৩০৪ নং কেবিন (পর্ব-৪)
এই দুপুরগুলো বড় নিঃসঙ্গ।বাইরের চড়া রোদ।কাকেদের বিষন্ন কা কা, পায়রাগুলোর বকবকম।একটু আগেই মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করেছে মেঘ।আজও ছোটো বোন জিয়াই খাবার পাঠিয়ে ছিল।নিম আলু সেদ্ধ, মুসুর ডাল, মোচা, পোস্ত বাটা।এই কদিনে আজ খানিকটা খেতে পারল সে। হাসপাতালের খাবারের গন্ধেই বমি আসছিল তার।
জিয়ার উপর খুব চাপ যাচ্ছে , নিয়মিত খাবার , জামা ধুয়ে পাঠানো, মেজ বোন সুমাও টিফিন বানিয়ে পাঠাচ্ছে।মাঝে মাঝে ভাবে মেঘ- কী হত আমার এরা দুজন না থাকলে ! তারপর ভাবে, ঈশ্বর এভাবেই সব ঠিক করে রাখেন ।
নিঝুম এই মন খারাপ করা দুপুরগুলো কেমন একা একা।তার ঘুম আসছে না।বসে বসে বাইরের রাধাচূড়া গাছটার, আর একটু দূরের নারকেল গাছদের পাতার দোলুনি দেখছে সে।
ওরা কী পরস্পর কথা বলছে! কী কথা! কেউ কী শুনছে ? নিশ্চয়ই শুনছে। নইলে ওদের এত ফিসফিসানি তো বৃথা হয়ে যেত।
সকালে সিস্টার রূপা অনেকগুলো গান শুনিয়েছে।এত অসাধারণ গানের গলা, মেঘ মোহিত হয়ে শুনছিল।সে গাইছিল, গোঠের রাখাল বলে দেরে কোথায় বৃন্দাবন. . . মেঘ ওর গানে বৃন্দাবন দেখছিল, রাখাল দেখছিল ।
তন্ময় হয়ে চোখ বুজে সে গাইছিল একের পর এক গান।গান শেষের পর মেঘ জড়িয়ে ধরল রূপাকে।ওর চোখে জল।
দিদি এভাবে কেউ আমাকে বলেনি গান গাইবার কথা। শখ করে গাই।আমি তো কখনো গান শিখিনি, শুনে শুনে তুলি।
তুই গান ছাড়িস না। এ ঈশ্বরের পরম দান তোকে। মেঘ বলল।
সে মেঘকে আলিঙ্গন করে একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে বলে গেল, তুমি রাতে আছো তো আজও।আমার ডিউটি আছে।শোনাবো তোমাকে আরো গান।
রূপা চলে যায়।
মেঘ এই ঘরে বসেই দেখতে পায় হালকা গোলাপি রঙের রুদ্রাণী লেখা ফ্ল্যাটটার চার তলার ছাদে একটা গেঞ্জি পরা ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। সে অনেকক্ষণ ধরে একবার সেদিকে আর একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে আর কোনো ঘুড়ি আছে কিনা।
নেই।একটা ফ্যাটফ্যাটে নীল সাদা আকাশ একাই ।কতগুলো কাক কেবল পাক মারছে। পাশের ছাদটায় দড়িতে খয়েরি, সবুজ, লাল, নীল, ম্যাক্সি, হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি, তোয়ালে ঝুলছে ।ওগুলোর মালিক কে বা কারা মনে মনে ভাবার চেষ্টা করে।ওই ছেলেটাই কী! কিংবা অন্য কেউ।
উত্তর না পেয়ে ওদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নেয় মেঘ।
পিয়ালি আজ সকালে তার অ্যাটেন্ডেন্ট।ও দেওয়ালে পিঠ দিয়ে একমনে মোবাইল ঘাঁটছে।নিজের মনেই হাসছে। মেঘ যে ওকে দেখছে সেদিকে তার খেয়াল নেই।
আবার বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে দেয় মেঘ।একটা ভাঙা ডালে বসে কাকটা ঠোঁট বেঁকিয়ে পালকের নিচ দিয়ে ঘাড় চুলকাচ্ছে। আর একটা ডালে ছোট্টো চড়ুই।বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল সে।ওদের মধ্যে কী মানুষের মতো বিবাদ, কোলাহল আছে? কে জানে!
এখানে থাকতে থাকতে তার মনেও অভিমান জড়ো হয়। কেন প্রিয় মুখগুলো ঠিক সময়ে এল না দেখা করতে! কেন যাদের কাছের মনে হয় তারা একবারও খোঁজ নিল না . . পরমুহূর্তে ভাবে, “আমার নাইবা হল পারে যাওয়া। যে হাওয়াতে চলত তরী অঙ্গেতে সেই লাগাই হাওয়া ॥ নেই যদি বা জমল পাড়ি ঘাট আছে তো বসতে পারি।“
সবুজ গেঞ্জি পরে সুইপার রাজু এলো।একহাতে ফিনাইল, আরেক হাতে বড় ঝাড়ু।
দিদি ফিন্যাইল দিব? তোমার তো গন্ধ লাগে , বলে বার দুয়েক ভিজে ঝাড়ুটা ঘরে বুলিয়ে বলল, আর কতদিন বলছে ডাক্তার?
মেঘ বলল, দেখা যাক।
এখানে কী আর ভালো লাগে! ডাক্তারকে বলো ছেড়ে দিতে, অনেকদিন তো হল।
রোজই তো বলছি রে।ছাড়ছে কই! ব লে জানতে চায় -কোথায় থাকিস তুই.?
পালপাড়া ফাঁড়ি।৮ টায় বাড়ি যাব, স্নান করে অল্প খেয়ে আবার চলে আসব।
রাতেও ডিউটি?
হ্যাঁ , ২৪ ঘন্টা।এমারজেন্সি সার্ভিস কিনা!
পিয়ালি এতক্ষণে হঠাৎ যেন হুশ ফিরে পেল। মোবাইল ছেড়ে বলে উঠলো, তোমার কাজ হলে এসো, মেলা বকিও না পেশেন্টকে।সিস্টার দিদিরা বকবে জানলে।
দেখছ দিদি, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছ বলে কেমন ব্যবহার করছে।আমি কী অচ্ছুৎ আছি!
মেঘ তাড়াতাড়ি বলে, পিয়ালি চুপ কর।
শালা দুনিয়া হারাম।খেটে মরব, কিন্তু ব্যবহার দেখো! বলতে বলতে রাজু বেরিয়ে যায় ।
পিয়ালিকে বকে মেঘ।এভাবে বলিস কেন? তোদের থেকে তো ওদের কাজ বেশি ।একটু কথা বললে কী এসে যায়!
তুমি জানো না দিদি, একবার সুযোগ দিয়েছ কী মাথায় চেপে বসবে।কী জাত তার নেই ঠিক। পিয়ালি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়।
মেঘ অবাক হয়ে যায় ওর কথা শুনে।হাসপাতালেও জাতপাত! সিস্টার সুজাতাকে দেখে তো তার মনে হয়নি সে মুসলমান। বরং মামাতো বোনার নামের সঙ্গে মিল থাকায় পরম আনন্দে তাকে সেই মুহূর্তে বোন পাতিয়ে নিয়েছে সে। অথচ এরা!
চুপ করে যায় মেঘ। জাতপাতের গোঁড়ামিই শেষ করবে এই দেশটাকে। নিজের মনেই হঠাৎ রেগে যায় সে। অনেক কষ্টে সংযত করে নিজেকে।
সিস্টার এলেন। এন্টিবায়োটিক চালু হবে। বাঁ হাতে স্যালাইনের মধ্যে দিয়ে এন্টিবায়োটিক দেওয়া শুরু করল সিস্টার।এই সময়টা বড় কষ্ট হয়, জ্বালা করে ।কয়েক মিনিটের মধ্যে হাত ফুলে গেল।স্যালাইন যাচ্ছে না।চ্যানেল জ্যাম হয়ে গেছে ।
এই তো কালকেই চ্যানেল করা হল। সিস্টাররা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল। বরফ, থম্বোকম দেওয়ার পর আবার অন্য জায়গায় চ্যানেল করল।
এন্টিবায়োটিক যাচ্ছে শরীরে।জ্বালা করছে হাত, ভারি হচ্ছে, সেই যন্ত্রণা ভোলার জন্য মেঘ মনে মনে গুন গুন করছে সকালে সিস্টার রূপার শোনানো মন ভোলানো গান –
“বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি ।
শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে
ঊর্ধমুখে নরনারী ।।
না থাকে অন্ধকার, না থাকে মোহপাপ,
না থাকে শোকপরিতাপ ।
হৃদয় বিমল হোক, প্রাণ সবল হোক,
বিঘ্ন দাও অপসারি”।
.
কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক