| 27 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প শিশুতোষ

অনুবাদ গল্প: চোর । রাস্কিন বন্ড । অনুবাদক: ঈশান মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট
চোর
[মূল গল্পঃ দ্য থিফ, লেখকঃ রাস্কিন বন্ড]
ভাবানুবাদঃ ঈশান মজুমদার
 
(১)



অরুণের সঙ্গে যখন আমার প্রথম আলাপ হয়তখনও আমি একজন পনেরো বছর বয়সি চোরই ছিলাম একটু আধটু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম এবং হাতসাফাইয়ের কাজে আমার বেশ ভালোই সাফল্য লাভ হচ্ছিল
দুর্গাপুরের উন্নয়নী ক্লাবে তখন টেবিল টেনিসের চর্চা ছিল ছেলেমেয়েদের মধ্যে খেলা দেখতে ভিড়ও হত অল্পবিস্তর সেই ভিড়েই অরুণকে প্রথম দেখি লম্বাবছর কুড়ি-বাইশের মধ্যে বয়েসমুখটা একটু ভালোমানুষ গোছের ওকে দেখেইআমার কার্যসিদ্ধির জন্য একেবারে যোগ্য প্রার্থী বলে মনে হয়েছিল আসলেমানুষের বিশ্বাস অর্জনে আমার খুব বেশি সময় লাগত না কী কারণে জানি নাহয়তো আমার সরল মুখশ্রীর জন্য অথবা আত্মবিশ্বাসী কন্ঠস্বরের দাপটেলোকে আমাকে সহজেই বিশ্বাস করে ফেলতঅরুণও করেছিল দূর থেকে তাকে কিছুক্ষণ নজরে রেখেআমি তার দিকে এগোলাম সে তখন মন দিয়ে খেলা দেখছিলআর মাঝে মাঝেই বলে উঠছিল, “আরে ডানদিকেডানদিকে মার ওর ব্যাকহ্যান্ডটা ভালো না
প্রায় তার গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমিও তার দেখাদেখি বলতে লাগলাম, “একদম কী যে করছেওইদিকে খেললেই পয়েন্ট দিয়ে দেবে আরে ডানদিকেজোরে মারমার -”
অরুণ আমার দিকে আড়চোখে দু-একবার দেখছিলহয়তো ওর মতের সমর্থক বলেই বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছিল আমার দিকে ঠিক এমন সময় অরুণের পছন্দের খেলোয়াড়টি বিপক্ষের ডানদিকে মারতেইছেলেটি বলটা মিস করল আর সুযোগ বুঝে আমিও বলে উঠলাম, “তোমরা চোখটা কিন্তু দারুণতেমনি তোমার খেলাটা সমন্ধে জ্ঞান কী দারুণ ধরে ফেললে ওর দুর্বলতা চেহারাটা দেখে মনে হচ্ছে খেলাধূলা করতে কোনও একসময়
তার চেহারা আদৌ খেলোয়াড়সুলভ ছিল নাতবুও আমার পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখেছিযে কোনও মানুষ চেহারা নিয়ে প্রশংসা পেলে খুশিই হয় মানেখুব মোটাসোটা কাউকে দেখে যদি আপনি বলেনস্বাস্থ্যটা বেশ ভালো হয়েছে তো আগের থেকেঅনেক রোগা লাগছে সে দশবারের মধ্যে আটবারই সেই গুণকীর্তন মেনে নেবেসে সত্যি হোক ছাই না হোক
আমার বিপুল প্রশস্তির উত্তরে অরুণ একটু হেসে বলল, “তোমারও তো দেখছি বেশ ভালো ধারণা রয়েছে খেলাটা নিয়ে” অরুণের কথায় আমি বেশ থতোমতো খেয়ে গেলামবলে কীআমি ওর শুনে শুনে দুটো তারিফ করলাম আর এত সহজে বাগে এসে গেলতার কারণ আমার সঙ্গে খেলা নিয়ে দুটো কথা বললে যে কেউ বুঝে ফেলত যেওই বিষয়ে আমার এক্কেবারে ভাঁড়ে মা ভবানী কিন্তু সেই মুহূর্তে থেমে যাওয়া মানে শিকারকে হাত থেকে বেরিয়ে যেতে দেওয়া তাই কথোপকথন চালিয়ে যেতে লাগলাম আমি
–      হ্যাঁএকটা সময় তো একটু আধটু খেলতাম তারপর ভাগ্য নিয়ে গিয়ে ফেলল এমন জায়গায় এখনও কোথাও খেলা হলে দেখতে বসে যাই ফিরে যাই সেই দিনগুলোয়
আড়চোখে লক্ষ করি অরুণের দৃষ্টি কেমন কোমল হতে শুরু করেছে ‘এক্কেবারে সাধাসিধে,’ মনে মনে বলে উঠলাম আমি
অরুণ প্রশ্ন করল আমায়, “ভাগ্য এনে ফেলল বলছ কেন?”
–      আমি মেদিনীপুরের খুব সাধারণ ঘরের ছেলে বাবা কলের মিস্তিরি ছিলআমাকেও কাজ শেখাত একবার যাত্রা শুনে ফেরার সময় মাঝরাস্তায় টেম্পোটা উলটে গেলবাবামা দুজনেই শেষ আমি মাসখানেক বাদে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম এক মামা ছিলেনতার দোকানেই কাজে নিয়ে নিলেন বছর চারেক সেখানে ভালোই কাজ করছিলামতারপর গত মাসে মামা হঠাৎ মারা গেলেন হার্টফেল করে মামার ছেলেরা আমায় একটুও পছন্দ করত না আসলেগলগ্রহ তোবুঝতেই পারছ তারা আমায় রাখতে চাইল নাতাড়িয়ে দিল সেই থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছি কখনও এখানেকখনও ওখানেদু-চারদিনের কাজ পাইচলে যায় কোনোমতে
–      নাম কী তোমার?”
–      শ্যামল
এটা বোধহয় আমার পঞ্চম বা ষষ্ঠ নাম ছিল এর আগে রবিভোলাতারেক এমন বহু নাম নিয়ে কাজ করেছি তার ওপরআমার মতো অনাথের পক্ষে বাবামার এই গল্পটা তৈরি করে নেওয়াও প্রয়োজনীয় বলে আমার আগেই মনে হয়েছিল শুধু ক্ষেত্র ও অবস্থার বিশেষে গল্পটা বদলে যেত খেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলআমার গল্প শুনে অরুণ ধীরে ধীরে ভিড়ের বাইরে বেরিয়ে এল তারপর উলটোদিকের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল সেআমিও অনুসরণ করলাম তাকে সে কিছুটা অস্বস্তি কাটানোর জন্যই বললকেমন লাগল খেলা?”
আমি সে কথার উত্তর দিলাম নাবরং একটা অনুরোধ আর দাক্ষিণ্য প্রত্যাশী গলায় বলে উঠলাম, “আমায় তোমার কাছে কাজ করতে দেবে?”
সে কিন্তু হাঁটা থামাল নাবরং আমার দিকে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “তা তোমার হঠাৎ এমন মনে হল কেন যে আমার কাজের লোক দরকার?”
–      সারাদিন ঘুরে বেড়াচ্ছি এমন একজনের খোঁজে যে আমায় একটা কাজ দেবে আমার অন্তত কোনও একটা হিল্লে হবে তুমি সেই লোকযে আমায় আমার কথা জিজ্ঞাসা করলে তাই মনে হলহয়তো তোমাকেই বলা যায় এই বিষয়ে
কখন কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবেএটা আমার ঠোঁটের গোড়ায় প্রস্তুত থাকত সবসময় অরুণ অল্প হেসে বললতুমি একটু বেশিই প্রশংসা করছ আমার!”
–      মোটেই না, আমি শুধু মনের কথাটাই বলছি
–      কিন্তু তুমি আমার কাছে কাজ করবে কীভাবে?”
–      কেনতুমি যে কোনও কাজ বলযে কোনওআমি করে দেব
–      আরে ব্যাপারটা সেটা নয় তোমায় মাইনে দিতে পারব না
এবার আমি একটু থমকে গেলামক্ষণিকের জন্য মনে হল আমি বোধহয় ভুল লোককে বেছে নিয়েছি আমার কার্যসিদ্ধির জন্য তারপর একটু ভেবে বললামআমার খাবারটুকু দিতে পারো?”
–      তুমি রান্না করতে পার?”
–      পারি
–      তাহলে তোমার খাবারও দিতে পারি
ডাহা একটা মিথ্যে বলে আমার হিল্লে হয়ে গেল কারণ ভাত ছাড়া অন্য কিছু করা আমার পক্ষে শুধু কঠিন নয়একেবারেই অসাধ্য ছিল তাও হোটেলের ক্যাশবাক্স থেকে রবিবারে টাকা হাতানোর আগে ওইটুকু শিখেছিলাম ওখানকার রাঁধুনির কাছে ফলেসেই নামমাত্র বিদ্যেটুকুই আমার পেটে ছিল তবেএকটা ব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যেবিশ্বাস অর্জনে আর মিথ্যাচরণে আমার দক্ষতা প্রশ্নাতীত


()

হাঁটতে হাঁটতে একসময় অরুণের বাড়ি পৌঁছে গেলাম একটা একতলা বাড়িখুবই ছোটোএকটা ঘরএকটা বারান্দাআর একটা কলঘর রান্নার জায়গাটা বাইরের বারান্দার এক কোণে অবস্থিত বাড়ির দিকে যাওয়ার সময়ই অরুণ বলছিলযে তার মা জন্মের সময় থেকেই নেই বাবা এই বাড়িটুকুই রেখে গিয়েছিল তার জন্য তাই মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই সে চিরকালই পেয়ে এসেছে পরে অবশ্য আরও কিছু জেনেছিলাম তার সমন্ধে যাই হোক বাড়িতে ঢুকে বারান্দাটা দেখিয়ে সে বললএখানে শুতে আপত্তি নেই তো তোমার?”
–      একেবারেই না তবে আমার সঙ্গে দুটো জামা প্যান্ট রয়েছে আর একটা চাদর শোয়ার জন্য কোনোকিছু তো আনিনি আমি
অরুণ অল্প ভেবে বললসে ব্যবস্থা হয়ে যাবে আমার কাছে আরেকটা পুরোনো গদি আছে যদিও ফাটাতবে এখনকার মতো কাজ চালিয়ে নিতে পারবে ওটার উপর শোয়ার ব্যবস্থা করে নাও একটা লেপ আর বালিশও আছে তবে একটু ছেঁড়াখোঁড়াসেটাই যা সমস্যার
–      তাতে আমার কোনও অসুবিধা হবে না
আমি দ্রুত অরুণকে আশ্বস্ত করে বলে উঠলাম এমন অবস্থায় যা পাওয়া যায়তাতেই মঙ্গল
সেদিন রাতে অবশ্য আমি যে খাবারটা রান্না করলামসেটাকে খাবার না বলাই ভালো অরুণ তার দুগ্রাস গলঃদ্ধকরণ করেনাক মুখ কুঁচকে বাকিটা রাস্তার বিড়ালটিকে খাইয়ে দিল শুধু তাই নয়আমাকেও পত্রপাঠ বিদায় নিতে বলল বেশ কড়া গলায় কিন্তু আমি আমার সেই অতি সরল হাসিমুখটি নিয়ে তার পিছন পিছন ঘুরতে লাগলাম কখনও বা দাঁড়িয়ে রইলাম তার সামনে সে খানিক অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকার পরহঠাৎই হাসতে শুরু করল হাসতে হাসতেই বলল, “উফবাবারে বাবাযা খাবার খাওয়ালেঠিক আছে, ঠিক আছেঅত ভাবার কিছু নেই আজকে তো আর হবে নাকাল থেকে তোমায় রান্না করা শেখাব
 
অরুণের সঙ্গে কাজ করতে আমার ভালোই লাগছিল সকালবেলা চা বানিয়ে দিয়ে আমি বাজারে চলে যেতামআর প্রায়ই সেখান থেকে দশকুড়ি টাকা সরিয়েবাড়ি ফিরে নির্লিপ্তভাবে বাজারমূল্য বৃদ্ধির দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করতাম সেই কারণেইপ্রতিদিনের জিনিসপত্র কেনায় আমার কিঞ্চিৎ সময় লাগত কখনও কখনও মনে হতঅরুণ বোধহয় বুঝতে পারছে ব্যাপারটাশুধু কিছু বলছে না আসলেসে কেমন যেন খামখেয়ালি প্রকৃতির মানুষ ছিল আরও একটা কারণ ছিলআমি ঘরের অনেক কাজই করতামঅথচ সে তো আমায় একটা টাকাও মাইনে দিত না তাই একটা অনুকম্পার জায়গা থেকেই ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেত
অরুণ আমায় লিখতেও শিখিয়েছিল তার আগে অবধি আমার বিদ্যে ছিল সঙ্গীন এর ওর দ্বারে লাথি ঝাঁটা খাওয়া একটা ছেলেকে আর অ আ ক খ কে শেখাবে বলুনঅরুণ শিখিয়েছিলস্লেট পেনসিল কিনে দিয়েছিলতারপর হাত ধরে ধরে লেখা শেখাতপড়তে শেখাত এমনকি আমার নিজের নামটাও আমায় লিখতে শিখিয়েছিল অরুণ
আমি যদিও এই সব অত্যাচার মেনে নিচ্ছিলাম শুধুমাত্র একটা বড়ো দাঁও মারার অপেক্ষায় আসলে প্রথম প্রথম যতই মনে হোক যে অরুণের বিশেষ উপার্জন নেইসময়ের সঙ্গে সঙ্গে জেনেছিলাম যে তা ঠিক নয় নিয়মিত উপার্জন না থাকলেওসে অল্পবিস্তর সুদের কারবার করত এক সপ্তাহে সে একজনের থেকে ধার করতঅন্য সপ্তাহে ধার দিত আসলেওর বাবার কিছু জমানো টাকা ছিলতা দিয়েই ব্যাবসাটা শুরু করে মুশকিল হলআয় খুব নিয়মিত না হলেওকিছুমাত্র আয় হলেই সে বন্ধুদের সঙ্গে আমোদ প্রমোদে বেরিয়ে পড়ত এটা একটা আজব ব্যাপার হয়ে উঠেছিল আমার কাছে মাঝে মাঝেই দেখতামও মাথায় হাত দিয়ে ভাবছে পরের মাসটা কেমন করে চলবে আবার পরের দিনই কিছু টাকা হাতে আসতেইবেরিয়ে পড়লেন বাবু সেগুলো ওড়াতে
তবে আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেইযখন অরুণ আমার সঙ্গে অক্ষরগুলোর পরিচয় করিয়ে দিততখন কখনও কখনও মনের মধ্যে অদ্ভুত সব চিন্তা খেলে যেত মনে হতএকদিন আমি লিখতে শিখবসেদিন আর যাই হোক পেট চালানোর তাগিদে আমায় চুরি করতে হবে না অরুণের আন্তরিকতার জন্যই বা আমার মনের একটা অন্য দিকের কারণেইমাঝে মাঝে আমার ভালো হতে ইচ্ছে করত তখন অজান্তেই চোখটা কেমন ভিজে যেতআর মাকে দেখতে ইচ্ছে করত খুব কিন্তু ‘মা’ ‘বাবা’ এই শব্দগুলোর মানেই তো জানতাম না সেভাবে বারো বছর অবধি একটা অনাথ আশ্রমে বড়ো হচ্ছিলামযেখানে শুধু খাটাতআর মারত ভালো লাগত নাতাই একদিন সেখান থেকে চুরি করে পালালাম সেই আমার প্রথম হাতেখড়িআর প্রথম সাফল্যের স্বাদ আমাকে যেন একটা অন্য মানুষে বদলে দিল কেউ ধরতে পারল না আমায় তারপর আবার চুরি করলামতারপর আবার এবং তারপর আবারও একই কাজ করে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠলাম অচিরেই শেষ চার বছরে ওই একটি বিদ্যেই রপ্ত করেছিলাম মনেপ্রাণে
যাই হোকঅরুণের বাড়িতে আমার দিন বেশ কেটে যাচ্ছিলআর আমি সুযোগের সদ্ব্যবহারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলাম দেখতে দেখতে বেশ কয়েকমাস কেটে গেল


()

একদিন দুপুরে অরুণ তাড়াতাড়ি বাইরে থেকে ফিরে এল দেখলাম বেশ মোটা একটা পাঁচশো আর একশো টাকা মেশানো বাণ্ডিল সে বালিশের তলায় রাখল বেশ কয়েক মাস তার বাড়িতে কাজ করার পরেও আমার নিজের প্রয়োজনে সেভাবে তাকে ব্যবহার করতে পারিনি আমি কিন্তু ব্যবহার করার অবকাশ আমার কাছে ছিল তার কারণচাবি সে আমার জিম্মায় রেখে যেত যখন খুশি চাইলেই তার ঘরে আসা যাওয়া করতে পারতাম আমি আসলেআমায় অবাক করে দিত তার বিশ্বাস আমার উপর তার কীসের টান ছিল আমি জানি নাকিন্তু তার এই আস্থার কারণেই আমি আমার সহজাত প্রতিভার দিকে নজর দিতে পারিনি সেভাবে
একজন লোভী মানুষের অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার মধ্যে আমি কোনোদিনও গ্লানি খুঁজে পাইনিকারণ আমি চিরকাল সেটা তার প্রাপ্য বলে মেনে এসেছি একজন বড়োলোকের টাকা চুরি করাও সহজকারণ সেটা তার পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু একজন সাধারণ মানুষযার উপার্জন নিয়মিত নয়যার টাকাপয়সার লালসাও নেইপ্রাচুর্যও নেইরয়েছে একরাশ খামখেয়ালিপনা তার সঙ্গে মিশেছে অগাধ বিশ্বাস আর ভরসা একজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের প্রতি তার সৎ পথের আয় চুরি করা কি এতই সোজা?
বালিশের তলায় রাখা অতগুলো টাকা অরুণের অজ্ঞাতে সরিয়ে ফেলাআমার পক্ষে এমন কিছু দুরূহ ব্যাপার ছিল না আমি আমার মনকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘এবার আসল কাজ করার সময় এসেছে বেশি ভাবতে গিয়েই আমি অভ্যাসের বাইরে চলে যাচ্ছি ওই টাকাগুলো না নিলেসে তো বন্ধুদের সঙ্গেই আজেবাজে খরচা করে অপচয় করবে তার উপর সে আমায় মাইনেও দেয় না’ কাজেই যাবতীয় দ্বন্দ্ব প্রতিদ্বন্দ্ব কাটিয়ে আমি প্রস্তুত হয়ে গেলাম মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য
বিকেলে বাজার করার অছিলায় একবার স্টেশন চত্বর থেকে ঘুরে এলাম একটা টিকিট কেটে রাখা দরকারযাতে পালাবার পথটা প্রশস্ত থাকে
 
শীতের রাত্তিরএমনিতেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে পাড়াগুলি অরুণও সেদিন একটু আগেই খেয়ে শুয়ে পড়ল সাড়ে এগারোটার দিকে আমি উঠে বসলাম বারান্দা দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে মাঝে মাঝেই মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে চাঁদটাকে আবার লুকোচুরি খেলার ফাঁকেই মেঘেদের ফাঁকি দিয়ে আড়ালআবডাল থেকে বেরিয়ে আসা চাঁদমায়াময়ী করে তুলছে চারপাশ উঠে বসে পরিকল্পনাটা নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবলাম অনেক টাকার ব্যাপারযা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেকটাই বেশি বারোটা পঁচিশের বাঘ এক্সপ্রেসটা রয়েছেওটা ধরতে পারলেই…
আমি সন্তর্পণে দরজা ঠেলে ভিতরে এলাম একমুখ প্রশান্তির ছায়া মেখে ঘুমোচ্ছে অরুণ চুপিসারে তার দিকে এগিয়ে এলামএকটু নড়ে উঠল কী সেনাহচোখের ভুল ধীরে ধীরে হাত বাড়ালাম তার বালিশের তলায়টাকাবাণ্ডিলটা বেশ মোটাবার করে আনলাম তারপর পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার মুখে একবার অরুণের দিকে তাকিয়েছিলাম কেমন একটা আবছায়া খেলা করছে তার মুখে অল্প একটু হাসি লেগে আছে কি তার ঠোঁটেঠিক দেখলাম কিনাতা আর যাচাই করা হল না
বাইরে বেরিয়েই প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম অলিগলি ধরে বাজারের ভিতর দিয়ে শর্টকাট করার চেয়েআমি একটু নির্জন রাস্তাগুলোই বেছে নিলাম পালানোর জন্য কে বলতে পারেতাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যদি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যায় দোকানপাট সব বন্ধশুধু দূরে কোথাও একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে বারোটা কুড়ি বেজে গেছেআর মিনিটখানেকের মধ্যেই স্টেশনে ঢুকে যাব হঠাৎ নোটগুলো গোনার কথা মনে হল কিন্তু দেরি হয়ে যাবে এই ভেবেই আর গুনলাম না শুধু একবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে আঙুল চালিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম – প্রায় খান ত্রিশেক নোট রয়েছে বাণ্ডিলটায়এই টাকায় যে আমার আগামী চারপাঁচ মাস বেশ নিশ্চিন্তেই কেটে যাবেসে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রইল না
স্টেশনে যখন পৌঁছলামতখন বাঘ এক্সপ্রেস ঢিমে তালে তার যাত্রা শুরু করেছে আমি ইচ্ছে করলেই দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়তে পারতামদৌড় শুরুও করেছিলামকিন্তু হঠাৎ কী মনে হতে দাঁড়িয়ে পড়লাম কেন যে দাঁড়িয়ে পড়লামতার উত্তর আমার কাছে সেদিন ছিল নাআজও নেই ট্রেনে উঠে পড়লে হয়তো আজ এখানে এই গল্পটা বলতাম না প্রায় ফাঁকা স্টেশনে দাঁড়িয়ে দেখলাম বাঘ এক্সপ্রেস স্টেশন ছেড়ে চলে গেল
পকেটের মধ্যে থাকা টাকাগুলো আমার শরীর ছুঁয়ে জানান দিচ্ছিল তাদের উপস্থিতি কিন্তু কোথাও একটা অদ্ভুত একাকীত্বএকটা বিছিন্নতাবোধ আমার মনকে গ্রাস করছিল কোথায় রাত কাটাব তা জানতাম না ওই শহরের কাউকেই তো চিনতাম না আমিএকজনকে ছাড়া সেই মানুষটা যার থেকে এই টাকাগুলো আমি
আমার ভিতর থেকে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল


()

স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এসেআমি বাজারের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম চারিদিক অন্ধকারনিস্তব্ধ মনে মনে অরুণের কথা ভাবছিলাম – কী নিশ্চিন্তেই না ঘুমোচ্ছে সেতার ক্ষতির কথা এখনও সে জানেই না চুরি করতে করতে একটা ব্যাপারে আমি বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিলাম – তা হল মানুষের মুখভঙ্গী অনেক কিছু বুঝতে পারতাম আমি তার মাধ্যমে কোনোকিছু হারানোর পরধনীর মুখে রাগের ছাপ আসে আবারদরিদ্রের মুখে ভয়ের ছাপ পড়ে ধীরে ধীরে কিন্তু অরুণের মুখে যে কী ছাপ গাঢ় হবেতা ঠাহর করতে পারছিলাম না রাগ বা ভয় কোনোটাই তার হবে না এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার মনে হলতার মধ্যে একটা অদ্ভুত শোক জন্ম নেবে এবং সেটা কখনোই টাকা হারানোর দুঃখে নয়বিশ্বাস হারানোর দুঃখে
আমি একটা রাস্তার ধারের দোকানের ভাঙা শেডের নিচে এসে বসলাম সোয়েটার পরে ছিলামভিতরেও গরম জামা ছিলতবুও শীত করছিল ‘কেন যে চাদরটা নিয়ে এলাম না,’ মনে মনে ভাবলাম আমি বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই এক খন্ড কালো মেঘ জমতে শুরু করেছিলঢেকে গিয়েছিল চাঁদটাও এবার বৃষ্টি শুরু হলঝিরঝির করে পড়তে লাগলদোকানের শেডে আমার অস্বস্তি বাড়তে লাগলতার সঙ্গে বৃষ্টিও বাড়ল ভাঙা শেড বেয়ে জল আমার গায়েও পড়তে লাগল – অচিরেই ভিজে গেলাম আমি জামাকাপড়গুলো আমার গায়ের সঙ্গে সেঁটে যেতে লাগল ধীরে ধীরে আমি আমার অস্বস্তিকে প্রশমিত করার জন্যই মনকে বোঝালাম‘এ কীআমার তো অস্বস্তি হবার কথা নয় পার্কের বেঞ্চে আমি তো অনেকবার রাত কাটিয়েছি’ কিন্তু বুঝতে পারলাম অরুণের বারান্দায় শোয়ার অভ্যেস আর তার ভালোবাসার উত্তাপএই সবকিছু আমায় পালটে দিয়েছে
আমি এক দৌড়ে বাজারের মধ্যেই অন্য আরেকটা দোকানের ছাউনির তলায় গিয়ে বসলাম একঝলক তাকিয়ে বুঝলামসেখানে জল পড়বে নাচালটাও ঠিকঠাকই রয়েছে পকেটে থাকা নোটগুলোর কথা হঠাৎ মনে হল আগের মতো কড়কড়ে নেই সেগুলোঅনেক নরম হয়ে গেছে জলে ভিজে অতগুলো নোটঅরুণের সেই ঘুমন্ত মুখআমার ট্রেনে না ওঠা এই সমস্ত ভাবনারা আমার মনের মধ্যে লুকোচুরি খেলতে লাগল
আমার মনের আকাশেও হয়তো মেঘ জমছিল ধীরে ধীরেএবারতা অঝোর বারিধারা ঢেলে দিল মনের ভিতর
অরুণের টাকা!
কে জানেহয়তো সকালে উঠে সে আমায় কিছু টাকা দিয়ে বলতযাও আজ একটা সিনেমা দেখে এসো
কিন্তু এখন আর তা বলার অপেক্ষা রাখে নাকারণ সবটাই আমার আমি এখন যা খুশি করতে পারি টাকাগুলো নিয়েসত্যিই কী করতে পারিআমার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আলোআঁধারির খেলা চলতে লাগল
অরুণের বাড়িতে রান্না করাবাজার যাওয়াএই সবকিছুর মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ পেতে শুরু করেছিলাম আমি ভালোবাসার আনন্দবন্ধুত্বের আনন্দবিশ্বাসের আনন্দ এবং আরও অনেক কিছুর একসঙ্গে মিলে যাওয়ার আনন্দ কিন্তু অরুণের তাগিদেলেখার জন্য পেনসিলটায় যখনই হাত ছোঁয়াতামআমার যেন প্রতিবার নবজন্ম হত হয়তো একটা বাচ্চাকে খুঁজে পেতামযে আর পাঁচজনের মতোই বড়ো হতে চেয়েছিলস্কুলে যেতে চেয়েছিল এবং কখনোই চুরি করতে চায়নি একটা গোটা বাক্য একদিন লিখতে শেখার যে স্বপ্নটা অরুণ আমার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিলসেটাই আমার মনের দরজায় বার বার কড়া নাড়তে লাগল
আসলেমোটা টাকার বান্ডিলের ভার আমায় অনেক কিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল আমার মনে হলযদি লিখতে শিখিপড়তে শিখিতাহলে হয়তো একদিন সৎপথে অনেক টাকা আমি উপার্জন করব তখন আমাকে আর পালিয়ে বেড়াতে হবে না বিশ্বাস ভাঙায় খেলাতেও মেতে থাকতে হবে না প্রতিনিয়ত চুরি করা কাজটাকে আমার খুব সহজ লাগতবিশ্বাস ভাঙার মতোই কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানোসৎপথে উপার্জন করা যে তার চেয়ে অনেক অনেক কঠিনতবুও সেটাই তো পথ আমার মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, “এরপর আরেকটা ট্রেন আছেপালাওপালাও” আমি উঠে দাঁড়ালামপা বাড়ালাম – স্টেশনের দিকে নয়অরুণের বাড়ির দিকে
 
বাড়ি পৌঁছে আমি ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকলাম বৃষ্টি তখন অল্প ধরে এসেছিল তবুওমেঘ তার মন্দ্রিত স্বরে গর্জে উঠছিল কারণেঅকারণে আমার মনে হলমাত্র কয়েক ঘন্টা আগে এই ঘরেই ঠিক এমনই সন্তর্পণে চুরি করতে ঢুকেছিলাম নানিঃশব্দে অরুণের মাথার কাছে এগিয়ে গেলাম আমি বালিশের নিচে টাকাগুলোকে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতটা বার করার সময়অরুণের চুলে আমার আঙুলগুলো অকস্মাৎ ছুঁয়ে গেল নাহঅরুণ জাগল নাশুধু দেখলামতার ঠোঁটে সেই আলতো হাসির রেশটা যেন লেগে রয়েছে তার নিঃশ্বাস আমার হাত ছুঁয়ে গেলমুখে আলোছায়ার খেলা চলছিল তখনও
 
পরদিন যখন ঘুম ভাঙলদেখলাম অরুণ নিজেই চা বানিয়ে ফেলেছে সকালের তীব্র আলোয়তার মুখোমুখি হতে কিঞ্চিৎ দ্বিধাবোধ হচ্ছিল হয়তো একটা চাপা লজ্জাও মাঝে মধ্যে ঘিরে ধরছিল আমায় হঠাৎই অরুণ আমার দিকে তার হাতটা বাড়িয়ে দিল দেখলামসেই হাতে ধরা রয়েছে দুটো একশো টাকার নোট আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে বলল, “বেশ কিছু টাকা কামিয়েছিতাই এবার থেকে তোমায় মাইনে দিতে পারব
আমার বেশ আনন্দ হলচুরির লজ্জা থেকে মুক্তির জন্য শুধু নয়অরুণ যে সেটা বুঝতে পারেনি একথা ভেবেই স্বস্তি পেলাম টাকাগুলো ফিরিয়ে দিয়ে আমি যে কোনও ভুল করিনিএমন একটা বিশ্বাস মনের মধ্যে জন্মাল সে এক অদ্ভুত আনন্দ এমন আনন্দ আমি কক্ষনও পাইনিঅন্তত চুরি করে পালানোর পর নিশ্চিতভাবে পাইনি কোনোদিনও হাসিমুখে আমি টাকাটা নিলামআর আমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল টাকাটা ভেজা!
হ্যাঁ, তখনও টাকাটা ভেজাই ছিল গত রাত্রের বৃষ্টির জল তখনও শুকোয়নি অরুণ জানতসবটা জানত মুখ নামিয়ে রেখেছিলাম আমি অরুণ কাছে এগিয়ে এলতারপর আমার মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে সে বলল, “আজ থেকে শুধু নিজের নাম লেখা নয়ভালোভাবে পড়াশোনাটা শেখাব তোমায়
গতরাত্রের ঘটনার সবটুকুই সে জানত তবুও অরুণের স্নেহের ছটা আর উত্তাপের পরশ আমায় এক লহমায় যেন আরও অনেক বেশি কাছে টেনে নিল আমার অভিভাবকহীনতাও ঘুচিয়ে দিল নিমেষের মধ্যে আমি বুঝলাম যে এমন কিছু বৃষ্টি মানুষের জীবনে মাঝেমধ্যে আসেযা শুধু সিক্ত করে দিয়ে যায় নাসব পাপ ধুয়ে দিয়ে যায় সব গ্লানি মুছে দিয়ে যায়
আমি চোখ তুললামআর আমার সেই সরল হাসিটা হাসলাম অরুণের দিকে তাকিয়ে তবে এবার আর সেটা জোর করতে আনতে হল না… নিজে থেকেই এল
কৃতজ্ঞতা: ম্যাজিকল্যাম্প

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত