eyes-of-a-blue-dog-by-gabriel-garcia-marquez

অনুবাদ গল্প : নীল কুকুরের চোখ । গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

Reading Time: 8 minutes

অনুবাদ: তুষার তালুকদার

অতঃপর মেয়েটি আমার দিকে তাকাল। ভেবেছিলাম, সে হয়ত আমায় প্রথমবারের মতো দেখছিল। কিন্তু যখন সে ল্যাম্পের দিকে ফিরে তাকাল এবং আমি আমার কাঁধের পেছনে তার স্নিগ্ধ উপস্থিতি বোধ করতে পারলাম তখন বুঝতে পারি সে নয় বরং আমিই তাকে প্রথমবারের মতো দেখছিলাম। আমি একটি সিগারেট ধরালাম। একটি পায়াহীন চেয়ারে নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখার আগ মুহূর্তে সিগারেটের কটু ধোঁয়ায় একটা টান দিলাম।
পরক্ষণেই আমি তাকে আবার দেখলাম, মনে হল, যেন সে ল্যাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতি রাতেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। পরবর্তী মিনিট কয়েকের জন্য আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চেয়ারে বসেই তাকিয়েছিলাম আমি, যদিও চেয়ারটি একটি পা-শূন্য। মেয়েটি দাঁড়িয়ে, তার কোমল, শান্ত ও দীর্ঘাকায় হাত ল্যাম্পের উপর, তাকিয়েছিল আমার দিকে। প্রতি রাতের মতো সেদিনও তার চোখের পাতা আলো ঝলমল করে উঠল। আর ঠিক তখনই আমার মনে হল সেই চিরাচরিত ব্যাপারটি, যখন আমি মেয়েটিকে বলেছিলাম: নীল কুকুরের চোখ। ল্যাম্প থেকে হাত না সরিয়েই সে উত্তর দিল: এটি আমরা কখনো ভুলব না। কক্ষপথ ত্যাগের সময় তার নিঃশ্বাস থেকে ভেসে আসল: নীল কুকুরের চোখ। আমি সব জায়গায় এটি লিখেছি।আমি তাকে ড্রেসিং টেবিলের দিকে যেতে দেখলাম। আয়নায় তার অবয়ব দেখে মনে হলো কিঞ্চিৎ পরিমাণ আলোকছটার মাঝেও সে আমার দিকে তাকিয়েছিল। দেখলাম, উষ্ণ ঘন কালো চোখে এক দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার পানে তাকিয়ে থেকেই সে তার গোলাপী রঙের হীরা-জহরতে আবৃত বাক্সটি খুলছিল। নাকের মধ্যে পাউডারের ছাপ দৃশ্যমান ছিল। সাজ শেষে বাক্স বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। ল্যাম্পের কাছাকাছি গিয়ে বলল: ‘আমি ভীত এই ভেবে যে কেউ আমার রুম নিয়ে স্বপ্ন দেখছে এবং আমার গোপনীয়তা ফাঁস করে দিচ্ছে।’ পরক্ষণে ল্যাম্পের আলোক শিখার ওপর তার দীর্ঘাকৃতির কাঁপতে থাকা হাত এমনভাবে রাখল যেন সে আয়নার সামনে বসার আগে নিজেকে উষ্ণ করছিল। সেই সাথে বলল: ‘তুমি ঠা-া অনুভব কর না’। আমি বললাম: মাঝে মাঝে। সে বলল: ‘এখন অবশ্যই অনুভব করবে’। তারপর বুঝলাম কেন আমি আমার বসে থাকা সিটে একা না। এটা ছিল তীব্র ঠা-ার সময় যা আমাকে একাকিত্বের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। ‘এখন আমি তা অনুভব করছি,’ আমি বললাম। ‘এটি সত্যিই অদ্ভুত কারণ রাতটি শান্ত। ‘খুব সম্ভবত বৃষ্টি থেমে গেছে।’ সে কোনো উত্তর দেয়নি। আবার সে আয়নার দিকে যেতে শুরু করল। আমি আবার পেছন ফিরে চেয়ারে বসলাম। তাকে না দেখলেও আমি জানতাম, সে কি করছিল। আমি জানতাম, আয়নার সামনে বসে সে আমার পেছন দেখছিল। আয়নায় তার ঠোঁট টুক টুকে লাল করে সাজানোর পূর্ব পর্যন্ত সে যথেষ্ট সময় পেয়েছিল আমাকে দেখার। আমার ঠিক উল্টো দিকের মসৃণ দেয়ালটিকে মনে হচ্ছিল আরেকটি অন্ধ আয়না। এ ঘোলাটে আয়নায় তাকে দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। তবে কল্পনা করতে পারছিলাম, দেয়ালের যে জায়গায় আয়নাটি ঝোলানো ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়েছিল সে। আমি বললাম, ‘আমি তোমাকে দেখছি।’ দেয়ালে তাকিয়ে বোধ করলাম, সে চোখ তুলে তাকিয়ে আমাকে দেখছিল। এবং তাকে দেখার জন্য আমি যে চেয়ার ঘুরিয়েছে তাও তার দৃষ্টি সীমানার মধ্যে ছিল। আমি যতোই তার শরীরের নিচের দিকে তাকাচ্ছিলাম, তার চোখ ততোই তার ব্রা-এর উপর ঘুরছিল। নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিল সে। আমি আবারও বললাম, ‘আমি তোমাকে দেখছি।’ আমার কথা শুনে, ব্রাসিয়ার থেকে চোখ সরিয়ে উত্তর দিল, ‘এটি অসম্ভব।’ কেন সম্ভব না তা আমি জানতে চাইলাম। আবার ব্রাসিয়ারের ওপর চোখ রেখে উত্তর দিল : ‘কারণ তুমি দেয়ালের দিকে তাকানো।’ পর মুহূর্তে আমি চেয়ারটি ঘুরালাম। সিগারেটটি আমার মুখে পুড়ছিল। আমি যখন আয়নার দিকে তাকিয়ে, সে তখন ল্যাম্পের কাছাকাছি। মুরগির দুটো ডানার মতো তার উন্মুক্ত হাত অগি্নশিখার ওপর। তার আঙ্গুলের ছায়ায় তার অবয়ব ছিল ছায়াবৃত। ‘আমার মনে হয় আমি শীতাক্রান্ত হতে যাচ্ছি’, বলল সে। ‘নিশ্চিতভাবে এটি একটি বরফের শহর।’ হঠাৎ তার চোখ শরীরের চামড়ার দিকে যেতেই তাকে বিমর্ষ দেখাল। ‘কিছু একটা করো’, সে বলল। এবং একে একে সে তার সব কাপড়-চোপড় খুলতে শুরু করল_ প্রথমেই খুলেছিল ব্রা। আমি তাকে বললাম, ‘আমি দেয়ালের ওপাশটায় যাচ্ছি।’ সে বলল, ‘না, তুমি ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকলেও যে কোনো উপায়ে তুমি আমাকে দেখবেই, যেমনি করে দেখছিলে কিছুক্ষণ আগে। তার কথা শেষ হতে না হতেই সে সম্পূর্ণ অনাবৃত হয়ে পড়েছিল।

আরো পড়ুন: অতিকায় ডানাঅলা অতিশয় বৃদ্ধ এক লোক । গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

তোমাকে প্রহার করার ফলে পেটের চামড়ায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে_ এমন একটি অবস্থায় তোমাকে আমি সর্বদা দেখতে চেয়েছিলাম। তাকে অনাবৃত দৃশ্যে দেখে আমার মুখনিঃসৃত শব্দাবলি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে এমনটি বোঝার আগেই সে নিশ্চল হয়ে পড়েছিল। ল্যাম্পের তাপে নিজেকে উষ্ণ করতে করতে বলল, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় আমি ধাতব দ্বারা তৈরি। এ কথা বলার পর কিছুসময় সে নিশ্চুপ ছিল। ল্যাম্পের উপর থাকা তার হাত এদিক ওদিক নড়ছিল; আমি বললাম, ‘মাঝে মাঝে কিছু কিছু স্বপ্নে আমি ভেবেছি তুমি কোনো যাদুঘরে থাকা ছোট্ট ব্রোঞ্জের তৈরি মূর্তি। হয়তো সে কারণে তুমি শান্ত, ঠা-া প্রকৃতির।’ সে বলল : মাঝে মাঝে আমি যখন আমার হৃদয়ের ওপর ঘুমাই, বোধ করি, আমার শরীর ফেঁপে যাচ্ছে এবং আমার দেহাবরণ পেটের মতো। পরবর্তীতে যখন দেহের ভিতর রক্ত চলাচল অনুধাবন করি, তখন মনে হয় কেউ যেন আমার পাকস্থলীকে নাড়া দিয়ে আমায় ডাকছে। এবং আমার ধাতব দেহের শব্দ আমি বিছানায় অনুধাবন করতে পারি। এটি অনেকটা, তুমি যাকে বল, লেমিন্যাটেড ধাতবের মতো। সে ল্যাম্পের খুব কাছাকাছি এল।’ ‘তোমাকে শুনতে ভালো লাগছিল’, আমি জানালাম। এবং সে বলল, আমরা যদি কোনো সময় একে অপরকে খুঁজে পাই, সেসময় আমি কাত হয়ে শুয়ে থাকলে আমার বুকের পাঁজরে মাথা রেখো, আশা করি, শুনতে পাবে প্রতিধ্বনি। আমি সবসময় চাইতাম তুমি যাতে মাঝে মধ্যে এমনটি করো। যখন সে কথা বলছিল, তার ভারি নিঃশ্বাস আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। সে বলল, বছরের পর বছর ধরে সে ভিন্নধর্মী কিছুই করেনি। বাস্তবে আমাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তার পুরো জীবন উৎসর্গীকৃত হয়েছে। খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে শনাক্তকারী শব্দগুচ্ছ ছিল : ‘একটি নীল কুকুরের চোখ।’ এ শব্দগুচ্ছ চিৎকার করে উচ্চারণ করতে করতে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। এবং সেই সাথে আরো বলছিল: যাকে আমি খুঁজেছি সে-ই একমাত্র লোক যে আমাকে বুঝতে পারত। ‘আমি সেই ব্যক্তি যে প্রতিরাতে তোমার স্বপ্নে আসি এবং বলি: একটি নীল কুকুরের চোখ।’ এবং সে বলল যে সে রেস্টুরেন্টে যেত ও খাবার অর্ডার দেয়ার আগে ওয়েটারদের বলত, ‘নীল কুকুরের চোখ।’ ওয়েটাররা শ্রদ্ধায় অবনত হতো। এমনকি সে ন্যাপকিনে ও টেবিলের ভার্নিশ ছুরি দ্বারা উঠিয়ে খোদাই করে লিখত; ‘একটি নীল কুকুরের চোখ’। তাছাড়া রেল স্টেশন, হোটেলের জানালা ও সরকারি দালান কোঠার দরজায় সে তর্জনী দ্বারা লিখত: ‘নীল কুকুরের চোখ’। তারপর সে জানাল, একবার মাঝরাতে এক ওষুধের দোকানে যাবার পর এমন একটি গন্ধ তার নাকে এসে লাগল যা সে অনেকদিন আগে একরাতে আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার পরে অনুভব করেছিল। মেয়েটি ভাবছিল, ‘আমি হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছি’। তারপর সে দোকানিকে বলল: ‘আমি প্রতিরাতেই একজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি, যে আমাকে বলে: ‘নীল কুকুরের চোখ।’ এবং সে আরো জানাল, দোকান সহকারি তার কথা শুনে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, মিস, বস্তুত আপনার চোখ দেখতে সে রকমই।’ প্রতিউত্তরে সে সহকারিকে বলল, ‘যে আমাকে স্বপ্নে ঐ কথাগুলো বলে তাকে আমার খুঁজে বের করতে হবে’। ওষুধ বিক্রেতা তার কথা শুনে হাসতে হাসতে কাউন্টারের অপর প্রান্তে চলে গেল। সে দোকানের মেঝের পরিষ্কার টাইল থেকে বের হয়ে আসা গন্ধ শুঁকতে থাকল। সে তার পার্স খুলে, লাল লিপস্টিক বের করে টাইলের ওপর বড় বড় অক্ষরে লিখল : ‘নীল কুকুরের চোখ’। সহকারি তার নিজ জায়গা থেকে উঠে এসে বলল, ম্যাডাম, আপনি টাইল নোংরা করেছেন।’ এবং সহকারি তাকে একটি কাপড়ের টুকরা দিয়ে বলল, ‘দয়া করে পরিষ্কার করুন।’ সে তখনো ল্যাম্পের পাশে দাঁড়ানো। আমাকে বলল, পুরো বিকেল জুড়ে সে টাইল পরিষ্কার করেছিল। চার ঘণ্টা সময় লেগেছিল। পরিষ্কার করার পুরো সময় তার মুখে ছিল ঐ একই কথা : ‘নীল কুকুরের চোখ’। একই কথা অবিরাম তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল, যতক্ষণ না জনসাধারণ এসে বলাবলি করতে থাকল, মেয়েটি বেপরোয়া।তার কথা শেষ হলো। আমি এক কোনায় চেয়ারে বসে দুলছিলাম। ‘প্রতিদিনই আমি ঐ শব্দাবলি মনে করার চেষ্টা করি, যা দ্বারা আমি তোমাকে খুঁজে পেতে পারি।’ আমি বললাম। ‘এখন আমি এ কথাগুলো আগামিকাল ভুলে যাব বলে মনে হয় না। ‘এখনও আমি একই কথা বারবার বলি এবং যখন প্রতিবার আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি, ভুলে যাই সে শব্দগুলো, যা দ্বারা আমি তোমাকে খুঁজে পেতে চাই।’ সে বলল, তুমি সেই কথাগুলো তোমার মধ্যে আবিষ্কার করেছ। এবং আমি তাকে বললাম, আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি, কারণ আমি তোমার ছাইচোখ দেখেছি। তবে পরবর্তী সকালটির কথা আমি কখনই স্মরণ করব না। সে আঙুল দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকল। ল্যাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে থাকল, তুমি যদি এখন একটু মনে করতে পারতে কোন শহরে বসে আমি ঐ কথাগুলো লিখে চলছি।

ল্যাম্পের আলোয় তার শক্ত করে রাখা দাঁতগুলো ঝলমল করে উঠল। আমি তোমাকে স্পর্শ করতে চাই, আমি বললাম। আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা মুখটি সে উপরে তুলল, মনে হচ্ছিল মুখটি জ্বলছে, তার মতো কিংবা তার হাতের মতো। আমি অনুভব করলাম, সে আমাকে দেখছে। ‘তুমি কখনো আমাকে এরকমটি বলোনি’, সে বলল। এখন বলছি এবং তা সত্য, আমি উত্তর দিলাম। ল্যাম্পের বিপরীত প্রান্ত থেকে সে আমার কাছে একটি সিগারেট চাইল। টানতে থাকা সিগারেটের মোথাটি আমার আঙুলের ভাঁজে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি সিগারেট টানছিলাম। সে বলল, ‘আমি জানি না কেন আমি মনে করতে পারছি না কোথায় আমি এটি লিখেছিলাম।’ আমিও তাকে বললাম, ‘হয়তো একই কারণে আমিও আগামিকাল শব্দগুলোকে আর মনে করতে পারব না।’ সে বলল, ‘না। মাঝেমাঝে আমার মনে হয়, আমি ঐ ব্যাপারটি স্বপ্নে দেখে থাকি। আমি উঠে দাঁড়ালাম ও ল্যাম্পটির দিকে যেতে পা বাড়ালাম। সে আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছিল। হাতে সিগারেট ও ম্যাচ নিয়ে আমি এগুচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে তার দিকে সিগারেটটি বাড়িয়ে দিলাম। দু’ঠোঁটে সে তা চেপে ধরল। ম্যাচ দ্বারা সিগারেটটি ধরিয়ে দেয়ার আগে সিগারেট মুখে কাঁধটি বাড়িয়ে দিল। ‘পৃথিবীর কোনো এক শহরের সব দেয়ালে ঐ শব্দগুলো ভেসে উঠবে: ‘নীল কুকুরের চোখ’, বললাম আমি। ‘আমি যদি আগামিকাল তা মনে করতে পারতাম, তবে তোমাকে খুঁজে পেতাম।’ সে আবার তার মাথা তুলল। সিগারেটটি ক্রমাগত তার ঠোঁটে পুড়ছিল। হঠাৎ তার দীর্ঘনিঃশ্বাসে ভেসে আসল : ‘নীল কুকুরের চোখ’। সিগারেটটি হাতে নিয়ে মিটিমিটি চোখে বলল : ‘আমি নিজেকে উষ্ণ করছি।’ কথাগুলো এত নিস্পৃহ মনে হলো যেন সে এগুলো উচ্চারণ করেনি বরং এক টুকরো কাগজে লিখে জ্বলন্ত সিগারেটের সামনে ধরে রেখেছিল। পরবর্তী কিছুক্ষণ কাগজটি তার তর্জনী ও বুড়ো আঙুলের মধ্যিখানে আটকে ছিল। আমি বললাম, ‘কাগজের লেখা আমি পড়েছি।’ এটি পুরোপুরি ছাইভস্মতে পরিণত হওয়ার আগে আমি আরো বললাম, ‘মাঝে মাঝে আমি ভীত হয়ে পড়ি তোমাকে উদ্যত হতে দেখে।’ সে ল্যাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল। বছর কয়েক ধরে আমরা একে অন্যকে দেখছিলাম। মাঝেমাঝে আমরা যখন একত্রিত হতাম, কেউ ঘরের বাইরে একটি চামচ ফেলে দিতো, ফলে আমরা জেগে উঠতাম। ধীরে ধীরে আমরা বুঝলাম, আমাদের সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্ব ঠুনকো কিছু ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। খুব সকালে চামচ পড়ার হওয়ার শব্দে আমাদের সব সাক্ষাৎগুলো মস্নান হয়ে যেত।

যাহোক, ল্যাম্পের ঠিক পাশে দাঁড়িয়েই আমার দিকে তাকিয়েছিল সে। আমি মনে করতে থাকলাম, আগেও ঠিক এমনি করে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। এমনকি যখন আমি স্বপ্নে চেয়ারে বসে বা পা দিয়ে চেয়ার ঘুরাতে ঘুরাতে ছাই রঙা চোখের অদ্ভুত এক মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকতাম তখনো। ঠিক এমনই এক স্বপ্নে আমি তাকে প্রথমবারের মতো জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কে তুমি?’ সে উত্তরে বলেছিল : ‘আমি মনে করতে পারছি না’। তবে আমি তাকে বলেছিলাম : ‘আমার মনে হয় আগে আমরা একে অন্যকে দেখেছি।’ সে অনেকটা উদাসীনভাবে বলল, আমার মনে হয়, ‘আমি তোমাকে নিয়ে একবার স্বপ্ন দেখেছি, এবং সেই সাথে যে কক্ষে আমাদের এতো সময়ের কথোপকথন সেই কক্ষকে নিয়েও।’ আমি তাকে বললাম, ‘দাঁড়াও মনে করার চেষ্টা করছি।’ এবং সে বলল, ‘কী অদ্ভুত!’ তবে ‘এটা নিশ্চিত যে নানা স্বপ্নে আমাদের দেখা হয়েছে।’

সিগারেটে দু’বার টান দিল সে। আমি দাঁড়িয়ে ল্যাম্পের দিকে তাকিয়েছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল তার দিকে। আমি তার উপরনিচ দেখছিলাম। সে তখনো কপার, শক্ত বা ঠা-া কোনো ধাতব বস্তু নয়, তবে হলুদ বর্ণের নরম, নমনীয় তামা। ‘আমি তোমাকে স্পর্শ করতে চাই’, আমি আবারও বললাম। সে বলল, ‘তুমি সবকিছু নষ্ট করে ফেলবে।’ আমি জানালাম, এখন তাতে কিছু যায় আসে না। বালিশটিকে ঘোরানোর জন্য যা যা করতে হয় আমাদের তা-ই করতে হবে কারণ আমাদের মিলিত হওয়া জরুরি। আমি আমার হাত বাড়িয়ে ল্যাম্পের উপর রাখলাম। সে নড়ল না। তাকে স্পর্শ করার আগে সে আবার আমাকে বলল, ‘তুমি সবকিছু নষ্ট করে দিবে’। কিন্তু আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, ‘এটা এখন কোনো বিষয় নয়।’ এবং সে বলল, ‘আমরা এখন বালিশ ঘুরিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে পারি, তবে জেগে-ওঠা মাত্র তুমি সব ভুলে যাবে।’ আমি ঘরের এক কোনায় যেতে শুরু করলাম। সে তখনো অগি্নশিখায় হাত উষ্ণ করছিল। অতঃপর সে বলে যেতে থাকল : ‘মাঝরাতে যখন আমি জেগে উঠি তখন বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকি; এবং বালিশের ওয়ারের পাড় ধরে টানতে থাকি আর সকাল না হওয়া পর্যন্ত বলতে থাকি, ‘নীল কুকুরের চোখ।’

তার কথা বলা শেষে, তার দিকে না তাকিয়ে আমি বললাম, ‘ইতোমধ্যে সকাল হয়ে গিয়েছে’। যখন দু’টা বাজল, আমি জেগে উঠলাম। এবং দেখলাম, আমি সুদূর অতীতে ফিরে গেছি। দরজার কাছে গেলাম। হঠাৎ তার কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পেলাম। ঠিক আগের মতো, স্বরে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন নেই। সে বলছে, ‘দরজা খুলবে না’। ‘অনেকগুলো দুর্বোধ্য স্বপ্নে এই কক্ষের প্রস্থান পথ জর্জরিত। আমি বললাম, ‘তুমি জানলে কীভাবে’? কারণ কিছুসময় আগে আমি এখানে ছিলাম। এবং আমাকে ফিরতে হয়েছিল যখন আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি আমার হৃদয়ের ওপর ঘুমাচ্ছিলাম। দরজাটি অর্ধেক খোলা অবস্থায় পেলাম আমি। একটি ঝিরঝিরে বাতাস আমার গায়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। সবজি বাগান ও পতিত জমির সুঘ্রাণ পেলাম। সে আবার কথা বলে উঠল। আমি নিশ্চুপতা ভেঙে তাকে বললাম, ‘আমার মনে হয় না ঘর থেকে বের হওয়ার ভিন্ন কোনো রাস্তা আছে। ‘আমি আমার নিজ ভূমির ঘ্রাণ পাচ্ছি।’ আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সে বলল, আমি তা তোমার চেয়ে ভালো বুঝি। যা ঘটছিল তা হলো, বাইরে একটি মহিলা এ শহরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। সে আরো জানায়: এটি সেই মহিলা যে সবসময় চেয়েছিল এ শহরে একটি ঘর পেতে, তাই এ শহর ছেড়ে যেতে পারেনি। অতীত কোনো স্বপ্নে এ মহিলাকে আমি দেখেছি বলে মনে করতে পেরেছি। তবে আমি জানতাম, দরজাটি এখন কিছুটা খোলা, তাছাড়া আধ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে নাশতা খেতে নিচে যেতে হবে। এবং আমি বললাম, ‘যে কোনো মূল্যে আমাকে এখন বিদায় নিতে হবে; কারণ এই মুহূর্তে ঘুম থেকে জেগে ওঠা জরুরি। কিছুক্ষণের জন্য বাইরে মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল, তারপর আবার শান্ত। ঘুমাচ্ছিল এমন কারোর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সমস্ত প্রান্তর, মাঠ-ঘাট থেকে বাতাস যেন কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে। চারিদিকে কোনো সুবাস ছিল না। ‘আগামিকাল তোমাকে আমি নিশ্চয় চিনতে পারব যখন দেখব রাস্তায় কোনো মহিলা লিখছে’: ‘নীল কুকুরের চোখ’। তার মুখে বিষাদের হাসি_ অসম্ভব বা দুর্লভ কোনো কিছুর কাছে আত্মসমর্পণের ছাপ যে হাসিতে স্পষ্ট, সে রকম একটি হাসি সহকারে সে বলল: ‘আগামিকাল দিনব্যাপী তুমি কোনো কিছুই মনে করতে পারবে না।’ এবং সে তার হাত ল্যাম্পের পেছন দিকে রাখল; ঘন মেঘে তাকে একদম দেখা যাচ্ছিল না। তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে জেগে ওঠার পর স্বপ্নে কী দেখেছিলে তার কোনো কিছুই মনে করতে পার না।’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>