| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

অযত্নের ছোঁয়া

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
এই কদিনেই ঘরটা কেমন অসহ্য লাগতে শুরু করেছে আমার। ক্যালেন্ডারের একঘেয়ে খটাখট, একটানা মশার ভনভনানি আর ভালো লাগছে না। শুধু বাথরুমটুকু যাচ্ছি, আবার এসে বসে পড়ছি। যেন দূরপাল্লার ট্রেনের কামরা। অথবা, সেলুলার জেলে কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামীর অসুস্থ কেবিন। একেবারে মিইয়ে যাওয়া জীবন। দেওয়ালের টিকটিকিটাও আজকাল বড্ড ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে আমার এই বন্দীদশা দেখে। ওকে তো আর টিউবের তলায় পচতে হয় না সারাদিন! থাকলে বুঝতো। দেওয়ালব্যাপী আরশোলা, উচ্ছিংরে, বোলতা খেতে দৌড়নো, আর শুধু একটা ডেরায় দিনের পর দিন কাটানো কেমন অস্বস্তির।
সেই এক টেবিল, এক চেয়ার, এক সরস্বতীমূর্তি, এক পুরনো খবরের কাগজ, এক মোবাইল, খটরখটর, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ক্রমবর্ধমান মৃতের সংখ্যার খবর। আর ভালো লাগছে না। আগে রোজ টেবিল-চেয়ার, সরস্বতী মুছতাম। ধুতাম। গুছিয়ে লেখালেখি করতাম। এখন আর ইচ্ছে করছে না। আমাকে কে ঝরঝরে করে তার ঠিক নেই!
পরশু ফিরেছি দুবাই থেকে। এয়ারপোর্টে বলল হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে। অবস্থা একদম ভালো নয়। পরপর আক্রান্ত হচ্ছে। তাই কোনো রিস্ক নয়। আমার আপত্তিও ছিল না। এত ধকল যায় এমনি, চোদ্দদিন ঘরে থাকা তো দেবতার আশীর্বাদ। বাবার ভাগ্যি, হাসপাতালে থাকতে বলেনি। ওখানে আমি মরে গেলেও যাবো না। অবশ্য, মরার পরে পৃথিবী আমায় কোথায় কোথায় নিয়ে যাবে আমি কীকরে জানবো!
সকলে গৃহবন্দী হলেও আমি ঘরবন্দী। অর্থাৎ, ঘরের মধ্যে ঘর। বন্দী, তস্য বন্দী। আসলে এটা নিজেরই সিদ্ধান্ত। শরীরটা খারাপ একটু বেশিই। জ্বরটা বাড়ছে। শ্বাসকষ্টও একটু একটু হচ্ছে মাঝেমধ্যে। প্যারাসিটামল খেয়ে খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছি। জানাচ্ছি না কাউকে, পাছে হাসপাতালে ভর্তি করে! হাসপাতালে যারা যায় আর ফেরে না, এ একটা দৃঢ় অন্ধবিশ্বাস আমার মধ্যে চিরকালীন। সেটা অবশ্য আমার পরিবারের অভিজ্ঞতাতেই প্রমাণিত। আপাতত এখানে আমি একলা থাকি, বাড়িতে আগে যারা ছিল সব কোনো‌ না কোনো কারণে হাসপাতালে গিয়ে আর ফেরেনি।
বেশি করে মনটা খারাপ হচ্ছে ছাদের জন্য। আমার পরম বিশ্বস্ত একাকী বন্ধু ছাদ। সেখানে আমি রোজ নিভৃতে সময় কাটাতাম, আমার মনের কথা জানাতাম নিশ্চিন্তে। একলা থাকি, তাই অযত্ন সয়ে গেছে। কষ্ট পেতে পেতে‌ অযত্নটাই অভ্যেস হয়ে গেছে। এসব কথাই বলতাম। সিমপ্যাথির জন্য না, হালকা হবার জন্য। ছাদও চুপ করে শুনত। আমার গার্লফ্রেন্ডের মতো কথায় কথায় আটকে দিত না। বাড়িতে থেকেও ছাদকে না দেখে থাকিনি কখনও। কিন্তু ঘরের যেখানে খুশি যাওয়া গেলেও ছাদে মানা। এই কারণটাও অবশ্য নিজেরই বানানো। লোকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, একা আছি, তাহলে সব একাই করছি। তো ছাদে যেতে কী প্রবলেম? প্রবলেম হচ্ছে, হাসপাতালের ভয়ে আমি বাইরের হাওয়াও লাগাবো না ঠিক করেছি। এ ঘরেই খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। সব দরজা জানলা, আর কলিংবেলের সুইচটাও অফ করে দিয়েছি। তাতে লোকে অসামাজিক মনে করলেও কিছু করার নেই, কারণ আমার কিছু হলে তারাও সঙ্গে সঙ্গে অসামাজিক হয়ে যাবে বলাই বাহুল্য।
তো ছাদে আর যাওয়া হচ্ছে না। ছাদেই ট্যাঙ্কের নীচটায় আমার এক পালিতা কন্যা আছে। একটা টগরের গাছ, টবে পোঁতা। মাথাটা ঈষৎ ঝোঁকানো, দুর্বল কান্ড, ভাঁজ করা কয়েকটা পাতা। বড় ভালোবাসি। কিন্তু সে আমায় পাত্তা দেয় না। কত জল দিতাম, সার দিতাম, গায়ে হাত বুলিয়ে দিতাম। ভালোবেসে একটাও ফুল দেয়নি এখনও। এতদিনের অযত্নে কেমন আছে কে জানে! মরেই বোধহয় যাবে; যা গরম! আহারে, বেচারা। কেন যে মরতে এনেছিলাম পুষতে! ঠিকমতো আদরযত্ন করতে না পরলে পোষা ঠিক নয়, তা সে মনুষ্যেতর জীবই হোক বা গাছ।
আজ সকাল থেকে শরীরটা খুব অসুস্থ। নগেনদাকে ফোন করতে হয়েছিল বাধ্য হয়েই। আর পারা যাচ্ছে না। পাড়ার দু-একটা লোক অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছে। খুব শ্বাসকষ্ট, আর জ্বর বোধহয় তিন হবে। বাঁচবো না মোটামুটি ধরেই নিয়েছি। হাসপাতাল তো, ও কাউকে ফেরায় না। বাড়ির কাউকে ফেরায়নি। আমি ওর কোন্ জন্মের শাগরেদ ছিলাম যে আমায় ফেরাবে? মৃত্যু অনিবার্য – আমি ড্যাম শিওর। শুধু একটাই আক্ষেপ থেকে গেল। মরার আগে আমার ছাদটাকে একবার বলে যাওয়া হল না। আর সেই টগরগাছটা। শেষবেলাতেও কি ভালোবেসে একটা সাদা পাপড়ি একটু টাটা করবে না?
লোকজন কাছে আসতে ভয় পাচ্ছে বুঝতে পারছি। রমেনদা, সাত্যকি, রঞ্জা, বুনিকাকিমা সবাই দূরে দূরে দাঁড়িয়ে মুখচাপা দিয়ে। ভাগ্যিস কোনোমতে নগেনদাকে খবরটা দিতে পেরেছিলাম, নয়তো ঘরেই পচে গলে থাকতে হতো। তাও অন্তত সকলকে জানিয়ে মরা যাবে।
আমাকে স্ট্রেচারে তুলে বাইরে আনা হল। অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। চারচাকার দৈত্য। গায়ে বড় বড় করে লেখা দেখলাম, “দীনবন্ধু লীলাময় হাসপাতাল”। সত্যিই! দীনবন্ধু যা লীলা দেখাচ্ছেন! যাকে আজীবন ঘৃণা করে এলাম, আজ তার কাছেই যেতে হচ্ছে মরতে। মানুষ শেষবেলাতেও কোনো না কোনো কারণে শান্তি পায় না বেশ বুঝলাম। একটা না একটা অপূর্ণ তৃপ্তি রয়েই যাবে।
একবার ঘাড় হেলিয়ে দেখলাম আমার বাড়িটা, আমার চিরপরিচিত জানলার ধারের ঘরটা, বাড়ির সামনের রাস্তাটা। রাস্তার ধারে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলাম। অবিকল সেই টগর! আমার ছাদেরটার মতো। কিন্তু একে তো আগে দেখিনি। রাস্তার ধারের এই নীচু আগাছাভারে জর্জরিত জায়গাটা মন দিয়ে খেয়াল করিনি কখনও। ওই কলেজ যাবার পথে পড়ে থাকা ইঁট  লাথি মেরে সরিয়ে ফেলে দিয়েছি, পা ঠুকে গোবদা কুনোব্যাঙ নামিয়ে দিয়েছি, বাজে কাগজ গোল্লা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছি ঘর থেকে। কিন্তু ঘুরে তাকাইনি। তাই হয়তো নজরে আসেনি। 
কী সুন্দর হাসছে টগরগাছটা! ধোঁয়াটে সাদা পাপড়িগুলো খলখল করছে ঝকঝকে আভায়। একে তো কেউ লালন করেনি। কেউ জল দেয়নি আদর করে। ময়লার ধাক্কায়, কুকুরের পটি-পেচ্ছাপে, পোকামাকড়ের গা ঘিনঘিনে উপদ্রবে বড় হয়েছে। আজন্ম মহামারি দেখেছে। মরে যাওয়া কেন্নো, পুড়িয়ে দেওয়া সাপ, কুকুরের ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া স্যানিটারি ন্যাপকিনের টুকরো- এসব দেখে চলেছে। মাঝে মাঝে হাওয়ায় আদর, আর বৃষ্টির গন্ধ। এটুকুই সান্ত্বনা। বেশিটাই অযত্ন অযত্নের ছোঁয়ায় স্বাধীনচেতা। “অনাদর একটা মস্ত স্বাধীনতা”, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। তাতেই হাসি আর ধরে না। আর আমার ছাদের টগর! কী দাম্ভিক! এত আদরেও মন গলে না। আর আমিও বা কী কম যাই! ঘরকুনো হয়ে শুয়ে বসে শুধু ভেবেই গেলাম, যত্ন না পেলে কেউ বাঁচে না।
টগরটা আমার দিকে বোধহয় ব্যঙ্গের হাসি হাসছে। অথবা, তৃপ্তির। অথবা, স্বাধীনতার। অথবা, গর্বের। অথবা, শুধুই নির্মল হাসি, যার অত সাহিত্যব্যাখ্যা নেই, অত নিগূঢ় অর্থ নেই। কে জানে! মানে হয়তো জানা যাবে না ওই হাসির। দরকারও নেই‌। আজকের হঠাৎ আবিষ্কার, এই অবধিই থাক। প্রথমেই সব জানার চেষ্টা করলে বাকি সময়টা ক্লিশে হয়ে থাকবে। আলাপটা না হয় ফিরে এসেই সারা যাবে। কিন্তু, ফিরব কী করে? হাসপাতাল থেকে তো কেউ বেঁচে ফেরে না!
আমাকে তোলা হয়ে গেছে অ্যাম্বুলেন্সে। ছোঁয়াছুঁয়ির কারণে এখানে কেউ বসবে না‌ নিশ্চয়ই। রমেনদা বা সাত্যকি বোধহয় সামনে উঠবে। ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে ক্রমাগত। আমি শুয়ে শুয়ে দেখছি শুধু কত মানুষের মাথা। মুখচাপা, হাতে কিংবা আঁচলে কিংবা রুমালে। কী ভয় সবার! আমি যদি ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে কেটে পড়ি! টগর কিন্তু দিব্যি হাসছিল আমাকে দেখে। গাছের কোনো ভয় নেই, গাছ এত বিজ্ঞও নয়। গাছ শুধু হাসতেই পারে।
আমার পাশের বাড়ির পরের বাড়ির বুল্টির বাবা নগেনদা পেছনের ডালাটা বন্ধ করে দিতে এল। পাশে ড্রাইভার চাবি হাতে। আমার কথা বলার অবস্থা নেই। ঠোঁটের পাশটা একটু নোনতা নোনতা লাগছে।
-কী গো আশিস? কাঁদছো কেন? আহা, বেচারার হাসপাতালে বড় ভয় ছিল!
আমি চকিতে গালে হাত বুলোলাম। টগরটার কথা মনে করলাম একবার। হাসছে। কী মিষ্টি হাসি! অযত্নের হাসি। স্বতঃস্ফূর্ত হাসি। ক্লান্ত স্বরে শ্বাস নিতে নিতে বললাম, “ছিল না গো নগেনদা, এখনও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। এই ফার্স্ট এই শেষ। আর যাচ্ছি না। তাড়াতাড়ি ফিরলে বাঁচি। করোনায় মৃত্যুভয় তো খুব কম, সুস্থই তো হয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ। তাই না?” কথাটা বলেই থমকে গেলাম। স্বরটা নিজের কানেই কেমন অচেনা ঠেকল। এমন আশাবাদী তো আমি কোনোদিন নই! নাকি, মৃত্যুর কাছাকাছি চলে এলে চিন্তাভাবনা বদলে যায়?
ওপাশের উত্তরটা আর শোনা হল না। হাওয়ায় ধাক্কা খেতে খেতে হারিয়ে গেল পাড়া-প্রতিবেশী, আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার ছাদ, ছাদের টগর। সব থেকে বেশি হারিয়ে গেল নব্য আলাপী প্রাকৃতিক টগর। আর ওর উষ্ণ মিষ্টি হাসিটা। ফিরে এসে আরো ভাব জমাতে হবে। ওর থেকেই জানতে হবে ওর ছাদতুতো জ্ঞাতিভাই-এর আমার ওপর এত অভিমান কেন? চোখের জলটা মুছে ফেলে টানটান হয়ে শুলাম। একটা নৈরাশ্যবাদী ‘আমি’কে বাইরে ফেলে রেখে অ্যাম্বুলেন্সের ডালাটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত