় কিন্তু উস্কে দিয়ে যায় সেটা হচ্ছে তৎকালীন বাংলায় অন্ত্যজ শ্রেণী সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত রান্নার সামগ্রী। চর্যায় যে রান্নার সামগ্রীটির নাম বারবার উল্লেখিত হয়েছে, সেটা হল হাঁড়ি । এই হাঁড়ি আর ভাতের একটি অদ্ভুত সহাবস্থান সূত্র আছে। বলা হচ্ছে, ভাত রান্না করবার জন্য রকমারি হাঁড়ি আছে। ভাতের ফ্যান যারা ফেলে দেয় তাদের হাড়ি একরকম, আর যারা ফেলেনা তাদের হাড়ি আর এক রকম। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, এই উপমহাদেশে যেখানে ভাতের খুব একটা চল নেই সেখানে কিন্তু হাঁড়ি নেই। থাকলেও ভ্যারাইটি নেই। সেক্ষেত্রে হাঁড়ির উপস্থিতি ভাতের প্রাধান্যতাকে দৃঢ় মান্যতা দেয়। যদিও হাঁড়ির ভ্যারাইটি নিয়ে চর্যাকাররা কিছু বলেনি। তবে চর্যায় বাসন বলতে হাঁড়ি পাশেপাশি কুড়ি অর্থাৎ কড়াইয়ের উল্লখে পেলাম না। যা গরীব শ্রেণীর অর্থনৈতিক দীনতায় ‘ওয়ান পট মিল’-এর সম্ভবনার দিকটি খুলে দেয়।

মধ্যযুগীয় খাদ্যাচার

বাঙালির মধ্যযুগীয় খাদ্যভাসের একটি পোক্ত কাঠামো তৈরি করা যায়। এবং এর সিংহভাগ কৃতিত্বই বর্তায় তৎকালীন বাংলার সাহিত্যকারদের উপর। এ সময়ের বিপুল উৎকৃষ্ট সাহিত্য বারবার নিঃশব্দে উঁকি মেরেছে বাঙালির রান্নাঘরে। তাদের খানাপিনা থেকে খাদ্যপদক্রম, আচার-বিচার সবই প্রত্যক্ষ করেছে তৎকালীন বাংলা সাহিত্য। এবার সেই সাহিত্য অনুসরন করে যদি দেখা যাবে এখানেও অগ্রাধিকার পেয়ে বসে আছে ভাত। শ্রীহর্ষ প্রাকৃতপৈঙ্গলে লিখছেন,

ওগগরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইকঘিত্তা দুগ্ধসজুত্তা ।

মোইণিমত্তা ণালিচগাচ্ছা দিজ্জই কন্তা খা পুনবন্তা ।।

অর্থাৎ, গরম ফেনা ওঠা ভাত তাতে গাইয়ের ঘি, পাট শাক, ময়না ( মতান্তরে মৌরলা) কলাপাতায় দুধ সহযোগে যার স্ত্রী তাঁকে পরিবেশন করেন তিনি পুণ্যবান। কাজেই আদি বাংলার মতো মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থাতেও ভাত ও মাছের প্রাথমিক শর্ত জারি করা হচ্ছে। তবে এই যুগের বিভিন্ন সাহিত্যে খাদ্যপদক্রম ও সহযোগী ব্যঞ্চনের বিশেষ উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জনবাবু ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)’–এ উনি লিখছেন, “ভাত সাধারনত খাওয়া হইত শাক ও অন্যান্য ব্যঞ্জন সহযোগে। দরিদ্র এবং গ্রাম্য লোকেদের প্রধান উপাদানই ছিল বোধহয় শাক ও অন্যান্য সবজি তরকারি। ডাল খাওয়ার কোনও উল্লেখই কিন্তু কোথাও দেখিতেছিনা। উৎপন্ন দ্রব্যাদির সুদীর্ঘ তালিকায়ও ডাল বা কলাইয়ের উল্লেখ কোথাও যেন নাই”। আসলে ডালের চল বাংলায় প্রথমে ছিলনা। এবং সেটা না থাকার কারণ বাংলার ভিজে পলিমাটি। ডালটা বরাবরই উত্তর ভারতে ছিল। বাংলায় সেটা এসেছে চৈতন্য পর্যায়ে। তার একটি বিশেষ কারণ নিরামিষাশী নতুন বৈষ্ণবদের প্রোটিনের চাহিদা বাড়াতে ডাল আসে উত্তর ভারত থেকে। সেই অজুহাতে মুসুর বাদে অন্যসব ডাল হয়ে গেল নিরামিষ। এবার একটি বিশেষ দিকের কথা বলে রাখা ভালো। বাংলার মধ্যযুগীয় খাদ্যাভাসের বিবর্তেনের দুটি বড় মুহূর্ত হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রীচৈতন্যদেব অন্য দিকে যবন শাসক। একদিকে যেমন চৈতন্য পর্যায় থেকে বাঙালি নিরামিষ খাদ্যধারার একটি নতুন অধ্যায় খুলে গেল, ঠিক তেমনই বাংলায় সুলতানি শাসন কায়েম হবার পর প্রথম বহিরাগত ভিন্ন খাদ্যরীতি বাংলার শ্বাশত খাবারকে প্রেরিত করল। বাংলায় মাংস খাবার রীতি আগে থেকেই ছিল । কিন্তু রন্ধনপ্রণালী ছিল আদি শাশ্বত বাংলার একান্ত নিজস্ব। কিন্তু সুলতানি শাসন কায়েম হবার পর বাংলার খাবারে ইন্দো-পারসিক প্রভাব লক্ষ করা যায়। বলা বাহুল্য, আমাদের অতিপ্রিয় ‘কারি’ রন্ধন পদ্ধতি কিন্তু এই ইন্দো-পারসিক প্রেরনারই ফলাফল। বেশ এই দুই রন্ধনপ্রেরনাকে নিয়ে চর্চার প্রথম ধাপে বরং আলোচনা করা যাক নিরামিষ খাদ্যাভাস নিয়ে।

মধ্যযুগীয় নিরামিষ খাদ্যধারা

হ্যাঁ, চৈতন্যদেবকেই মধ্যযুগীয় নিরামিষ খাদ্যধারার প্রাণপুরুষ ধরে নেওয়া যেতে পারে। তার অনুপ্রেরনায়ই চতুর্দশ শতক থেকে বাংলায় যে ভক্তিবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা তৎকালীন বাঙালির খাদ্যাভ্যাসকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছিল। পঞ্চদশ শতকে “চৈতন্যচরিতামৃতে” বাঙালির এই নিরামিষ রসনাতৃপ্তির যে ছবি পাওয়া যায় তা সত্যিই বেশ লোভনীয়। দেখা যাচ্ছে সেই রসনার স্বাদ স্বয়ং চৈতন্যদেবও উপেক্ষা করতে পারেননি। তার পাতে সে সময় থাকতো-

পীত সুগন্ধী ঘৃতে অন্ন সিক্ত কৈল

চারিদিকে পাতে ঘৃত বাহিয়া চলিল।।

কেয়াপত্র কলার খোলা ডোঙ্গা সারি সারি।

চারিদিকে ধরিয়াছে নানা ব্যঞ্জন ভরি।।

দশ প্রকার শাক নিম্ব সুকতার ঝোল

মরিচের ঝাল ছানাবড়া, বড়ী, ঘোল।।

দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধকুষ্মাণ্ড, বেসারি লাফরা

মোচা ঘণ্ট , মোচা ভাজা বিবিধ শাকরা।।

বৃদ্ধকুষ্মাণ্ডবড়ীর ব্যঞ্জন অপার

ফুলবড়ী ফলমূলে বিবিধ প্রকার।।

নব-নিম্বপত্রসহ ভৃষ্ট বার্তাকী

ফুল বড়ী পটলভাজা কুষ্মাণ্ড মানচাকী।।

ভৃষ্ট-মাষ, মুদগ সূপ অমৃতে নিন্দয়

মধূরাম্ল বড়াম্লাদি অম্ল পাঁচ ছয়।।

মুদগবড়া মাষবড়া কলাবড়া মিষ্ট

ক্ষীরপুরী নারিকেলপুলী আর যত পিষ্ট।।

এর পাশপাশি তার খাদ্যতালিকায় থাকতো নিমবেগুন ,পটলভাজা, ফুলবড়ি ভাজা, মুগের ডাল প্রভৃতি । সন্দেশ বা রসগোল্লার চল সেসময় ছিলনা। তবে মিষ্টির স্বাদ পূরণ হত মুগের বড়া, মাষকলাইয়ের বড়া, ঘিয়ের পায়েস (ঘৃত সিক্ত পরমান্ন) ক্ষীরপুরী, নারকেলপুলীর উপাদেয় উপস্থিতিতে। তবে চৈতন্যদেবের সবচেয়ে পছন্দের পদটি হল দুধলাউ। ‘চৈতন্যভাগবত’- এও শচীমায়ের হাতে দুগ্ধ-লকলকি দিয়ে নিমাইয়ের ভোজনের কথা বারবার এসেছে। বছরের পর বছর ধরে নব-উত্থিত বৈষ্ণবরা চৈতন্য আশ্রিত নিরামিষ খাদ্যধারাকে অনুসরণ করে এসেছে। আজও তা বর্তমান। তারা মুসুর ডাল ও পুঁই শাককে আমিষের দলে রাখতেন। এখনো কাটোয়ার শ্রীপাট গৌরাঙ্গবাড়ি ও মাধাইতলাতে কৃষ্ণের ভোগে পুঁই ও মুসুর ডালকে অশুচি মানা হয়। মধ্যযুগীয় নিরামিষাশী বৈষ্ণবদের শেষপাতের অম্বল ও মুখশুদ্ধিতে থাকতো ‘তেঁতুলের ঝোল’ বা জলপাইয়ের টক এবং ‘তাম্বল-কর্পুর’ সহযোগে বাঙালিরা মুখশুদ্ধি করতেন। অবশ্য ‘নরোত্তম বিলাস’ অনুযায়ী বৈষ্ণবরা পানে সুপারির বদলে হরিতকী খেতেন।


আরো পড়ুন: অজানা কথায় বাঙালি খাদ্য


মধ্যযুগীয় আমিষ খাদ্যধারা

আমিষ খাদ্যধারা দুটি স্বতন্ত্র দিক অবর্তিত হয়েছিল মধ্যযুগের বাঙালির পাতে। প্রথমটি এতদিন ধরে চলে আসা বাঙালির স্বতন্ত্র আমিষ রন্ধনপ্রনালী আর দ্বিতীয়টি বহিরাগত যবনদের নিজস্ব আদি রন্ধন প্রণালী। বলা বাহুল্য গোঁড়া হিন্দুরা রান্নায় যবনদের মতো পেয়াজ-রসুন দিত না। বহু যুগ পর্যন্ত তা ছিল তাদের কাছে অছ্যুত, যেমন ছিল মুরগিও। তবে বিবর্তনের ধারা সব মিশে গেছে। এখন পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া বাঙালির রসনার স্বাদ মেটে না। মধ্যযুগীয় হিন্দুদের স্বতন্ত্র আমিষের তালিকায় সর্ব প্রধান ছিল মাছ। এবার বাঙালির মৎস্যভক্তি নিয়ে অনেক কিছুই লেখা যায় কিন্তু মাছ সংক্রান্ত যথার্থতা বোধহয় কবি ঈশ্বর গুপ্ত দুই লাইনে করে গেছেন। তিনি লিখছেন,

“ ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল

ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল । ”

বেহুলার বিয়ের ভোজে মৎস্য ব্যঞ্জনের যে বাহার তা বেশ লক্ষণীয়। কি ছিল সে পাতে ?

১। বেসন দিয়া চিথল (চিতল)-র কোল ভাজা, ২। মাগুর মৎস্য দিয়া মিরিচের ঝোল, ৩। বড় বড় কৈ মৎস্যে কাঁটার দাগ দিয়া লবঙ্গ মাখিয়া তৈলে ভাজা ৪। মহাশৌলের অম্বল, ৫। ইচা (চিংড়ি) মাছের রসলাস, ৬। রোহিত মৎস্যের মুড়া দিয়া মাসদাইল, ৭। আম দিয়া কাতল মাছ, ৮। পবদা মৎস্য ও আদা দিয়ে সুখত (শুকতুনি) ৯। আমচুর দিয়া শৌল মৎস্যের পোনা, ১০। বোয়াল মৎস্যের ঝাঁটি (তেঁতুল মরিচ সহ) ১১। ইলিস মাছ ভাজা, ১২। বাচা, ইচা, শৌল, শৌলপনা, ভাঙ্গনা, রিঠা ও পুঠা (পুঁটি) মাছ ভাজা । সমস্ত ভাজাই তৈল দিয়া ।

মধ্যযুগীয় বাঙালির মৎস্যপ্রীতির আরো নমুনা মেলে তৎকালীন বিভিন্ন টেরাকোটা শিল্পকর্মে । যেমন পাল আমলে নির্মিত সোমপুর বিহার ও ময়নামতীর শালবন বিহারের একাদিক টেরাকোটা প্যানেলে মাছ কোটার দৃশ্য। এছাড়াও হুগলীর পারুলের বিশালাক্ষী মন্দিরের টেরাকোটায়, মেদিনীপুরের ভাট্টগ্রামের দামোদর মন্দির ও কৃষ্ণপুরের ব্রজরাজ মন্দির কিংবা বাঁকুড়ার নারায়নপুরের রাধাদামোদর মন্দিরের টেরাকোটা প্যানেলের কারুকর্মে ।

বাঙালির মাছের আলোচনা হবে আর ইলিশ ব্রাত্য থাকবে তা কি করে হয় ? ইলিশ নিয়ে হ্যাংলামিটা বরাবরই বাংলার রসাগ্রাহী কবিরা করে গেছেন। সাহিত্যরস ছাপিয়ে সে রস অচিরেই তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের পাঠকদেরও জিভে জল আনবেনা তা তাদের লেখার বর্ননাতেই প্রকট। তবে ইলিশ মাছের আদি উল্লেখটি পাওয়া যায় জীমূতবাহনের রচনায়। তারপর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পূর্ব বঙ্গের পদ্মার ইলিশের গুনগান গেয়েছেন মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত থেকে বংশীদাস, জানকীনাথ। বিজয়গুপ্ত লিখছেন,

আনিলা ইলিশ মৎস্য করিল ফালা 

তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন দক্ষিন সাগর কলা

আবার বংশীদাস লিখছেন–

ইলিশ তলিত করে, বাচা ও ভাঙ্গনা ।

শউলের খদ ভাজে আর শউল পোনা ।।

মধ্যযুগের সাহিত্যক উপাদানে মাছ নিয়ে এতসব উল্লেখ থাকলেও স্মৃতি পুরানে কিন্তু মাছ নিয়ে নানা নিষেধাঞ্জা প্রচলিত ছিল। যেমন-বৃহদ্ধর্মপুরানে বলা হচ্ছে, শুধুমাত্র শুভ্রবর্ণ ও আঁশ যুক্ত রোহিত, শাল, শফরি প্রভৃতি মাছ ব্রাহ্মণের ভক্ষ । অবশ্য তারাও বহু আগে ‘মনুসংহিতা’র চতুর্থ অধ্যায়ে ১৬ সংখ্যক শ্লোকে বলা হয়েছে, বোয়াল ও রোহিত এই দুই মাছ রাজীব মাছ, সিংহতুণ্ড মাছ ( যার ঠোঁট সিংহের মতো ) ও আঁশযুক্ত মাছ দৈব ও পৈত্রাদি কাজে এবং প্রানাত্যয়াদি স্থলে ভক্ষণ করতে হবে। মূলত মধ্যযুগীয় স্মৃতিকাররা রুই মাছকে মৎস্য খাদ্যতালিকার সিংহাসনে রাজাধিরাজে ভূষিত করেছেন তা বলাই যায়।

এবার বরং একটু চোখ রাখা যাক যবনদের মৎস্য খাদ্যপ্রীতির উপর। তারা মূলত মাংসভক্ষনকারী হলেও লোভনীয় পদ্মার ইলিশের লোভ সামলাতে পারেনি। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত তাদের মুসলিম বাবুর্চিরা তাদের ইলিশ রেঁধে খাইয়েছেন। বলা বাহুল্য সে ইলিশ পেঁয়াজ রসুন সর্ষে নিয়ে জমিয়ে ইলিশ। মধ্যযুগের কট্টর হিন্দু সামাজ পেঁয়াজ রসুনকে সেকালে রান্নাঘরে ঢোকার অনুমতি দেননি। কিন্তু সুলতানি শাসক থেকে মোঘল সুবাদার কিংবা মুর্শিদাবাদের নবাব তারা কিন্তু খাবারে অবাধে পেঁয়াজ-রসুন ঢেলেছেন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো মধ্যযুগীয় বাংলায় রাজধানী হিসেবে পূর্ববঙ্গের ঢাকার গুরুত্ব পাবার সঙ্গে সঙ্গে আদি বাংলা ও মুসলিম শাসকদের তুর্কি-আফগান-পারসিক প্রভাবের সমন্বয়ে বাংলার খাদ্যপ্রেমীরা পেয়েছিল ঢাকাই খাবারের স্বাদ। যা আজও বর্তমান। মাছ নিয়ে শেষ করার আগে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর পছন্দের একটি পদের নাম আপনাকে শুনিয়ে দেব। গঙ্গার ইলিশকে মান্যতা দিয়ে নিয়ে এক নতুন পোলাও খাবার আবদার করেছিলেন তার বাবুর্চির কাছে। সে পদ আজও জনপ্রিয় মুর্শিদাবাদে। ইলিশ মাছের ‘মাহি পোলাও’ ।

মধ্যযুগীয় খাদ্য তালিকায় মাছ যতই প্রধান স্থান পাক না কেন। বাঙালির মুখ থেকে মাংসের আদিম স্বাদ কিন্তু মোটেই যায়নি। মধ্যযুগের বাঙালির মাংস খাবারের বাহার শুনলে আজও যেকোনো বাঙালির চোখ কপালে উঠবে। হাঁস, ছাগল, হরিণ, পায়রা, খরগোশ, গোসাপ (কালকেতুর উপাখ্যান স্মরণীয়) কচ্ছপ এমনকি শজারু পর্যন্ত সে নাকি উদরস্থ করেছে। বাংলার স্মৃতিকার ভট্টদেব তাঁর প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণ গ্রন্থে গোধা, কচ্ছপ, শশক প্রভৃতি পঞ্চনখী প্রাণীর মাংস ভক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে চতুর্দশী তিথিতে এগুলি খাওয়া নিষিদ্ধ। সে যুগের মাংস রসনা তৃপ্তির একটি চমৎকার নিদর্শন পাওয়া যায় ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ

কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝোল ঝাল রসা

কালিয়া দোলমা বাঘা সেকচি সমসা ।

অন্য মাংস শিক ভাজা কাবাব করিয়া

রান্ধিলেন মুড়া আকে মসলা পুরিলা ।।

মধ্যযুগীয় উচ্চশ্রেণীতে মাংস খাওয়া নিয়ে কিছু বিধি নিষেধ থাকলেও অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের মাংস খাওয়া নিয়ে স্মার্তরা অনেকটাই ছাড় দিয়েছিলেন। যেমন, অত্রিসংহিতায় ব্রাহ্মণদের মাংস বেচতে নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও শুদ্রকদের উপর কোন নিষেধ জারি হয়নি। তাই বোধহয় কালকেতু ফুল্লারাদের বাজারে মাংস বেচে জীবিকা নির্বাহ করতে অসুবিধা হয়নি। তবে মধ্যযুগীয় বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কদর ছিল খাসি ও পাঁঠার মাংস। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে ‘বুড়া খাসির তেল’ কিংবা মানিক গাঙ্গুলির ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে ‘খাসি মাংস ভাজা’ ছিল সেকালে উচ্চবিত্ত বাঙালির রসনার অঙ্গ। সেকালে খাসির মাংস রান্না করার যে উপাদেয় বর্ণনা ‘মনসামঙ্গলে’-এ দ্বিজ বংশীদাস দিচ্ছেন-

ভাজিছে খাসীর তৈলে দিয়া তেজপাতা

ধনিয়া সুলপা বাটি দারচিনি যত।

মৃতা-মাংসে ঘৃত দিয়া ভাজিলেক কত ।।

রান্ধিছে পাঁঠার মাংস দিয়া খর ঝাল।

পিঠালী বাটিয়া দিল মরিচ মশাল।

আবার বিজয়গুপ্ত তাঁর কাব্যে জানাচ্ছেন।

মাংসেতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল 

ছাল খসাইয়া রান্ধে বুড়া খাসির তেল।।

ছাগ মাংস কলার মুলে অতি অনুপম।

ডুম ডুম করিয়া রান্ধে গারোডের চাম ।

দুর্গাপুজোতে বলির মাংস রান্নায় আজও পেঁয়াজ রসুনের ব্যবহার চলেনা। বাংলার স্মৃতিশাস্ত্রে পেঁয়াজ রসুনকে ‘জাতিদুষ্ট’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেক্ষত্রে বলির মাংস রাঁধবার জন্য ঘি, মরিচ, নারকেল, গরমমশালা প্রভৃতির ব্যবহার হয়। তবে বহিরাগত যবনদের পাতে মাংসের পদে ঢেলে পড়ত পেয়াজ-রসুন। তাদের খাবার বরাবরই ঝাঁঝাল, মশলাদার। পূর্ববঙ্গের ঢাকাই খাবারে যেরূপ দেখা যায়। সে সময় তাদের পাট থেকে আজকের বাঙালিরা নানা মাংসের পদ পেয়েছে। যেমন- মোরগ মসাল্লাম, কোরমা, কালিয়া, কাবাব। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো মধ্যযুগের প্রথমভাগে যে ‘পলান্ন’ নামক নমক পদটি পাওয়া যায় তা ছিল আদতে ‘বিরিয়ানি’।

বাঙালির খাদ্যের আধুনিক যুগ

এই কথাটা বাঙালিকে হামেশাই শুনতে হয় যে সাহবেরাই আমাদের আধুনিক করেছে। তার আগে আগে বাঙালিরা ছিল ‘ভেতো’ কুঁড়ে। শিক্ষিত সমাজের রান্না নাকি তাদেরই দান। কিন্তু তা যে একেবারেই নয় তা ইতিহাসই সাক্ষ্য দিচ্ছে। রানি প্রথম এলিজাবেথের সময়েও ইংল্যন্ডের সাহেবদের খাবার বলতে ছিল শীত আসার আগে নুন মাখিয়ে রেখে দেওয়া মাংস আর শুটকি মাছ। আর তা খেতে হতো কোন মশলা ছাড়াই। ভারত অভিযানের কল্যাণে ভারতের মশলার ভাণ্ডার ইংল্যন্ডে না পৌঁছালে সেই ব্রিটিশ কুইসিনের যে কি দশা হতো সেটা ভালোই আন্দাজ করা যায়। তবে হ্যাঁ, সাহেবদের কাছ থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যাচার আমাদের বাঙালিরা আয়ত্ব করেছে। সেটা হল সকালের প্রাতরাশ আর সান্ধ্যভোজ । হ্যাঁ, প্রাচীন ও মধ্যযুগেও লোকে সকাল- সন্ধ্যায় খেত কিন্তু তাঁর কোন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিলনা। যেটা হল ব্রিটিশরা আমাদের দেশে আসার পর। তাদের আরও একটি দান হল আমাদের এই চলতে ফিরতে ফাস্টফুড খাবার চল। এই বদভ্যাসটি তাদের থেকেই বাঙালি রপ্ত করেছে। এই সময় বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের বনিকরা বাংলার খাদ্যধারাকে প্রভাবিত করেছে। এর মধ্যে ব্রিটিশ ও পোর্তুগিজরা বাঙালির খাবারকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছে। আমি এখানে বাঙালির দুটি নিত্যচাহিদার নাম করব – চা ও মিষ্টি। চা গাছ ভারতে পূর্বে থাকলেও চা চাষ ও পানের অভ্যাস ধরানোর কৃতিত্ত্বটা কিন্তু ব্রিটিশদের ওপরেই বর্তায়। ১৮৩৮ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক ‘চা সমিতি’ তৈরি করে ভারতে চা চাষকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলেন। পরে দ্বারকানাথ ঠাকুর ‘বেঙ্গল টি আসোসিয়েশন’ নামে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি খুলে বাঙালির চা-প্রীতিকে উস্কে দেন। বলা বাহুল্য এখন বাঙালির সকালে চা ছাড়া চলেনা। ঠিক চায়ের মতোই আরেকটি বাঙালির অতি পছন্দের বস্তু হল মিষ্টি । ‘মিষ্টিখোর’ বাঙালির বদনাম চিরকালই । কিন্তু এই মিষ্টিই বাঙালির মুখে তুলেছিল পোর্তুগিজরা। বাংলায় মিষ্টি যদিও আগেই ছিল। তার নমুনা আমরা মধ্যযুগীয় চৈতন্যের খাবার পাতেই পেয়েছি। কিন্তু তা ছিল গুড়ের বা চিনির মিষ্টি। প্রাচীন বাংলায় দুধকে ছিন্ন করা পাপ বলে গন্য হতো তাই সে যুগে মিষ্টি থাকলে তা ছানার মিষ্টি নয়। কিন্তু পর্তুগিজরা বাঙালিকে ছানা কাটতে শেখাবার পরই মিষ্টি নিয়ে বাঙালির হইহই পড়ে যায়। তারা হুগলীতে ছানা তৈরির কারখানা খোলার পরই ময়রাদের মিষ্টি বানার হিড়িক পড়ে গেল। রসগোল্লা, সন্দেশ, জলভরা, পান্তয়ার মতো জিভে জল আনা মিষ্টি বাঙালির পাতে পড়ল। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে পোর্তুগিজদের বাংলায় ব্যবসা করতে এসে থেকে যাওয়া বংশধরদের সংখ্যা প্রায় বিশ হাজার ছুঁয়ে যায়। এঁদের অনেকেই রন্ধনশিল্পে মধ্যম পাণ্ডব ছিলেন। নিজেদের দেশের রান্নার কৌশল বাঙালির বিভিন্ন আদি খাবারের সাথে মিশিয়ে দুর্দান্ত সব ফিউশন রেসিপি বাংলার মাটিতে লুকিয়ে রেখে যায়। সত্যি বলতে তার অনেকগুলিই আজ বাংলার লস্ট রেসিপি। এ রকমই একটি রিসিপির সন্ধান দিচ্ছেন বাংলার এক পর্তুগিজ ডিসেন্ডেন্ট প্রদীপ রজারিও। রেসিপিটির নাম ‘ঠাকুরদার নোনা গোস্ত’ , যে রেসিপিতে মাংসকে ম্যারিনেট করে মাটির সড়ায় মাটির নীচে দু-সপ্তাহ রেখে দেওয়া হতো তারপর তা রান্না করা হত। প্রাচীন বাংলায় বাসি খাবার খাওয়ার প্রচলন কোন দিনই ছিলনা। যে অভ্যসটা বাঙালি কিন্তু ইউরোপীয় সামজের থেকে নিয়েছে । কিছুদিন আগেও যখন বাঙালির ঘরে ফ্রিজ আসেনি তখন, মধ্যবিত্ত বাঙালিরা বেঁচে যাওয়া মাংস পুড়ে রাখতো ‘মিট সেফ’-এ, যা এখন আর প্রায় দেখাই যায়না। তারপর বিভিন্ন আনাজপাতি বিশেষত আলু আর লঙ্কা আর টমেটো পর্তুগিজদের হাত ধরেই বাঙালির হেঁশেলে ঢোকে। তবে আলুর জনপ্রিয় ব্যবহারটি বোধহয় বাঙালিকে শিখিয়ে গেছেন আওধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। তিনি যখন লাখনৌ থেকে সদলবলে কলকাতায় এসে থাকতে শুরু করলেন তখনই তার সাথে এল তার অতি পছন্দের বিরিয়ানিও। কিন্তু বিরিয়ানি কলকাতায় এসেই তার রূপ পালটে গেল। কারন তাতে যোগ হল আলুর স্বাদ। যদিও আলু কোনো কালেই বিরিয়ানির রিসিপিতে ছিলনা। সেটা তৎকালীন নবাবের কর্মচারিরা মাংসের যোগানের ঘাটতি পূরণে হাঁড়িতে ফেলেছিল। আজ বিরিয়ানিতে সেই আলুই ফ্যাশন। আলু ছাড়া বিরিয়ানি বাঙালির কাছে নুন ছাড়া পান্তা। বেশ সব জাতির কথা তো হল এবার যাদের কথা না বলেই নয় তাদের কথা বলি। তারা হলেন চিনা যারা ১৮২০ র পর কলকাতায় এসে টেরিটা বাজার (অধুনা ট্যাংরা) অঞ্চলে এসে থাকতে শুরু করে। তারা যেহুতু এসেছিল চিনের ক্যান্টন অঞ্চল থেকে তাই তারা ভারতে অন্যান্য বসবাসকারী চিনা থেকে আদি ও খাঁটি চিনা। তাই তাদের রান্নাতেও সেই আদি চিনা স্বাদই কলকাতা পেয়েছিল। আজ আমাদের অতিপ্রিয় চাউমিন যে তাদেরই আনা তা বাঙালি ভোলে কি করে। এছাড়াও চিনিও নাকি এদেরই আনা। যদিও এ বিষয়ে একটি বিরোধী মত আছে। বিরোধীপক্ষ বলে চিনি গেছিল ভারত থেকেই চিনে। তবে একথা স্বীকার করেই হবে চাউমিন আজ বাঙালির অঘোষিত জাতীয় খাদ্য। তবে চাউমিনেও আলুর সংযোজনটা চিনি-দ্রব্যের বঙ্গীয়করন ! যেটা বাঙালিরা বরাবর করেই থাকেন ।

শেষের কথা

আলোচনার শেষ পর্বে এসে একটি কথাই বলব, বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতি প্রবাহমান নদীর মতো যার জলে মিশে রয়েছে আদিবঙ্গের আদিম পলি আর বাঙালির পেরিয়ে আসা চার সহস্র বছরের পরিচয়ের শিকড় যা আজও বইতে বইতে কোনও ঘাটে এসে ঠেকলেই প্রকৃত বাংলার শেষ বংশধররা শিকড়ের গায়ে লেগে থাকা আদিম পলির গন্ধে ঠিকই চিনতে পারে, এ আমার বাংলা !

পুনশ্চ, খাবার নিয়ে এতো আলোচনা করলাম শেষপাতে মিষ্টি না পড়লে চলে, আর সাহিত্যে বাঙালির শেষপাতের মিষ্টি রবীন্দ্রনাথ। তাই তার কবিতা দিয়েই শেষ করছি-

“ আমসত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলি দলি

সন্দেশ মাখিয়া লও তাতে

হাপুস হাপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ

পিপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে ।”

তথ্যসূত্র

১। বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব) – নীহাররঞ্জন রায়

২। খানাতল্লাশি – পিনাকী ভট্টাচার্য

৩। ভারত অনুসন্ধান- অঞ্জন গোস্বামী

৪। মাছ ও বাঙালি- শ্রীরাধাপ্রসাদ গুপ্ত

৫। প্রাচীন বাংলার গৌরব- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

৬। মধ্যযুগের বাঙালির খাবার- রূপঙ্কর সরকার ( নুনেতে ভাতেতে- ক্যাফে টেবিল )

৭। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে হিন্দু বাঙালির খাদ্যাভাস – মুগ্ধ মজুমদার

৮। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রসঙ্গ – বানী সংসদ

৯। ইন্টারনেট ও ফেসবুক পোস্ট ।

 

কৃতজ্ঞতা: সপ্তডিঙ্গা

 

শুভদীপ বোয়াল

ট্র্যাভেল ও ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট ছাত্র। সম্পাদক, ভূত-তত্ত্ব।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত