| 27 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১)

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

মা-বাবার সেপারেশনের সেই সময়টা অনেক চেষ্টা করেও ভুলতে পারিনি।

ভুলতেই দেয়নি কেউ! দু’চার পাঁচ কথার পরেই মুখটা দুঃখী দুঃখী করে সমবেদনার সুরে সবাই বলেছে, ‘মা-বাবা তো নিজেদের পথ নিজেরাই দেখে নিল! তোমরা ভালো আছো তো মা? ইস! এই বয়সেই এত বড় একটা ধাক্কা…’

আমি মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই সহানুভূতির স্রোতকে আগলেছি। বার বার মনে করতে না চাইলেও ভুলতে পারার আর জো ছিল কোথায়?

আসলে মনে রেখে দেওয়ার মতো কোনো বিশাল কীর্তি তো নয়! দুজন মানুষ একে অপরের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে একসাথে পথ চলার আগ্রহটা হারিয়ে ফেলে। তারপর পথের মাঝখানেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, ‘আচ্ছা অনেকদূর তো একসাথে এলাম! এখন তুমি তোমার পথ দেখো…আমি আমার।’ যেই ভাবা সেই কাজ। তল্পিতল্পা গুটিয়ে যে যার পথে হাঁটা দেয়। ঠিক যেন শাখাপ্রশাখা ছাড়ানো বিশাল গাছটিকে উপড়িয়ে নিয়ে অন্য জায়গায় লাগিয়ে ফেলা। তাড়াহুড়োতে খেয়ালও করা হয় না, অজস্র কচি শাখা কাটা পড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে। বিশাল গাছটি হয়ত নতুন মাটিতে অস্তিত্ব খুঁজে পাবে, কিন্তু পড়ে যাওয়া শাখাগুলো কি আর মাথা তুলতে পারবে কোনোদিন?

সেরকমই দুটি কচি শাখা আমিআর আমার ছোটভাই নয়ন।

মা-বাবার বিচ্ছেদের পর থেকেই নানী আমাদের আগলে রেখেছিল। আমাদের বিশাল সম্পদশালী দাদাবাড়িতে নয়ন আর আমার ঠাঁই হয়নি। চারজন চাচা অট্টালিকাসম বাড়ির চারটি বিশাল ফ্ল্যাট দখল করে নিয়ে নিজেদের রাজত্ব গড়ে নিয়েছিল। সেইসব ফ্ল্যাটে গিয়ে ধর্ণা দিয়ে বসে থাকার মানে নেই কোনো। তারা কেউওই এক ইঞ্চিও সম্পত্তির দখল ছাড়তে রাজি হবে না। আর তাছাড়া… আমার নিজের বাবা যেখানে জীবিত আছে, সেখানে তাদের ঘাড়ে দায়দায়িত্ব চাপাতে যাওয়া কেন বাপু?

বাবা তার ভাইদের মধ্যে শুরু থেকেই ছিল দলছুট। বংশ তথা সামাজিক মর্যাদার পরোয়া না করে যেদিন সাধারণ এক স্কুল মাস্টারের মেয়েকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেদিনই দাদা সমন জারী করে দিয়েছিল,

‘নিজের পছন্দে বিয়ে করেছো, খুব ভালো কথা। কিন্তু ভবিষ্যতে আমার সয় সম্পত্তির কানাকড়িও চোখে দেখতে পারবে না। এই বলে দিলাম! তখন আবার নিজের ভাগ ফলাতে চলে এসো না! আজ কীসের মোহে উড়ে বেড়াচ্ছো নিজেই জানো। দু’দিন পর যখন রস ফুরিয়ে যাবে, তখন যেন বাপের সিন্দুকের খোঁজ না পড়ে! এখন সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে! ভালোমত ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।’


আরো পড়ুন: ফাহমিদা বারীর উপন্যাস চোরকাটা (পর্ব-১)


বাবা তখন সদ্য যৌবনের ছোঁয়ায় মূর্ছা যাওয়া একজন প্রেমিকপুরুষ। আমার সুন্দরী মায়ের অফুরান সৌন্দর্য তাকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমার নানাবাড়িতে কী আছে কী নেই, ভবিষ্যতে কেন দাদার সিন্দুকের খোঁজ পড়বে…অতশত ভাবনা ভাবার মতো মনমানসিকতা তখন ছিল না বাবার।

কিন্তু সময়ের নদী কি আর চিরকাল একই ধারায় প্রবাহিত হয়? তাকেও ধারা পাল্টাতে হয়। সাড়া দিতে হয় নতুন পথের হাতছানিতে।

মায়ের কালোচোখের ডাগর চাহনি একসময় ম্লান হয়ে এলো বাবার কাছে। ঝুট ঝামেলার নিত্য নতুন পাঁচফোড়নে সংসারের তপ্ত কড়াইয়ে রোজ শুরু হয়ে গেল ফুটফাট শব্দ। আস্তে আস্তে সেটা কানফাটানো গর্জনে রূপ নিলো। বাবা দোষ দিত মায়ের অগোছালো সংসারবিবাগী মনকে। আর মায়ের অভিযোগের ফর্দ তো তখন বিশাল বড়!

বাবা দিনরাত ঘরে বসে সংসারের খুঁত বাছতে থাকে চাল বাছার মতো… বাবার সাজপোষাকে আধুনিকতা নাই, কথাবার্তায় একেবারেই খ্যাত… বাবার কোনো বন্ধু নাই…হবে কেমন করে? দিনরাত বউয়ের পেছনে খবরদারি করে ফুরসত মিললে তো বন্ধু জুটবে! ছেলেমেয়ে দুটো কি মায়ের একার? সব দায় কেন তাকে একাই বইতে হবে? বাবা কেন গায়ে বাতাস লাগিয়ে সব দায় থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিবে… ইত্যাদি ইত্যাদি!

এখানে বলে রাখি, আমার নয়টা পাঁচটা অফিসগামী বাবার জীবনে বিয়ের পর যতটা পরিবর্তন এসেছিল…মায়ের জীবনে পরিবর্তন এসেছিল তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। মা আচমকাই পাল্টাতে শুরু করে। খুব আচমকা না, ধাপে ধাপে বললে বুঝি ভালো হয়। মা সম্ভবত বিলাসী জীবনের স্বাদ পেতে চাইতো। জীবনের প্রথমাংশে স্কুলশিক্ষক বাবার কাছে অনেক সাধ আহলাদের মৃত্যু ঘটেছিল মায়ের। সেই অপূর্ণ সাধ আহলাদগুলো মা হয়ত বিয়ের পরস্বামীর কাছে এসে মেটাতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার বাবা তো তখন নিজের বাবার পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত। মায়ের সাধ মেটানোর ইচ্ছা তার মধ্যে আদৌ কখনো ছিল কী নাএটা এখন আর জানার সুযোগ নাই, কিন্তু সাধ্য যে ছিল না এটা তো তখন আমরাও বুঝতে পারতাম!

একদিন বাবার এক বন্ধু বেড়াতে এলেন আমাদের বাসায়। বাবার ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। চলনবলনে দুর্দান্ত স্মার্ট। শার্টের এতটুকু কোনাতেও ভাঁজ পড়তে দেয় না এমন অবস্থা।

মা তখন দিনরাত সংসারের খ্যাঁচখ্যাচানিতে অগ্নিমূর্তি হয়ে থাকে। রান্নাঘরের জ্বলন্ত চুলার পাশে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে কেমন যেন ভয় ভয় করতো। মনে হতো, চুলা নাকি মা…কার আঁচ বেশি?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত