| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প : আমি শুধু ফোন করতে এসেছিলাম

আনুমানিক পঠনকাল: 18 মিনিট

অনুবাদ : অমিতাভ রায়
বর্ষণমুখর বসন্তের বিকেলে ভাড়া করা গাড়ি চালিয়ে মারিয়া দে লা লুস্‌ সেরওয়ানতেস্‌ একা একাই বার্সেলোনায় ফেরার পথে। মোনোগ্রোস মরুভূমিতে গাড়িটা বিগড়ে গেল। সাতাশ বছরের মারিয়া বুদ্ধিমতী এবং সুন্দরী। মেক্সিকোর মেয়ে মারিয়া বছর কয়েক আগেই সংগীতশিল্পী হিসেবে বেশ নাম করেছে। হোটেল রেস্তোরাঁয় ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়ানো এক যাদুকরের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়। সারাগোসায় কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সেরে দিনের শেষে বাড়ি ফিরে স্বামীর সঙ্গে বেরোনোর কথা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ঝড়ের চেয়েও জোরে ছুটে যাওয়া গাড়ি-লরিগুলোকে থামানোর ব্যাকুল প্রয়াস ঘণ্টাখানেক ধরে চালানোর পর একটা ভাঙাচোরা-বিধ্বস্ত বাস ওকে করুণা দেখাল। যদিও বাসের ড্রাইভার ওকে আগেভাগেই জানিয়ে দিল যে তারা কিন্তু বেশি দূরে যাচ্ছে না। “এটা কোনও ব্যাপার নয়’,–মারিয়া বলল। ‘আমি শুধু একটা টেলিফোন করতে চাই।”
সেটা সত্যি সত্যিই দরকার। সাতটার আগে বাড়ি পৌঁছোতে না পারার খবরটা স্বামীকে জানানো প্রয়োজন। গোড়ালির উপর পর্যন্ত ঢাকা বুট জুতো মানে ‘বিচ্‌ স্যু” আর ছাত্রছাত্রীদের ইউনিফর্মের মতো “স্টুডেন্টস্‌ কোট্‌’ পরিহিতা মারিয়াকে এপ্রিল মাসের বৃষ্টিতে ভেজার পর চুপসে যাওয়া একটা ছোট্ট পাখির মতো লাগছিল। গাড়িটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় মারিয়া মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছে যে গাড়ি থেকে চাবিটা খুলে নেওয়ার কথাও মনে নেই। ড্রাইভারের পাশে বসে থাকা মিলিটারি মেজাজের এক মহিলা একটু সরে বসে মারিয়ার বসার জায়গা করে দিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা তোয়ালে আর একটা কম্বল। মারিয়া তোয়ালে দিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা গা-হাত-পা ভালো করে মুছে নিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে গুছিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখল দেশলাইটা ভিজে গেছে। পাশে বসা মিলিটারি মেজাজের মহিলা একটা লাইটার এগিয়ে দিয়ে মারিয়ার কাছে তখনও পর্যন্ত শুকনো থাকা একটা সিগারেট চাইলেন। ধূমপান করতে করতে মারিয়া উচ্চ স্বরে নিজের অবস্থাটা বোঝাবার চেষ্টা করল। বাসের ঘরঘর আওয়াজ এবং বৃষ্টির ঝমাঝমানিকে ছাপিয়ে কথা বলবার জন্যই ওকে গলা তুলতে হয়েছিল। কিন্তু পার্শ্ববর্তিনী নিজের ঠোঁটের উপর তর্জনী চেপে ধরে মারিয়াকে থামতে ঈঙ্গিত করলেন।
‘ওরা ঘুমোচ্ছে’, তিনি ফিসিফিসিয়ে বললেন। মারিয়া কাঁধ বাঁকিয়ে পেছন ফিরে দেখল যে পুরো বাসটা নানান বয়সের এবং চেহারার ঘুমন্ত মহিলায় ভর্তি। তারা প্রত্যেকেই মারিয়ার মতো কম্বল মুড়ি দিয়ে আছে। তাদের ঝিমুনিটা ছোঁয়াচে। মারিয়া গুটিসুটি মেরে বসে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙার পর মারিয়া দেখল আঁধার নেমেছে আর ঝড় থেমে গিয়ে শুরু হয়েছে তুষারপাত। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে অথবা পৃথিবীর কোন প্রান্তে আছে–এ বিষয়ে মারিয়ার কোনও ধারণা নেই। পার্শ্ববর্তিনী ওকে খুঁটিয়ে দেখছেন। “আমরা কোথায় এলাম”,-মারিয়া প্রশ্ন করল। 
‘আমরা পৌঁছে গেছি’,–মহিলা জবাব দিলেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বিশাল বাড়ির পাথর বাঁধানো উঠোনে বাসটা ঢুকছে। মনে হচ্ছে নান বা সন্ন্যাসিনীদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই অতি প্রাচীন বাড়িটি। উঠোনের আবছা আলোয় বাস যাত্রীদের স্থানুবৎ হয়ে বসে থাকাটা চোখে পড়ছে। মিলিটারি মেজাজের মহিলা স্কুলের বাচ্চাদের দেওয়া নির্দেশের মতো মহিলাদের বাস থেকে নামতে না বলা পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। ওরা সবাই বয়স্কা নারী । ওদের চলা-ফেরা, নড়া-চড়া এত শ্লথ যে উঠোনের আলো আঁধারিতে ওদের স্বপ্নে দেখা ছবির ছায়া বলে মনে হচ্ছে। বাস থেকে সবার শেষে নামার সময় মারিয়া ভাবল যে ওরা সবাই নান। কিন্তু যখন দেখল ইউনিফর্ম পরিহিতা কয়েকজন মহিলা বাসের দরজায় দাঁডিয়ে বাস যাত্রীদের কম্বল ধরে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে বাস থেকে নামিয়ে মুখে কোনও শব্দ না করে শুধুমাত্র নির্দেশাত্মক হাততালি দিয়ে বাসযাত্রীদের সারিবদ্ধ করাচ্ছে, তখন আবার মারিয়ার ধারণার নিশ্চিন্ত ভাবটা একটু আলগা হল। যিনি ওকে কম্বলটা দিয়েছিলেন এবং বাসে বসতে দিয়েছিলেন, তাকে বিদায় জানিয়ে কম্বলটা ফেরৎ দিতে গেলে তিনি বললেন উঠোনটা পেরোবার সময় মাথা ঢাকার জন্য কম্বলটা লাগবে ; আর পরে ওটা রিসেপশন অফিসে জমা দিয়ে দিলেই চলবে। ‘’ওখানে কোনও টেলিফোন আছে?”–মারিয়া প্রশ্ন করে। ‘’নিশ্চয়ই’,–মহিলা বললেন। ‘’ওরা তোমায় দেখিয়ে দেবে টেলিফোনটা কোথায় আছে।” তিনি আরেকটা সিগারেট চাইলেন এবং মারিয়া ভেজা প্যাকেটের বাকিটুকু তার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বলল “যেতে যেতে রাস্তাতেই ওগুলো শুকিয়ে যাবে’। চলন্ত বাসের পাদানিতে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাবার সময় “তোমার সৌভাগ্য কামনা করি” কথাগুলো তিনি চিৎকার করার মতো জোরে উচ্চারণ করলেন। তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাসটা রওনা দিয়ে দিল। 
বাড়িটার দরজার দিকে দৌঁড় লাগাল মারিয়া। জোরালো হাততালি দিয়ে জনৈক মেট্রন ওকে থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ধমকের সুরে চিৎকার করে বলল,-“থাম। আমি থামতে বলছি।” মারিয়া কম্বলের তলা থেকে মাথা বের করে দেখল বরফের মতো ঠাণ্ডা একজোড়া চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে আর একটা তর্জনী উঁচিয়ে রাখা আছে ওর দিকে। নির্দেশটা ও মেনে নিল। রিসেপশন অফিসের সামনে মেয়েদের দলটা যখন দাঁড়িয়েছিল তখন হঠাৎ নিজেকে ছিটকিয়ে বের করে নিয়ে ও টেলিফোনটার খোঁজ নিল। জনৈক মেট্রন ওর কঁধে একটা ছোট্ট চাপড় মেরে ওকে লাইনে ঢুকিয়ে দিতে দিতে স্যাকারিনের মতো মিষ্টি ঝরানো স্বরে বলল,–“এই দিকে, সুন্দরী, টেলিফোনটা এই দিকে।” 
অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে মারিয়াও আলো-আঁধারিতে ঘেরা একটা বারান্দা দিয়ে চলতে শুরু করে একটা ডর্মিটরিতে পৌঁছোনোর পর মেট্রন কম্বলগুলো ওদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে যার যার নির্দিষ্ট বিছানা দেখিয়ে দিল। অন্য একজন মেট্রন যাকে কিছুটা মানবিকতাসম্পন্ন মনে হচ্ছিল এবং মারিয়া থেকে অনেকটা আগে লাইনের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে একটা লিস্ট হাতে নিয়ে সদ্য আগত মহিলাদের জামার সঙ্গে লটকানো কার্ডবোর্ড ট্যাগে লেখা নামের সঙ্গে লিস্টটা মেলাতে শুরু করল। মারিয়ার কাছে এসেই সে চমকে উঠল। মারিয়ার জামায় কোনও পরিচয়পত্র না দেখে সে তো পুরোপুরি বিস্মিত। 
‘আমি শুধু ফোন করতে এসেছিলাম’, –মারিয়া তাকে বলল। মারিয়া খুব দ্রুততার সঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলল, হাইওয়েতে গাড়িটা বিগড়ে যায়। ওর স্বামী এখানে-ওখানে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়ায়। আপাতত সে ওর জন্য বার্সেলোনায় অপেক্ষা করছে। মাঝরাতের আগে ওদের তিন জায়গায় ম্যাজিক দেখানোর কথা আগে থেকেই ঠিক করা আছে এবং নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি পৌঁছে তার সঙ্গে বেরোতে না পারার কথা ও স্বামীকে জানাতে চায়। তখন প্রায় সন্ধে সাতটা। তাকে আর দশ মিনিটের মধ্যে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে। ওর আশঙ্কা ঠিক সময়ে উপস্থিত না হওয়ায় ওর স্বামী সমস্ত অনুষ্ঠান বাতিল করে দেবে। মেট্রন মন দিয়ে শোনার জন্ ওর কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল। 
‘তোমার নাম কী?’–সে প্রশ্ন করল। 
মারিয়া নিজের নামটা উচ্চারণ করে কিছুটা স্বস্তি পেল। কিন্তু মহিলা বারংবার লিস্ট মিলিয়েও ওর নাম দেখতে না পেয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে অন্য একজন মেট্রনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করল। তারও কিছু জানা নেই বলে সে শুধু কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে দিল। 
‘কিন্তু আমি শুধু একটা ফোন করতে এসেছিলাম,’’–মারিয়া বলল। 
‘নিশ্চয়ই’,–সুপারভাইজার ওকে নির্ধারিত বিছানার দিকে নিয়ে যেতে যেতে প্রকৃত ধৈর্য বজায় রেখে যথেষ্ট শান্তস্বরে বললেন,–“তুমি যদি ভালো হও তা হলে যাকে ইচ্ছে ফোন করতে পারবে। তবে এখন নয়, আগামীকাল।” 
তখন মারিয়ার মনে চিন্তার উদ্রেক হল। এবং ও বুঝতে পারল কেন বাসে করে আনা মহিলাবৃন্দ অ্যাকোয়ারিয়ামের নিচে পড়ে থাকা খাবি খাওয়া মাছের মতো নাড়াচড়া করছিল। আসলে তাদের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল এবং ভারি পাথরের দেওয়াল এবং হিমশীতল সিঁড়ি সমন্বিত এই অন্ধকার প্রাসাদটা মহিলা মানসিক রোগীদের একটা হাসপাতাল। মারিয়া ডর্মিটরি থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত। কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছোনোর আগেই মিস্ত্রিদের মতো সারা শরীর ঢাকা ‘কভার-অল’ পোশাক পরিহিতা বিপুলকায় এক মেট্রনের বিরাট হাতের এক ধাক্কায় মারিয়ার গতি একেবারে স্তব্ধ। এক প্যাঁচেই ধরাশায়ী মারিয়া। মারিয়া সন্ত্রস্ত হয়ে, থমকে গিয়ে দেখে নিল নিজের চারপাশটা। 
‘ভগবানের দোহাই’,–সে বলল,–“আমার মরা মায়ের নামে দিব্যি করে বলছি যে আমি শুধু একটা ফোন করতে এসেছিলাম।’ কাভার-অল পরিহিতা এই মহিলা তার অসাধারণ শক্তির জন্য হারকুলিনা নামে পরিচিত। তার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই মারিয়া বুঝে গেল কোনওভাবেই তাকে গলানো সম্ভব নয়। 
গোলমেলে রোগীদের সামলানো হারকুলিনার দায়িত্ব। ‘ভুল করে খুন করার কাজে’ দক্ষ মেরু ভালুকের মতো তার হাত দুটো এর আগে দু’জন আবাসিককে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মেরে ফেলেছে। প্রথম ঘটনাটা দুর্ঘটনা বলে প্রতিপন্ন হয়। দ্বিতীয় ঘটনাটা কম পরিষ্কার ছিল এবং হারকুলিনাকে মৃদু অথচ দৃঢ় তিরস্কার করে এই মর্মে সাবধান করে দেওয়া হয় যে ভবিষ্যতে এমন ঘটলে তাকে সরেজমিন তদন্তের সম্মুখীন হতে হবে। তবে স্পেনের বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালের যাবতীয় সন্দেহজনক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই অভিজাত পরিবারের এই কালো ভেড়িটার একটা বিতর্কিত ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত। ঘুম পাড়ানোর জন্য প্রথম রাতে মারিয়াকে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিতে হল। ভোর হবার আগে ধূমপানের নেশায় ঘুম ভেঙে গেলে ও বুঝতে পারল যে ওর কবজি এবং গোড়ালি বিছানার লোহার রডের সঙ্গে বাঁধা। ও চিৎকার করল, কিন্তু কেউ এল না। সকালে বার্সেলোনায় ওর স্বামী যখন মারিয়ার কোনও সন্ধান পেল না, তখন মারিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারণ, যন্ত্রণায় জ্ঞানহীন অবস্থায় ওকে পড়ে থাকতে দেখা গেছিল। 
জ্ঞান ফেরার পর মারিয়া বুঝতে পারল না যে কতটা সময় কেটে গেছে। কিন্তু এখন জগৎটাকে ভালোবাসার স্বর্গ বলে মনে হল। ওর বিছানার পাশে দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন যার শান্ত পদচারণ, সৌম্য হাসি এবং হাতের বরাভয় ভঙ্গি ওকে আবার ফিরিয়ে দিল বেঁচে থাকার আনন্দ। তিনি এই উন্মাদ আশ্রমের অধ্যক্ষ এবং অবশ্যই ডাক্তার। 
তাঁকে কিছু বলার আগেই এমনকি শুভেচ্ছা বিনিময়েরও আগে মারিয়া একটা সিগারেট চেয়ে বসল। একটা সিগারেট ধরিয়ে মারিয়াকে দিলেন তিনি। প্রায় ভর্তি সিগারেটের পুরো প্যাকেটটাও দিয়ে দিলেন। মারিয়া চোখের জল আটকে রাখতে পারল না। “এখন তোমার প্রাণভরে কাঁদার সময়’,–ডাক্তার ভদ্রলোক ঘুম মেশানো গলায় বললেন। ‘চোখের জল সবচেয়ে ভালো ওষুধ’।
কোনওরকম লজ্জা ছাড়াই নিজেকে প্রকাশ করল মারিয়া। অথচ খুচরো প্রেমিকদের সঙ্গে বিছানা পর্যন্ত গড়ানো অবসর বিনোদনের সময়েও মারিয়া এতটা খোলামেলাভাবে নিজেকে কখনও মেলে ধরতে পারেনি। ডাক্তার সব শুনছেন। আঙুল দিয়ে ওর চুল পরিপাটি করে সাজিয়ে তুললেন। ঠিক ভাবে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেবার জন্য বালিশটা ভালো করে গুছিয়ে দিলেন।
ও স্বামীকে জানাতে চায়। জটিল এবং অনিশ্চিত মানসিক অবস্থা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য অধ্যক্ষ জ্ঞান ও মাধুর্য মেশানো কথায় এমন পরামর্শ দিলেন যা কোনওদিন স্বপ্নেও সম্ভব বলে ভাবতে পারেনি মারিয়া। জীবনে এই প্রথমবার একজন পুরুষ সর্বান্তকরণে ওকে বুঝে উঠে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনেও আশ্চর্যজনকভাবে পারিশ্রমিক হিসাবে বিছানায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন না। দীর্ঘ একঘণ্টা বাদে মনের গভীরের আস্তরণগুলো আস্তে আস্তে তার সামনে খুলে ফেলার পর মারিয়া স্বামীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করল।
আভিজাত্য-ব্যক্তিত্ব বজায় রেখেই উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার। “রাজকন্যে, এখন নয়’,–আগের চেয়ে অনেক বেশি স্নেহ দিয়ে ওর গালে হাত বুলিয়ে তিনি বললেন,–“না মা, এখন নয়। ঠিক সময়ে সব কিছু হবে।” দরজা থেকে তিনি বিশপের ভঙ্গিতে আশীর্বাদ করলেন। তার উপর আস্থা রাখতে বলে চিরতরে বিদায় নিলেন তিনি।
সেদিন বিকেলে মারিয়াকে একটা ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে মানসিক হাসপাতালে নথিভুক্ত করে নেওয়া হল। কোথা থেকে ও এসেছে এবং ওর পরিচয় সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলে লিখে রাখা হল একটা সাদামাটা মন্তব্য। নথির পাশে হাসপাতালের অধ্যক্ষ স্বহস্তে মতামত জ্ঞাপন করে লিখলেন,- ‘বিক্ষুব্ধ’। 
মারিয়া যেমন আন্দাজ করেছিল সেদিন কিন্তু ঠিক তার উলটোটাই ঘটেছিল। বার্সেলোনার ‘হোর্তা’ এলাকার আধুনিক ফ্ল্যাট থেকে ওর স্বামী তিনটি অনুষ্ঠানের কর্মসূচি রক্ষার জন্য নির্ধারিত সময়ের আধ ঘণ্টা বাদে বেরিয়ে পড়ে। গত দু’বছরের স্বাধীন এবং স্বচ্ছন্দ দাম্পত্য জীবনে এই প্রথম তার দেরি। স্বামী ভদ্রলোকের আশঙ্কা অবিশ্রান্ত বর্ষণ, যার ফলে সপ্তাহের শেষে পুরো জেলাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তার জন্যই এই বিলম্ব। বাইরে বেরোনোর আগে সে একটা চিরকুটে ওই রাতের কর্মসূচি লিখে ফ্ল্যাটের দরজায় টাঙিয়ে দিয়ে যায়। 
প্রথম অনুষ্ঠানে যেখানে সব বাচ্চারা ক্যাঙারুর পোশাক পরেছিল, সেখানে তার সেরা খেলা, “অদৃশ্য মাছ’ বাদ পড়ে। কারণ মারিয়ার সহায়তা ছাড়া এই খেলাটা দেখানো সম্ভব নয়। এক তিরানব্বই বৎসর বয়স্কা বৃদ্ধার বাড়িতে দ্বিতীয় অনুষ্ঠান। এই বৃদ্ধ গত তিরিশ বছর ধরে বিভিন্ন জাদুকরকে বাড়িতে আমন্ত্রণ করে জাদু-প্রদর্শনীর আয়োজন করে নিজের জন্মদিন উদ্‌যাপন করেন। মারিয়ার অনুপস্থিতি তাকে এমন সমস্যায় ফেলে যে সহজ-সরল খেলাগুলোতেও মন বসানো তার পক্ষে সম্ভব হল না। “রামব্লাস্‌’’-এর একটা কাফেতে ছিল তার তৃতীয় অনুষ্ঠান। এখানে তাকে রোজই খেলা দেখাতে হয়। একদল ফরাসি পর্যটকের জন্য আয়োজিত এই প্রদর্শনীটা এতই সাদামাটা হয়েছিল দর্শকদের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব হল না ; কারণ, তাদের জাদুতে আস্থা নেই। প্রতিটি প্রদর্শনীর শেষে সে বাড়িতে একবার ফোন করেছে। এবং ব্যাকুলভাবে মারিয়ার জবাবের জন্য অপেক্ষা করেছে। শেষ টেলিফোনটার জবাব না পেয়ে সে আর নিজের উপর আস্থা রাখতে পারেনি এবং বুঝল কিছু একটা ঘটেছে। 
ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীর জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা তার ভ্যান গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফেরার পথে, ‘পাসেও দে গ্রাসিয়া’ দিয়ে যাওয়ার সময় পাম গাছগুলোর মধ্যে বসন্তকালের শোভা দেখতে দেখতে মারিয়াকে ছাড়া এই শহরটার হাল কী দাঁড়াবে এই আশঙ্কায় সে শিউরে ওঠে। বাড়ির দরজার বাইরে আটকানো চিরকুটটা অবিকৃত অবস্থায় দেখে নিভে যায় তার শেষ আশা। মানসিকভাবে সে এতটাই বিপর্যস্ত যে পোষা বিড়ালটাকে খাওয়ানোর কথাও মনে নেই।
লিখতে লিখতে এখন খেয়াল হল তার আসল নামটাই আমি জানি না। কারণ, বার্সেলোনায় আমরা তাকে পেশাগত নামেই চিনতাম ‘সাতুর্নো দ্যা ম্যাজিসিয়ান’। বিদ্‌ঘুটে চরিত্রের এই মানুষটাকে সামাজিক করে তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু মারিয়া মনোরম ব্যবহার করে তার ঘাটতিগুলো পুষিয়ে দিত। বিচিত্র রহস্যের সমাহার এই সমাজ, যেখানে কোনও পুরুষ তার স্ত্রীকে মাঝরাতের পর কাছে ডাকার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না, সেখানে মরিয়া তাকে সব দিক থেকে সামলিয়ে চলত। বাড়িতে পৌঁছে সাতুর্নো পুরো ঘটনাকে ভুলে যাওয়াই ভালো বলে মনে করল। এবং সেই রাতেই সে সারাগোসায় পৌঁছে ঠাকুমার ঘুম ভাঙানোর পর জানতে পারল যে দুপুর বেলায় খাওয়াদাওয়া সেরে, মারিয়া সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। ভোরের দিকে সে ঠিক এক ঘণ্টা ঘুমোল। ঘুমের মধ্যে সে দেখল একটা অদ্ভুত স্বপ্ন। মারিয়ার পরনে বিয়ের পোশাক। রক্তের ছিটে লাগা জীর্ণ-ছিন্ন বিয়ের পোশাক পরা মারিয়াকে দেখে ঘুমটা ভেঙে গেল এবং তখনই তার গভীর আশঙ্কা হল মারিয়া চিরতরে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর এখন থেকে ওকে ছাড়াই সাতুর্নোকে একা একা এই বিরাট পৃথিবীর মুখোমুখি হতে হবে। তাকে নিয়ে গত পাঁচ বছরে তিন জন পুরুষকে ছেড়ে চলে গেছে মারিয়া। দেখা হওয়ার ছ’মাস পরে তাকে মেক্সিকো শহরে ছেড়ে দিয়ে মারিয়া চলে যায়। অথচ তখন আন্‌জুরেশ জেলার এক পরিচারিকার ঘরে পাগলের মতো ভালোবাসার চরম আনন্দ খুঁজে পেতে ওরা রীতিমতো লড়াই চালাচ্ছিল। সারা রাত, ব্যাখ্যা করা যায় না এমন সব বিদ্‌ঘুটে আচরণ করে পরের দিন সকালে মারিয়া চলে যায়। ওর যাবতীয় জিনিসপত্র, এমনকী আগের বিয়ের আংটিটাও ফেলে রেখে গেল। পড়ে রইল সেই চিঠিটা, যাতে ও লিখেছিল,-“এই রকম বন্য ভালোবাসার বেদনাদায়ক দাপট সহ্য করা সম্ভব নয়।” সাতুর্নো ভেবেছিল প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে গেছে মারিয়া। হাই স্কুলে পড়ার সময়ই এক সহপাঠীকে মারিয়া গোপনে বিয়ে করেছিল। আইনের হিসাবে বিয়ের বয়স না হওয়ায় সেই বিয়েটা গোপনেই সারতে হয়। বছর দুয়েক প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া কাটাবার পর ও আরেক জন পুরুষের খোঁজে হারিয়ে যায়। না, ঠিক হারিয়ে যায়নি। ও বাবা-মার কাছে ফিরে গেছিল এবং সাতুর্নোও যে কোনও মূল্যে ওকে ফেরৎ পাবার জন্য পিছু ধাওয়া করেছিল। তার নিঃশর্ত নিবেদন,–যতটুকু রাখতে পারবে তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও, এক সুদৃঢ় ও প্রত্যয়সূচক ‘না’ শুনে তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল। “ছোট-বড় সব রকমের প্রেমই আমি করেছি’–ও তাকে বলেছিল। এবং সবশেষে ও নির্দয়ভাবে বলেছিল,–“তোমার সঙ্গে এটা একটা ছোট্ট প্রেম।” ওর অনমনীয়তা তাকে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য করে। প্রায় এক বছর পরে যখন সে জোর করে সব ভুলে গেছে, সেই সময় নিজের সরাইখানা গোছের ঘরে পয়লা নভেম্বরের ‘অল সেন্টস ডে’র ভোরে হাজির হয়ে সাতুর্নো দেখল,–কমলা রঙের ফুলের মুকুট মাথায় পরে আর কুমারী কনের মতো পশমি ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে মারিয়া বসার ঘরের সোফায় ঘুমোচ্ছে। 

আরো পড়ুন: নীল কুকুরের চোখ

মারিয়া তাকে সত্যি কথাই বলল। একজন স্বচ্ছল নিঃসন্তান বিপত্নীক,–ওর নতুন প্রেমিক। ক্যাথলিক নিয়ম মেনে ওকে পাকাপাকিভাবে বিয়ে করবে বলে সে দিন-ক্ষণ স্থির করে ; কিন্তু বিয়ের পোশাকে গির্জার বেদির সামনে অপেক্ষা করতে করতেই ওর সময় কেটে গেল। বিয়েটা না হলেও, বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে আনন্দানুষ্ঠানটা উদযাপন করা হল। মারিয়াও সেই সুরে তাল মেলাল। ও নাচল, গাইল। ওকে প্রচুর মদ্য পান করতে হল। অবশেষে মাঝ রাতে এক বিমর্ষ মানসিক অবস্থায় গৃহত্যাগ করে ও সাতুর্নোর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। 
সে বাড়িতে ছিল না। হলের মধ্যে রাখা ফুলদানিতে মারিয়া চাবির গোছাটা পেয়ে গেল। এটা ওর জানা। কারণ, চাবিগুলোকে ওরা সব সময়েই এখানে লুকিয়ে রাখত। এখন মারিয়া নিঃশর্ত আত্মসমপর্ণের জন্য প্রস্তুত। ‘এবার কতদিন,–সে প্রশ্ন করল। ভিনিসিউস্‌ দে মোরায়েস্‌-এর একটা ছোট্ট পংক্তিকে উদ্ধৃত করে ও বলল,–“যতদিন টিকে থাকে, ততদিন ভালোবাসা শাশ্বত’’। দুবছর পরেও ভালোবাসা শাশ্বত ছিল। মারিয়াকে মনে হল অনেক পরিণত। অভিনেত্রী হবার অভিপ্রায় পরিত্যাগ করে সাতুর্নোকে কাজে আর বিছানায় পুরোপুরি সঙ্গ দিতে শুরু করল মারিয়া। গত বছরের শেষের দিকে ওরা জাদুকরদের এক সম্মেলন সেরে পেরপিগ্‌নান শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে প্রথম বারের জন্য বার্সেলোনায় যায়। বার্সেলোনা শহরটা ওদের এত ভালো লেগে গেল যে গত আটমাস ধরে ওরা এখানেই আছে। শহরটায় ওরা এতটাই মানিয়ে গেল যে কাতালোনিয়ান পাড়া “হোর্তা”-য় একটা ফ্ল্যাটও কিনে ফেলল। এলাকাটা কলরব মুখর। ওদের কোনও কাজের লোক নেই। কিন্তু গোটা পাঁচেক ছেলে-পিলে নিয়ে থাকার জন্য ফ্ল্যাটটা যথেষ্ট। যতটা আশা করা যায়, ওরা ততটাই আনন্দে দিন কাটাচ্ছিল। শনিবার সকালে সারাগোসায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে সোমবার সন্ধে সাতটাব মধ্যে ফিরে আসার কথা দিয়ে ভাড়া করা গাড়িটা নিয়ে মারিয়ার বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত মারিয়ার দিক থেকে কোনও খোঁজ খবর এল না। 
পরের সপ্তাহের সোমবার বিমা কোম্পানির লোকজন মারিয়ার খোঁজ করতে এল। “আমি কিছু জানি না’–সাতুর্নো বলল,–“সারাগোসায় ওর খোঁজ করুন।’ সে এভাবেই ব্যাপারটা শেষ করল। সপ্তাহখানেক পরে একজন পুলিশ অফিসার এসে জানালেন মারিয়া যেখানে ছেড়ে চলে গেছিল তার থেকে ন’শো কিলোমিটার দূরে কাদিস্‌ শহরের পিছনের একটা রাস্তায় ভাঙাচোরা অবস্থায় গাড়িটাকে দেখা গেছে। গাড়ি চুরি যাওয়া নিয়ে মারিয়া বিস্তারিতভাবে কিছু বলতে পারে কিনা অফিসার জানতে চাইলেন। সাতুর্নো বিড়ালটাকে খাওয়াচ্ছিল এবং সেই অবস্থাতেই অফিসারের দিকে একবারও না তাকিয়ে সরাসরি বলল যে পুলিশের এ ব্যাপারে একদম সময় নষ্ট করা উচিত নয়। কারণ, তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে, কার সঙ্গে গেছে সেটাও তার জানা নেই । তার বলার ভঙ্গি এত দৃঢ় যে অফিসার অস্বস্তি বোধ করলেন এবং নিজের প্রশ্নের জন্য ক্ষমা চেয়ে চলে গেলেন। পুলিশ এখানেই ঘটনাটার সমাপ্তিরেখা টেনে দিল। 
মারিয়া তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে এমন সন্দেহ সাতুর্নোর মাথায় আগেও এসেছিল। রোজা রেগাস্‌-এর আমন্ত্রণে ইস্টারের ছুটিতে নৌবিহারের জন্য কাদাকেস্‌ সফরের সময় একবার এ রকম সন্দেহ হয়েছিল। ফরাসি গোধূলিবেলার ঘিঞ্জি স্বর্গ, সাগরের ধারের ভিড় ঠাসা এক পানশালায় ছ’জনের বসার টেবিলে কুড়িজনকে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে হয়েছিল। দিনের দ্বিতীয় প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরাতে গিয়ে মারিয়া দেখল দেশলাইয়ে একটাও কাঠি নেই। টেবিলের ঘিঞ্জি ভিড়ের মধ্যে থেকে ব্রোঞ্জের ব্রেসলেট পরা একটা লিকলিকে হাত মারিয়ার সিগারেটটা ধরিয়ে দিল। মানুষটকে না দেখেই মারিয়া ধন্যবাদ জানাল। কিন্তু জাদুকর সাতুর্নো তাকে দেখল। নিখুঁতভাবে দাড়ি-গোঁফ কামানো, মৃত মানুষের মতো ফ্যাকাশে অথচ কিশোরসুলভ নাদুসনুদুস চেহারার একটা ছেলে আগুনটা এগিয়ে দিল। ছেলেটার কোমর ছাড়ানো এক রাশ চুল পনি-টেল করে বাঁধা। পানশালার জানালার শার্সিগুলো ত্রামোন্তানা ঝড়ের প্রবল বাতাসকে কোনওরকমে প্রতিহত করছে। অথচ ওই ঠাণ্ডাতেও ছেলেটির পরনে একটা সাদামাটা সুতোর পাজামা আর পায়ে এক জোড়া সস্তা চপ্পল।
লা বার্সেলোনেতার এক রেস্তোরাঁয় হেমন্তকালের আগে দেখা না পাওয়া পর্যন্ত ছেলেটি সাতুর্নো বা মারিয়ার নজরে আসেনি। সামুদ্রিক খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ এই রেস্তোরাঁটায় ছেলেটিকে সেই একইরকম পাজামা পরা অবস্থায়ই দেখা গেল। তবে এবার পনি-টেল নয়, খোঁপা বাঁধা চুল। সে তাদের দুজনকে এমন ভাবে স্বাগত জানাল যে দেখে মনে হল তারা কত পুরোনো বন্ধু। তারপরে যে ভাবে ছেলেটি মারিয়াকে চুমু খেল এবং মারিয়াও যে ভঙ্গিতে চুমু ফিরিয়ে দিল তাতে সাতুর্নোর সন্দেহ হল ওরা নিশ্চয়ই নিয়মিত গোপনে দেখাসাক্ষাৎ করে। কয়েকদিন বাদে বাড়ির নাম-ঠিকানা লেখার খাতার পাতা ওলটাতে গিয়ে সাতুর্নো দেখল মারিয়া একটা নতুন নাম এবং ফোন নম্বর লিখেছে। বিদ্বেষের এক নির্দয় আগুন তক্ষুণি জ্বলে উঠল সাতুর্নোর মনে। আগন্তুকের পরিচিতিটাই চূড়ান্ত প্রমাণ। একুশ বছর বয়স। বড়লোকের একমাত্র সন্তান। কেতাদুরস্ত দোকানের পসরাকে বাহারি কায়দায় সাজিয়ে রোজগার করে। তবে অর্থের বিনিময়ে বিবাহিতা মহিলাদের শারীরিক চাহিদা পূরণ করে সস্তুষ্ট করার কাজে ছেলেটি এর মধ্যেই যথেষ্ট নাম-ডাক করেছে। তবে যে রাতে মারিয়া বাড়ি ফিরল না সেই দিন পর্যন্ত সাতুর্নো নিজেকে সংযত রাখল। তারপর থেকে প্রতিদিন সকাল ছটা থেকে সাতুর্নো ছেলেটিকে পরের দিন ভোর পর্যন্ত ক্রমাগত ফোন করে যেতে লাগল। প্রথম প্রথম প্রতিদিন দু’তিন ঘণ্টায় একটা ফোন করে যেত। তারপর যখনই সে ফোনের কাছে থাকত ছেলেটিকে ফোন করে যেত। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হল এই যে সাতুর্নোর এই যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি সম্পর্কে কেউই গুরুত্ব দিয়ে কথা বলত না। 
চতুর্থ দিন ঘরদোর সাফসুথরো করতে থাকা জনৈকা আন্দালুসিয়ান মহিলা ফোনটা ধরলেন। সাতুর্নোকে পাগল করে দেবার জন্য যথেষ্ট এমন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে তিনি উত্তর দিলেন,–“ভদ্রলোক বেরিয়ে গেছেন।” “সেনোরিতা মারিয়া ঘটনাচক্রে ওখানে আছেন। কিনা,’-এমন একটা প্রশ্ন না করার উত্তেজনা সাতুর্নো দমন করতে পারল না। 
‘মারিয়া বলে কেউ এখানে থাকে না’,–মহিলা তাকে বললেন। ‘ভদ্রলোক অবিবাহিত।” 
‘আমি জানি’–সাতুর্নো বলল। মারিয়া ওখানে থাকে না ; তবে মাঝে মাঝেই ওখানে হাজির হয়, তাই না ?” 
মহিলা বিরক্ত হলেন ‘ধ্যাৎ!! এটা আবার কোন অপদার্থ?” সাতুর্নো ঝুলে রইল। মহিলা অস্বীকার করায় সাতুর্নোর সন্দেহ স্থির নিশ্চয়তায় পরিণত হল। সে নিয়ন্ত্রণ হারাল। পরের ক’দিন বার্সেলোনেতার পরিচিত মানুষজনকে তাদের নামের বর্ণানুক্রম অনুযায়ী প্রশ্ন করে চলল সাতুর্নো। কেউ কিছু বলতে পারল না। কিন্তু প্রতিটি ফোন বাড়িয়ে চলল তার অস্বস্তি। কারণ, বিদ্বেষপূর্ণ বুনো উত্তেজনা ও ক্ষোভ সেই ঘিঞ্জি স্বর্গের মতো পানশালার পরিচিতদের মধ্যে যথেষ্ট তামাশার খোরাক হিসাবে এর মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। এবং তারা সাতুর্নোর প্রশ্নের জবাবে এমন সব রসিকতা করত যাতে সে কষ্ট পায়।
কেবল তখনই সে বুঝতে পারল যে সেই সুন্দর-উদ্দাম-রহস্যাবৃত শহরে সে কত একা এবং সেখানে সে কোনওদিনই সুখী হতে পারবে না। ভোরবেলায় বিড়ালকে খাওয়ানোর পর, মনকে শক্ত করে মৃত্যুকে আহ্বান করার বদলে মারিয়াকে ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সাতুর্নো। 
দু’মাস বাদেও মারিয়া মানসিক হাসপাতাল বা উন্মাদ আশ্রমে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারল না। এবড়ো-খেবড়ো কাঠের লম্বা টেবিলটার সঙ্গে শেকল দিয়ে বাঁধা রেশনের খাদ্যসামগ্রী টুকরিয়ে টুকরিয়ে কোনওরকমে ও বেঁচে ছিল। মধ্যযুগীয়, জীর্ণ খাবার ঘরটায় টাঙানো জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্র্যাঙ্কোর লিথোগ্রাফে আঁকা ছবিটার দিকে ওর দু’চোখ আটকিয়ে থাকত। সকাল-সন্ধ্যার প্রার্থনা ও গির্জার অন্যান্য নিয়মকানুন যা দিনের বেশিরভাগ সময় ধরে চলত তার থেকে প্রথম দিকে ও নিজেকে এড়িয়ে চলত। ও উঠোনে বল খেলাও অপছন্দ করত। অথবা ওর সহ-আবাসিকদের যে দলটা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে কৃত্রিম ফুল তৈরির কষ্টসাধ্য কাজ করত তাতেও ওর অসম্মতি। কিন্তু তৃতীয় সপ্তাহের শেষে ও আস্তে-ধীরে গির্জার প্রাত্যহিক কাজকর্মে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। ডাক্তারদের মতে প্রত্যেকেই এইভাবে শুরু করে। তারপর আগে-পরে প্রত্যেকেই উন্মাদ আশ্রমের নিয়মকানুনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়। 
প্রথম ক’দিন সিগারেটের অভাব দূর করার জন্য মারিয়া সেই মেট্রিনের দ্বারস্থ হত, যে সোনার পরিবর্তে সিগারেট দেয়। কিন্তু ব্যাগের সামান্য অর্থ সিগারেটের জন্য খরচ হয়ে যাবার পর আবার ওর দুঃখের দিন উপস্থিত। তখন ও অন্যান্য সহ-আবাসিকদের মতো ফেলে দেওয়া সিগারেট থেকে কুড়োনো তামাক খবরের কাগজের টুকরোয় জড়িয়ে নিয়ে ধূমপান শুরু করে। এভাবে সিগারেট খেয়ে ফোন করার প্রবল আগ্রহ পূরণের চেষ্টা করে মারিয়া। পরে ঘর সাজানো নকল ফুল তৈরি করে কয়েকটা পেসেতা উপার্জন করার পর ও কিছুটা সাময়িক সান্ত্বনা পেল। 
রাত্রির একাকীত্ব ওর কাছে সবচেয়ে কঠিন সমস্যা। আলো-আঁধারিতে ওর মতো অন্য অনেক আবাসিকই জেগে জেগে শুয়ে থাকে। তাদের কিছু করার সাহস নেই। কারণ, রাত্রির ডিউটিতে থাকা মেট্রন ভারী দরজাটা তালা-শেকল দিয়ে আটকে রেখে নিজেও জেগে থাকে। একরাতে মনের মধ্যে জমে থাকা দুঃখকে দূরে সরিয়ে অনেক সাহস নিয়ে পাশের বিছানার মহিলাকে প্রয়োজনের থেকে যথেষ্ট উচ্চস্বরে মারিয়া জিজ্ঞেস করল,–“আমরা কোথায় আছি?” 
প্রতিবেশিনী দৃঢ়, শান্ত, বলিষ্ঠ ও টানটান ভাষায় উত্তর দিল,–“নরকের গর্তে।’ ‘ওরা যে বলে এটা মুরদের দেশ’–অন্য একজন বলল। শব্দটা একটু দূর থেকে আসায় সমস্ত ডর্মিটরিটা গমগম করে উঠল। ‘’এবং এটা নিশ্চিতভাবে সত্য। কারণ, গরমের সময় চাঁদ উঠলে সাগরের ধারে কুকুরের ডাক শুনতে পাবে।” মধ্যযুগের স্পেনীয় জাহাজের নোঙর তোলার শব্দের মতো তালা লাগানো শেকলটা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। এবং দরজাটা খুলল। তাদের নির্দয় অভিভাবিক যাকে এই তাৎক্ষণিক নৈঃশব্দ্যের মধ্যে একমাত্র জীবন্ত প্রাণী বলে মনে হচ্ছিল,–ডর্মিটরির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পায়চারী শুরু করে দিল। ভয়ে সিটিয়ে গেল মারিয়া। এবং তার কারণ ওর অজানা নয়। 
উন্মাদ আশ্রমে আসার প্রথম সপ্তাহ থেকে রাত্রির মেট্রন মারিয়াকে তার সঙ্গে নিরাপত্তা রক্ষীদের ঘরে শোয়ার জন্যে সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। পুরোপুরি বাণিজ্যিক ভাষায়–সিগারেট, চকোলেট বা অন্য যা কিছু মারিয়া চায় তা ভালোবাসার সঙ্গে বিনিময়ের প্রস্তাব সে ওকে দিয়েছে। ‘তুমি সব কিছু পাবে’,–মেট্রন চুক্তির সুরে বলে। ‘তুমি রানি হবে।” মারিয়া প্রত্যাখ্যান করায়, সে পদ্ধতি পালটাল। ওর বালিশের তলায়, জামার পকেটে, অন্যান্য অপ্রত্যাশিত জায়গায় প্রেম নিবেদন করা চিরকুট রাখা শুরু করল। চিরকুটগুলোর ভাষা এতই হৃদয় বিদারক যে পাথরকেও গলিয়ে দিতে পারে। ডর্মিটরির ঘটনা যে রাতে ঘটল তার মাসখানেকেরও বেশি আগে মনে হয় মারিয়া পরাজয় মেনে নিতে স্বীকার করে নিয়েছিল। 
অন্য আবাসিকরা ঘুমিয়ে পড়েছে এটা নিশ্চিত হবার পর মেট্রন মারিয়ার বিছানায় এল এবং সব রকমের অশ্লীল শব্দ ওর কানে ফিসফিসিয়ে ঢেলে দিতে দিতে মুখে চুমু খেল। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ওর হাতগুলো আশঙ্কায় সিঁটিয়ে আছে। ওর পা দুটো অজানা ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে। তারপর মারিয়ার অসারতাকে আশঙ্কাজনিত কারণের বদলে সস্তুষ্টির প্রকাশ বলে মনে করে নিয়ে মেট্রন সাহসের ডানায় ভর করে আরও এগোল। সেই মুহূর্তে মারিয়া হাতের উলটো পিঠ দিয়ে তাকে এক ধাক্কা দিয়ে পাশের বিছানায় পাঠিয়ে দিল। অগত্যা আবাসিকদের উত্তপ্ত প্রতিবাদেব মধ্যে বিরক্ত মেট্রন উঠে দাঁড়িয়ে ‘কুত্তি’ বলে চিৎকার করল। “যতক্ষণ না তুই আমার জন্য পাগল হবি ততক্ষণ এই নরকের গর্তে পাঁচবি।‘’ 
জুন মাসের প্রথম রবিবারে কোনও রকম আভাস না দিয়েই গরম পড়ে গেলে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিল। কারণ, উন্মাদ আশ্রমের অধিকাংশ আবাসিক নিজেদের বেঢপ আকারের সার্জের শেমিজগুলো গরমের দাপটে খুলে ফেলতে শুরু করল। গির্জার বারান্দায় মুরগি তাড়ানোর মতো উদোম হওয়া আবাসিকদের পিছনে মেট্রনরা ছুটে বেড়াচ্ছে দেখে মারিয়া বেশ মজা পায়। এহেন বন্য ঘুষোঘুষির থেকে মারিয়া একটা জনশূন্য দপ্তরে পৌঁছে গেল যেখানে একটা টেলিফোন আছে। ডায়ালটোনের ধারাবাহিক যান্ত্রিক শব্দও কানে এল। মারিয়া কোনওরকম চিন্তা না করেই টেলিফোনটা ধরল। টেলিফোনে বহু দূর থেকে ভেসে আসা এক হাসিসিক্ত কণ্ঠস্বর কানে এল যা শুনে ও ভীষণ মজা পায়। টেলিফোন কোম্পানি যান্ত্রিক স্বরে সময় বলছে–‘এখন সময় হল,–৪৫ ঘণ্টা ৯২ মিনিট ১০৭ সেকেন্ড।’
‘যত্ত সব!’ ও ফোনটা ধবেই থাকলে এবং মজাটা উপভোগ করল। পালাবা্র এক অপূর্ব সুযোগ উপস্থিত বুঝতে পেরে ও চলে যাবার উদ্যোগ নিল। সাংঘাতিক উত্তেজনা এবং প্রচণ্ড তাড়াহুড়োয় ও ছ’টা নম্বর ডায়াল করল। যদিও ওটা ওর বাড়ির নম্বর কিনা সে বিষযে ও নিশ্চিন্ত নয়। ও অপেক্ষা করল। ওব হৃৎপিণ্ডের ধূকপুকুনি অনেক বেড়ে গেছে। অনেক আগ্রহ নিয়ে শূন্যগৃহে পরিচিত ফোনের দুঃখজনক আও‍য়াজটা ও শুনছে। একবার, দুবার, তিনবার,-“এবং অবশেষে ও নিজের ভালোবাসার মানুষেবা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। ‘’হ্যালো ?” 
গলায় জমে থাকা কান্নাটা, যেটা গলে যাওয়ার জনা অপেক্ষা কবছিল, সেই স্বরে ও বলল, –“ প্রিয় আমার, হৃদয় আমার।’ কান্না ওর কথাকে ছাপিয়ে গেল। টেলিফোনের অপর প্রান্ত সংক্ষিপ্ত-শান্ত-বিরক্ত স্বরে জ্বলন্ত বিদ্বেষ ভরা শব্দে উচ্চারণ করল,-“বেশ্যা।” 
সে টেলিফোনের রিসিভারটা ছুড়ে ফেলে দিল। সেই রাতে মারিয়া রাগে অন্ধ হয়ে, হিংস্রভাবে খাবার ঘরে টাঙানো সামরিক বাহিনীর সর্বাধ্যক্ষের লিথোগ্রাফের ছবিটা এক টানে নামিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ভেঙে চুরমার করে কাচের জানালা দিয়ে বাগানে ছুড়ে ফেলে দিল। আর এর ফলে নিজেও রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে গেল চিৎপাত হয়ে। যে মেট্রেনরা ওকে বাধা দিতে গিয়ে ঘুসি মারছিল তাদের প্রতিহত করার মতো রাগ তখনও ওর মনে জমা ছিল। হারকুলিনা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুঠো পাকাচ্ছে। এই দৃশ্য না দেখা পর্যন্ত ও রাগে জ্বলছিল। মারিয়া ছেড়ে দিল। ওরা ওকে হিংস্র রোগীদের ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে ওর পায়ে টারপেন্টাইন ফুটিয়ে দিল। ইঞ্জেকশান দেওয়ায় পা দুটো ফুলে গিয়ে ওর চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল এবং মারিয়া বুঝল এ পৃথিবীতে এমন কোনও কিছু নেই যা ওকে এই নরক থেকে মুক্তি দিতে পারে। পরের সপ্তাহে ওকে ডর্মিটরিতে ফেরত পাঠানো হলে ও রাতের মেট্রনের ঘরের দিকে পা টিপে টিপে গিয়ে দরজায় টোকা দিল। 
স্বামীর কাছে খবরটা পৌছে দেবার দাম মারিয়ার কাছে থেকে সে অগ্রিম হিসাবে দাবি কবল। রাতের মেট্রন দেনা-পাওনার এই পুরো বিষয়টা একেবারে গোপন রাখার শর্ত দিল এবং মারিয়া অবশ্যই রাজি। ওর দিকে সুদৃঢ় তর্জনী উঁচিয়ে বলে উঠল,– ‘ওরা যদি দেখে ফেলে তুমিই মরবে।’
পরের শনিবারে জাদুকর সাতুর্নো মেয়েদের উন্মাদ আশ্রমে তার ভ্যানটা চালিয়ে নিয়ে উপস্থিত। মারিয়ার উদ্ধার পর্ব উদ্‌যাপনের ছক তার মনে কষা হয়ে গেছে। উন্মাদ আশ্রমেব অধ্যক্ষ নিজের দপ্তরে তাকে স্বাগত জানালেন। দপ্তরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং যুদ্ধ জাহাজের মতোই সুনিয়ন্ত্রিত। তিনি সাতুর্নোর স্ত্রী সম্পর্কে একটি সহানুভূতিশীল প্রতিবেদন পেশ করলেন। সাতুর্নোর সঙ্গে তার কথাবার্তার আগে পর্যন্ত কেউ জানত না কবে, কখন, কোথা থেকে ও এসেছিল। সাতুর্নো কী করে তার স্ত্রীর খোঁজখবর পেল, এই প্রশ্নে অধ্যক্ষ যথেষ্ট কৌতুহল দেখালেন। সাতুর্নো মেট্রনকে রক্ষা করল। সে বলল “আমায় বিমা কোম্পানি বলেছে।’ 
জবাবে অধ্যক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ালেন। “আমি জানি না বিমা কোম্পানিগুলো কী করে সব খবর জোগাড় করে।” নিজের টেবিলে পড়ে থাকা একটা ফাইলের ওপর নজর দিয়ে তিনি বললেন,–“ওর অবস্থাটা যে যথেষ্ট খারাপ এটা একেবারে নিশ্চিতভাবে বলা যায়।” 
তার স্ত্রীর ভালোর জন্য আশ্রমের বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন সাতুর্নো কোনও প্রশ্ন ছাড়াই মেনে চলবে এই প্রতিশ্রুতি পেলে সমস্ত প্রকার সাবধানতা নিয়ে মারিয়াকে সপ্তাহে একবার দেখতে দেবার সম্মতি দিতে তিনি প্রস্তুত। তা ছাড়াও, তিনি ওকে কীভাবে চিকিৎসা করছেন তা নিয়েও প্রশ্ন করা চলবে না। কারণ, এতে হিংস্র আচরণ ও জ্ঞান হারানোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। এসব ঘটনা ঘনঘন ঘটছিল এবং বিপজ্জনকও বটে। 
‘কী আশ্চর্য –সাতুর্নো বলল। “বরাবরই ও একটু রগচটা, কিন্তু নিজেকে স্থির রাখার ক্ষমতাও ওর প্রচুর।” 
ডাক্তার জ্ঞানী ব্যক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। ‘বেশ কিছু মানসিক আচরণ বহুদিন সুপ্ত থাকে। তারপর একদিন হঠাৎ বেরিয়ে আসে”,–তিনি বলে চলেন। “সে যাই হোক আমাদের সৌভাগ্য যে ও এখানে এসে গেছে। আর কড়া হাতে এইরকম রোগীদের চিকিৎসা করাই আমাদের বিশেষত্ব। এরপর তিনি টেলিফোন সম্পর্কে মারিয়ার অদ্ভুত এবং নির্দিষ্ট আকর্ষণের বিষয়ে সাতুর্নোকে সাবধান করে দিলেন। 
‘ওকে একটু মানিয়ে নিতে হবে’’,–তিনি বললেন। 
‘আপনি একদম ভাববেন না’’,–সাতুর্নো হালকা চালে ডাক্তারকে বলল। ‘ওটা আবার আমার বিশেষত্ব।” 
সাবেক আমলের গির্জার দরদালানটাকে গারদ আর ব্যক্তিগত ও গোপনীয় কথা বলার দুটো খুপরিতে ভাগ করে নিয়ে তৈরি হয়েছে উন্মাদ আশ্রমের—“ভিজিটিং রুম’ বা সাক্ষাৎকক্ষ। ওরা দু’জনে আশা করে থাকতে পারে এমন কোনও খুশির জোয়ার ভিজিটিং রুমে সাতুর্নোর উপস্থিতির পরে সৃষ্টি হল না। ঘরের মাঝখানে একটা ছোট্ট টেবিল আর দুটো চেয়ারের পাশে মারিয়া দাঁড়াল। টেবিলের উপর একটা ফুলদানি। তবে তাতে কোনও ফুল নেই। স্ট্রবেরি রঙের ছেঁড়া-ফাটা কোটি আর দাতব্য হিসেবে পাওয়া জুতো পরিহিতা মারিয়া নিশ্চয়ই ওই জায়গা থেকে চলে যেতে রাজি। হারকুলিনা ঘরের এক কোনায় প্রায় অদৃশ্যভাবে মুঠো পাকানো হাতে দাঁড়িয়ে। স্বামীকে ওখানে ঢুকতে দেখে মারিয়া নড়তে পারল না। জানালার কাচে কেটে যাওয়া ওর মুখের দাগগুলো এখনও মিলিয়ে যায়নি। এবং ওর মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। ওরা নিয়মমাফিক চুম্বন বিনিময় করল। 
‘কেমন লাগছে? –সাতুর্নো জিজ্ঞেস করল মারিয়াকে। 
‘তুমি এখানে শেষ পর্যন্ত এসেছ’–ও বলল। “এটা মৃত্যুপুরী।” বসার মতো সময় ওদের ছিল না। কান্নায় ভেঙে পড়ে মারিয়া কষ্টকর জীবন, মেট্রনদের নৃশংসতা, কুকুরের পক্ষেও অযোগ্য খাদ্য এবং সীমাহীন সেই রাতগুলোর কথা, যখন সে ত্রাসে-ভয়ে-শঙ্কায় দু’ চোখের পাতা বন্ধ করতে পারে না,– তাকে এক নাগাড়ে বলে গেল। 
এমনকি এটাও জানি না যে কত দিন বা কত মাস কিংবা কত বছর আমি এখানে আছি। আমি শুধু জানি প্রতিটা দিন আগের দিনের চেয়ে আরও বেশি খাবাপ,’’–বলতে বলতে ও ফুঁপিয়ে উঠল। ‘আমার মনে হয় না যে আমি একই রকম থাকব।’ 
‘এখন ও সব চুকে গেছে’,–বলতে বলতে সাতুর্নো মারিয়ার মুখের সদ্য কাটা দাগগুলোয় হাত বোলাতে লাগল। ‘আমি প্রতি শনিবার আসব। অধ্যক্ষের অনুমতি পেলে আরও ঘন ঘন আসব। দেখেনিও, শেষ পর্যন্ত সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।’ 
ওর ভীত-সন্ত্রস্ত চোখ দুটো এক দৃষ্টিতে সাতুর্নোকে দেখতে লাগল। সাতুর্নো তার পেশাগত দক্ষতা মিশিয়ে পরিস্থিতিটা হালকা করতে চাইল। গুরু-গম্ভীর চালে অথচ মিঠে বুলিতে সে এক রাশ মিথ্যায় ডাক্তারের ধারণাকে ওর কাছে নিবেদন করল। ‘’এর মানে হল,”—সে সবশেষে বলল,–“সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে তোমার আরও কয়েকটা দিন দরকার।” মারিয়া পরম সত্য বুঝে গেল। 
‘ভগবানের দিব্যি, তুমিও অন্তত আমায় পাগল ভেবোনা’–ও ডুকরে উঠে বলল। 
‘একটু বোঝবার চেষ্টা কর’’–হাসার চেষ্টা করে সে বলল,–“তুমি এখানে ক’দিন থাকলে সেটা সবার জন্যই মঙ্গল। অবশ্যই ভালোভাবে থাকা দরকার।’’ 
‘কিন্তু তোমায় তো আগেই বলেছি যে আমি শুধু একটা ফোন করতে এসেছিলাম’, –মারিয়ার মন্তব্য। 
এহেন ভয়াবহ আচরণের প্রতিক্রিয়া কীভাবে প্রকাশ করা যায় তা সাতুর্নোর জানা নেই। সে তাকাল হারকুলিনার দিকে। হারিকুলিনা নিজের ঘড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,–সময় ফুরিয়ে এসেছে,— বোঝবার চেষ্টা করে সুযোগটার সদ্ব্যবহার করল। এক ঝলকে পিছনের দিকে তাকিয়ে মারিয়া ঈঙ্গিতটাকে প্রতিহত করতে চাইল। এবং দেখল হারকুলিনা ওকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আক্রমণ হানতে চলছে। তারপর ও স্বামীর গলা আঁকড়ে ধরে সত্যিকারের পাগলির মতো ডুকরিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ভালোবেসে, যতটুকু ভালোভাবে পারা যায় ততটুকু যত্ন দিয়ে মারিয়াকে হারকুলিনার করুণার উপরে ছেড়ে দিল সাতুর্নো। হারকুলিন পিছন থেকে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোনওরকম প্রতিবাদ করার সুযোগ না দিয়েই সে বা হাতের প্যাঁচে মারিয়াকে বেঁধে ফেলল আর লৌহদৃঢ় ডান হাত দিয়ে ওর গলাটা আটকে ধরে জাদুকর সাতুর্নোকে চেঁচিয়ে বলল,-“চলে যান।” 
ভয়ে পালিয়ে গেল সাতুর্নো। কিন্তু পরের শনিবার উন্মাদ আশ্রমে গিয়ে সাতুর্নোর মন থেকে আগের দিনের আশঙ্কা মিশ্রিত ভয়ার্ত ভাবটা দূর হ’ল। উন্মাদ আশ্রমে সে তার বিড়ালটাকে নিয়ে গেছিল। তার নিজের পোশাকের মতো পোশাকে বিড়ালটাকে সাজিয়েছিল। তার পরনে লিওতার্দো থেকে কেনা লাল হলুদ থাইট্‌ আর মাথায় টুপি। মাথা নাড়ালে দোলে এমন একটা দোলানো ঝুঁটি টুপির উপরে বসানো। ভ্যানটাকে নিয়ে সে ঢুকে গেল আশ্রমের উঠোনে। ঘণ্টা তিনেকের এক জম-জমাট প্রদর্শনী করে সবাইকে মাতিয়ে দিল সাতুর্নো। আবাসিকরা ভীষণ উপভোগ করল। বারান্দা থেকে জাদুর খেলা দেখতে দেখতে তারা উত্তেজনায় চেঁচাচ্ছিল আর উৎসাহে হয়ে উঠছিল উচ্ছল-উদ্দীপ্ত। মারিয়া ছাড়া সবাই সেখানে উপস্থিত। স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করল মারিয়া। এমনকি বাবান্দা থেকেও তাকে দেখল না। সাতুর্নো মর্মাহত। “এটা একটা সাদামাটা প্রতিক্রিয়া’’–অধ্যক্ষ তাকে সান্ত্বনার স্বরে বললেন, “এটা কেটে যাবে’। 
কিন্তু এটা কোনওদিনই কাটেনি। মারিয়াকে বহুবার দেখতে গিয়ে বার্থ হয়ে চিঠি দিল সাতুর্নো। কিন্তু তাতেও কিছু হল না। খামবন্ধ চিঠিটা চারবার মন্তব্যহীনভাবে ফেরত এল। হাল ছেড়ে দিয়ে উন্মাদ আশ্রমের দপ্তরে নিয়মিত মারিয়ার জন্য সিগারেট পাঠিয়ে যেতে লাগল সাতুর্নো। সিগারেট মারিয়ার কাছে পৌঁছায় কিনা, এ বিষয়ে অবিশ্যি সে কোনও দিনই খোঁজ নেয়নি। অবশেষে ক্লান্তিকর একঘেয়ে বাস্তবতায় একদিন তাও বন্ধ হয়ে গেল। 
সাতুর্নো আবার বিয়ে করে নিজের দেশে ফিরে গেছিল,—এর থেকে বেশি খবর কারও জানা নেই। বার্সেলোনে ছাড়বার আগে তার আধা-অনশনে থাকা বিড়ালটাকে জনৈকা বান্ধবীব কাছে সে দিয়ে যায়। বান্ধবীটি মারিয়াকে নিয়মিত সিগারেট পৌঁছে দিতেও সম্মত। রোসা বেগাস্‌ যতদূর মনে করতে পারে, বছর বারো আগে ‘কোতে ইংলিসে’-র বিভাগীয় বিপণিতে সেই বান্ধবীটির সঙ্গে রোসার একবার দেখা হয়েছিল। মাথার চুল কামিয়ে গোরুয়া আলখাল্লা পরে থাকায় তাকে তখন প্রাচ্যের সন্ন্যাসিনীদের মতো লাগছিল ; এবং সে অন্তঃসত্তা। রোসাকে সে বলেছিল যে, যখনই পেরেছে তখনই সে মারিয়াকে সিগারেট পৌঁছে দিয়েছে; এমনকি বেশ কিছু আকস্মিক ঘটনায় সে মারিয়াকে সামলিয়েছে। দুর্দিনের দুঃস্বপ্নের মতো ধ্বংস হয়ে যাওয়া হাসপাতালটার ধ্বংসাবশেষ দেখার দিন পর্যন্ত নিয়মিত এইসব কাজ করে গেছে বলে রোসাকে সে জানিয়েছিল। শেষ যেদিন সে মারিয়াকে দেখে সেদিন নাকি তাকে খুব প্রাণোচ্ছল এবং কিঞ্চিৎ পৃথুলা লাগছিল। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যে মারিয়ার মনে গির্জার শান্তির ছাপা পড়েছে। সেই দিন বান্ধবীটি তার কাছে গচ্ছিত রাখা বিড়ালটাকেও মারিয়ার কাছে নিয়ে গেছিল; কারণ, বিড়ালটাকে খাওয়ানোর জন্য সাতুর্নো তাকে যা অর্থ দিয়েছিল তা-ও তদ্দিনে ফুরিয়ে গেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত