| 28 নভেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত প্রবন্ধ এই দিনে

কিভাবে ও কেন আমি হিন্দুধর্ম স্বীকার করলাম: ভগিনী নিবেদিতা 

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আজ ২৮ অক্টোবর ভগিনী নিবেদিতার শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় বিনম্র শ্রদ্ধা। বিশেষ দিনে  ইরাবতীর পাঠকদের জন্য জয়া চৌধুরী অনুবাদ করেছেন How and why I adopted the Hindu Religion (কিভাবে ও কেন আমি হিন্দুধর্ম স্বীকার করলাম) ভগিনী নিবেদিতার  একশত  সতের বছর আগের একটি বক্তৃতা ১৯০২ সালে ২ রা অক্টোবর এই বক্তৃতাটি তিনি বোম্বাইয়ের হিন্দু লেডিজ সোস্যাল ক্লাবে দিয়েছিলেন।


আমি জন্ম থেকে আঠেরো বছর বয়স পর্যন্ত একজন ইংরেজ নারী হিসাবে প্রতিপালিত ও বড় হয়েছিলাম। ইংরেজ বালিকারা যেমন হয় ঠিক সেভাবে আমায় শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। খৃষ্টধর্মের নীতিগুলি অবশ্যই অতি শৈশবেই আমার ভেতর গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। খুব ছোটবেলা থেকেই সব ধর্মের অনুশাসনগুলির প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলাম। আত্মত্যাগের জন্য শিশু যীশুকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতাম ও মনপ্রাণ থেকে ভালবাসতাম।  মানবজাতির উদ্ধারের জন্য তিনি ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন একথা জেনেও আমি যখন তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতে পারি নি তখনও তিনি হাসিমুখে আমায় সয়ে গেছেন। খৃষ্টিয়ান নীতিগুলির সত্যতা সম্বন্ধে আমি প্রশ্ন তুলতে শুরু করি। অনেকগুলিই আমার কাছে নকল ও সত্যের সঙ্গে সাযুজ্যহীন মনে হতে থাকে। এই সন্দেহ দিনে দিনে যত বাড়তে লাগল খৃষ্টিয়ানিটির ওপর আমার বিশ্বাস তত নড়বড়ে হতে লাগল। সাত বছর আমি এরকম অব্যবস্থিত চিত্তে রয়ে গিয়েছিলাম। খুব অসুখী, কিন্তু ক্রমাগত সত্যের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। গির্জায় যাওয়া এড়িয়ে যেতে লাগলাম। তবু আমার শান্তি পাবার আকাঙ্ক্ষা আমায় বাধ্য করত গির্জার দোরগোড়ায় ছুটে যেতে। সেখানে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে অন্তরের শান্তি যাতে অনুভব করি তার চেষ্টা করতাম। আমার চারপাশের মানুষ যেমন করত, আমিও এতদিন যা করে এসেছি ঠিক সেরকম। কিন্তু হায়! কোনরকম শান্তি, সত্যকে খুঁজতে চেয়ে আমার আহত মনকে আশ্রয় দেবার মত কোন কিচ্ছু সেখানে পাওয়া যেত না।

এই সাত বছরের বিক্ষুব্ধ অবস্থা চলাকালীন আমার মাথায় একটি ভাবনা এল যদি প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়ি তাহলে যা খুঁজছি তা নিশ্চয় ওর মধ্যে পাওয়া যাবে। তখন আমি গভীর মনোযোগে পড়তে থাকি পৃথিবী কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল ইত্যাদি। আর সেগুলো সব পড়ে মনে হল প্রকৃতিতে অন্ততঃ নিয়মের সাযুজ্য আছে। কিন্তু তখন খৃষ্টধর্মকে আরো বেশি করে পারম্পর্যহীন মনে হতে লাগল। তখন হঠাত করে বুদ্ধের জীবনী বইটি আমার হাতে আসে। কিন্তু এখানেও দেখি এক শিশু এমনকী শিশু যীশুর জন্মেরও অনেক শতাব্দী আগে জন্মেছিলেন এবং এঁর আত্মত্যাগও যীশুর চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এই প্রিয় শিশু গৌতম বুদ্ধ আমার মনে বেশ জোরালোভাবে জায়গা করে নিল। পরবর্তী তিন বছর আমি বৌদ্ধধর্ম নিয়ে গভীর পড়াশোনায় ডুবে গেলাম। এবং আমিএই ধারণায় আরো আরো প্রভাবিত হলাম যে পরিত্রাণ বুদ্ধ প্রচার করেছিলেন তা খৃষ্টধর্ম প্রচারিত উপদেশগুলোর চাইতে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এইবার আমার জীবনের বিশ্বাসের গতিপথে মোড় এল। তোমাদের মহান ভাইসরয় লর্ড রিপনের এক তুতো ভাই আমায় আমন্ত্রণ করলেন একটি চায়ের আসরে। সেখানে ভারত থেকে কোন একজন মহান স্বামীজী এসেছেন এবং তিনি হয়ত আমার আত্মার এই অনুসন্ধানে কোন সাহায্য করতে পারবেন।  সেখানে যে স্বামীর সঙ্গে আমার পরিচয় হল তিনি আর কেউ নন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি পরে আমার গুরু হন। যার শিক্ষা আমার এত দিন ধরে সেই প্রশ্ন নিয়ে ব্যকুল ও সন্দেহাকুল আত্মাকে রেহাই দিল। প্রথম একটি কি দুটি সাক্ষাতেই আমার মনের সন্দেহ তিনি নিরসন করে দিয়েছিলেন। ওহ্‌ না না! আমার বেশ কটি উষ্ণ আলোচনা ঘটে তাঁর সঙ্গে, এবং তাঁর শিক্ষার ওপর অনুসন্ধান করতে গিয়ে একটি বছর ব্যয় করি। তারপর তিনি আমায় ভারত দর্শন করতে বলেন। সেখানকার যোগীদের দেখতে বলেন। তাঁর জন্মভূমিতে থেকে বিষয়টি অনুধ্যান করতে বলেন। আর আমি তখন দেখলাম অন্তত এই বিশ্বাসটিতে আমি নির্ভর করতে পারছি। যতদিন না পরমানন্দের সঙ্গে আমার আত্মার মিলন ঘটে ও মুক্তিলাভ হয় ততদিন আমি বিশ্বাসে ভর করে থাকতে পারি? এখন আমি তোমাদের বললাম আমি কেন এবং কখন তোমাদের এই ধর্মকে নিজের করে নিই। তোমরা যদি আরও শুনতে চাও আমি তাহলে বলব। 

ভারতবর্ষকে আমি ভালবাসি কেননা সমস্ত উচ্চ ও শ্রেষ্ঠ ধর্মের জন্মস্থান এটি। ঠিক যেমনটি শ্রেষ্ঠ পর্বতশৃঙ্গ হিমালয় এদেশেই আছে। এখানেই সব মহিমময় পর্বতগুলি রয়েছে। এই সেই দেশ বাড়িগুলি যেখানে সরল, যেখানে সবচেয়ে বেশি গৃহশান্তি দেখা যায়। যেখানে নারী স্বার্থহীন ভাবে, বিচক্ষণতার সঙ্গে, বিরক্তি প্রকাশ না করে, ভোর থেকে শিশির পড়া পর্যন্ত প্রিয় মানুষদের সেবা করে, যেখানে মায়েরা, পিতামহী- মাতামহীরা পড়ে, ভবিষ্যদ্রষ্টা হয়ে তাদের সব জিনিষ সামলায় নিজের সুখের কথা না ভেবে আর এই নিঃস্বার্থপরতার ভেতর দিয়েই নারীত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সহত্বের জয়গান ঘোষিত হয়। 

হ্যাঁ আমার প্রিয় বোনেরা, এই ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছ বলে তোমাদের প্রত্যেককে আমি দারুণ ভালবাসি, প্রতিজনকে অনুরোধ করব পাশ্চাত্য সাহিত্যের বদলে এদেশের মহান সাহিত্যগুলি পড়। তোমাদের সাহিত্য তোমাদের উন্নত করবে। তাকে নির্ভর কর। তোমাদের বাড়ির ভেতরের সারল্য ও অপ্রমাদকে ভরসা কর। প্রাচীনকালে যেমন ছিল এখনও যেভাবে তোমাদের বাড়িগুলিতে আছে ঠিক সেভাবে এই পবিত্রতা ধরে রাখো।   

পাশ্চাত্যের আধুনিক বহির্মুখী বিলাস ও ব্যসন এবং আধুনিক ইংরিজী শিক্ষাকে তোমাদের সশ্রদ্ধ বিনয় নষ্ট করতে দিও না। তোমাদের পূর্বজরা তাদের ভালবাসার জনেদের জন্য যে পারস্পরিক বন্ধন আগে থেকেই ভেবে গঠন করে গেছে যার ফলস্বরূপ ছোট থেকে বড় পর্যন্ত সবার ভেতর সন্তানসুলভ ও কর্তব্যমূলক তফাৎ রক্ষা করে গেছেন তার ওপর নির্ভর কর। এই আবেদন শুধু আমি হিন্দু বোনেদের প্রতি রাখছি তা নয়, আমার মুসলমান ওএবং অন্যান্য ধর্মের বোনেদের প্রতিও রাখছি। আমার দত্তক নেওয়া দেশে জন্মানো সব নারীই আমার বোন বলে ভাবি এবং এখানেই আমার গুরু স্বামী বিবেকানন্দের কাজ করা চালিয়ে যাব।    

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত