| 26 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২০) । বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

১৯৩৫ সনে প্রথম অসমিয়া চলচ্চিত্রের কাহিনি হিসেবে’ জয়মতী’র নির্বাচনকে আমরা এক ধরণের দুঃসাহসিকতা বলতে পারি। সেই সময় ভারতীয় চলচ্চিত্রে মনোরঞ্জনধর্মী কাহিনি, পৌরাণিক কল্প-কাহিনি বা আবেগ সর্বস্ব  অবাস্তব নাটকের ( রাজা হরিশচন্দ্র, পুরাণ- ভগত, চন্ডীদাস, অযোধ্যাসা রাজা, অপরাধ, অধিকার..) বিপরীতে জয়মতী ছিল এক ঐতিহাসিক’ বাস্তবতা জড়িত কাহিনি। বিদেশের প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জ্যোতিপ্রসাদ চলচ্চিত্রের সৃষ্টিশীল এবং নান্দনিক রূপটি আয়ত্ত করেছিলেন। তাই ত়াঁর সজাগ বাস্তব- চিন্তা , স্বভাবজ  গভীর শিল্প বোধ এবং চলচ্চিত্রের নান্দনিক ধারণা আমরা জয়মতীতে প্রতিফলিত হতে দেখতে পাই।

জ্যোতিপ্রসাদের মনে   সজীব হয়ে থাকা বিদেশের চলচ্চিত্র অভিজ্ঞতার সমস্তটুকুই সীমিত সুবিধার মধ্যেও জ্যোতিপ্রসাদ জয়মতীতে প্রয়োগ করেছিলেন। আজকের ইতিহাস ভিত্তিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে নির্মাতারা যে ধরনের অধ্যয়ন গবেষণাদি করে, জ্যোতিপ্রসাদ তাই করেছিলেন।’ জয়মতীর সমালোচকরা লিখেছেন যে অত্যন্ত বাস্তব সম্মত দৃশ্য সজ্জা, চরিত্র উপযোগী পরিচ্ছদ এবং রূপসজ্জার দ্বারা জ্যোতিপ্রসাদ ‘জয়মতী’তে ষোলো সতেরো শতকের অসমের পরিবেশ, রাজনৈতিক এবং গার্হস্থ্য জীবনের সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তিনি কয়েকজন পন্ডিত গবেষকের সঙ্গে আলোচনা করে পুঁথি-পাঁজি এবং বিদেশি ভ্রমণকারীর টীকা  পড়ে, পুথি-চিত্র এবং সত্রের ঘরবাড়ি দেখে এবং কিংবদন্তির বর্ণনাকে গ্রহণ করে কাহিনির সমসাময়িক একটি বাস্তব  জগত  তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদ জয়মতীর  নির্মাণ আরম্ভ করেন প্রায় শূন্য থেকে। আর তাই প্রথম অসমিয়া  চলচ্চিত্রের কারিগরি ত্রুটি এবং অন্যান্য বিসঙ্গতি অপ্রত্যাশিত ছিল না। বরং বলতে হবে, জ্যোতিপ্রসাদের জয়মতী নির্মাণ সমস্ত বিপদ এবং বিফলতার সম্ভাবনাকে প্রত্যাহ্বান হিসেবে নিয়ে করা যুবক রক্তের দূঃসাহস এবং অদমনীয় উদ্যমের পরিণতি।

জয়মতী জনগণের সমাদর  লাভ করলেও জ্যোতিপ্রসাদ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তখনকার দিনে চলচ্চিত্রটির জন্য তার খরচ হয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। কিন্তু মাত্র কুড়ি হাজার টাকা হাতে নিয়ে নামায় জ্যোতিপ্রসাদকে নিজের তহবিল থেকে ত্রিশ হাজার টাকার লোকসান ভরে ‘ জয়মতী’ কে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। জয়মতীর  প্রথম সংস্করণে লোকসান ভরেও জ্যোতিপ্রসাদ হার মানলেন না । অসুস্থ শরীরে তিনি ভাতৃ হৃদয়ানন্দ আগরওয়ালা এবং নটসূর্য ফণী শর্মার সঙ্গে ১৯৪৮ সনে কলকাতা গিয়ে কালী ফিল্ম স্টুডিওতে ‘ জয়মতী’র দ্বিতীয় সংস্করণ সম্পন্ন করেন। প্রথম সংস্করণের মতো দ্বিতীয় সংস্করণেও জ্যোতিপ্রসাদকে নিজেই সংগীত, সংলাপ আদির ডাবিংয়ের কাজ করতে হয়েছিল । ‘জয়মতী’র হিন্দি ডাবিংয়ের কথা ভেবেছিলেন যদিও আর্থিক অনটনের জন্য সেই কাজ সম্পন্ন হল না। যে সময়ে কলকাতার বাঙালিরা প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র থেকেও জ্যোতিপ্রসাদের ‘জয়মতী’ শতগুণে ভালো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিল সেই সময় একদল অসমিয়ার ‘জয়মতী’কে নাকচ করার মানসিকতা দেখে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া বলেছিলেন – ‘বঙ্গদেশে প্রকাশিত বাঙালির প্রথম ফিল্মের চেয়ে তার এই ফিল্ম যে শতগুণে ভালো হয়েছে একথা বাঙালি দর্শককে  কলকাতায় বলতে আমি নিজের কানে শুনেছি । কিন্তু আমাদের মধ্যেই জনাচারেক কোমরে কাপড় বেঁধে বের হল, জয়মতী ফিল্মটা খারাপ হয়েছে বলে খুব চেঁচামেচি করল। অবশ্য সমালোচনার প্রয়োজন আছে,না হলে ভবিষ্যতে মানুষ দোষ সংশোধন করতে পারে না, এই ধরনের সমালোচক একজনকে দেখে আমি খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু বাকিদের সমালোচনা, সমালোচনা নয়, সমালোচনার নামে লাথি এবং ছি ছি। এভাবে মানুষের সহজ উদ্যমে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে অসমিয়া স্বদেশের  উন্নতি করতে যায়।’


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-১৯)


চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে জ্যোতিপ্রসাদ মাত্র দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।তারই একটি ছিল ‘জয়মতী’ এবং অপরটি ‘ইন্দ্রমালতী’।ইন্দ্রমালতী হল জ্যোতি প্রসাদ আগরওয়ালার ‌ দ্বিতীয় চলচ্চিত্র।জয়মতী মুক্তি লাভ করার চার বছর পরে অর্থাৎ ১৯৩৯ সনে ‘ইন্দ্রমালতী’ মুক্তি লাভ করে।

‘ইন্দ্র মালতী’  চলচ্চিত্রটি একটি সামাজিক কাহিনিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কাহিনির পটভূমি হল তেজপুর।ব্রহ্মপুত্র তীরের এই শহরটিতে বাস করে বিপত্নীক ব্যারিস্টার মহেন্দ্রনাথ বরুয়া।একমাত্র পুত্র ইন্দ্রজিৎ কলকাতায় পড়াশোনা করে। ইন্দ্রজিতের বয়স একুশ বছর। পিতার অনুরোধে ইন্দ্রজিৎ সোনাপুর গ্রামে কাকা -কাকিমার কাছে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে যায়। তেজপুর শহর থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে সোনাপুর গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ, আত্মীয় এবং গ্রামের জনগনের অতিথি পরায়ণতা ইন্দ্রজিৎকে মুগ্ধ করে।গ্রামের শিক্ষক হলিনামের একমাত্র কন্যা মালতীর সঙ্গে ইন্দ্রজিতের পরিচয় হয়। একদিন গ্রাম ছেড়ে ইন্দ্রজিৎ কলকাতার ছাত্রাবাসে ফিরে আসে।মালতীর সঙ্গে গ্রামে কাটানো মধুর স্মৃতি ইন্দ্রকে ব্যাকুল  করে তোলে। এদিকে সোনাপুর গ্রামের ধনী চাষির পুত্র চন্ডীরাম মালতীর পাণিপ্রার্থী। কিন্তু মালতী বা তার পিতা কারও এই বিয়েতে সায় নেই। চন্ডীরাম মালতীকে অপহরণ করে মিছিং গ্রামে রাখে। ইন্দ্রজিৎ সে কথা জানতে পেরে কলকাতা থেকে বন্ধু ললিতকে সঙ্গে নিয়ে মিছিং গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কলকাতার অসমিয়া ব্যবসায়ী সুন্দরপ্রতিম বরুয়া তার বোন কুইনির সঙ্গে ইন্দ্রজিতের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ ব্যাপারটিতে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না।চন্ডীরামের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মালতী শেষপর্যন্ত নদীতে ঝাঁপ দেয়। ইন্দ্রজিৎ এবং ললিত মালতীকে অর্ধমৃত অবস্থায় নদীতে ভেসে থাকতে দেখতে পায়। দুজনেই মালতীকে উদ্ধার করে। মালতী তাদের সঙ্গে চলে যায়। সংক্ষেপে এটাই হল ‘ইন্দ্রমালতী’র কাহিনি। জ্যোতিপ্রসাদ  এতে একটি নিখুঁত প্রেমের কাহিনি সহজ সরল ভাষায় তুলে ধরেছেন। কাহিনিটি জ্যোতিপ্রসাদ নিজেই রচনা করেন। এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত কলা-কুশলীরা ছিলেন জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালাঃ প্রযোজক,গজেন বরুয়াঃ নৃত্য পরিচালনা, অভিনয়ে মনোভিরাম বরুয়া, ফণী  শর্মা, জ্ঞানদাভিরাম  বরুয়া, শিশু শিল্পী ভূপেন হাজরিকা এবং আরও অনেকে। 

‘জয়মতী’র মতো  ইন্দ্রমালতীর চিত্রগ্রহণের কাজ ভোলাগুলির চা-বাগানের চিত্রবন স্টুডিওতে না করে তেজপুরের   মিশন চারিয়ালির তালবাড়িতে, জ্যোতিপ্রসাদের কাঁঠালবাগানে হয়। একটি জায়গায় ক্যামেরা রেখে কেবল কোণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সাত দিনে প্রায় পনেরোশো ফুট রিল তুলে বহিঃদৃশ্যের  কাজ সম্পন্ন করা হয়। তারপর আটজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জ্যোতিপ্রসাদ অন্তঃদৃশ্য গ্রহণের জন্য কলকাতা গমন করেন। মাত্র তিন দিনের মধ্যে নারকেলডাঙ্গার অরোরা স্টুডিওতে শুটিংয়ের কাজ শেষ করা হয় ।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত