| 27 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২৪) । বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

জ্যোতি প্রসাদের মতে শ্রীশঙ্করদেব অসমে যে সংস্কৃতির প্রচলন করে রেখে গেলেন তা হল  কৃষ্ণ সংস্কৃতি। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন যে যখন সংসারের দুষ্কৃতির প্রাদুর্ভাব হয় তখনই তিনি  সংস্কৃতি রূপে এবং দুষ্কৃতীকে বিনাশ করে সুন্দর সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য যুগে যুগে কৃষ্ণ স্বরূপ মহান ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকে  মহাভারতের যুদ্ধে দুস্কৃতির বিনাশের জন্য যদিও স্থূল অভিযান আরম্ভ করতে হয়েছিল, তথাপি তিনি জোর দিয়েছিলেন অন্তসংস্কৃতির উদঘাটনে, আর তাই গীতায়  অর্জুনকে এই অন্ত সংস্কৃতির বিকাশ সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছিলেন।সমস্ত ধর্মেই বলে যে দুষ্কৃতির রঙ্গভূমি হচ্ছে মানুষের মন এবং হৃদয়। তাই শ্রী শঙ্করদেব স্থূল রণের   পরিবর্তে হৃদয় পরিবর্তনের পরিকল্পনা  গ্রহণ করেছিলেন। এই পরিকল্পনায় অন্ধকারকে জয় করে আলোকময় জীবনের বিকাশ সাধন করার পণ ছিল। এই আলোকময়  জীবনের বিকাশ  সম্ভব হয় যদি কৃষ্ণ সত্যের আলোক এখানে পড়ে। কৃষ্ণ আলোকময় জীবনের মহাসত্য প্রকাশ করার জন্য অনেকে তাকে ঈশ্বর বলে ভেবেছে বলে জ‍্যোতিপ্রসাদ  বলেছেন।
অহিংসা এবং প্রেমের পূর্ণ প্রকাশ ঘটে সাংস্কৃতিক বাতাবরণে। কৃষ্ণ যেভাবে বাঁশির সুললিত সুরে সংস্কৃতির বাণী নির্গত করে, ঠিক সেভাবেই জনতা লোকসঙ্গীতের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে। শ্রী শঙ্করদেব তাই সাধারণ জনতার মুখের ভাষাকে নিয়ে সঙ্গীত রচনা করে মানুষের মধ্যে কৃষ্ণ সংস্কৃতি বিলিয়ে দেয়। মানুষের সামনে এতদিন বন্ধ হয়ে থাকা বেদ-বেদান্তের বাণী মুক্ত হয়ে গেল। সাধারন জনতা তার স্বাদ পেয়ে তৃপ্তি লাভ করল।
সমস্থ কিছুকে বাধা দিতে পারলেও সময়কে বাধা দেওয়া সম্ভব নয় । শঙ্করদেবের সময় থেকে আমরা অনেকখানি এগিয়ে এসেছি । আমাদের সমাজে পশ্চিমী ধরন ধারনের আদব কায়দায় জ্যোতিপ্রসাদ ও লালিত পালিত হয়েছে। বিভিন্ন পশ্চিমী লেখকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে । তিনি কার্ল মার্কস পড়েছেন, কডওয়েল পড়েছেন। নতুন চিন্তা, নতুন দর্শনের আলোকে জ্যোতিপ্রসাদের মন  আলোড়িত হয়েছে। তিনি অনুভব করলেন এই নতুনের ভিড়ে অসমের মানুষ শঙ্করদেবকে ভুলতে শুরু করেছে। তার মনে হল শঙ্করদেবকে ভুলতে দেওয়া যাবে না, কারণ শঙ্করদেব হলেন অসমিয়া জীবনের প্রাণ। শঙ্করদেব কে ভুলে গেলে অসমিয়াদের অসমিয়াত্ব থাকবে না । কিন্তু তা বলে পাশ্চাত্যের প্রতিবাদী চিন্তা ধারাগুলির আগমনকে রোধ করা যাবেনা। পৃথিবীর মঙ্গল সাধন করা, জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্য যে সমস্ত চিন্তার উদ্ভব হয়েছে সেগুলিকে বাধা দেওয়া মুর্খামি হবে।
এই কথা প্রসঙ্গে জ্যোতিপ্রসাদ শঙ্কররদেব সম্পর্কে নতুন ভাবে ভাবতে শুরু করেছিলেন ।তিনি চিন্তা করেছিলেন কীভাবে পশ্চিম থেকে আগত নতুন চিন্তার সঙ্গে শঙ্করী আদর্শকে শামিল করা যায়। তিনি অনুভব করেছিলেন যে একটি সংস্কৃতি যখন বহুদিনের পুরোনো হয়ে যায় তখন তাতে স্থবিরতা দেখা দেয়। শঙ্কর সংস্কৃতিতেও একটা সময়ে এই ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। তাই তিনি তাতে নতুন জল ঢেলে যুগোপযোগী করে নিতে চেয়েছিলেন।
জ্যোতিপ্রসাদের মতে সংস্কৃতি যদি দুস্কৃতির সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতে না পারে তাহলে সংস্কৃতি বেঁচে থাকবে না। দুস্কৃতির সঙ্গে শিল্পীই লড়াই করতে পারে। তাই ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে কৃষ্ণকে শিল্পী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাই তিনি দুষ্কৃতির সঙ্গে লড়াই করতে পেরেছিলেন। কৃষ্ণের হাতের বাঁশিটা প্রমাণ করে যে তিনি একজন শিল্পী ছিলেন। তাঁর বাঁশির সুললিত  সুরে যমুনার পারের গোপীরা স্থির থাকতে পারত না ।
জ্যোতি প্রসাদের মতে  শ্রী শঙ্করদেবের কৃতিত্ব এখানেই  যে তিনি এরকম একজন বিশ্বশিল্পীকে অসমিয়া মানসের সঙ্গে পরিচয়  করিয়ে দিয়েছিলেন। নাহলে হয়তো কৃষ্ণ সংস্কৃতি অসমে প্রচলিত হত না । শ্রীশঙ্করদেব কৃষ্ণ আদর্শকে বাস্তবে  রূপায়িত করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন । কৃষ্ণের আদর্শ হল শিল্পী আদর্শ। জ্যোতিপ্রসাদ অনুভব করেছিলেন যে যেদিন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ প্রকৃত শিল্পী হবেন সেদিন এই পৃথিবী থেকে দুষ্কৃতি বিদায় নেবে। তাই কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম বোধের শ্রীশঙ্করদেবের যে দর্শন তিনি তাকে সমর্থন করেছিলেন। নিজের সত্তায় কৃষ্ণ শিল্পীসত্তাকে অনুভব করতে পারলেই মানুষ প্রকৃত শিল্পীতে রূপান্তরিত হবে। সক্রেটিস যেভাবে বলেছিলেন যে পৃথিবীর মস্ত মানুষ জ্ঞানী হলে কেউ খারাপ কাজ করবে না, সেভাবেই জ্যোতিপ্রসাদও ভেবেছিলেন যে  সমস্ত মানুষ প্রকৃতার্থে শিল্পী হলে তারা দুষ্কৃতী মূলক কাজ থেকে বিরত থাকবে।
জ্যোতিপ্রসাদ বুঝতে পেরেছিলেন যে ধণতন্ত্রবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদি কিছু মানুষকে দুঃখী করে রাখার প্রধান কারণ। তাই এই দুটি ‘বাদ’কে ধ্বংস করতে না পারলে নিস্তার নেই। এই দুটিকে নিপাত  করার জন্য তাই তিনি কখনও কৃষ্ণের বাঁশির  সঙ্গে অর্জুনের গাণ্ডীবের ও প্রয়োজন অনুভব করেছেন। অর্জুনের গাণ্ডীব ধ্বংস করে। কিন্তু এই ধ্বংসের বেদীতেই সৃষ্টি  হয় নতুনের । গান্ডীব স্বরূপ অস্ত্র ঘটানো ধ্বংসের বেদীতে বাঁশি রূপী  শিল্পই সৃষ্টি ঘটাতে পারে – এই  কথা জ্যোতিপ্রসাদ সম্যকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাই দুষ্কৃতীর সঙ্গে সংঘাতে আসা সংগ্রামে কৃষ্ণ সংস্কৃতির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। 
জ্যোতিপ্রসাদ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে রূপান্তরের মধ্য দিয়েই স্থায়িত্ব সম্ভব। রূপান্তরকামী স্থায়িত্বের কোনো অর্থ নেই। শঙ্করদেবের সমাজ শংকরদেবের দিনেই থেমে গেলে তা আধুনিক সমাজের প্রতি কোনো অবদান যোগাতে পারে  না। সংস্কৃতির স্থবিরতাই দুস্কৃতির জন্মদিন কবে। তাই শঙ্করদেব আদিষ্ট সংস্কৃতিতে চলমানতা আনতে হবে। এটা সম্ভব হবে বর্তমান যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন চিন্তা নতুন দর্শনের মাধ্যমে।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত