| 26 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

রাইকিশোরী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

আজ ১৭ মে কবি, কথাসাহিত্যিক যুগান্তর মিত্রের জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


মিতুর চোখে ঘুম এলেই সে এসে দাঁড়াত সামনে। কেউ দেখতে পেত না। শুধু মিতুই দেখত। আর মিতু চোখ বন্ধ করে থাকত।বড়রা ভাবত মিতু ঘুমিয়ে পড়েছে। কারণ ওর চোখ বোজা। মিতু তার সঙ্গে কথা বলত। সেও মিতুর কথার জবাব দিত মৃদু হেসে। দুজনের কথোপকথন কেউ শুনতে পেত না। কেননা মিতুর ঠোঁট নড়ত না।প্রথম যেদিন এলো, মিতুর মনে আছে, তখন দুপুর। সকালে স্কুল থাকে বলে দুপুরে ঘুমাতেই হবে। বাবার কড়া নির্দেশ।
মাও জোর করে ঘুম পাড়াত ওকে। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসতে চাইত না। এক দুপুরে সে এসে দাঁড়াল সামনে। মার চোখেও ঘুম। মিতুও ঘুমিয়ে পড়বে একটু বাদেই। আচমকা সে এসে দাঁড়াতেই মিতু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। সে আলতো হাসি ছড়িয়ে দিল। মিতুর মনে হল যেন এক টুকরো আলো ছড়িয়ে পড়ল। মার দিকে তাকিয়ে দেখল মা ঘুমিয়ে পড়েছে।
অচেনা লোক বলে ভয় পাওয়ার কথা মিতুর। কিন্তু তার বদলে কেমন যেন আনন্দ হচ্ছে তার। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো মিতুর একেবারে সামনে। তারপর মায়াবী গলায় বলল, আমি ইন্দুদ্যুতি। অনেক দূর দেশ থেকে তোমার কাছে এসেছি।
মিতু আড়চোখে মায়ের দিকে চাইল। মা যদি জেগে যায়? ইন্দু বলল, ভয় পেও না। মা এখন ঘুমের দেশে। মা’র ঘুম ভাঙবে না মিতু। আমার কথা শুনতেই পাবেন না।
-তুমি আমার নাম জানো? কথাটা বলেই মিতু ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল। ইন্দু তখন বলল, ভাবনা কোরো না, মা এখন তোমার কথাও শুনতে পাবেন না। আর মজার কথা কি জানো? মা যদি জেগে ওঠেন, অন্য কেউ যদি এইসময় এখানে আসেন, তাও তোমার কথা শুনতে পাবেন না। তোমার ঠোঁট নাড়া দেখতে পাবেন না। তাঁরা দেখবেন তুমি ঘুমোচ্ছ।
বিস্ময়ে মিতুর মুখ হা হয়ে যায়। তা কী করে হবে ইন্দুদাদা?
মিতুর মাথায় হাত রাখে ইন্দু। তারপর বলে, আমাকে তুমি দাদা বলে ডাকবে না মিতু। শুধু ইন্দু বলে ডাকবে। আমার নাম ইন্দুদ্যুতি। মানে চাঁদের আলো।
-তুমি যে আমার থেকে অনেক বড়!
-তা হোক। আমাকে কেউ দাদা বলে না। অন্যকিছু বলেও ডাকে না। শুধুই ইন্দু বলে ডাকে। তুমিও ইন্দু বলেই ডাকবে।
“আচ্ছা” বলে মিতু চুপ করে যায়। ইন্দু তখন আবার বলে, তুমি জানতে চাইছিলে না কেন তোমাকে আর আমাকে এইসময় কেউ দেখতে পারবে না? আসলে কি জানো, আমার শরীরে যাদু-আলো আছে। মায়াবী আলো। সেই আলো তোমার গায়ে এসে পড়েছে বলেই তোমার কথা বলা, ঠোঁট নাড়া কিচ্ছু দেখতে পাবে না কেউ।
-আর মা? মার গায়ে কি তোমার আলো পড়েনি?
-না মিতু। মার গায়ে আমার যাদু-আলো পড়তে দিইনি। আমি যার গায়ে চাইব, তার গায়েই এই আলো ফেলতে পারি।
মিতু আবার অবাক হয়। ইন্দু বলে, তুমি খুব ভালো মেয়ে। আজ থেকে আমি তোমার বন্ধু। এখনই বিদায় নেবো। আবার রাতে ঘুমের দেবী যখন তোমার শিয়রে উপস্থিত হবেন, সেইসময় আসব। তখন অনেকক্ষণ তোমার কাছে থাকব। তোমার সঙ্গে গল্প করব।
-ঠিক আসবে তো? আকুতি নিয়ে মিতু জানতে চায়।
-আসব। ঠিক আসব। তবে আমি যে এসেছিলাম আর আবার যে আসব সেকথা কাউকে কোনোদিন বোলো না। তাহলে আমি বুঝতে পেরে যাব। হাওয়া আমার কানে সেই সংবাদ পৌঁছে দেবে। আমিও আর কখনো আসব না তোমার কাছে। তোমার মতো অন্য কারও কাছে চলে যাব।
বলতে বলতেই মিলিয়ে গেল ইন্দু। যেমন ভাবে হঠাৎ এসে পৌঁছেছিল এখানে, তেমন করেই যেন হঠাৎই চলে গেল। মিতু ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলো।
সেই রাতে আবার এলো ইন্দু। তার হাতের দু’পাশ থেকে বেরিয়ে আসা দুটো ডানা দেখা যাচ্ছে। এরপর থেকে নিয়মিতই আসে ইন্দু। তার ডানায় হাওয়া রিনরিন শব্দ তুললেই মিতু বুঝতে পারে সে এসে গেছে। তখনই মিতু চোখ বন্ধ করে ফেলে। বাবা ভাবে ওর ঘুম এসে গেছে। বাবা খুব খুশি হত। বাবাকে যে আর গল্প বলতে হবে না! প্রতি রাতে ঘুমানোর সময় বাবাকে গল্প শোনাতে হত। রূপকথার গল্প, রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প, পঞ্চতন্ত্রের গল্প।
সেদিন রাতে বাবা পঞ্চতন্ত্রের গল্প বলছিল, মিতু কিছুতেই মন দিয়ে শুনতে পারছিল না সেই গল্প। কেননা সে যে অপেক্ষা করছিল ইন্দুর জন্য। হঠাৎই রিনরিন শব্দ ভেসে এলো। সেই শব্দ শুধু মিতুই শুনতে পেলো। বাবা শুনতে পায়নি। মাও নয়। কাছে থেকে বাবা শুনতে না পারলে, রান্নাঘরে খাওয়ার বাসনপত্র গোছাতে থাকা মা কী করে শুনবেন!
-দুপুরে যখন এসেছিলে তখন তো তোমার ডানা ছিল না?
ইন্দু হেসে ফেলল। ছিল মিতু, আমার পেছন দিকে ছিল বলে দেখতে পাওনি। আসলে আমিই আড়াল করে রেখেছিলাম। কেননা প্রথমেই আমার ডানা দেখে ফেলো আমি তা চাইনি। ধীরে ধীরে বুঝতে হয় কাউকে। আস্তে আস্তে কোনোকিছু বুঝে নিতে হয়। এই ডানা আমি আড়াল করতে পারি, মেলে দিয়ে উড়েও যেতে পারি।
-উড়ে যেতে পারো? অনেক অনেক দূরে?
-হ্যাঁ মিতু, আমি অনেক দূরে উড়ে যেতে পারি।
-তুমি কোথায় থাকো?
হা হা করে হেসে উঠল ইন্দু। আমি তোমার কাছেই থাকি। কিন্তু তুমি দেখতে পাও না। কারণ আমি তোমাকে দেখা দিতে চাই না।
-কেন দেখা দিতে চাও না?
-বলেছি না তোমাকে ধীরে ধীরে সবকিছু বুঝতে হয়। সব বুঝে যাবে মিতু। অপেক্ষা করো।
মিতু চুপ করে শোনে ইন্দুর কথা। কী মিষ্টি করে কথা বলে ! কত গল্প করে। সুন্দর সুন্দর সেই গল্প। মিতু আশ্চর্য হয়ে শোনে। কিন্তু আরও আশ্চর্য হয়, ইন্দু চলে গেলেই গভীর ভাবে ঘুমিয়ে পড়ে মিতু, আর ঘুম ভেঙে গেলে সেইসব গল্প কিছুতেই মনে পড়ে না তার।
(২)
মিতুর আজ সন্ধ্যে থেকেই খুব উত্তেজনা হচ্ছে। আজ ইন্দু ওকে কোথায় যেন নিয়ে যাবে। এখন আর জানতেও চায় না ইন্দুর কাছে। কেননা সে ধীরে ধীরে সবকিছু বুঝে নিতে চায়। মিতু জানে ইন্দু ঠিক তাকে নিয়ে যাবে। ঠিক সময়মতো তাকে সব জানাবে। তাই উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করে রাতের জন্য। আনন্দে তার ভিতরে কেমন যেন কলকল করে শব্দ হয়। আচ্ছা, এই শব্দটা কি কেউ শুনতে পাচ্ছে? ভাবে মিতু। নাহ্‍, কিছুতেই শুনতে পাচ্ছে না। নিশ্চিত জানে সে।
রাতের খাওয়ার পর মিতু তার বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে গভীর আবেশে। এবার সে চোখ বুজে থাকবে। বাবা মা ঠাম্মা সবাই জানে মিতু রাতের খাওয়া হলেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এখন আর ওকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে হয় না। একমাত্র মিতুই জানে সে চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে ইন্দুর জন্য। ইন্দু এলে তার সঙ্গে নানা গল্প হয়। তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে।
শুয়ে সবে চোখটা বুজেছে, ইন্দুদ্যুতির ডানা মেলার মিষ্টি রিনরিন শব্দ ভেসে এলো। মিতুর ভেতরে বেজে উঠল বাজনা। ওর খুড়তুতো দাদা ছোট্টুদা খুব সুন্দর সিন্থেসাইজার বাজাতে পারে। মিতুর মনে হল তার ছোট্টুদার সেই সিন্থেসাইজারের টুংটাং বেজে উঠল মনের কোন্ এক গভীরে। ইন্দু এসে মিতুর মাথায় আলতো হাত রাখল। মিতু পাশ ফিরে দেখল তাকে। আজ ইন্দুকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। ডানাগুলো মুড়ে রেখেছে পিঠের উপরে। আর মাথার পেছন দিক থেকে কোমড় ছাড়িয়ে নেমে গেছে লাল ভেলভেটের মতো একটা পাতলা কাপড়। ছবিতে দেখেছে অনেক রাজার পেছনে এইরকম ঝোলে। সুপারম্যানের ছবিতেও এইরকম একটা লাল কাপড় ঝুলতে দেখেছে সে। আর এই লাল কাপড়ের ঝালরটার জন্যই ইন্দুকে বেশি সুন্দর দেখতে লাগছে।
-কখন যাবে আমাকে নিয়ে? ইন্দুর হাত ধরে মিতু জিজ্ঞাসা করল।
স্মিত হেসে ইন্দু বলল, এই তো এখনই যাব। কথাটা বলেই মিতুর হাত ধরল ইন্দু। আর মিতু সম্মোহিতের মতো ইন্দুর হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। দুজনে বেরিয়ে এলো বাইরে। মিতু একটুও আশ্চর্য হল না, এই যে তারা দরজা-জানালা বন্ধ থাকলেও কীভাবে বাইরে বেরিয়ে এলো এই দেখে। কেননা মিতু জানে ইন্দুর যাদু-আলো সবকিছু করতে পারে।
একটা অরণ্যের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে দুজনে। আগে আগে ইন্দু আর পিছনে মিতু। রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ কানে ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে পেঁচার ডাকও শুনতে পাচ্ছে সে। চাঁদের আলো গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছে অরণ্যের ঘাসের উপর, শুকনো পাতার উপর। দু-একটা শেয়াল আর অচেনা পশুও চলে গেল তাদের পাশ দিয়ে। অথচ মিতুর একটুও ভয় করছে না। কারণ ও চলেছে ওর ইন্দুর সঙ্গে।
যেতে যেতে ইন্দু মিতুর সঙ্গে গল্পও করছে মাঝে মাঝে। স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা খলখল করে বলে চলেছে মিতু। অরণ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর একটা বিরাট মাঠ পড়ল সামনে। ইন্দু কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। তারপর পিছন ফিরে মিতুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসির আলখাল্লা ঝুলিয়ে দিল ইন্দু। সেই মাঠে জ্যোৎস্নার আলো থইথই করছে। মাঠের মধ্যের ঘাসগুলো যেন সেই আলো গায়ে মেখে লুটোপুটি খাচ্ছে। মাঠের পাশের তালগাছ আর খেজুরগাছ চাঁদের আলো গায়ে মেখে নেচে উঠছে। মিতু এগিয়ে গিয়ে ইন্দুর গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
ইন্দু তার দুই হাত ছড়িয়ে দিল দু’পাশে। তার পিঠের লাল ঝালর হালকা হাওয়ায় দুলে উঠল।
-তুমিও তোমার দুই হাত এইভাবে ছড়িয়ে দাও। মিতুকে বলল ইন্দু। সে যেভাবে হাতদুটো ছড়িয়ে দিয়েছে সেইভাবেই ছড়িয়ে দিল মিতু। “এবার চোখ বন্ধ করো।” ইন্দুর এই কথা শুনে মিতু চোখ বন্ধ করল। তারপর বুঝতে পারল মাটি ছাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে উপরে, আরও আরও। চোখ মেলে দেখল টুকরো মেঘের পাশ দিয়ে সে উড়ে চলেছে। শরীরটা দারুণ হালকা লাগছে। ইন্দুও চলেছে তার পাশে পাশে। আকাশের তারাগুলো কাছে কাছে এগিয়ে আসছে। কতক্ষণ এভাবে ভেসে চলেছিল মনেই করতে পারে না মিতু। এমনকি ভেসে যেতে যেতে কোন্ সুদূরে চলে গিয়েছিল তাও মনে করতে পারে না সে। কেননা কখন যেন ঘুমের অতলে তলিয়ে গয়েছিল মিতু। তবে খুব সুন্দর কোনো একটা প্রাসাদে যে সে গিয়েছিল এটা তার খুব মনে হয়। পরদিন ইন্দুকে জিজ্ঞাসা করেছিল। কিন্তু ইন্দু কিছুতেই বলতে চাইল না। শুধু মিটিমিটি হাসল। আর বলল, ধীরে ধীরে ঠিক বুঝে যাবে।
এভাবেই প্রতিদিন ইন্দুর সঙ্গে গল্প করে, কখনো নতুন নতুন জায়গায় ঘুরে দিন কাটতে লাগল মিতুর। পড়াশুনায় এখন মিতু সবার থেকে ভালো হয়ে গেছে। কীভাবে যেন পরীক্ষায় সব প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারে। কোনো অঙ্কই আর ভুল হয় না। ক্লাশে সব বিষয়ে সে সেরা নম্বর পায়। খুব মিষ্টি গান গাইতে পারে। আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়ও পুরস্কার পায়। তার চমৎকার নাচ দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। এভাবেই মিতু বড় হয়ে ওঠে।
(৩)
সকাল থেকেই বাড়িতে হইহই কাণ্ড। আজ মিতুর জন্মদিন। সকাল সকাল বাবা বাজারে চলে গেছে দুটো ব্যাগ নিয়ে। জমিয়ে বাজার করবে বলে গেছে। মিতুর আনন্দ হচ্ছে ঠিকই, পাশাপাশি লজ্জা লজ্জাও করছে। গতবছর পর্যন্ত তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এবারই কেমন যেন মনে হচ্ছে তার। ছোট্টুদা কাল বলল, হ্যাঁ রে মিতু, তুই তো বড় হয়ে গেলি! এবার তোর আঠারো বছর হয়ে যাচ্ছে মানে ভোট দেওয়ার অধিকার পাচ্ছিস। এখন তুই দেশের জনমত-দেওয়া নাগরিক।
ছোট্টুদা এইরকমই। ইউনিভার্সিটিতে রাজনীতি করে। কলেজেও করত। তাই বয়সের প্রসঙ্গেও রাজনীতির উদাহরণই মনে পড়ে ওর। তাছাড়া ছোট্টুদা খুব হইহই করতে পারে। সব ব্যাপারেই হইচই মাতামাতি করতে পারে। আজ সকাল সকাল একগাদা বেলুন নিয়ে হাজির। ঘরে ঘরে বেলুন ফুলিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। এতে আরও বেশি লজ্জা লজ্জা করছে মিতুর।
দুপুরে দারুণ রান্না করেছে মা। চিংড়ি মাছ, আবার মাংসও। এছাড়া পায়েস তো ছিলই। যদিও পায়েস খেতে একদম ভালো লাগে না মিতুর। কোনো মিষ্টিই খেতে ভালো লাগে না। তবু এক চামচ হলেও খেতেই হবে। ঠাম্মা নিজে হাতে পায়েস খাইয়ে দিয়ে হাতে একজোড়া সোনার কানের দুল গুঁজে দিল। বলল, এইটা তোর জন্যই রাখছিলাম। আমার বিয়ায় পাওয়া। আমার মা আমারে দিছিল। রাইখ্যা দিস। বিয়ার সময় কাজে লাগব।
হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছিল ঠাম্মা। তারপর বাবাকে ডেকে বলল, নাড়ু রে, মাইয়া তো বড় হইয়া গেলো। এইবার পোলা খোঁজন লাগব। বিয়া দিতে হইব।
বাবাও লাফিয়ে উঠল। ঠিক বলেছ মা। এবার একটা বিয়ে দিতে হবে মিতুকে। কীরে মিতু, পাত্র খুঁজব নাকি নিজেরই দেখা আছে? হা হা হা …
পড়াশুনা, কোথাও একা একা যাওয়া এইসব ব্যাপারে খুব কড়া বাবা। এছাড়া অন্য সময় বাবা মিতুর বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু। সারাক্ষণ হাসিখুশি আর মজা করে। তবে বাবার আজকের কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো। আমার তো কাউকেই তেমন করে ভালো লাগেনি। মনে মনে বলে।
-আমি এখন বিয়ে করব না বাবা। আরও অনেক পড়ব। আদুরে গলায় বলল মিতু। মা খাবার টেবিল পরিষ্কার করতে করতে বলে উঠল, না না, এখন বিয়ে করবে কেন? ধিঙ্গি হয়ে ঘুরে বেড়াও। বাপের আদরে তো মাথায় উঠে গেছো।
মা সবসময় কেন যেন খিটিমিটি করে। খুব কম সময় মাকে ভালোভাবে কথা বলতে দেখেছে মিতু। তবে জ্বরটর হলে বা শরীর খারাপ হলে মা খুব টেনশন করে। পারলে সারা দিনরাত মাথার কাছে বসে থাকবে আর বিড়বিড় করবে “শুধু অনিয়ম করবে মেয়েটা আর রোগ বাঁধাবে। এই মেয়েকে নিয়ে আমি কী যে করি !”
খাওয়ার পরেই আজ খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছে। আজকাল কলেজ থাকে বলে দুপুরে ঘুমানো যায় না। ফাইভে ওঠার পর থেকেই দুপুরে স্কুল থাকত। তাই আর ঘুমানো হয়ে ওঠে না। রবিবারও ঘুমায় না। বইপত্র পড়ে। তবে ইন্দু প্রতিদিনই দুপুরে একবার করে দেখা করে। হয়তো টিফিন টাইমে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করে টিফিন খাচ্ছে। সেইসময় ডানায় রিনরিন শব্দ তুলে ইন্দু এসে পড়ে। সবার মাঝে থেকেও ঠিক ইন্দুর সঙ্গে গল্প করে নেয় একটু। হাসেও। মিতু জানে ওদের দুজনের কথাবার্তা বা হাসি কেউ টের পায় না। ছুটির দিনেও দুপুরে কথা বলে যায় ইন্দু। মাঝে মাঝে সকালে বা সন্ধ্যাতেও ইন্দু এসে ধরা দেয়।
আজ ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু ইন্দু আসছেই না। সারাদিনে একবারও কি আসতে নেই ইন্দু? আজ আমার জন্মদিন, তবু আসবে না? প্রতি জন্মদিনেই তো তুমি দিনেরবেলা একবার এসে দেখা দাও। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। কী যে ভালো লাগে ইন্দু তোমাকে বোঝাতে পারব না! আজ কেন এলে না? অভিমানে চোখ ভিজে আসে মিতু্র। ঘুম তবু এসেই যায়। খাওয়াটা বেশিই হয়ে গেছে। তাই ঘুম পাচ্ছে। কিছুতেই ঘুম আটকাতে পারল না মিতু। ইন্দুর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল।
রাতের খাওয়ার পরে ইন্দু এলো। কেন সারাদিনে একবারও আসেনি অনুযোগ করল মিতু। ইন্দু মিটিমিটি হাসে। কিন্তু কিছুই বলে না। মিতু মুখ গোমড়া করে যখন পাশ ফিরে শুয়ে থাকল, তখন ইন্দু ওকে কাঁধ টেনে পাশ ফিরিয়ে দিল।
-ওঠো মিতু, চলো আমরা ছাদে যাই। গল্প করি। আজ তোমাকে খুব দরকারি একটা কথা বলতে এসেছি।
মিতু সম্মোহিতের মতো উঠে দাঁড়ায়। ইন্দুর হাত ধরে পায়ে পায়ে ছাদে উঠে আসে। তারপর দু’হাত দুদিকে প্রসারিত করে চোখ বুজে দাঁড়ায়। ইন্দু বলে, চোখ খোলো মিতু। আমরা আজ কোথাও যাব না। এখানেই আজ তোমার সাথে কথা বলব। তোমাকে কিছু বলার আছে আমার মিতু।
চোখ মেলে তাকায় মিতু। আজ কেন যেন পূর্ণ চোখে দেখতে ইচ্ছে করে এই পুরুষকে। বলিষ্ঠ শরীর থেকে যেন জোৎস্নার গুঁড়ো গুঁড়ো আলো ছলকে নামছে ছাদে। ইন্দু এসে ডান হাত চেপে ধরে মিতুর। তারপর বাঁ হাত পেছন দিক থেকে এনে কাঁধে রাখে। মিতুর সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। এই প্রথম ইন্দুর স্পর্শে তার এইরকম অনুভূতি হয়। কিন্তু ইন্দুর কথায় সেই অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
-আজই আমাদের শেষ দেখা মিতু। কাল থেকে আর আসব না আমি।
চকিতে ছিটকে যায় মিতু। কেন আসবে না ইন্দু? আমি যে তোমার প্রতীক্ষায় থাকি।
-আজ থেকে তুমি আর কিশোরী নেই মিতু। এখন তুমি যুবতী। আমি তোমার কিশোরীবেলার ইন্দু। তোমার সাথী। তোমার চাঁদের আলো। কাল থেকে হয়তো অন্য কেউ আসবে। সূর্যের দীপ্তি নিয়ে। প্রখর তাপ নিয়ে। সে হবে তোমার সাথী।
-আমি চাই না আর কাউকে। আমি শুধু আমার ইন্দুকে চাই।
-তা হয় না মিতু। বোঝার চেষ্টা করো। আমাকে যেতেই হবে। আটকাতে পারবে না যে! তবে আমি থেকে যাব তোমার মনের গভীরে। মাঝে মাঝেই তোমার ডাকে সাড়া দেবো। আমাকে দেখতে পাবে না আর। অনুভব করতে পারবে শুধু।
বলতে বলতেই মিতুর থেকে খানিকটা তফাতে চলে যায়। তারপর দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়ায় ইন্দু। তার পিঠের লাল উড়নি থেকে ঝরে ঝরে পড়ে জ্যোৎস্নার গুঁড়ো। আর ইন্দু ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে নীল আকাশের সীমানায়।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মিতুর মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। চোখমুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসে। মনে মনে বলে, ইন্দু ইন্দু ইন্দু … কোথায় তুমি?
-আমি আছি আমি আছি আমি আছি রাইকিশোরী, তোমার মনের গহীনে। চিরকাল সেখানেই বাসা বেঁধে থাকব। মিতু বুঝতে পারে তার বুকের ভেতর থেকে কথা বলে উঠল ইন্দু। ডায়েরির পাতায় সে কলম দিয়ে লেখে “ইন্দু ইন্দু ইন্দু …” তারপর তার নাম আর ইন্দুদ্যুতির নাম মিশিয়ে লেখে ইন্দুমতি।
হঠাৎই মিতুর চিৎকার করে বলে উঠতে ইচ্ছে করে “রাইকিশোরী ইন্দুমতি”। কিন্তু সে-কথাটা মনে মনেই বলে। অনেক, অনেকবার। কেননা এখন তো আর ইন্দুর যাদু-আলো নেই। এখন সবাই যে শুনতে পাবে তার কথা!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত