Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,eid-2021-bangla golpo tanjina hossain

ঈদ সংখ্যার গল্প: আমার বন্ধু, আমার শত্রু । তানজিনা হোসেন

Reading Time: 7 minutes

 

পাখিটার কি ডানা ভেঙে গেছে?

গামলা ভর্তি বরফ ঠান্ডা পানিতে পা চুবানো নভেরার।  পায়ের গোড়ালি লাল, ফুলে ঢোল। নভেরার সুন্দর মুখটি যন্ত্রণাকাতর।  গাঢ় করে টানা কাজল দেয়া চোখ দুটি ছল ছল করছে। সমুদ্র অতল সেই চোখে গভীর বেদনার আঁকিবুঁকি। 

ইসমত ঘরে ফিরে ওকে এ অবস্থায় দেখে উদ্বিগ্ন হন- কী হল? কিভাবে?

-ডানা ভেঙেছে আবার। স্বগতোক্তি করে নভেরা। পাখিটার।  ডানা।  আবার!

পাখি তার বড় প্রিয়। প্যাঁচা।  নয়তো অনেক উঁচুতে একটা একলা ভুবনচিল।  কিংবা একটা রহস্যময় শালিক যে কিনা একদিন তার শবযাত্রী হবে।  অথবা একটা রক্তবর্ণ দ্যুক।  পাখিরা তাকে ভাবায়।  কেন তারা অকারণে পরিযায়ী জীবন যাপন করে? কেন তারা বার বার ঠিকানা হারায়?

নভেরার পাখি হতে ইচ্ছে করে খুব। 

ইসমত কিছু না বলে ড্রয়ার খুলে ব্যথানাশক মলম খুঁজে বের করেন।  ফিরে আসেন সাদা ফুল নকশা করা একটা সুতির রুমাল হাতে, আর সেই মলম।  হাঁটু গেড়ে বসেন ঠান্ডা পানির গামলার পাশে।  বলেন-পা ওঠাও, মলম লাগিয়ে দিই।

কী সুন্দর মসৃণ ফরসা দুটি পা।  বোম্বে শহরের মাঝখানে এই উঁচু দালানের কাঁচের জানালা ভেদ করে আসা শেষ বিকেলের হলদে আলোয় আশ্চর্য সুন্দর পা দুটি এক জোড়া পদ্ম ফুলের মত ফুটে থাকে ইসমতের বৈঠকখানায়।  নভেরার পা দেখে ইসমতের সুদূর অতীতে ফেলে আসা লাহোরের এক ধূসর সোনালি বিকেলের কথা মনে পড়ে যায়।

যেদিন আদালত থেকে বেরিয়ে ইসমত, মান্টো আর শহিদ একটা টাঙ্গা নিয়ে শহরময় মহানন্দে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।  ঘুরে ঘুরে কাশ্মিরী শাল আর কারুকাজ করা জুতা কিনেছিলেন দোকান থেকে।  পথের ধারে দাঁড়িয়ে মাছ ভাজা খেয়েছিলেন কাগজের প্লেটে।  কোটের পকেট ভর্তি করে নিয়েছিলেন বাদাম।  সেদিন মান্টোর ধবধবে ফরসা দুটি পা টাঙ্গার পাটাতনে দেখে ইসমত ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন।

আমার পা দুটি আমি প্রত্যাহার করে নিয়েছি-মান্টো অবশ্য বলেছিল।

কেন?-ইসমত প্রতিবাদ করেছিলেন-পা দুটি আকর্ষণীয়।  সুন্দর!

-এগুলি মেয়েদের পায়ের মত।

-তাতে সমস্যা কি? মেয়েদের প্রতি তো আপনার আগ্রহ কম নয়!

-এটা একেবারেই ফালতু কথা ইসমত। -মান্টো রেগে গিয়েছিল একটু-আমি মেয়েদেরকে একজন পুরুষের মত করেই ভালোবাসি।  তার মানে এই নয় যে আমার পা মেয়েদের মত হতে হবে! 

সাদা ফুল তোলা রুমালটা দিয়ে নভেরার পদ্ম ফুলের মত পা দুটি মুছে দিয়ে ইসমত তার খসখসে আঙুলে ব্যথা নাশক মলম ঘষে দেন।  যন্ত্রণায় কাতরে ওঠে নভেরা।  ইসমত ভাবেন তার ভাই আজিম বেগ চুঘতাই এর পা দুটিও ছিল ভারি সুন্দর।  আম্মা বলতেন, যাদের পা সুন্দর তারা খুব মেধাবী আর সংবেদনশীল হয়!

কিন্তু এই সব মলমে কি সত্যি সব ব্যথা সারে?

-আজ নাচতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে নভেরা। পায়ের গোড়ালি আর হাঁটুতে চোট পেয়েছি। নাচটা বোধ হয় আর হবে না। 

ইসমত স্বান্তনা দেন, ‘’ভেব না।  ফয়েজ সাহেব বোম্বেতে এসেছেন।  উনি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন।’’

নভেরা এ কথা শুনে কেন যেন বিষন্ন হয়ে যায়।  মেয়েটা সাক্ষাৎ বিষন্নতার প্রতিমূর্তি।  গাঢ় কালো শাড়ি, কপালে কালো টিপ।  চোখেগাঢ় করে কাজল আঁকা।  কালো কেন এত প্রিয় ওর? অথচ ইসমতের প্রিয় রং সাদা।  ইসমতের শহরে সাদা সাদা তুলোর মত মেঘ শরতের আকাশ জুড়েএমাথা থেকে ওমাথা উড়ে বেড়ায়। বোম্বের সব উঁচু নিচুদালান বাড়ির ছাদে বিকেল বেলা ঘুড়ি ওড়ায় শিশু বুড়োরা সেই আকাশে।  সাদা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ঘুড়িগুলো মাছরাঙা পাখির মত ডানা মেলে নেচে ওঠে।

আর ইসমতের গল্পেও সাদা লিহাফ গভীর নির্জন অন্ধকারতম রাতে হাতির শুঁড়ের মত ফুলে ওঠে বেগমসাহেবের বিছানায়! কিংবা মেহদি মাখা নববধূর হাতে ঢেলে দেয়া হয় ঘন সাদা ক্ষীর যা চেটে চেটে খায় তার ভড়কে যাওয়া নতুন স্বামী!

নভেরা মুখ নীচু করে বলে-আমার জীবন দুর্ঘটনাময়।  যখনই আমি কিছু করতে চাই, একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা এসে সব তছনছ করে দেয়।  গুরুপিল্লাইদের ওখানে আমার আর যাওয়া হবে না।  আমি জানি।  এই শেষ! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নভেরা।  মেয়েটা কম কথা বলে।  ইসমত ঠিক তার উল্টো।  সেবার লাহোরে, আদালতে দ্বিতীয়বার শুনানির আগের রাতে, শ্রদ্ধাভাজন আসলাম সাহেবও ধমকে উঠেছিলেন-তুমি বড় বেশি কথা বলো।

ইসমত জবাব দিয়েছিলেন, ঠিক।  আমার আম্মাও তাই বলতেন।  বলতেন তুই শুধু দুইটা কাজই পারিস।  জিভ নাড়াতে আর পেট ভরাতে!

আসলাম সাহেব রেগে গিয়ে বলেছিলেন, এত কথা বলো না ইসমত।  কাল তুমি আদালতে ক্ষমা চেয়ে নেবে।

-কী হবে যদি ক্ষমা না চাই? জরিমানা?

-আর অসম্মান।  বেইজ্জতি!

ইসমত চশমাটা কপালের ওপরে ঠেলে দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসেন।  মেয়েটার সাথে কখনও গল্প করা হয় নি।  যদিও শুনেছেন লাহোরের শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনে সে ব্যাপক আগ্রহের জন্ম দিয়ে এসেছে।  কয়েক মাস আগে ফয়েজ সাহেব ওকে রেখে গেছিলেন এক কুয়াশা মাখা ভোরে।  বলেছিলেন-ও তোমার এখানে থাকবে কিছুদিন।  নাচ শিখতে এসেছে বোম্বেতে। 

ইসমতের ফ্ল্যাটটা তো সকলের জন্য উন্মুক্ত।  নতুন গোঁফ ওঠা কবি থেকে শুরু করে বেঙ্গালোর এর বেশ্যা অব্দি।  যার যখন ইচ্ছে এখানে আসে।  ইসমত কাউকে ফেরান না।  কিন্তু মেয়েটার অদ্ভুত বিষন্ন দুটি চোখ, পিঠময় ছড়ানো এক রাশ ঘন কাল চুল আর মিশকালো বেশভূষা দেখে অবাক হয়েছিলেন। কদিন যেতেই বুঝেছেন সে ভীষণ অন্যমনস্ক।  নিজের চারদিকে এক দুর্ভেদ্য কালো দেয়াল তুলে দিয়ে নিজের ভেতর এক পরাবাস্তব জগতে বিচরণ করে মেয়েটা।  কখনও উষর  আকাশের দিকে চেয়ে একটা সারা বিকেল কাটিয়ে দেয়, আর কে জানে পথ চলতে বোম্বের রাস্তায় দানা খুঁটে খাওয়া কবুতরদের সাথেও কথা বলে হয়তো।  গুরুপিল্লাইদের ওখানে ভরতনাট্যম শিখে ও যখন ফেরে তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে।  তারপর সে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। 

ফয়েজ সাহেব বোম্বে এলে এখানে ওখানে ওকে ঘুরতে নিয়ে যান। নানা লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। নভেরা তাঁর সাথে যায় বই কি, কিন্তু কীভাবে যেন সমস্ত কিছু থেকে বিযুক্ত থাকে।  এ পৃথিবী তাকে পায় না কখনও।  কিন্তু ফয়েজ সাহিব কি ওর প্রতি অনুরক্ত?  ‌

‌জ‌ি‌স‌ ‌র‌া‌হ‌ ‌চ‌ল‍ে‌ ‌জ‌ি‌স‌ ‌স‌ি‌ম‌ত‌ ‌গ‌া‌য়‍ে

‌য়‍ুঁ পাঁও লহু-লুহান হুয়ে

সব দেখনেওলালে ক্যাহতে থে

য়ে ক্যায়সি রিত রচায়ি হ্যায়

য়ে মেহেন্দি কিউ লাগওয়ায়ি হ্যায়

ও কেহতে থে-কিওঁ কেহেতু-এ-ওয়াফা

কা না হক-চর্চা করতে হো

পাঁও সে লহু কো ধো ডালো। 

(যে পথেই গেছি যে দিকেই যাই

এমনই রক্তাক্ত হয়েছে পা

দেখেছে যারাই-বলেছে

এ কেমন আচার রচনা করছ

এই মেহেদি কেন লাগিয়েছ

ওরা বলত-কেন প্রতিশ্রুতি রক্ষার দীনতা

নিয়ে অনর্থক মাতামাতি করো

পা থেকে এই রক্ত ধুয়ে ফেলো।)

এরকম একটা কবিতা কি ফয়েজ সাহেব লিখে ফেলতে পারেন ওর পায়ের চোট দেখে?

ইসমতের মনে পড়ে দুই বছর আগে লাহোরে দেখা “বিনাশের দেবী”র গল্প করছিলেন উচ্ছসিত  ফয়েজ সাহেব।  বিস্ফোরিত ক্রুদ্ধ চোখের অধিকারীণী এক নারী দুই হাতে প্রাণপনে শ্বাসরোধ করে রেখেছে একটি ভয়াল শকুনের।  যেন অ্যাপস্টেইনের সেইন্টমিশেল এন্ড দ্য ডেভিল! কী আশ্চর্য শ্বাসরুদ্ধকর আর যন্ত্রণাময় এক সৃষ্টি।  কিসের এত ক্রোধ, কেন এই যন্ত্রণা? এমন অশুভ ভয়াল দৃশ্য কী করে ওর কোমল রেশমী মাথায় খেলা করে? লাহোরের বিদগ্ধ সমাজ অবাক হয়েছিল।  যেমন একদিন বিস্মিত আর ক্রুদ্ধ হয়েছিল ইসমতের ওপরও।

কিভাবে তুমি এমন নোংরা একটা লেখা লিখতে পারলে? ঠিক এভাবেই বলেছিলেন আসলাম সাহেব, লাহোরে তাঁর বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই।

ইসমতও আক্রমণ করে বসেছিলেন, বেশ।  আপনি যে তবে “পাপের রাত” লিখলেন? যৌনতার বিশদ বিবরণসহ? তার বেলায়? 

-আমার কথা আলাদা।  আমি পুরুষ।

-তো সেটা কি আমার দোষ?

-কি বলতে চাও? রাগে তাঁর মুখ লাল দেখাচ্ছিল।

-বলতে চাই যে আল্লাহ আপনাকে পুরুষ বানিয়েছেন তাতে আমার করার কিছু নাই, আর আমাকে মেয়ে বানিয়েছেন তাতেও আমার হাত ছিল না।  আপনি যেমন কিছু লেখার সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করার দরকার মনে করেন নি, তেমনি আমিও মনে করি না যে আমার লেখার জন্য আপনার অনুমতি চাইতে হবে।

আসলাম সাহেব রাগে চিৎকার করে উঠেছিলেন, “ভুলে যেও না তুমি একটা শিক্ষিত মেয়ে আর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে!”

-আপনিও একজন শিক্ষিত মানুষ আর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান!

সোফার ওপর আহত পা দুটি তুলে দিয়েছে নভেরা।  ব্যথা হয়তো একটু কম এখন।  আচ্ছা, ঢাকার মুসলিম সম্ভ্রান্ত মানুষগুলো কি ওর সাথেও এমন চিৎকার করেছে যখন সে সকলের চোখের সামনে তাঁবু খাটিয়ে হামিদের সাথে দিন গুজরান করত শহীদ মিনারের সামনে? যখন সে হাতুড়ি আর বাটালি হাতে পুরুষদের মত মই বেয়ে উঠে ঝালাই করে নিত তার প্রিয় সাপগুলোকে? শব্দহীন আর আত্নমগ্ন মেয়েটা কখনও এসব গল্প করে নি তাঁর সাথে।  তাঁরও জিজ্ঞেস করার সময় হয় নি।

বোম্বে শহরের আকাশ জুড়ে সিঁদুরের মত লাল রঙা সন্ধ্যা নেমে আসে।  একে একে জ্বলে ওঠে রাস্তার ঝকমকে আলোগুলো।  দূর হতে ভেসে আসা সমুদ্রের হাওয়া কানাকানি করে ইসমতের ফ্ল্যাটের জানালায়।  ইসমত অভ্যাস বশত জানালার পাশে তাঁর লেখার টেবিলে গিয়ে বসেন। সাদা লেসের পর্দাপত পত করে ওড়ে তাঁর কাঁধের ওপর।  টেবিল ল্যাম্প এর হলদে আলোয় তাঁর মুখটা বড় ধারালো দেখায়।  তাঁকে দেখে নভেরার নিজের করা সিটেড ওম্যান এর কথা মনে পড়ে যায়।  সেই রকমই প্রখর, ঋজু, দৃপ্ত তাঁর বসার ভঙ্গি।  তিনি বসে আছেন ঠিকই, কিন্তু চেয়ে আছেন অনেক দূরে, মুম্বাই এর সর্পিল আলো ঝলমল রাজপথের সুদূর শেষ প্রান্তের দিকে।  যে পথের শেষে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই।

কিন্তু তাঁর কাছে এর চেয়ে বেশি প্রিয় সবুজ মাঠের বুক চিরে আঁকাবাঁকা রুপালি সাপের মত চলে যাওয়া একটা সরু খাঁড়ি।  তেরহি লেকির এ যার কথা তিনি লিখেছিলেন।  খাঁড়ির দুই ধারে ছোট্ট ছোট্ট পোকার মত ব্যাঙেরা সবুজ ঘাসের ওপর লাফাত, তিনি একটা কাগজের নৌকা বানিয়ে তার ওপর ব্যাঙগুলোকে বসিয়ে দিয়ে ভাসিয়ে দিতেন খাঁড়ির জলে।  কাগজের নৌকা যত দূর ভেসে যেত ততই তিনি সানন্দে হাততালি দিয়ে পাশে পাশে ছুটতেন।  তারপর একটা কাঠের টুকরো সেই কাগজের নৌকাতে আটকে গেলে সেটা কেবল পানির মধ্যে এক জায়গায় ঘুরপাক খেতে থাকত, আর অসহিষ্ণু ব্যাঙগুলো তখন লাফ দিয়ে জলে নেমে পড়ে অদ্ভুত পারদর্শিতায় সাঁতরে গিয়ে পাড়ে উঠত।  কী মজার ছিল সেই সব দৃশ্য!

ইসমতের কাছে এইউঁচু ফ্ল্যাটের জানালা থেকে বোম্বের বুক চিরে চলে যাওয়া সাপের মত লম্বা রাস্তাটাকে মনে হয় সেই সরু খাঁড়ি, আর মানুষগুলোকে মনে হয় ছোট ছোট ব্যাঙ। অথচ তিনি এসব ভুলে যাবেন।  নভেরা আপন মনে ভাবে।  একদিন এই সন্ধ্যা, এই শহর, এই রাজপথ, এই ব্যাঙ অথবা মানুষ-সব কিছু ভুলে যাবেন তিনি।  আশ্চর্য এক বিস্মৃতির জগতে আকন্ঠ ডুব দেবেন তিনি।  সেই বিস্মৃতি তাঁকে মুক্তি দেবে এই শহরের সমস্ত আলো-অন্ধকার পাপ-পূণ্য পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব থেকে।  লোকে বলে নভেরার দিব্যদৃষ্টি আছে।  সে যা বলে তাই হয়।  সে জানে যে এই আশ্চর্য দৃপ্ত নারী তাকেও একদিন ভুলে যাবেন।  যেমন করে তাকে আসলে সবাই ভুলে যাবে।  গাঢ় অন্ধকার বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাবে সে-ও।  যেমন করে পাখি ডানা মেলে উড়ে যায় নিজের আকাশ ছেড়ে অন্য আকাশে। আর কখনও ফিরে আসে না।  সেভাবেই এই একটা সন্ধ্যা হারিয়ে যাবে মহাকাল থেকে।

অন্ধকার সর্পিল রাজপথে দৃষ্টি মেলে ইসমতও তখন ফেলে আসা দিনগুলির কথা ভাবেন।  জনাকীর্ণ আদালত থেকে বেরিয়ে তারা রাতের লাহোরে উড়ে বেড়াচ্ছিলেন পাখির মত।  “নক্ষত্রের আলো আবছায়া, কী আবছায়া অস্পষ্ট” সুরিন্দর কাউর এর রেশমের মত কন্ঠ আর পান্জাবি গান তাদের মুগ্ধ করেছিল।  অচেনা অজানা এক হারানো প্রেমিকের স্মৃতির মত ব্যথাতুর নগরী হয়ে উঠেছিল লাহোর।  সূর্যাস্তের রঙের মত আফসানায় হারিয়ে যাচ্ছিল শহরটা এক ফেলে আসা অসীম অতীতের খালে।  

ইসমত কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী মান্টো সাহেব, আমরা কি ক্ষমা চেয়ে নেব নাকি? জরিমানার টাকাটা দিয়ে অনেককিছু কেনাকাটা করা যাবে।”

মান্টো চোখ পাকিয়ে বলেছিল, “রাবিশ!”

দিনের বেলা আদালতে চলতে থাকা সেই বাহাসের পর থেকে তার মেজাজ খারাপ।

ইসমত লোকটির দিকে চেয়ে বলেছিলেন, “আমি দু:খিত। দেখতেই পাচ্ছেন মান্টো সাহেব ভারি মেজাজী মানুষ। উনি রাজি হবেন না।”

লোকটা বলল, “না মানে , শুধু আপনি, চাইলে…”

ইসমত সিরিয়াস হয়ে বলেছিলেন, “আপনি জানেন না এই লোকটা কী ভয়ানক ঝামেলা করতে জানে! তিনি আমার বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব করে তুলবেন এরপর। তার ওই ভয়ংকর রাগের শিকার হবার চেয়ে আমার কাছে আদালতের শাস্তিই শিরোধার্য।”

লাহোর থেকে বোম্বে-ইসমত আফসানা মাখা সেই দীর্ঘ নস্টালজিক রাজপথ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।  লোকটা অকালে অসময়ে রাগ করে চলে গিয়ে সবাইকে শাস্তি দিতে চাইল।   কেন? কেন এত রাগ ছিল ওর? 

নভেরা সোফার ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে।  জানালা দিয়ে এক টুকরো আবছা চাঁদের আলো তার ভীষণ মায়াবী মুখটার ওপর আলপনা আঁকছে সযত্নে।  ইসমতের কেন যেন মনে হয় এই মেয়েটিও চলে যাবে দূরে, অনেক দূরে।  রাগ, না অভিমান, নাকি বঞ্চনা! তাকে অতটা দূরে ঠেলে দেবে সেহয়তো নিজেও জানে না।  যেমন সে জানে না হামিদকে কি সে সত্যি ভালোবাসত কিনা! যে হামিদ ফ্লোরেন্সের বর্ণিল শীতার্ত রাতে গান গেয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়েছিল! হিম শীতল ঠান্ডা মেঝের স্পর্শ পেলে তার সুন্দর পা দুটি জমে যাবে বলে অস্থির হয়ে উঠেছিল।  অথচ হামিদকে ও ছেড়ে এল কেন, কিংবা হামিদই ছেড়ে গেল ওকে?

নভেরার ঘুমন্ত শরীরের ওপর কম্বলটা টেনে দেন ইসমত।  কে কাকে কেন ছেড়ে যায় তা কে বলতে পারে? কে কাকে কীভাবে ভালোবাসে তাই বা কে জানে? এ জগতে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক এক রহস্যময় জিনিস।  অনেক সময়ই কোন শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না তাকে। 

ইসমতের মনে হয় নভেরা কি ঘুমের ঘোরে তাকেও উল্টোএ কথা জিজ্ঞেস করছে, “আপনিই বলুন, আপনি আর মান্টো সাহেব…, মান্টো সাহেব সত্যি কী ছিলেন আপনার কাছে?

ইসমত একটু হেসে স্বগতোক্তি করেন, “হি ওয়াজ মাই ফ্রেন্ড, এন্ড মাই এনিমি।”

নভেরা ঘুমের অতলে হারিয়ে যায় বলে সে কথা আর শুনতে পায় না।

‌‌

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>