| 27 এপ্রিল 2024
Categories
চলচ্চিত্র ধারাবাহিক সিনেমা

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৪) । বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

 জ্যোতি প্রসাদ আগরওয়ালা বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। সাহিত্যের সমস্ত ক্ষেত্রেই তার পদচারণা অসমিয়া সাহিত্যকে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছিল। নাটকের মতো অসমিয়া  কবিতার ক্ষেত্রেও  তিনি তার প্রতিভার উল্লেখযোগ্য স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

 একথা সত্যি যে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা কল্পনা বিলাসী এবং সুন্দরের সেবক ছিলেন। কিন্তু তিনি পলায়নবাদী ছিলেন না। কবিতার মাধ্যমে তিনি ভাষাহীন সাধারন জনতার মুখে ভাষা দিতে চেষ্টা করেছেন। সাধারণ জনতাকে ছলনার সাহায্যে ভুলিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে দেখে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এবং দেশীয় সুবিধাবাদী শোষকদের জ্যোতিপ্রসাদ সতর্ক করে দিয়েছেন। ভলান্টিয়ারের দুঃখ,জ্যোতি শঙ্খ, পোহরর  (আলোর)গান , জনতার আহ্বান, সাবধান সাবধান, ইত্যাদি কবিতায় জ্যোতিপ্রসাদ শোষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন ।-

‘সুবিধাবাদী দল

তোর মিথ্যা হবে কৌশল

জনগণের তুই সেবা চুরি করে

বাড়াতে চাইছিস বল।’

    জ্যোতিপ্রসাদের সমস্ত রচনাতেই ঐতিহ্য চেতনা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কবিতার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাই, জ্যোতি প্রসাদের কবিতায় লাচিত, জয়মতী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বীর বীরাঙ্গনার শৌর্য,বীরত্ব এবং ত‍্যাগ  সজীব হয়ে উঠেছে-

‘অলর-অচল আমার

বজ্রপথার

অস্থিত আহি আহি হানিছে আঘাত

প্রতিঘাত পেয়ে

হতবীর্য সিংহসম

যায়

শতমুখী অসমিয়া যোদ্ধার

গৌরব গায়।’


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৩)


    জ্যোতি প্রসাদ আগারওয়ালা পাহাড়- সমতল, হিন্দু- মুসলমান, জন-জাতিকে এক সূত্রে বেঁধে নিয়ে গতিশীল বৃহত্তর জাতি গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদের এই ভাবনা কবিতার মধ্যে ও ফুটে উঠেছে।কবির  কবিতায় জাত-পাত,ধর্মের ভেদাভেদ পরিহার করে সমস্ত জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।তাঁর ‘গাঁওর জীয়রী’,’অসমীয়া ডেকার উক্তি’,’অসমীয়া ছোৱালীর উক্তি’,ন-জোৱান ই হিন্দ’,’অসমর নবীনজোৱানর  সংকল্প’ ইত্যাদি কবিতায় জ্যোতিপ্রসাদের  এই মানসিকতা লক্ষ্য করা যায় ।-

আমিই খাসিয়া          আমিই জয়ন্তীয়া

             ডফলা আবর অঁকা,

আমিই সিংফো           ভয়ামের মিরি

           সোবনশিরীয়া যুবক,

বিজয়ী আহোম        কছারী কোচর

           মেচর কুমার আমি

    জ্যোতিপ্রসাদ একজন দক্ষ শিল্পী। তার সমস্ত রচনায় এই শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। কবির  শিল্পী মন অসমিয়া সমাজের সমস্ত অশুভ শক্তি নাশ করে আলোকমুখী  করে তুলতে চেয়েছিলেন। কবিতার মধ্যে কবির  এই শিল্পী মনোভাব নিখুঁতভাবে অংকিত হয়েছে।-

‘ শিল্পী মই তিনিও কালর

অতীতর

বর্তমানর

অনাগত ভবিষ্যতর ।

আদিতেই  যাত্রা করি অনাদিলৈ যাঁও ,

ধ্বংসর মাজেদি মই

রূপান্তরেদি রূপ পাই

নবতম সৃষ্টির শলিতা জ্বলাও।’

(বিশ্ব শিল্পী)

    অসমীয়া কাব্য সাহিত্যে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা একটি বিশিষ্ট ধারার সৃষ্টি করেছেন। জোনাকি যুগের ঐতিহ্য যদিও তার কবিতাকে গড়ে তুলেছে, তার কবিতায় কিন্তু যুগের পরিবর্তনের প্রভাব ও সুস্পষ্ট। তার কাব্য দর্শনের প্রেরণা চন্দ্র কুমার আগরওয়ালা বলে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। চন্দ্রকুমারের কবিতায় অনুভূত সৌন্দর্যের প্রতি স্পৃহা এবং মানবতাবাদ দুটিই জ্যোতিপ্রসাদকে বিপুলভাবে আলোড়িত করেছে। কিন্তু  চন্দ্রকুমারের কাব্য দর্শন জ্যোতিপ্রসাদেরও কাব্য দর্শন বললে ভুল করা হবে। চন্দ্রকুমারের   মানবতাবাদী  দর্শনে ছিল বিমুর্ত ভাব ধারার সুস্পষ্ট প্রভাব । জ্যোতিপ্রসাদের  সময় ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সৃষ্টি করা সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়নের সময় । তাই অনিবার্যভাবেই জ্যোতিপ্রসাদের কবিতাকে স্পর্শ করেছিল এই সময়।

কবি মই

কবিতা বিলাসী মই নহওঁ

মোৰ কবিতা

নবীন দিনর

নব-জ‍্যোতি প্রণতা

দুঃখিত দুখেরে উচ্ছ্বসিতা

চির আশারে তাই আনন্দিতা।

    জ্যোতিপ্রসাদের কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই জাতির মুক্তি আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল।’জনতার প্রাণরো প্রাণত মনরো মনত’ বিচরণ করে তিনি সাম্রাজ্যবাদী শাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে সবাইকে জাগাতে চেয়ে ছিলেন। প্রত্যেকের মুখেমুখে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আগুন ঝরা গান। হিংসা কে অতিক্রম করে তার কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে গান্ধীবাদের সংযম-

বুকুর ভিতরত হিংসা বাঘে

যেন পিঞ্জরত বনাই

গুঁজরি গুমরি বারে বারে

আহিব খোজে ওলাই।

অহিংসা বাণীরে তাক খুচি খুচি

যত ভিতরলৈ সোমাই ,

তথাপিও সি মাটিত কামুরি

আছে গোরাই।

(  বুকের ভেতর থেকে  হিংসারূপী বাঘ মাঝে মধ্যেই গর্জন করে বেরিয়ে আসতে চায়। অহিংসার বাণীর সাহায্যে তাকে মনের ভেতরেই  আবদ্ধ করে রাখি।)

    জ্যোতিপ্রসাদের কবিতায় আলোক,জ্যোতি,আলো এবং সুন্দর –এই ধরনের শব্দ আমরা ঘন ঘন দেখতে পাই।চন্দ্রকুমার আগরওয়ালার ‘সুন্দরের আরাধনা জীবনের খেল’ কথাটা জ্যোতিপ্রসাদের কল্পনাশক্তিকে উদ্দীপিত করেছিল।কবি আলোকের যাত্রী। এই যাত্রা কোথা থেকে আরম্ভ করে কোন পথ দিয়ে কোথায় গিয়ে মিলিত হবে তার একটা আভাস আমরা নিচের কবিতায় পেয়ে যাই।–

    ‘লুইতর পারে পারে ভারত- সাগর লৈ

    মুকুতা বিচারি ভটিয়াওঁ

    ওপজা গাঁওর পরা

    নিজরার পারে দি

    জানজুরি নৈয়ে দি

    লুইতর রূপালী বালিয়ে মই

    জোনাকত বালিভাত খাই

    সোৱণশিরীয়া সোন দিনৌ কমাওঁ

    মার যোৱা বেলিটির জিলিকনি লেখি মই

    নতুন পুৱার ছবি চাওঁ

    মহাভারতর বাটে পৃথিবীর সবাহলৈ যাওঁ

    মই কিন্তু শিল্পী প্রাণে

    গাঁওর গণ্ডিতো থাকি

    উপজিয়ে হৈ আহো বিশ্বনাগরিক (-শিল্পীর আলোক যাত্রা)

( ব্রহ্মপুত্রের তীর ধরে আমরা মুক্তোর খোঁজে ভারত সাগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব। সূর্যাস্তের মধ্যে আমি নতুন ভোরের ছবি দেখি। মহাভারতের পথে আমি বিশ্বসভায় যাত্রা করব। শিল্পী প্রাণের অধিকারী আমি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেও আমি জন্মমুহূর্ত থেকেই বিশ্বনাগরিক।)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত