| 10 মে 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: ক্রীম ।। হারুকি মুরাকামি । অনুবাদঃ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

অনুবাদঃ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

 

এই শ্বাসকষ্টটা আমার বছরে এক দু’বার হতো। আমার ধারণা মানসিক চাপ থেকে আমার এটা হতো। এই সময়ে আমি খুবই গোলমেলে অনুভব করতাম, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসত এবং আমি ফুসফুসের ভেতরে যথেষ্ট বাতাস নিতে পারতাম না। ফলে আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যেতাম, যেন আমি একটা প্রবল স্রোতের টানে জলের নিচে ডুবে যাচ্ছি এবং আমার শরীর ক্রমশ জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। সেই সময়গুলোতে আমি যা করতে সক্ষম ছিলাম তা হলো মাটিতে শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে থাকা এবং অপেক্ষা করতে থাকা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার শরীর স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার এই লক্ষণগুলো কমে গিয়েছিল (এবং কিছু কিছু সময়ে আমার লজ্জায় আরক্তিম হয়ে যাওয়াও কমে গিয়েছিল)। কিন্তু আমার কৈশোরকালে এই সমস্যা আমাকে সত্যিই ভোগাত।

দোলনার বেঞ্চে বসে আমি শক্তভাবে আমার চোখ বন্ধ করলাম। নিচু হয়ে থাকলাম এবং অপেক্ষা করতে থাকলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না এই সমস্যা আমাকে ছেড়ে যায়। এই সময়কাল পাঁচ মিনিট অথবা পনের মিনিট দুটোই হতে পারে, আমি জানি না কত দীর্ঘ ছিল তা। পুরো সময়েই অদ্ভুত অনুভূতিটি কয়েকবার এল এবং অন্ধকারের ভেতরে হারিয়ে গেল। আমার নিঃশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে করতে আমি অনুভূতিটির সংখ্যা গুনতে গুনতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার চেষ্টা করতে লাগলাম। পাঁজরের ভেতরে আমার হৃদয় অস্থিরভাবে কাঁপতে লাগল, যেমন করে আতঙ্কগ্রস্ত ইঁদুরেরা খাঁচার ভেতরে ছোটাছুটি করে থাকে।

গণনা নিয়ে এতটাই নিবিষ্ট ছিলাম যে, আমি কিছুক্ষণ বুঝতেই পারিনি যে কেউ একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি অনুভব করলাম যেন কেউ একজন আমার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। খুবই ধীরে ধীরে ও সতর্কতার সাথে আমি আমার চোখ খুললাম এবং মাথাকে এক ডিগ্রি উপরে তুললাম। আমার হৃদযন্ত্র তখনও অস্বাভাবিকভাবে ধড়ফড় করছিল।

আমার বিপরীতদিকে একজন বৃদ্ধ লোক বেঞ্চের উপরে বসেছিলেন এবং সোজা আমার চোখের ভেতরে তাকিয়ে ছিলেন। আমার ধারণা একজন যুবক মানুষের পক্ষে বৃদ্ধদের বয়স অনুমান করতে পারা সহজ নয়। আমার কাছে সকল বৃদ্ধ লোকদেরকেই শুধুমাত্র বয়স্ক বলেই মনে হয়। ষাট বা সত্তুরের ভেতরে কি আদৌ কোনো পার্থক্য আছে? তাদের কেউই এখন আর যুবক নন, এটাই সত্য। লোকটির পরনে ছিল ধূসর নীলাভ রঙের উল কার্ডিগান, বাদামি রঙের প্যান্ট এবং নেভি-ব্লু রঙের স্নিকার। দেখে মনে হচ্ছিল সবগুলো জামাই বেশ পুরোনো। তার মাথার চুলগুলোর রঙও ছিল ধূসর এবং অনমনীয়। চুলের গোছাগুলো স্নানরত পাখির পাখার মতো কানের উপরে এসে পড়ছিল। লোকটি কোনো চশমা পরে ছিলেন না। আমি জানি না কতক্ষণ পূর্বে তিনি এখানে এসেছিলেন, তবে আমার মনে হচ্ছিল যে তিনি অনেকক্ষণ যাবতই আমাকে দেখছিলেন।

আমি নিশ্চিত যে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, ‘তুমি কি ঠিক আছ?’ অথবা এই ধরনের কিছু। কারণ আমার চেহারা দেখে তিনি নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন যে আমার সমস্যা হয়েছে (এবং আসলেই আমার সমস্যা হয়েছিল)। কিন্তু তিনি আমাকে কিছুই বললেন না, এমনকি আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করলেন না। শুধুমাত্র একটা ভাঁজকরা কাল রঙের ছাতার এক প্রান্তকে শক্ত করে লাঠির মতো ধরে থাকলেন। ছাতাটির হাতলটি ছিল কাঠের তৈরি এবং অম্বর রঙের। ওটাকে প্রয়োজনে অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারত। আমি ধারণা করলাম যে, তিনি এই এলাকাতেই বাস করেন। কারণ তার হাতে আর কিছুই ছিল না। আমি বসে বসে আমার নিঃশ্বাসকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম, এবং বৃদ্ধ লোকটি নীরবে আমাকে দেখছিলেন। মূহূর্তের জন্যেও তার চোখের পলক পড়ছিল না। এটা আমার ভেতরে অস্বস্তির সৃষ্টি করল – যেন আমি কারও বাড়ির পেছনের উঠোনে অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়েছি। আমি বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ে বাসস্টপের দিকে যাত্রা শুরু করতে চাইলাম। যত দ্রুত সম্ভব। কিন্তু অজ্ঞাত কোনো কারণে আমি আমার পা তুলতে পারলাম না। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পর, হঠাৎ করে লোকটি কথা বলে উঠলেন।

‘এক বৃত্তের অনেকগুলো কেন্দ্র।’

আমি তার পানে তাকালাম। পরস্পরের চোখের দিকে। তার কপালটি ছিল খুবই প্রশস্ত, নাক টিকালো। পাখির ঠোঁটের মতো ধারালো। আমি একটা কথাও বলতে পারলাম না। সুতরাং বৃদ্ধ লোকটি পুনরায় শান্তভাবে তার কথার পুনরাবৃত্তি করলেনঃ ‘এক বৃত্তের অনেকগুলো কেন্দ্র।’

স্বাভাবিকভাবেই আমার ধারণাই ছিল না তিনি কী বলার চেষ্টা করছিলেন। শুধু আমার মাথার ভেতরে একটা চিন্তা এসেছিল যে, এই লোকটাই খ্রিস্টান মিশনারিদের লাউডস্পিকারওয়ালা কারটির চালাচ্ছিলেন। হতে পারে যে, তিনি নিকটেই কোথাও কারটি পার্ক করে এখানে একটা বিরতি নিচ্ছিলেন। না, এটাও ঠিক নয়। এই লোকের কণ্ঠস্বর আমি যে কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম, তার থেকে ভিন্ন। লাউডস্পিকারের কণ্ঠস্বরটি ছিল এর চেয়ে অনেক কম বয়সী মানুষের। অথবা এমনও হতে পারে যে, এই লোকটি তা রেকর্ড করছিলেন।

‘আপনি কি বৃত্তের কথা বললেন?’ আমি অনিচ্ছা সহকারে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। যেহেতু তিনি আমার চেয়ে বেশি বয়সের ছিলেন, আমার ভদ্রতাই আমাকে সাড়া দিতে বাধ্য করল।

‘অনেক সময়ে কয়েকটা কেন্দ্র থাকে – না, কিছু কিছু সময়ে সীমাহীন সংখ্যক কেন্দ্র থাকে – এবং সেটা হলো পরিধি ছাড়াই কোনো বৃত্ত।’ বৃদ্ধ লোকটি রাগতভাবে কথাগুলো বলছিলেন এবং তার কপালের ভাঁজগুলো গভীরতর হচ্ছিল। ‘তুমি কি ধারণা করতে সক্ষম?’

আমার হৃদয় তখনও কর্মক্ষম হয়নি। তথাপি আমি চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। একটা বৃত্ত যার কয়েকটা কেন্দ্র আছে এবং কোনো পরিধি নেই। কিন্তু যেভাবেই আমি চিন্তা করে থাকি না কেন, আমি বিষয়টাকে অনুধাবন করতে পারলাম না।

‘আমি বুঝিনি,’ আমি বললাম। বৃদ্ধ লোকটি আমার দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকালেন। মনে হচ্ছিল তিনি আমার নিকট থেকে অধিকতর ভালো কোনো উত্তর আশা করছেন।

‘আমি মনে করি না স্কুলে আমাদের গণিতক্লাসে এমন ধরনের কোনো বৃত্ত সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল।’

তিনি মাথা নাড়লেন, ‘ অবশ্যই না। এটা আশাও করা হয় না। কারণ স্কুলে এই ধরনের বিষয় কখনই শিক্ষা দেয়া হয় না। তুমিও তা খুব ভালোভাবেই জান।’

আমিও তা খুব ভালোভাবেই জানি? বৃদ্ধ লোকটির এটা মনে করার কারণ কি?

‘এই ধরনের বৃত্ত কি বাস্তবেই আছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘অবশ্যই আছে,’ বৃদ্ধ লোকটি কয়েকবার মাথা নেড়ে বললেন। ‘সত্যিকারভাবেই এই বৃত্ত আছে। কিন্তু সবাই তা দেখতে পায় না, তুমি জান।’

‘আপনি কি দেখতে পান?’

বৃদ্ধ লোকটি কোনো উত্তর করলেন না। আমার প্রশ্নটি শূন্যের ভেতরে কিছুক্ষণ ঝুলে থাকল এবং অবশেষে অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে গেল।

বৃদ্ধ লোকটি আবার বলে উঠলেন, ‘শোন, তোমার নিজের শক্তি দিয়ে তোমাকে চিন্তা করে নিতে হবে। তোমার সমস্ত অভিজ্ঞানকে ব্যবহার কর, দেখতে পাবে। একটা বৃত্ত যার অনেকগুলো কেন্দ্র আছে, কিন্তু পরিধি নেই। তুমি যদি এমন চেষ্টা করতে পার যে, তোমার ঘাম দিয়ে রক্ত বের হবে – তাহলে ক্রমশ এক সময়ে তুমি বুঝতে পারবে বৃত্তটি কী।’

‘কঠিন মনে হচ্ছে,’ আমি বললাম।

‘অবশ্যই এটা কঠিন,’ লোকটি বললেন , যেন তিনি শক্ত কোনোকিছুকে পিটাচ্ছেন। ‘পৃথিবীতে যা কিছুই তুমি সহজে অর্জন করতে সক্ষম, তা মূল্যবান নয়। ‘অতঃপর নতুন একটা অনুচ্ছেদ শুরু করার মতো করে তিনি তার গলা খাঁকারি দিলেন তা পরিষ্কার করার জন্যে। ‘কিন্তু তুমি যখন তোমার প্রচুর সময় ও প্রচেষ্টা ব্যয় করবে, তখন তুমি কঠিন জিনিসও অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং সেটাই হবে তোমার জীবনের ক্রীম।’

‘ক্রীম?’

ফরাসী ভাষায় crème de la crème বলে একটা এক্সপ্রেশন আছে। তুমি কি জানো?’

‘জি না, আমি ফরাসি ভাষাই জানি না,’ আমি বললাম।

‘ক্রীমের ভেতরে ক্রীম। অর্থ হলো শ্রেষ্ঠদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এটা দিয়ে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ নির্যাস বা সারাংশকে বোঝানো হয়ে থাকে। বুঝতে পেরেছ তুমি? এটা ছাড়া জীবনের অন্য সকল কিছুই ক্লান্তিকর ও মূল্যহীন।’

আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না বৃদ্ধ লোকটি আমাকে কোনো পয়েন্টের দিকে নিতে চাচ্ছিলেন। Crème de la crème?

‘বিষয়টা নিয়ে চিন্তা কর’, তিনি আমাকে বললেন। ‘তোমার চোখ দুটোকে আবার বন্ধ কর, এবং একটা বৃত্তের কথা চিন্তা কর, যার অনেকগুলো কেন্দ্র আছে, কিন্তু পরিধি নেই। তোমার মস্তিষ্ককে তৈরিই করা হয়েছে কঠিন বিষয় নিয়ে ভাবার জন্যে এবং তোমাকে কোনো গন্তব্যে নিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্যে, যেখানে পৌঁছার পর তুমি বিষয়টা বুঝতে পারবে, যা তুমি প্রথমে বুঝতে পারনি। তবে এই বিষয়ে তোমার অলস হওয়া ও তাচ্ছিল্য করা চলবে না। শুরুর সময়টাই হলো তোমার জন্যে সবচেয়ে সংকটপূর্ণ। কারণ এই সময়েই মস্তিষ্ক ও হৃদয় রুপ পরিগ্রহ এবং ভাবনাকে ঘনীভূত করে।’


আরো পড়ুন: জন্মদিনের মেয়ে ।। হারুকি মুরাকামি

 

আমি আমার চোখ পুনরায় বন্ধ করলাম এবং বৃত্তের চিত্রটাকে দৃশ্যমান করার চেষ্টা করলাম। অলস হতে বা উপেক্ষা করতেও আমি চাইলাম না। কিন্তু, লোকটি যা বলছিল তার অর্থ আমার সকল চেষ্টা স্বত্বেও বুঝতে সক্ষম হলাম না। প্রতিটা বৃত্তেরই একটা কেন্দ্র আছে এবং একটা পরিধি আছে যার উপরের প্রতিটা বিন্দুই কেন্দ্র থেকে সমান দূরত্বে অবস্থিত। এই খুব সহজেই কম্পাস দিয়ে এঁকে ফেলা যায়। আমার কাছে মনে হলো লোকটি কি এমন কিছুর কথাই বলছেন না, যা বৃত্তের সম্পূর্ণ বিপরীত?

তবে আমি লোকটিকে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ বলে ভাবতে পারলাম না। এমনকি এটাও ভাবতে পারলাম না যে, তিনি আমকে উত্যক্ত করার জন্যে প্রশ্নটা করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা জানাতে চাইছেন। সুতরাং আমি পুনরায় চেষ্টা করলাম বুঝতে। কিন্তু আমার চিন্তাশক্তি একটা জায়গাতেই ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং সামনে এগুতে পারছিলাম না। কীভাবে একটা বৃত্ত একাধিক বা অসংখ্য কেন্দ্র থাকার পরেও তা বৃত্ত হিসেবেই থাকতে পারে? এটা কি কোনো পোস্টমডার্ন দার্শনিক রুপক? শেষ পর্যন্ত আমি চেষ্টা পরিত্যাগ করলাম এবং আমার চোখ খুললাম। চিন্তা করার জন্যে আমার আরও সুত্র প্রয়োজন।

কিন্তু চোখ খুলে আমি লোকটিকে দেখতে পেলাম না। আমি চারদিকে তাকালাম, কিন্তু পার্কের ভেতরে আমি ছাড়া আর কেউই ছিল না। মনে হচ্ছিল তিনি কখনই অস্তিত্বশীল ছিলেন না। আমি কি এতক্ষণ কল্পনা করছিলাম, তাহলে? অবশ্যই না। এটা কখনই আমার উদ্ভট কল্পনা হতে পারে না। তিনি এই একটু পূর্বেই আমার সামনে ছিলেন, তার ছাতাটিকে আঙুল দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন, শান্তভাবে কথা বলছিলেন, অদ্ভুত প্রশ্ন করছিলেন আমাকে, এবং তারপর চলে গেছেন।

আমি অনুভব করলাম আমার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক ও স্থির হয়ে এসেছে। আমার ভেতরের অস্থিরতার স্রোত অন্তর্হিত। আকাশের ফাঁকে ফাঁকে এখানে-সেখানে মেঘের ঘন স্তরগুলো পুনরায় দৃশ্যমান হচ্ছে। পোতাশ্রয়ের উপরেও। একটা আলোকরশ্মি প্রতিসরিত হয়ে ক্রেনের উপরিভাগের এলুমিনিয়ামের ঢাকনাকে আলোকিত করেছিল। মনে হচ্ছিল সকল আলোকরস্মিই এক স্থানে গিয়ে মিলেছে। আমি অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম। যেন একটা পৌরাণিক দৃশ্য আমার দৃষ্টিকে অসাড় করে দিয়েছে।

স্যালোফোন কাগজ দিয়ে মোড়া লাল ফুলের তোড়াটিও আমার পাশেই ছিল। অদ্ভুত যা কিছু আমাকে কেন্দ্র করে ঘটে গেল তার সাক্ষী হিসেবে। আমি ফুলের তোড়াটি নিয়ে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে পুনরায় ভাবলাম এবং শেষ পর্যন্ত সেটিকে দোলনাটির উপরে রেখে দিলাম। আমার নিকটে এটাই সবচেয়ে যৌক্তিক বলে মনে হলো। তারপর আমি দাঁড়ালাম এবং বাসস্টপের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। যেখানে আমি পূর্বে বাস থেকে নেমেছিলাম। বাতাস বইতে শুরু করল এবং মাথার উপরের স্থির মেঘগুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে গেল।

আমার গল্প বলা শেষ হবার পর একটু বিরতি দিয়ে আমার সেই কনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে বলল, ‘আমি আসলেই কিছু বুঝলাম না। তার পরে কি হয়েছিল? কোনো তত্ত্ব বা উদ্দেশ্য কি তুমি এই ঘটনা থেকে খুঁজে পেয়েছিলে?’

আমন্ত্রণ পত্রের নির্দেশিকা অনুসরণ করে শরৎকালের রোববারের সেই বিকেলে কোবে পর্বতের শীর্ষে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে একটা পিয়ানো বাজানোর অনুষ্ঠান হবার কথা ছিল, কিন্তু পৌঁছার পর আমি আবিষ্কার করেছিলাম যে, হলো ঘরটিতে কেউই ছিল না। এই ধরনের একটা ঘটনার অর্থ কি হতে পারে? কেনই তা ঘটেছিল? এই প্রশ্নগুলোই আমার বন্ধু আমার নিকট থেকে জানতে চাচ্ছিল। খুবই স্বাভাবিক ছিল তার প্রশ্নগুলো। কারণ যে গল্পটা আমি তাকে বলছিলাম তা আসলেই কোনো উপসংহারে পৌঁছেনি।

‘আমি নিজেও বুঝি নাই, এমনকি এখনও,’ আমি স্বীকার করলাম।

ওটা ছিল প্রাচীন কোনো ধাঁধার মতোই অমীমাংসিত। সেদিন যা ঘটেছিল তা ছিল আমার ধারণাশক্তির অতীত ও দুর্বোধ্য। আমার আঠারো বছর বয়সে ঘটনাটি আমাকে হতবিহবল এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছিল। এতটাই যে, এক মূহূর্তের জন্যে হলেও আমি আমার পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম।

‘কিন্তু আমার মনে হয় তত্ত্ব বা উদ্দেশ্য এখানে সত্যিকারের বিষয় ছিল না।’

আমার বন্ধুকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। ‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ যে, বিষয়টি কি ছিল তা জানারই প্রয়োজন নেই?’ সে প্রশ্ন করল।

আমি মাথা নাড়ালাম।

‘কিন্তু আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম,’ সে বলল,’ বিষয়টা নিয়ে আমার চিন্তার অন্ত থাকত না। আসল সত্য কি ছিল এবং কেন তা ঘটেছিল তা আমি অবশ্যই জানতে চাইতাম।’

‘অবশ্যই। সেই সময়ে আমাকেও সেটা চিন্তিত করত। খুবই। এবং আমি মনে মনে কষ্টও পেতাম। কিন্তু সময় অতিক্রান্ত হবার পর দূর থেকে বিষয়টিকে নিয়ে চিন্তা করা আমার নিকটে গুরুত্বহীন বলেই মনে হত। মনে হতো যে, এ ধরনের বিষয় নিয়ে মন খারাপ করে থাকার কোন মানে হয় না। এমনকি এটাও মনে হয়েছিল যে, জীবনের সারাংশ বা ক্রীমের সাথে আদৌ এর কোনো সম্পর্ক বা সংযোগ নেই।’

‘ক্রীম অফ লাইফ,’ সে পুনরাবৃত্তি করল।

‘এই ধরনের ঘটনা জীবনে কখনও কখনও ঘটেই থাকে,’ আমি তাকে বললাম। ‘এই ধরনের অনেক ব্যাখ্যাতীত, অযৌক্তিক ঘটনাবলী আমাদের মানসিক শান্তিকে ভীষণভাবে নষ্ট করে থাকে। আমি মনে করি এগুলো নিয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিৎ নয়। বরং উচিৎ চোখ বন্ধ করে এগুলোকে অতিক্রম করে চলে যাওয়া। যেন আমরা একটা বিশাল ঢেঊয়ের নিচ দিয়ে অতিক্রম করছি।’

আমার কনিষ্ঠ বন্ধু বিশাল সেই ঢেউয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। সে ছিল একজন অভিজ্ঞ সার্ফার (surfer)। ঢেঊকে অতিক্রম করার সময়ে তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নিতে হতো। অবশেষে সে নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল,’ কিন্তু কোনকিছু সম্পর্কে চিন্তা না করাও যথেষ্ট কঠিন কাজ।’

‘তুমি ঠিক বলেছ। এটা আসলেই খুব কঠিন কাজ।’

কিন্তু কোনো মূল্যবান জিনিসই সহজে পাওয়া যায় না, বৃদ্ধ লোকটি বলেছিল অটল বিশ্বাস নিয়ে। এমন করে যেন পিথাগোরাস তার উপপাদ্যগুলোকে ব্যাখ্যা করছিলেন।

‘সেই বৃত্ত যার অনেক কেন্দ্র, কিন্তু কোনো পরিধি নেই, সে সম্পর্কে তুমি কি কোনো উত্তর পেয়েছিলে?’

‘ভাল প্রশ্ন,’ আমি বললাম। আমি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম। আমি কি পেয়েছিলাম?

আমার জীবনে যখনই ব্যাখ্যাতীত, অযৌক্তিক এবং মানসিকভাবে বিভ্রান্তিকর কোনো ঘটনা ঘটে (আমি বলছি না যে, সেটা প্রায়ই ঘটে থাকে, তবে কয়েকবার তো ঘটেছেই), আমি সেই বৃত্তের কাছে ফিরে আসি – পরিধিহীন, কিন্তু অনেকগুলো কেন্দ্র সম্পন্ন বৃত্ত। যেমন করে আমার আঠারো বছর বয়সে করেছিলাম – দোলনার উপরে বসে। আমি আমার চোখদ্বয় বন্ধ করি এবং হৃদয়ের কম্পন শুনতে থাকি।

কোনো কোনো সময়ে আমার মনে হয় সেই বৃত্তকে আমি অনুভব করতে সক্ষম, কিন্তু গভীরতর কোনো বোধ আমাকে পুনরায় বিভ্রান্ত করে। এই বৃত্তটা খুব সম্ভবত নির্দিষ্ট আকৃতির কোনো বৃত্ত নয়। ওটার কোনো নির্দিষ্ট অবয়বও নেই। শুধুই তা আমাদের মনের ভেতরে অস্তিত্বশীল থাকে। আমরা যখন কাউকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসি, অথবা তার জন্যে গভীর সহমর্মিতা অনুভব করি, অথবা বিশ্বাসকে (অথবা বিশ্বাসের কাছাকাছি কোনোকিছুকে) আবিষ্কার করি – সেটাই হলো সেই মহার্ঘ সময় যখন আমরা বৃত্তটিকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে সেভাবে বুঝতে সক্ষম হই এবং আমাদের হৃদয়ও তা মেনে নেয়। আমি স্বীকার করছি যে, এর চেয়ে অধিকতর স্পষ্ট ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।

তোমার মস্তিষ্ক কঠিন বিষয় চিন্তা করতে সক্ষম। চিন্তা তোমাকে সেই বিন্দুতে নিয়ে যাবে, যেখানে পৌঁছার পর তুমি বুঝতে পারবে, যা তুমি প্রথমে বুঝতে পার নাই। এবং সেটাই তোমার জীবনের ক্রীম। এটা ছাড়া অন্য সকল কিছুই ক্লান্তিকর ও মূল্যহীন। ধূসর চুলের সেই বৃদ্ধ আমাকে সেই কথাই বলেছিল, যখন একটা মেঘাচ্ছন্ন রবিবার বিকেলে কোবের পর্বতের চূড়ায় আমি যখন এক গুচ্ছ লাল ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে ছিলাম। এমনকি এখনও যখন কোনো বিভ্রান্তিকর কোনো কিছু আমার জীবনে ঘটে, আমি সেই বিশেষ বৃত্ত নিয়ে চিন্তা করি। ভাবি যে, ওটা ছাড়া অন্য সকল কিছুই ক্লান্তিকর ও মূল্যহীন। এই অনুপম ক্রীমকে আমাদের অন্তরের গভীরে অবশ্যই লালন করতে হবে।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত