আজ ২১ এপ্রিল। গবেষক, চলচ্চিত্র নির্মাতা,সাহিত্যিক রেজা ঘটকের জন্মতিথি।ইরাবতী পরিবার এই শুভ লগ্নে রেজা ঘটককে জানায় জন্মতিথির শুভেচ্ছা।
গল্প হারানোর গল্প।। রেজা ঘটক
২০ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৯:৫৬
`স্বপ্নভঙ্গ’ নামে আমার একটি গল্প হারিয়ে গেছে। গল্পটির বয়স আনুমানিক সাত আট বছর। তখন আমরা ধানমণ্ডি নদীর পারে রোজ আড্ডা মারতাম। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত। তাল-মাতাল আড্ডা। আড্ডায় আড্ডার কথা থাকতো। স্মৃতিচারণ থাকতো। সারা বিশ্বের চলমান রাজনীতি থাকতো। আমাদের দৈনন্দিন আনন্দ বেদনা থাকতো। আর থাকতো কিছু একটা না করার ভারী আক্ষেপ। আমাদের সেই আড্ডার পাশাপাশি আরেকটি আড্ডার এমনি এক আক্ষেপ থেকে `আড্ডাঘর’ নামক একটি গদ্যের কাগজ বের হওয়া শুরু হল। `আড্ডাঘর’-এর সবাই আমাকে চিনতো। গল্প লিখি তাও জানতো। আমাদের সান্ধ্যকালীন মূল আড্ডার বাইরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা কিসিমের ভিন্ন ভিন্ন আড্ডায় আমার অবাধ বিচরণ ছিল। ফলে `আড্ডাঘর’-এর আমিও একজন আড্ডারু। আড্ডাঘরের আড্ডাটি বিকেল পর্যন্ত ধানমণ্ডিতে থাকতো। সন্ধ্যায় সেই আড্ডা চলে যেতো পুরানা পল্টন মানুদা’র অফিসে। রাত-মধ্যরাত পর্যন্ত সেই আড্ডা চলতো ধ্রুবদা’র পল্টন লাইনের বাসায়, চিলেকোঠার ছাদে।
`আড্ডাঘর’-এর সম্পাদনা পরিষদে চার-পাঁচজন ছিলেন। শিল্পী ধ্রুব এষ, শিল্পী মাসুক হেলাল, গল্পকার শেখর ইমতিয়াজ, কথা সাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীম, কার্টুনিস্ট আহসান হাবিব, গল্পকার রুদ্রাক্ষ রহমান, আরো কে কে যেনো। দুই তিনটি সংখ্যা হাতে পাওয়ার পর একদিন রুদ্রাক্ষ আমাকে বললো, তুই একটা গল্প দে। আমি তখন প্রফেসর নজরুল ইসলামের নগর গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করতাম। ধানমণ্ডির সাতাশ নম্বরে অফিস। অফিসে যারা পথে, দুপুরে লাঞ্চের সময়, বিকেলে কাজের অবসরে বা সন্ধ্যায় অফিস ছুটির পর আড্ডাঘরের আড্ডায় আমিও জড়িয়ে গেলাম। রুদ্রাক্ষ একদিন ভারী নাখোশ আমার উপর। পরদিন সকালে গল্প না নিয়ে আড্ডায় থাকা যাবে না এমন হুঙ্কার দিল। কী করি কী করি কী গল্প দেই? সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন আড্ডায় আসতেন ফটোগ্রাফার পাভেল রহমান। মাসুক ভাই জানালেন, পরদিন পাভেল ভাই আড্ডায় থাকবেন। আমি আড্ডা মিস করতে চাই না। আবার রুদ্রাক্ষের কড়া হুঙ্কারে মাথার মধ্যে ভো ভো উতলা। রাতে একটানা লিখে ফেললাম `স্বপ্নভঙ্গ’ গল্পটি। ফটোকপি করার সুযোগ নাই। রুদ্রাক্ষ হাতে লেখা আসল কপি আমার থেকে ছিনিয়ে নিল।
পরের সপ্তাহে `আড্ডাঘর’ বের হল। সেখানে `স্বপ্নভঙ্গ’ গল্পটি ছাপা হয়েছে। আড্ডায় তখন আমার সেই গল্পটি আলোচনার শীর্ষে। গোটা পুরুষ জাতির একটি কলংকের কথা সেই গল্পে ছিল। রুদ্রাক্ষ আমাকে একটা `আড্ডাঘর’-এর কপি দিল। সেদিন সূর্যাস্তের আগেই সেই সংখ্যাটি ধানমণ্ডি নদীর পারেই আমার পড়া হয়ে গেল। সেটি নিজের সংগ্রহে রাখার ব্যাপারটি আর মাথায় ছিল না তখন। সন্ধ্যার আড্ডায় আমাদের ভোরের কাগজের শামীম ভাইয়ের বাসায় রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত হল। শামীম ভাই আমার গল্পটি পড়বেন তাই আড্ডাঘর সংখ্যাটি শামীম ভাইকে দিলাম।
রুদ্রাক্ষ জানিয়েছিল আড্ডাঘর এখন থেকে শাহবাগ নিয়মিত পাওয়া যাবে। কয়েকটা বইয়ের দোকানে আড্ডাঘর রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। তুই আরো গল্প দে। কিন্তু রুদ্রাক্ষ আমার উপর রুদ্রমূর্তি ধারণ না করা পর্যন্ত আমার থেকে আর গল্প পায় না। আমাদের আড্ডা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। রুদ্রাক্ষ আর গল্প পায় না। এর মধ্যে রুদ্রাক্ষের একমাত্র ছেলে রারা অসুস্থ হল। চিকিৎসার জন্যে রারাকে নিয়ে ভারতে যেতে হল। আড্ডাঘর আর নিয়মিত বের হয় না। ততোদিন আমি নগর গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণা ছেড়ে পান্থপথে গল্পকার রাজীব নূরের সঙ্গে যোগ দিয়েছি। `পাঠসূত্র’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলার জন্যে আমরা দিন-রাত তখন ভারী ব্যস্ত। ধানমণ্ডি নদীর পাড়ে সন্ধ্যায় তখন যারা আড্ডা দিতাম তারা তখন পান্থপথে পাঠসূত্রের অফিসে এক পশলা আড্ডা মারা শুরু করলো। তারপর সেই আড্ডার রথি মহারথিরা ধানমণ্ডি নদীর পারে চলে যায়। আমি আর রাজীব নূর প্রকাশনার কাজে হয়তো চলে যাই ফকিরাপুল, বাংলাবাজার বা পল্টন। কিন্তু কাজের ফাঁক ফোকর বের হলেই আমি চলে যেতাম ধানমণ্ডি’র আড্ডায়। কখনো রাজীব নূর আড্ডা থেকে মটর সাইকেলে আমাকে তুলে নিয়ে যেতো। কখনো বা রাজীব নূর নিজেও আড্ডা দিতে ধানমণ্ডি যেতো মাথা ক্লিয়ার করতে।
ধানমণ্ডি নদীর পারের সান্ধ্যকালীন আড্ডার নিয়মিত সেনাপতিরা হলেন কবি জাফর আহমেদ রাশেদ, কবি ফিরোজ এহতেশাম, গল্পকার খোকন কায়সার, গল্পকার রোকন রহমান, কবি নাসিম রেজা, কবি পুলক বিশ্বাস, সুরকার সুদত্ত চক্রবর্তী পবন, বিশিষ্ট চার্টার্ড ম্যানেজার রিয়াজ হক, বিশিষ্ট ব্যাংকার মইনুল বিপ্লব, বিশিষ্ট শেয়ার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ নাহিদ, বিশিষ্ট আড্ডারু শামীম আহমেদ ও বিশিষ্ট আড্ডারু সত্যজিৎ পোদ্দার বিপু। অনিয়মিত আড্ডারু হলেন কবি টোকন ঠাকুর, শিল্পী আব্দুল হালিম চঞ্চল, শিল্পী শাহীনুর রহমান, ডাক্তার কল্লোল চৌধুরী, বিশিষ্ট সমাজসেবক গোলাম রসুল, কবি অলক চক্রবর্তী, ফটোগ্রাফার সুমন শামস ও বিশিষ্ট পুলিশ এসআই হুমায়ুনসহ আরো অনেকে।
ওই সময় টোকন ঠাকুর ফিল্ম বানানোর কাজে ব্যস্ত হলেন। `ব্ল্যাকআউট’ নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি একজন সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করলাম। পাঠসূত্র, টোকন ঠাকুরের ফিল্ম, পালাকারের নাটক, ইত্যাদি মিলিয়ে ধানমণ্ডি নদীর পারের আড্ডায় যাওয়া ধীরে ধীরে অনিয়মিত হয়ে গেল। ততোদিন খোকন কায়সার চট্টগ্রামে বদলি হয়েছেন। কবি নাসিম রেজা’র অকাল প্রয়াণ। রোকন রহমানের চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তন, অলক চক্রবর্তী’র খুলনায় বদলি, পুলক, পবন, রিয়াজের বিয়ে। ঘটনার পর ঘটনা। আমরা সবাই কতো ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
ততোদিনে আড্ডাঘর আর প্রকাশ পায় না। ইমতিয়ার শামীম লন্ডন চলে গেলেন। বিচিত্রা অফিস বন্ধ হয়ে গেল। রুদ্রাক্ষ চলে গেল দৈনিক যুগান্তরে। মাসুক ভাই চলে গেলেন প্রথম আলোতে। শেখর ইমতিয়াজ চলে গেলেন দৈনিক জনকণ্ঠে। আমাদের ১৯ কাঁঠালবাগানের চারতলা মেসবাড়ি ভেঙ্গে সেখানে নয়তলা এপার্টমেন্ট হল। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আবাসহীন আমার রাত কাটানোর জায়গা হল শাহবাগ কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি। গড়ে রোজ ৮০ থেকে ১১০ জন নৈশ পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক। আমিও সেই পাঠাগারের নিয়মিত সদস্য হয়ে গেলাম। গোসলের জন্য চলে যেতাম জগন্নাথ হলে। জামাকাপড় বদলানোর জন্যে চলে যেতাম কাঁঠালবাগানে স্বপনের লন্ড্রিঘরে। আর পাউরুটি, কলা, বিস্কুট মেরে দিন সাবার করে দিতাম। এক সময় খেয়াল করলাম আমার গল্পগুলো আর আমার সঙ্গে নেই। শেখর ইমতিয়াজ একদিন আমাকে ধরে রায়েরবাজার তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। বললেন, রেজা বই বের করেন। নইলে গল্পগুলো হারিয়ে যাবে। বললাম, গল্পগুলো হারিয়ে গেছে। শেখরদা বললেন, তাঁর কাছে কয়েকটি আছে। ভোরের কাগজ থেকে শামীম ভাই কয়েকটা সংগ্রহ করে দিলেন। তারপর রাজীব নূর পাঠসূত্র থেকে বের করলেন আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ `বুনো বলেশ্বরী’। তারপর আবার গল্প হারানো শুরু হল।
সমকাল থেকে টোকন ঠাকুর আমার হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো উদ্ধার করে পায়েলকে দিলেন। পায়েল জয়তী থেকে প্রকাশ করলো আমার শিশুতোষ গল্পের বই `গপ্পো টপ্পো না সত্যি’। শুরু হল গল্প খোঁজা।
টোকন ঠাকুর, শামীম আহমেদ, অনু হোসেন, জাফর আহমদ রাশেদ, রাজীব নূর হাফিজ রশীদ খান এদের মাধ্যমে আরো কিছু গল্প উদ্ধার করে টোকন ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে বিবর্তন থেকে বের হল আমার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ `সোনার কংকাল’। আবারো গল্প খোঁজা। কিন্তু গল্প আর হাতে পৌঁছায় না। চট্টগ্রামের কবি হাফিজ রশীদ খান দুইটি গল্প খুঁজে দেবার দায়িত্বে আছেন। একটি পাওয়া গেল। `ভোম ভোম শংকর’। ওটি সোনার কংকালে স্থান পেয়েছে। এখনো `দুই নারী’ পাওয়া যায়নি। আমার `দুই নারী’ গল্পটি চট্টগ্রামের দৈনিক সুপ্রভাত-এর প্রথম ঈদসংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। `ভূমিপুত্র’ গল্পটি `ভূমিপুত্র হিরোতাস’ নামে সাপ্তাহিক ২০০০-এর হরলেক্স বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। গল্পটি অনেক খুঁজেও উদ্ধার করা যায়নি। গোলাম মুর্তাজা ভাই অবশ্য বলেছিলেন, তাঁর কাছে একটি কপি হয়তো থাকবে। সাবের ভাই (মইনুল আহসান সাবের) ২০০০-এর গুদামে লোক লস্কর লাগিয়ে খুঁজিয়েছিলেন। ওই বিশেষ সংখ্যাটি পাওয়া যায়নি। জাফর আহমেদ রাশেদ আমার একটি গল্প নিয়েছিলেন। `অজগর’ নিয়ে লেখা। ওই গল্পটি আর আমি পাইনি। পাঠসূত্রের অফিসে কম্পিউটার থেকে আমার কম্পোজ করা বেশকিছু গল্প কে বা কারা যেনো ডিলিট করে দিয়েছিল। সেই গল্পগুলো’র কোনো কপি আমার কাছে নেই। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমার অনেক গল্প ছাপা হয়েছিল। সেই গল্পগুলো এখনো আমি অনুসন্ধান করি।
আমার হারানো গল্পের সংখ্যা অনেক। তার মধ্যে কিছু গল্প আমি এখনো স্বপ্নে দেখি। কিছু গল্প এখনো উদ্ধারের আশা রাখি। কিছু গল্প হয়তো আর কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। বারবার বাসা বদল, উদ্বাস্তুজীবন, খামখেয়ালী, আর নিজের অসচেতনা অবহেলার গেড়াকলে আমার গল্পগুলো হারিয়ে গেছে।
আমার গল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো একটু চেষ্টা করলে হয়তো আমার কিছু গল্প উদ্ধার করা সম্ভব। কিন্তু সবাই নিজ নিজ পেশা, সংসার, আর দিন দুনিয়ার নানান কাজে ভারী ব্যস্ত। তাদের কীভাবে বলি, প্লিজ, আমার গল্পগুলো খুঁজে দিন, স্যার। হারানো গল্পগুলো নিয়ে একটি গল্প সংকলন বের করতে পারলে আমার নিজের অনেক কষ্ট লাঘব হতো। কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি সেই সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন, কী যে আনন্দের হতো। আহা আমার হারানো গল্পগুলো কোথায় যে আছে!
গবেষক, চলচ্চিত্র নির্মাতা
জন্ম: ২১ এপ্রিল, ১৯৭০; বাংলা ৮ বৈশাখ, ১৩৭৭। জন্মস্থান: পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের উত্তর বানিয়ারি গ্রামে।অর্থনীতিতে স্নাতকসহ (সম্মান) মাস্টার্স। আর্থ সামাজিক নানা বিষয়ে প্রায় দু’ দশক ধরে গবেষণা করছেন।২০০৬ সাল থেকে চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন নাটক নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত। লেখালেখিতে প্রধান বিষয় ছোটগল্প। এছাড়া উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সমালোচনা এবং কবিতা লেখার চর্চাও করেন। নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখেন।পত্র-পত্রিকা এবং অনলাইনে নিয়মিত কলাম লিখছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয়।