| 26 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: এক কাপ চা । ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

অনুবাদ – লুনা রাহনুমা

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Katherine Mansfield Writer

ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড, ১৮৮৮ সালে নিউজিল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী এই লেখিকা তাঁর সময়কালের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী লেখিকা ছিলেন। স্কুলে থাকাকালীন সময় থেকেই ক্যাথরিন সাহিত্য রচনায় পারদর্শিতার প্রমান রাখেন। পড়ালেখার শেষ ধাপে তিনি লন্ডনে যান, সেখানে মাত্র একবছর থেকে ১৯০৬সালে আবার নিউজিল্যান্ডে ফিরে আসেন। তখন থেকে নিয়মিত লেখা আরম্ভ করেন ক্যাথরিন। ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডকে ছোটগল্পের “মাস্টার” বলা হতো। প্রতিভাধর এই লেখিকার শরীরে এক্সপ্রেমুলামারী টিউবকোলোসিস রোগের লক্ষণ দেখা যায় ১৯১৭সালে। মানব শরীরে রোগ প্রতিরোধের অসামান্য ক্ষমতা থাকলেও তিনি এই রোগে মারা যান মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডের ছোটগল্পগুলোর ভেতর জনপ্রিয় হিসেবে,‘The Garden Party’, ‘The Daughters of the Late Colonel’, ‘Bliss’, ‘Prelude’, ইত্যাদি নাম উল্লেখ করা যায়। আমি আজকে ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডের ‘A Cup of Tea’ গল্পটি অনুবাদ করেছি।


“রোজমেরি- একদেখায় চোখে লেগে থাকার মতো সুন্দর মেয়ে না। না, তাকে খুব সুন্দরী বলা যায় না। তাহলে, দেখতে ভালো বলা যায়? কেউ যদি তার মুখের সবগুলো অংশ আলাদা আলাদা করে দেখে….. কিন্তু কেউ কেন অতটা নিষ্ঠুর হবে যে আরেকজন মানুষকে কেটে টুকরো টুকরো করবে? মেয়েটির বয়স অল্প, বুদ্ধিমতী, মানসিকতায় আধুনিক, পোশাকে মারাত্মক রুচিশীল, সাম্প্রতিক হালের সংবাদপত্র, বই, বিনোদন বিচিত্রা সবকিছু তিনি পড়ে ফেলেন সবার আগে। আর তার আয়োজন করা পার্টিগুলোতে থাকে দেশের সবচেয়ে আলোচিত সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ লোকদের সমাবেশ। সেই পার্টিগুলোতে শিল্পীমহলের প্রতিনিধিত্বে যারা উপস্থিত হন- তারা অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ, সেই শিল্পীরা মূলত ব্যতিব্যস্ত থাকে রোজমেরীর রূপ ও গুন্ কীর্তনে। আর কিছু শিল্পীকে ভাষায় বর্ণনা করতে গেলে ভয়ঙ্কর শোনাবে এখানে। তারা ছাড়া বাকিরা সবাই যথেষ্ট সামাজিক শিল্পী। মানুষের সামনে পরিচয় করিয়ে দেবার মত যোগ্যতা রাখে সেসব শিল্পীকুল।

রোজমেরি বিয়ে করেছেন দুই বছর আগে। ওর পুরুষ ভাগ্য ভালো। রোজমেরির স্বামী ওকে ভীষণ ভালোবাসে। ওরা খুব ধনীলোক। বাড়াবাড়ি রকমের পয়সাওয়ালা বলতে যা বোঝায় আরকি। যেখানে আপনি অথবা আমি শপিং করতে হলে বড়জোর বন্ড স্ট্রিটে যাবো সেখানে রোজমেরি শপিং করতে চলে যায় সোজা প্যারিসে। যখন ফুল কিনতে চায় তখন ওর গাড়িটি রিজেন্ট স্ট্রিটের সবচেয়ে বড় ফুলের দোকানটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রোজমেরি দোকানের ভেতর ঢুকে একঝলক ফুলের দিকে তাকিয়ে আঙুল তুলে কিছু ফুল দেখিয়ে বলে: “আমি ওটা, ওটা আর ওটা চাই। আমাকে ওই ফুলগুলোর চারটি করে তোড়া দেবেন। আর গোলাপের ওই ঝাঁকাটি ফুলদানি সহ। ওখানে যতগুলো গোলাপ আছে আমি সবগুলোই নিবো। না, কোন লাইলাক দেবেন না আমাকে। লাইলাক আমার বিশ্রী লাগে। লাইলাকের কোনো শেইপ নেই।”

সঙ্গে সঙ্গে লোকটি লাইলাকের সমস্ত অস্তিত্ব সরিয়ে ফেলতো চোখের সামনে থেকে, যেন রোজমেরীর কথা খুব সঠিক। লাইলাক ফুলগুলো ভীষণ রকমের আকার আকৃতিহীন, বিসদৃশ্য এক সৃষ্টি।

“আর ওই বেঁটে টিউলিপগুলো নেবো। ওই যে লাল আর সাদা রঙের গুলো।”

ফুল কেনা শেষ হলে রোজমেরীর পেছন পেছন গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে যাবে দোকানের রোগা-পাতলা মেয়েটি। মেয়েটির কোলে থাকে কাগজে মোড়ানো প্যাকেটে অনেক অনেক ফুলের ভার, দেখে মনে হবে লম্বা একটি কাপড়ে পেঁচিয়ে মানব শিশু নিয়ে হাঁটছে রুগ্ন মেয়েটি……..

একদিন শীতের সময় বিকেলে রোজমেরি কার্জন স্ট্রিটের একটি ছোট্ট এন্টিক শপে গিয়েছিলো নতুন কী কী এসেছে দেখতে। বরাবর দোকানটা তার খুব পছন্দের। তার একটি কারণ ছিল, দোকানের জিনিসগুলো সত্যি পছন্দ করার মতো। দ্বিতীয় আরেকটি কারণ ছিল, দোকানের মালিক ভদ্রলোকটি রোজমেরিকে দেখলে খুশিতে যেন দিশেহারা হয়ে যেত। রোজমেরি যখন গাড়ি থেকে নেমে দোকানে ঢুকতো, লোকটি নিজের মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করতে গিয়ে একেবারে মাটিতে বসে পড়তো। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠতো। খুশিতে এতটাই আত্মহারা হয়ে যেত লোকটি যে তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বেরুতে চাইতো না। চাটুকারিতা বলবো! অবশ্যই। রোজমেরিকে দেখলে সবাই এরকম করে উঠে। কিছু একটা আছে মেয়েটির ভেতর ……

“এটা দেখেন ম্যাডাম,” ক্ষীণস্বরে বলে লোকটি, “আমার দোকানের সবজিনিস আমি খুব ভালোবাসি ম্যাডাম। নিজের কাছ থেকে এদেরকে আলাদা করে যদি কাউকে দিতে হয় তাহলে আমি এদেরকে এমন কারো হাতেই তুলে দিতে চাই যাদের এইসব জিনিসের মূল্য বোঝার মতো দুর্লভ অনুভূতি আছে……।”

তারপর সে আরেকটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীল ভ্যালভেটের চারকোনা কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটিকে রোজমেরীর দিকে ঠেলে দিলো তার ফ্যাকাশে আঙুলের ডগা দিয়ে।


আরো পড়ুন: ইরানী কবি ফোরাহ ফারুখজাদের কবিতা

আজকের বস্তুটি একটা ছোট গয়নার বক্স। রোজমেরীর জন্যই রেখে দিয়েছিলো সে এটাকে। কোন কাস্টমারকে দেখায়নি এখন পর্যন্ত। মিনা করা অপূর্ব সুন্দর একটি বাক্স, দেখে মনে হয় ক্রিম দিয়ে বানানো। বাক্সের ঢাকনার উপরে ক্ষুদে একটি মেয়ে ফুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, তার গলায় একটি অস্ত্র ঝোলানো। মেয়েটির মাথায় সবুজ ফিতার যে টুপি পরানো হয়েছে, তা জেরানিয়ামের পাপড়ির চেয়ে বড় হবে না। আর তার মাথার উপর দেবদূত প্রহরীর মতো ভেসে আছে গোলাপি মেঘ।

রোজমেরি ওর হাতমোজা দুটি খুলে ফেললো। এইসব দুর্লভ বস্তু খুঁটিয়ে দেখার সময় সে হাতমোজা খুলে ফেলে। কোন সন্দেহ নেই, বাক্সটি তার পছন্দ হয়েছে। খুবই পছন্দ হয়েছে; ওটা ওর কাছে সংগ্রহে রাখার মতো একটি দারুন জিনিস। ছোট্ট বাক্সটিকে সামনে পিছনে ঘুরিয়ে, ঢাকনা খুলে, ঢাকনা বন্ধ করে যতবার দেখছিলো, ততবার নীল ভ্যালভেটের উপরে নিজের আঙুলগুলোর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো রোজমেরি। দোকানদার লোকটিও যেন তার দৃষ্টির গহব্বরের অন্ধকারে তীক্ষ্ণ আলোর মতো রোজমেরীর মনের কথাটি বুঝতে পেরেছিলো। তাই সে কাউন্টারের উপর ভর দিয়ে একটি পেন্সিল ঠেলে দেয় রোজমেরীর দিকে, পেন্সিলকে ধরে থাকা তার রক্তহীন ফ্যাকাশে আঙ্গুলগুলো নেড়ে সে রোজমেরিকে হালকা সুরে বলে: “ম্যাডাম মেয়েটির গায়ের উপর ফুলগুলোকে ভালো করে দেখুন একবার।”

“অপূর্ব!” রোজমেরি ফুলগুলোর প্রশংসা করে। “কিন্তু দাম কত?” দোকানদার যেন কথাটি শুনতে পেলো না। কিছুক্ষণ পর অবশ্য মৃদু আওয়াজ আসে রোজমেরীর কানে, “আটাশ
গিনি, ম্যাডাম।”

“আটাশ গিনি।” রোজমেরি কথা না বলে বাক্সটি কাউন্টারের উপর রেখে দিলো। নিঃশব্দে হাতমোজা দুটি পরে নিলো আবার। আটাশ গিনি। কেউ যদি সাংঘাতিক পয়সাওয়ালা হয়, তবুও …..

রোজমেরি শূন্য চোখে দোকানদারের মাথার পেছনে একটি এন্টিক চায়ের কেটলির দিকে তাকিয়ে রইলো। আর স্বপ্নের মতো আচ্ছন্ন স্বরে বলে: “ঠিক আছে, বাক্সটা আমার জন্য রেখে দেবেন ভেতরে। পারবেন? আমি ……. “

রোজমেরি কথা শেষ করার আগেই দোকানেরদার মাথা নুইয়ে সম্মতি জানায়, যেন এইরকম একটি গয়নার বাক্স পৃথিবীতে একমাত্র রোজমেরীর জন্যই রাখার কথা। প্রয়োজনে সে চিরকাল বাক্সটিকে রেখে দেবে তার জন্য।

দোকানের দরজাটি ক্লিক করে বন্ধ হয়ে আছে। রোজমেরি বাইরে তাকায়। শীতের সেই বিকেলে বৃষ্টি পড়ছিলো এবং বৃষ্টির সাথে মনে হচ্ছিলো কালো অন্ধকারও নেমে এসেছে। মলিন ছাইয়ের মতো অন্ধকার চারপাশ ছেয়ে ফেলেছে। বাতাসে কেমন একটা শীতল তিক্তস্বাদ মাখা। সদ্য জ্বলে উঠা ল্যাম্পগুলো দেখে মনে হচ্ছে ওদের মন খারাপ। রাস্তার উল্টোপাশের ঘরগুলোতে যে বাতি জ্বলছিল, মনে হচ্ছে তাদের মন খারাপ। চতুর্দিকে সব আলোরা এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তারা সবাই কোন অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়ে জ্বলছে। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া লোকগুলোসব তাদের ঘৃণ্য ছাতার তলায় মুখ লুকিয়ে দ্রুত পালাচ্ছে এদিক সেদিক। রোজমেরি এক অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব করে। গলার মাফলারটি বুকের সাথে চেপে ধরে; ইচ্ছে হচ্ছে এইমুহূর্তে গয়নার বাক্সটিও যদি এইভাবে হাতের মুঠোয় চেপে রাখতে পারতো সে!

রোজমেরির গাড়িটা কাছেই অপেক্ষা করছিলো। ফুটপাতটি পার হলেই গাড়িতে গিয়ে বসতে পারে। কিন্তু রোজমেরি দোকানের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকে। পরিস্থিতি, জীবনে এমন ভয়ঙ্কর কিছু পরিস্থিতি আসে যখন মানুষ তার চিরচেনা নিরাপদ আশ্রয় থেকে মাথা উঁচু করে চারপাশের অজানা পৃথিবীতে চোখ রাখে। আর সেই অনুভূতি খুব ভয়ঙ্কর। মানুষকে তখন সেই অনুভূতি থেকে সাবধানে বেঁচে আসতে হয়। একটি দুর্ঘটনা ঘটার আগে মানুষটিকে তখন নিজের নিরাপদ গৃহে পৌঁছে যেতে হয় দ্রুত আর তার প্রয়োজন হয় চমৎকার এক কাপ চা।

এই চিন্তাটি রোজমেরির মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে উপস্থিত হলো মেয়েটি। একটি অল্প বয়সী মেয়ে, রোগা শরীর, অপরিচ্ছন্ন ময়লা চামড়া – কোথা থেকে এলো মেয়েটি? – রোজমেরির কনুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটির কণ্ঠস্বর দীর্ঘশ্বাসের মতো ক্লান্ত, প্রায় কাঁকড়ার মতো শ্বাস ফেলল: “ম্যাডাম, আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?

“আমার সাথে?” রোজমেরি ঘুরে দাঁড়ায়। তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শীর্ণ প্রাণীটির মুখে প্রকান্ড একজোড়া চোখ। অল্প বয়স। রোজমেরির থেকে বয়সে বড় হবে না কোনভাবেই। মেয়েটি তার রক্তাভ হাতজোড়া দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে কোটের কলার, আর এমনভাবে কাঁপছিলো তার গোটা শরীর, মনে হচ্ছিলো যেন সে এইমাত্র ঠান্ডা পানির পুকুর থেকে উঠে এসেছে।

“ম – ম্যাডাম,” তোতলাতে থাকে মেয়েটি, “আমাকে এক কাপ চা খাবার পয়সা দেবেন দয়া করে?”

“এক কাপ চা?” মেয়েটির কণ্ঠে কেমন একটা সাধারণ সারল্য, আন্তরিকতা ছিল; সেটাকে কিছুতেই ভিক্ষুকের স্বর বলা যায় না।

“তোমার কাছে কোন পয়সা নেই?” রোজমেরি প্রশ্ন করে।

“একটি পয়সাও নেই ম্যাডাম,” উত্তর আসলো।

“অন্যরকম একটি সন্ধ্যা, অসাধারণ!” বাইরে ঘোলা অন্ধকারে চোখ রাখে রোজমেরি আর মেয়েটি তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে রোজমেরির দৃষ্টি অনুসরণ করে। অসাধারণের চেয়েও বেশি কিছু। আচমকা রোজমেরির মনে হলো আজকের সন্ধ্যার পুরো ব্যাপারটি একটি অন্যরকম এডভেঞ্চার হবে। রীতিমত দস্তয়েভস্কির উপন্যাস থেকে উঠে আসা ঘটনার মতো আজ এই অন্ধকারে মেয়েটির সাথে তার দেখা হওয়া। মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলে কেমন হয়? এতদিন গল্পের বইয়ে পড়া কিংবা মঞ্চে দেখা নাটকের মতো একটা কিছু করলো না হয় সে মেয়েটির সঙ্গে? কেমন হবে? খুব রোমাঞ্চকর হবে।

ভাবতেই রোজমেরি নিজের কানে শুনতে পায় সে তার বান্ধবীদের কাছে গর্বিত সুরে বলছে: “মেয়েটিকে আমি সোজা আমার বাড়িতে নিয়ে গেলাম,” ম্লানমুখের মেয়েটির কাছে এগিয়ে গিয়ে রোজমেরি বললো, “আমার বাড়িতে চলো চা খাবে।”

মেয়েটি চমকে পেছন ফিরলো। আশ্চর্যজনক কথাটি শুনে মুহূর্তের জন্য তার শরীরের কাঁপনও থেমে গিয়েছে। রোজমেরি নিজের একটি হাত রাখে মেয়েটির কাঁধে। “আমি সত্যি বলছি তোমাকে,” স্মিত হাসি হাসে রোজমেরি। নিজেই টের পেলো তার কণ্ঠস্বর খুব নরম আর আন্তরিকতায় মাখা।

“অসুবিধা কি? চলো। আমার সাথে গাড়ি করে আমার বাড়িতে, সেখানে বসে এক কাপ চা খাবে।”

“আপনি – আপনি সত্যি বলছেন না,” মেয়েটি বলে, তার কণ্ঠে কষ্টের ছোঁয়া।

“আমি কিন্তু সত্যি বলছি আমার বাড়ি চলো,” আর্তনাদ করে উঠে রোজমেরি। “আমি বলছি তুমি এসো আমার সাথে। আমি খুশি হবো। চলো আমার সাথে।”

মেয়েটি তার ঠোঁটে নিজের আঙ্গুল ছোঁয়ায়। রোজমেরিকে তার প্রকান্ড চোখ জোড়া দিয়ে গ্রাস করে ফেলে প্রায়। “আপনি – আপনি আমাকে থানায় নিয়ে যাবেন না তো?” আবার তোতলাতে থাকে মেয়েটি।

“থানা!” জোরে হেসে ফেলে রোজমেরি। “কেন আমি অমন নিষ্ঠুর হবো তোমার সাথে বলো? তেমন কিছু চিন্তা নেই আমার মাথায়। এই ঠান্ডায় আমি তোমাকে গরম পরিবেশে একটু আরাম দিতে চাই। আর তোমার কোনো গল্প থাকলে আমি সেসব কথা শুনবো।”

ক্ষুধার্ত মানুষকে বশ করা সহজ। পাইক গাড়ির দরোজা খুলে রেখেছিলো আর একটুপরেই তারা অন্ধকারের ছাইয়ের ভেতর দিয়ে সরসর করে এগিয়ে চলতে লাগলো।

“এই যে,” নিজেকে বলে রোজমেরি। নিজের হাতে মখমলের চাবুকের অস্তিত্ব আর বুকের ভেতর বিজয়ের উল্লাস অনুভব করে। সরাসরি বলতে পারতো, “এই যে, তোমাকে পেয়েছি আমি এখন,” জালে আটকানো ছোট্ট প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে সে। কিন্তু অবশ্যই রোজমেরি করুণা দেখিয়েছে মেয়েটিকে। আর করুণা বা দয়ার চেয়েও বেশি যা তা হলো…..। রোজমেরি আসলে দরিদ্র মেয়েটিকে একটি ছোট্ট প্রমাণ দিতে চেয়েছিলো – প্রমাণটা এমন যে, গল্পে পড়া পৃথিবীর আশ্চর্য ঘটনাগুলো মানুষের জীবনে সত্যিই ঘটে। রূপকথার পরীরা জীবন্ত হয়, আর ধনী মানুষদেরও মন নামক বস্তুটি আছে। আবার সকল মেয়েরা পরস্পরের বোনের মত। রোজমেরি আবেপ্রবণ হয়ে মেয়েটির দিকে ঘুরে বলে, “ভয় পেয়ো না।”

“তাছাড়া চিন্তা করে দেখো, কেন তুমি আসতে না আমার সাথে? আমরা দুজনই মেয়ে। আমি যদি তোমার চেয়ে বেশি ভাগ্যবতী হয়ে থাকি তাহলে অবশ্যই তোমার আমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করা উচিত ….” কিন্তু আনন্দের সাথে শুরু করা কথাটি এই মুহূর্তে কিভাবে শেষ করবে তা বুঝতে পারে না রোজমেরি।

অবশেষে গাড়িটি থামলো। বেল বাজলো। বাড়ির দরজা খুললো। খুব অস্থির ছোটাছোটির ভেতর রোজমেরি আজ তার নিজের বাড়ীর সবখানে নতুন করে চোখ মেলে দেখে। ঘরের ভেতর নরম উষ্ণতার সাথে মিষ্টি একটি গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে সবখানে। বাড়ির সবকিছু আগের মতোই আছে কিন্তু রোজমেরি আগে কখনো এদেরকে এমন করে দেখেননি। এমন করে ভাবেনি। উপলব্ধি করেননি। আজ বুঝতে পারছে এই বাড়িতে বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করলে তারা কেমন অনুভব করে। মনটা চনমনে হয়ে গেলো তার। নিজেকে রোজমেরির মনে হচ্ছিলো সে যেন নার্সারির সবচেয়ে ধনী বাচ্চা মেয়েটি, যে আলমারীর সবগুলো বন্ধ দরজা এখন নিজের হাতে খুলবে একটি একটি করে, আর সেখানে সবগুলো বাক্স খুলে বের করে দেখবে ভেতরের গুপ্তধন।

“এসো, উপরে এসো,” রোজমেরি মেয়েটিকে ডাকে, নিজের মনে খুব উদার হতে আরম্ভ করেছে সে, “আমার ঘরে এসো।”

বাড়ির কাজের লোকগুলোর অবাক চোখ সরছিল না মেয়েটির উপর থেকে। রোজমেরি বুঝলো এদের এই দৃষ্টি থেকে মেয়েটিকে বাঁচানো প্রয়োজন। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে রোজমেরি সিদ্ধান্ত নেয় সে এই মেয়েটিকে আবিষ্কার করবে ধীরে ধীরে। কোন তাড়াহুড়ো করবে না। আলাদিনের দৈতকেও ডেকে আনবে না সে এর রহস্য উদ্ঘাটন করতে। একেকটি দুর্দান্ত আবিষ্কার, খুব প্রাকৃতিকভাবেই আবিষ্কৃত হতে হয়।

নিজের রুমে ঢুকে আজ খুশিতে চোখে পানি চলে আসে রোজমেরীর! কী সুন্দর পর্দা টানানো শোবার ঘর। বার্নিশ করা আসবাবপত্রগুলোতে আলোর প্রতিবিম্ব যেন আগুন জ্বেলেছে। ঘরের সোনার কুশন আর প্রিমরোজ আর নীল কার্পেট! মেয়েটির মনে হয় চোখে ধাঁধা লেগে গেছে, সে ভেতরে আসে না। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। অবশ্য ব্যাপারটা রোজমেরীর খারাপ লাগে না।

“ভেতরে এসো, এখানে বসো,” আহ্বান করে মেয়েটিকে। রোজমেরি তার প্রিয় বিশাল চেয়ারটিকে টেনে ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা ফায়ার প্লেসের কাছে নিয়ে যায়। “এই চেয়ারে বসো। তোমার শরীরটা গরম হবে। তোমাকে দেখতে মনে হচ্ছে তুমি ঠান্ডায় জমে আছো।”

“আমার সাহস হচ্ছে না ম্যাডাম,” মেয়েটি বলে উঠলো, আর কয়েক পা পিছিয়ে গেলো।

“ও, প্লিজ,” দৌড়ে মেয়েটির কাছে এগিয়ে যায় রোজমেরি, “ভয় পেয়ো না। ভয় পাবার কিছু নেই, সত্যি। বসো এখানে, আমি কাপড় বদলে আসছি, তারপর আমরা পাশের রুমে গিয়ে চা খাবো আর গল্প করবো। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?” বলতে বলতে রোজমেরি রোগ পাতলা প্রাণীটাকে হালকা হাতের ধাক্কায় তুলতুলে চেয়ারটিতে ফেলে দিলো।

কোনো প্রতিবাদ এলো না। মেয়েটিকে চেয়ারে যেভাবে বসিয়ে দেয়া হয়েছে সে পুতুলের মতো ঠিক সেইভাবেই বসে রইলো। তার হাতদুটি দুই দিকে পড়ে রয়েছে আর মুখটি সামান্য হা করা। সত্যি কথা বললে, মেয়েটিকে দেখতে খুব হাস্যকর লাগছিলো। কিন্তু রোজমেরীর তখন এসব কিছু চোখে পড়লো না। সে মেয়েটির গায়ের উপর ঝুকে বললো, “তুমি তোমার টুপিটি খুললে না তো? তোমার সুন্দর চুলগুলো সব ভিজে আছে। আর ঘরের ভেতর টুপি ছাড়াই বেশি ভালো লাগে, তাই না?”

ফিসফিসে একটি কণ্ঠে কেউ বলে, “টুপি ছাড়া বেশি ভালো লাগে, ম্যাডাম,” ছেঁড়া, বাঁকা টুপিটি মাথা থেকে খুলে ফেলা হলো।

“দাও, আমি তোমার কোটটিও খুলে দেই,” রোজমেরি এগিয়ে যায়।

মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়ায়। কিন্তু সে একহাতে চেয়ারের একপাশের হাতলে ভর দিয়ে কাত হয়ে থাকলো আর বাকিটুকু রোজমেরি করলো। মেয়েটিকে সে টেনে তুলে দাঁড় করালো। কাজটা রোজমেরীর জন্য বেশ পরিশ্রমের ছিল। কারণ একপক্ষ নিজেকে শিশুর মতো হাত পা নেতিয়ে বিছিয়ে রেখেছিলো। রোজমেরির মনে হলো, কেউ যখন অন্যের সাহায্য চায় তাকেও কিছুটা এগিয়ে আসা প্রয়োজন, তা না হলে সাহায্য করার কাজটি খুব দুরূহ হয়ে পড়ে। তাছাড়া এই কোটটিকে নিয়ে সে এখন কী করবে? ফেলে দিলো মেঝের উপর। টুপিটাকেও। রোজমেরি যখন একটি সিগারেট বের করতে যাচ্ছিলো ঠিক তক্ষুনি মেয়েটি গোঙানির স্বরে খুব দ্রুত বলে উঠলো: “আমি খুব দুঃখিত ম্যাডাম, আমি এখন অজ্ঞান হয়ে যাবো। আমার হাতে সময় কম। আমাকে এখনই কিছু খেতে হবে।”

“হায় ঈশ্বর, আমি কতো নির্বোধ!” রোজমেরি দৌড়ে গিয়ে বেল বাজালো। “চা! এক্ষুনি চা আনো। আর একটু ব্র্যান্ডি, জলদি!”

কাজের মেয়েটি চলে গেলো চা আনতে। কিন্তু ঘরের মেয়েটি কেঁদে ফেললো আবার: “না, আমি ব্র্যান্ডি খাবো না। আমি কখনো ব্রান্ডি খাইনি। আমি শুধু এক কাপ চা চাই ম্যাডাম।” কথা শেষ করে হাউমাউ কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।

পুরো ঘটনাটি খুব সাংঘাতিক ছিল। আবার মিষ্টিও বলতে হয়। রোজমেরি মেয়েটির চেয়ারের পাশে হাঁটু ভেঙে বসলো। “এমন অসহায়ের মতো কেঁদো না। কাঁদার মতো কিছু হয়নি,” বলে মেয়েটির দিকে তার জরির লেইস লাগানো মসলিনের রুমালটি এগিয়ে দিলো। তখন রোজমেরি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নিজের হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটির পাখির মতো চিকন রুগ্ন কাঁধখানি।

যাক অবশেষে মেয়েটির লজ্জা ভাঙে। অবশেষে সে বুঝলো তারা দুজনেই নারী। আর তাই সে হাঁফ ছেড়ে বললো, “আমি এসব আর সহ্য করতে পারছি না। আমি নিতে পারছি না একদম। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”

“তোমাকে কিছুই করতে হবে না। আমি তোমাকে অনেক যত্ন করবো। তুমি আর কাঁদবে না। কেন বুঝতে পারছো না আমার সাথে তোমার দেখা হয়ে যাওয়াটা কত ভালো হয়েছে তোমার জন্য। আমরা একসাথে চা খাবো। তুমি আমাকে সব কথা বলবে। আমি তোমার জন্য একটা কিছু ব্যবস্থা করবো। কথা দিলাম। এখন কান্না থামাও। প্লিজ!”

চা আসার সাথে সাথে মেয়েটি কান্না থামালো। টেবিলের দুইপাশে বসেছে তারা দুজন। রোজমেরি মেয়েটির প্লেটে একে একে তুলে দিলো বাটির সবগুলো স্যান্ডউইচ, মাখন ও পাউরুটি। যতবার মেয়েটির কাপ খালি হয়ে যাচ্ছিলো, রোজমেরি নিজের হাতে ততবার তার কাপে চা, ক্রিম আর চিনি ঢেলে দিলো, ভরে ভরে।

সবাই বলে চিনি নাকি মানুষকে চাঙ্গা করে। রোজমেরি নিজে কিছু খেলো না; সে একটি সিগারেট ধরিয়ে আড়চোখে লুকিয়ে মেয়েটির খাওয়া দেখতে থাকে। মেয়েটি যেন বুঝতে না পারে রোজমেরি ওকে দেখছে। হালকা এই খাবারটুকুর ফল হলো মারাত্মক। চায়ের টেবিল থেকে যখন মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো, রোগা-পাতলা শরীর, জট পাকানো চুলের মাথা, কালো ঠোঁট, খুব হালকা ও পলকা ব্যক্তিত্বের মেয়েটি যখন আবার রোজমেরির ঘরে চেয়ারে গিয়ে বসলো, তখন দেখা গেলো তার সুবিশাল চোখ জোড়াতে কেমন উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। রোজমেরি আরেকটি সিগারেট ধরায়। এবার কথা বলার সময় এসেছে।

“এখন বলো, তুমি লাস্ট কখন খেয়েছিলে?” খুব নরম সুরে জানতে চায় রোজমেরি।

সেই মুহূর্তে ঘরের দরজার হ্যান্ডেলটি ঘুরে গেলো।

“রোজমেরি, আমি কি ভিতরে আসতে পারি?” ফিলিপ এসেছে।

“অবশ্যই।”

ফিলিপ ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। “ওহ, আমি সরি,” বলে ফিলিপ কথা থামিয়ে তাকিয়ে থাকে।

“কোন অসুবিধা নেই,” রোজমেরি হেসে বলে। “এ হচ্ছে আমার বন্ধু, মিস- “

“স্মিথ, ম্যাডাম,” নিষ্প্রভ মুখের মেয়েটি বলে উঠলো। মেয়েটি এখন আশ্চর্যরকমের শান্ত আর ভয়শূন্য।

“স্মিথ,আমরা এখন একটু গল্প করবো,” রোজমেরি বলে।

“ওহ- হ্যাঁ,” ফিলিপ বলে, “বেশ,” মেঝের উপরে পড়ে থাকা কোট আর টুপিটির দিকে চোখ যায় তার। ফায়ার প্লেসের আগুনের কাছে গিয়ে ফিলিপ আবার ঘুরে দাঁড়ায়, “খুব জঘন্য একটি সন্ধ্যা আজ,” কথাটি বলে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে নির্জীব প্রাণীটির দিকে। প্রাণীটির হাত দেখে, পায়ের জুতো দেখে, তারপর তাকায় রোজমেরির দিকে।

“হ্যাঁ ঠিকই বলেছো, তাই না?” রোজমেরিও গলা ছড়িয়ে বলে,”জঘন্য আবহাওয়া।”

ফিলিপ একটি কমনীয় হাসি হাসল। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কি আমার সাথে একটু লাইব্রেরিতে আসতে পারবে এখন? জরুরি কথা ছিল। মিস স্মিথ, কিছু মনে করবেন না তো?”

প্রকান্ড চোখ জোড়া ফিলিপের দিকে তাকিয়ে থাকে। যদিও কথাটির উত্তর দিলো রোজমেরি,
“আমি আসছি।”

তারা দুইজন একসাথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

লাইব্রেরীর ঘরে যখন ওরা দুজন একা হলো, ফিলিপ জানতে চায়, “তুমি আমাকে বলবে মেয়েটি কে? এসব কী হচ্ছে এখানে?”

রোজমেরি দরজার পিঠে হেলান দিয়ে হাসতে আরম্ভ করলো। বললো: “মেয়েটিকে আমি কার্জন স্ট্রিট থেকে তুলে এনেছি। সত্যি বলছি। তুলে আনার মতোই একটি জিনিস বটে। মেয়েটি আমার কাছে চা খাবার পয়সা চেয়েছিলো। আমি তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছি।”

ফিলিপ চিৎকার করে উঠলো বিস্ময়ে, “কিন্তু এই জিনিসটাকে নিয়ে তুমি কী করবে?”

ফিলিপিকে আর কোন বাজে কথা উচ্চারণ করার সুযোগ না দিয়ে রোজমেরি খুব দ্রুত বলে উঠলো, “ওর সাথে তুমি ভালো ব্যবহার করবে। খুব সুন্দর আচরণ করবে মেয়েটির সাথে। ওকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। কিভাবে, কবে তা জানি না। আমার এখনো কথা হয়নি মেয়েটির সাথে। কিন্তু তুমি ওকে সম্মান দেখাবে – শ্রদ্ধা করবে – মেয়েটি যেন মনে করে- “

“আমার প্রিয় প্রেমিকা, তুমি একটা পাগল। তুমি নিজেও জানো এই কথা। কিন্তু তুমি যা যা বললে, আমার পক্ষে তা করা সম্ভব না।”

“আমি জানতাম তুমি এমন কিছুই বলবে। কিন্তু কেন পারবে না? আমার একটা ইচ্ছে হয়েছে, এটাই কী যথেষ্ট না? আর তাছাড়া, আমরা তো এমন সব ঘটনা হরহামেশাই বইয়ে পড়ি। তাই আমি ঠিক করেছি – “

“কিন্তু,” ফিলিপ একটি শুকনো সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে বললো, ” মেয়েটি আশ্চর্যরকমের সুন্দরী।”

“সুন্দরী?”

ফিলিপের কথায় রোজমেরি এতটাই অবাক হলো যে তার মুখ লাল হয়ে গেলো। “তোমার কাছে তাই মনে হয়? আমি – আমি অবশ্য সেটা খেয়াল করিনি।”

“হায় ঈশ্বর!” একটি ম্যাচের কাঠি দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরায় ফিলিপ, “মেয়েটি চোখ জুড়িয়ে যাবার মতো রূপবতী। ডার্লিং, তুমি মেয়েটিকে গিয়ে আরেকবার ভালো করে দেখো। তোমার ঘরে ঢুকে আমি আরেকটু হলে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলাম। তাছাড়া ….. আমার মনে হয় তুমি একটি মারাত্মক ভুল করতে যাচ্ছ। উত্তেজনার বশে এতক্ষণে উনাকে কোন অশ্লীল কথা বলে থাকলে আমি সরি, ডার্লিং। কিন্তু দাড়াও, আমি এক্ষুনি গিয়ে মিস স্মিথকে জিজ্ঞেস করে আসি তিনি আজ রাতে আমাদের সাথে ডিনার করতে পারবেন কিনা!”

“তুমি একটা অবিশ্বাস্য ক্যারেক্টার,” বলে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে যায় রোজমেরি। কিন্তু সে তার নিজের ঘরে গেলো না যেখানে মেয়েটি বসে আছে। বরং রোজমেরি তার ছোট্ট লেখার ঘরটিতে গিয়ে নিজের ডেস্কে বসে রইলো কিছুক্ষণ।

সুন্দরী! মেয়েটি অবশ্যই মিষ্টি! মাথা ঘুরে যাবার মতো রূপবতী! রোজমেরির হৃদয়ে ঘন্টা বাজতে থাকে ভারী হয়ে। সুন্দরী! মিষ্টি! নিজের চেক বই বের করলো। কিন্তু না, চেকে কোন কাজ হবে না। সে ড্রয়ার খুলে পাঁচ পাউন্ডের পাঁচটি নোট হাতে নিলো। দুইটি নোট আবার ড্রয়ারে রেখে দিয়ে তিনটি নোট হাতের ভিতর খামচে ধরে নিজের শোবার ঘরে গেলো। আধঘন্টা পর রোজমেরি যখন লাইব্রেরিতে গেলো, ফিলিপ তখনো সেখানেই ছিল।

“আমি আপনাকে জানাতে এসেছি যে,” লাইব্রেরীর দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে আর নিজের চোখের তারায় প্রেমের বিচ্ছুরণ ছিটিয়ে রোজমেরি বলে, “মিস স্মিথ আজ রাতে আমাদের সাথে খাচ্ছেন না।”

হাতের কাগজটি নামিয়ে রেখে ফিলিপ বলে, “কেন, কী হয়েছে? উনার কি অন্য কোথাও নিমন্ত্রণ আছে?”

ফিলিপের পাশে এসে রোজমেরি তার হাঁটুর উপর বসলো। “উনি চলে যেতে চাইলেন। তাই আমি গরিব বেচারিকে কিছু পাউন্ড উপহার দিলাম। আমি তো আর উনাকে উনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রাখতে পারি না, তাই না?” হালকাভাবে বলে।

এইমাত্র রোজমেরি চুল বেঁধে এসেছে, চোখে হালকা রং, আর গলায় পড়েছে মুক্তোর মালা। নিজের আঙুলে ফিলিপের গাল স্পর্শ করে বলে, “আমাকে তোমার ভালো লাগে?”

রোজমেরির স্পর্শ, আবেদনময়ী কণ্ঠের মিষ্টি ছোঁয়া, বাঁকা চাহনি, ফিলিপকে এবার বিপদে ফেললো। নিজের দুইহাতে রোজমেরিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, “আপনাকে আমার সাংঘাতিক রকমের ভালোলাগে। এখন একটি চুমু দাও।”

এরপর হালকা বিরতি।

রোজমেরি যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে বলে, “আজকে আমি এন্টিক শপে একটা গয়নার বাক্স দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। ওটার দাম আটাশ গিনি। আমি কি ওটা কিনতে পারবো?”

নিজের হাঁটুর উপরে বসা রোজমেরিকে হালকা একটি ঝাকুনি দিয়ে ফিলিপ বললো, “পারো, মাঝেমধ্যে তুমি একটু অপব্যয় করতে পারো বৈকি।”

রোজমেরি কিন্তু এই কথাটি জানার জন্য অমন উদগ্রীব হয়ে ছিলো না তখন।

“ফিলিপ,” নিজের বুকের সাথে ফিলিপের মাথা চেপে ধরে রোজমেরি তার কানের কাছে ফিসফিস করে প্রশ্ন করে, “আমি কী সুন্দরী?”

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত