| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

মহামারী সংখ্যা: অতিমারি-মহামারির সাক্ষী থেকেছে ভারত

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি’। লিখে গিয়েছেন কবি। করোনাভাইরাসের আগেও বহুবার মহামারিতে ত্রস্ত হয়েছে আমাদের দেশ। আসুন, একবার দেখে নেওয়া যেওয়া যাক গত দু’টি শতকে কীভাবে ভারতে আছড়ে পড়েছিল অতিমারি এবং মহামারির প্রকোপ। ১৮১৭-২৪ অবধি পূর্বভারত বারবার আক্রান্ত হয়েছে কলেরায়। কখনও তীব্র, কখনও মাঝারি রোগের প্রকোপ থেকে গিয়েছে। পূর্ব ভারত থেকে তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং সেখান থেকে সুদূর পশ্চিম এশিয়ায়, পূর্ব আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলেও। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলেরার অতিমারি প্রথম দেখা গিয়েছিল তৎকালীন কলকাতায়। একে বলা হয় ‘ফার্স্ট এশিয়াটিক কলেরা প্যান্ডেমিক’ বা ‘এশিয়াটিক কলেরা’। চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষকদের ধারণা, কুম্ভমেলা পরবর্তী সময়ে কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল উচ্চ গাঙ্গেয় বদ্বীপ থেকে। তারপর সেই রোগ ব্রিটিশ সৈন্য, নৌবাহিনী ও বাণিজ্যতরীর মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিল অন্যান্য মহাদেশে। অবশেষে ১৮২৪ ক্রিস্টাব্দে কলেরার দুর্বার গতি প্রতিহত করা সম্ভব হয়। মনে করা হয়, ১৮২৩-এর শেষে যে তীব্র ঠান্ডা পড়েছিল তাতেই অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে আসে কলেরার জীবাণু। এই অতিমারিতে কত জন প্রাণ হারিয়েছিলেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান এখন পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় কলেরা-অতিমারি শুরু হয়েছিল ১৮২৬-এ। এরও উৎসস্থল মনে করা হয় পূর্বভারতের গাঙ্গেয় বদ্বীপকেই। তারপর তা বাণিজ্যপথ ধরে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের অন্য শহরে এবং ক্রমে অন্যান্য দেশে। সেই দফায় কলেরার আক্রমণ অব্যাহত ছিল ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ অবধি। ১৮৪৬-এ আবার ফিরে এল কলেরা। এ বার আগের থেকে আরও ভয়াবহ রূপে। তৃতীয় দফায় অতিমারি জারি ছিল ১৮৬০, কোথাও কোথাও ১৮৬৩ অবধিও। এই কলেরা-অতিমারিকে ধরা হয় উনিশ শতকের ভয়ঙ্করতম অতিমারি হিসেবে। এ বারও কলেরা ছড়িয়েছিল ভারতের গাঙ্গেয় বদ্বীপ থেকেই। তারপর তা পৌঁছে গিয়েছিল এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং উত্তর আমেরিকাতেও। ১৮৫৪ সালে এর প্রভাব ছিল সবথেকে ভয়াবহ। শুধু গ্রেট ব্রিটেনেই প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৩ হাজার মানুষ।

কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ত কলেরা? এ নিয়ে তখন দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকরা। আধুনিক গবেষকদের ধারণা, তখনও বহু দেশে মূলত নদীর জলই পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করা হত। তার থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল অসুখ। তা ছাড়া, বিশ্বজুড়ে মানুষের পরিযাণ বা মাইগ্রেশন কমবেশি জারি থাকে কমবেশি সবসময়েই। ফলে তাদের এবং দেশান্তরে যাওয়া সৈন্য ও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে রোগের ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগত না। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে গাঙ্গেয় বদ্বীপ থেকে কলেরা পুণ্যার্থীদের মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিল পশ্চিম এশিয়ায়। প্রথম বছরে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩০ হাজার তীর্থযাত্রী। পাশাপাশি, রোগ ছড়িয়েছিল আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশেও। চতুর্থ দফার কলেরা অতিমারি পৃথিবীতে স্থায়ী হয়েছিল ১৮৬৩ থেকে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি। পঞ্চম দফায় কলেরা-অতিমারি ভারতে শুরু হয়েছিল ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়ার অন্য অংশ, ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকায়। ষষ্ঠ কলেরা-অতিমারি দেখা দিয়েছিল ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। দেশ জুড়ে প্রাণ নিয়েছিল প্রায় ৮০ হাজার মানুষের। তবে এ বার আর গাঙ্গেয় বদ্বীপ নয়। মনে করা হয়, সে বার অতিমারির উৎস ছিল হরিদ্বারের কুম্ভমেলা। এ দফায় ১৯২৩ থ্রিস্টাব্দে প্রশমিত হয় কলেরা প্রকোপ। সপ্তম কলেরা-অতিমারি শুরু হয়েছিল ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে। এ বার আর ভারত নয়। কলেরার উৎস ছিল ইন্দোনেশিয়া। সেখান থেকে তৎকলীন পূর্ব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ)হয়ে রোগের জীবাণু প্রবেশ করে ভারতে। 

গত দু’শো বছরে মোট সাতবার কলেরা অতিমারিতে আক্রান্ত হয়েছে ভারত-সহ গোটা বিশ্ব। ১৮১৭ থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ অবধি কলেরা-অতিমারিতে ভারতে প্রাণ হারিয়েছেন দেড় কোটির বেশি মানুষ। ১৮৬৫ থেকে ১৯১৭ অবধি এই পরিসংখ্যান ছিল দু’কোটি ৩০ লক্ষ। কলেরার পাশাপাশি আরও একটি যে রোগের লাগামছাড়া প্রকোপ দেখা যেত অতীতে, তা হল প্লেগ। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বম্বে শহরে দেখা দিয়েছিল প্লেগের মহামারি। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে সাবেক বম্বের জনসংখ্যা ছিল আট লক্ষ ২০ হাজার। রোগের প্রকোপে বহু মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। মৃত্যু এবং আতঙ্কিত শহরবাসীর পালিয়ে যাওয়া, দুই মিলিয়ে দ্রুত হারে কমে যায় তৎকালীন বম্বের জনস‌ংখ্যা। ১৯৯১ সালের জনগণনায় এই শহরের বাসিন্দা ছিলেন ৭ লাখ ৮০ হাজার জন। ১৯৭৪ সালে ভারতে দেখা দেয় বসন্তরোগের মহামারি। সে বছর জানুয়ারি থেকে মে মাস অবধি ১৫ হাজারের বেশি মানুষ গুটি বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সবথেকে বেশি মানুষ প্রাণ হারান বিহার, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গে। হু-এর হিসেব মতো এই পাঁচ মাসে ভারতে গুটি বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬১ হাজার ৪৮২ জন। প্রাণে রক্ষা পেলেও অনেকে এই রোগের জেরে হারিয়েছিলেন দৃষ্টিশক্তি। ১৯৯৪ সালের অগস্টে ভারতে আবার দেখা দেয় প্লেগের প্রকোপ। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং দিল্লিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫৬ জন। তবে তিন মাসের মধ্যে প্লেগের তীব্রতা প্রশমিত করা গিয়েছিল। এরপরেও ২০০৯ সালে ফ্লু-এর অতিমারি দেখা দেয় দেশ জুড়ে। গত কয়েক বছরে সোয়াইন ফ্লু-সহ বিভিন্ন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভারতে প্রাণ হারান প্রায় কয়েক হাজার মানুষ।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত