ওমপ্রকাশ বাল্মীকি ও তাঁর পাঁচটি অনুবাদ কবিতা
ওমপ্রকাশ বাল্মীকি [ Omprakash Valmiki ]
উত্তর প্রদেশের মুজফফরনগর জেলার বরলা গ্রামে ১৯৫০ সালের ৩০শে জুন কবি ওমপ্রকাশ বাল্মীকির জন্ম। অত্যন্ত দারিদ্র্যে কেটেছে তাঁর প্রথম জীবন। তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় (ঠাকুর)-দের কাছ থেকে অবহেলা,অত্যাচার, বঞ্চনা দেখেছেন শৈশব থেকেই। দলিত পরিবারে জন্মগ্রহণ সূত্রে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্যকে নিয়তি বলে মেনে নেবার প্রবণতার ভয়াবহতাকে খুব অল্প বয়স থেকেই চিহ্নিত করেছিলেন কবি। শৈশব থেকে দেখা চারপাশের এই নিপীড়ন ও সামাজিক বৈষম্য ওমপ্রকাশকে খুব বিচলিত করত। তিনি বিশ্বাস করতেন, দলিতই দলিতের কষ্ট বুঝতে পারে। উচ্চবর্ণের মানুষরা ব্যবহার করে যে-কুয়ো, তার জলে ‘অন্ত্যজ’ হবার অপরাধেই অধিকার হারাতে হয় ; একই পঙক্তিতে সামাজিক অনুষ্ঠানে সকলের সাথে অংশগ্রহণও নিষিদ্ধ — এই সব প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করেই কবি পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন এবং হিন্দিতে এম.এ.পাশও করেন।
এম.এ.পাশ করার পর ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে যোগ দেন। চাকরিসূত্রেই বদলি হয়ে কিছু সময় মহারাষ্ট্রে থাকতে হয় কবিকে। সে সময়েই সেখানকার দলিত সাহিত্য চর্চার সংস্পর্শে আসেন। ড. ভীমরাও আম্বেদকরের রচনাবলিতে গভীর মনোনিবেশ করেন। তার পর থেকেই আমূল বদলে যায় তাঁর লিখনশৈলী। তাঁর আত্মকথা’জুঠন’ই তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। হিন্দি দলিত সাহিত্যে ওমপ্রকাশ বাল্মীকি হয়ে ওঠেন অন্যতম জনপ্রিয় এক নাম। তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর অত্যাচার তাঁকে ক্রুদ্ধ করত ; দলিত শ্রেণীর অসহায়তা তাঁকে অস্থির করত। ‘বর্ণব্যবস্থা কে মারে লোগ/ইস তরহ কিঁউ জীতে হ্যায়/তুম পরায়া কিঁউ লগতে হো উনহে/কভী সোচা হ্যায়?’ সরাসরি প্রশ্ন তুলতেন তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় স্পষ্ট হত দলিত সম্প্রদায়ের অসহায় ও নিষ্ক্রিয় অবস্থাটিও : ‘এক তুম হো/জিস পর কিসী চোট কা/ অসর নহী হোতা !’
কবিতা ছাড়াও গল্প, আলোচনা প্রভৃতি লিখেছেন। তাঁর ভাষা সহজ, আবেগময় হয়েও সরাসরি, ভণিতাহীন। লেখালিখি ছাড়াও নাটকে অভিনয় ও নির্দেশনায় আগ্রহী ছিলেন।
‘দলিত সাহিত্য কা সৌন্দর্য শাস্ত্র’ এই আলোচনা গ্রন্থের জন্য ১৯৯৩ সালে তাঁকে ড. আম্বেদকর রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। ‘সলাম’, এবং ‘ঘুসপেঠিয়ে’ এই দুটি গল্পগ্রন্থ ছাড়াও’সদিয়োঁ কা সন্তাপ’, ‘বস্ বহুত হো চুকা’, ‘অব অওর নহী’ প্রমুখ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
২০১৩ সালের ১৭ই নভেম্বরে কবি ওমপ্রকাশ বাল্মীকি প্রয়াত হন।
ইরাবতীর পাঠকদের জন্য ওমপ্রকাশ বাল্মীকির ‘কভী সোচা হ্যায়?’, ‘ওহ ম্যায় হুঁ’, ‘ঠাকুর কা কুঁয়া’, ‘কবিতা অওর ফসল’ এবং ‘চোট’ এই শিরোনামের পাঁচটি মূল হিন্দি কবিতা থেকে অনুবাদ করেছেন স্বপন নাগ।
কখনো ভেবেছো
তুমি তো মহান
তোমার কন্ঠ-নিঃসৃত সমস্ত শব্দই পবিত্র
এমনটাই মেনে নিয়েছিলাম
তুমি কত শত বই পড়েছো
অজস্র শব্দ আর তাদের অর্থ
সবই অনায়াস আয়ত্তে তোমার
সহিষ্ণুতা তোমার পরিচয়
এই যে বর্ণব্যবস্থা, তাকে তুমি আদর্শ মনে করো
তোমার বিশ্বাস আর সংস্কৃতিকে
ছেনাল বানিয়েছিল মার্কসবাদীরা
আর তাই, সাম্যবাদের পরাজয় হলে
খুশিতে উছলে ওঠো তুমি
রুশ ভেঙে খান খান হলে
আনন্দে তোমার বুক ফুলে ওঠে
হ্যাঁ, সত্যিই সহিষ্ণু তুমি
দাঙ্গায় মারা যাচ্ছে যখন
আবদুল আর কাসিম
মারা যাচ্ছে কাল্লু আর বিরজু
তুমি তখন সত্যনারাণের’কথা’শুনতে শুনতে
ভুলে যাও খবরকাগজটাও দেখতে
তুমি পুজো করো
গান্ধীর হত্যাকারীকে
আর দল বেঁধে ভাঙতে যাও ঈদগাহ্
কখনো ভেবেছো
এই বর্ণব্যবস্থারই অভিশাপে
পচা নোংরা নর্দমার পাশে ওরা
এভাবে বসত করে কেন ?
তোমাকে ওরা যে নিজের লোক ভাবে না,
ভেবে দেখেছো কখনো, কেন ?
আমিই সে
আমিই সে
সাতসকালে সাফসুতরো সড়কের
যে চমক —
সে আমি !
দক্ষ হাতে
খেলনা দেখে যেমন
পুলকিত হয় শিশুরা
যে-আনন্দ ঝিলিক দেয় তাদের মুখে —
সে আমি !
ক্ষেতের মাটিতে
অঙ্কুরিত অন্নের সুগন্ধ —
সে তো আমি !
সেই অন্ন, যা নিজের ঘর ভুলে
ঝাড়াই-বাছাই করে পৌঁছে দেয় ওরা
অন্যের ঘরে, আর
ঘরের বাচ্চারা কাঁদে খিদের জ্বালায়
সেই কান্নার মধ্যে যে-খিদে
সে আমি !
প্রতারিত-শোষিত মানুষের
ক্ষতবিক্ষত চেহারায়
ক্ষতেরই মত লেপ্টে আছে
সন্তপ্ত দিন
সে চেহারায় বেঁচে আছে তবুও
অবশিষ্ট যে-আশা
সে আমি !
বৃক্ষের শিকড়ে নদীর জল
রোদ্দুরে হাওয়ায়
শ্রমিক-শোণিত গন্ধ
বানের জলে ভেসে যাওয়া চালাঘরের কান্না
আর খরায় এ পৃথিবীর নিষ্ফলা হাহাকার
সেও আমি !
শুধু আমিই !!
ঠাকুরের কুয়ো
উনুন মাটির
মাটি পুকুরের
পুকুর ঠাকুরের।
খিদে রুটির
রুটি বজরার
বজরা ক্ষেতের
ক্ষেত ঠাকুরের।
বলদ ঠাকুরের
লাঙল ঠাকুরের
লাঙলের মুঠো আমার হাতে
ফসল কিন্তু ঠাকুরের।
কুয়ো ঠাকুরের
জল ঠাকুরের
ক্ষেতখামার ঠাকুরের
গলি-মহল্লা ঠাকুরের
আমার, তাহলে আমার কী ?
গাঁ ?
শহর ?
দেশ ?
আরো পড়ুন: বিশ্ব কবিতা দিবসে বিশ কবির অনুবাদ কবিতা
কবিতা ও ফসল
ঠান্ডাঘরে বসে
ঘাম নিয়ে কবিতা লেখা
ঠিক যেন
সাদা কাগজের ওপর
রাজধানীতে ফসল ফলানো।
ফসলই হোক কিংবা কবিতা
দুটিরই মধ্যে থাকে ঘামের স্বাক্ষর।
ঘাম ছাড়া ফসল
অথবা কবিতা
একেবারেই বেমানান।
মানুষের বিরুদ্ধে
মানুষের ষড়যন্ত্র —
অন্ধ, গভীর সমুদ্র সমান
যার তরাই জুড়ে
অসংখ্য হাত
ধারালো করছে তাদের নখ,
মুছে ফেলছে আঙুলে লেগে থাকা
তাজা রক্তের দাগ।
দাগ : যার কন্ঠস্বর পৌঁছয় না
নাতিশীতোষ্ণ ঘরের কামরায়,
পৌঁছতেই পারে না।
শুধু কবিতাই
শোনাতে পারে ঘামের মহাকাব্য ;
রৌদ্রদগ্ধ দুপুরেও
পৃথিবীর বুকে যে
ফসলের মুখে
লিখে রাখে সবুজের গান।
আঘাত
পাথুরে চাঁইয়ের ওপর
হাতুড়ির আঘাতে
জন্ম নেয় স্ফুলিঙ্গ,
যে স্ফুলিঙ্গ কখনো আগুন হয়ে ওঠে।
আগুনে তেতে
লোহাও নরম হয়ে যায়
যেমনটা চাই
হাতুড়ির ঘায়ে সেও
তেমনই আকার নেয়।
একমাত্র তুমিই,
যার ওপর কোনো আঘাতেই
কিছু যায় আসে না !
অনুবাদক