| 9 মে 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

ইরাবতী এই দিনে: শেলী নাজের দশটি কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
আজ ১১ মার্চ কবি শেলী নাজের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।

 

 

কলা অনুষদ

নিষাদ গোত্রের শিক্ষকেরা এসে পড়ায় এ কলা অনুষদে
ভাঁজ খোলে ছন্দদেবী চোষট্টি কলায়, অতলান্তিক সে হৃদে

বালিকারা কোনদিন পারেনি খুলতে জট বটের ঝুড়ির
শেকড়ের গায়ে গায়ে লেগে থাকে মৃদুজল মাতামুহুরির

শিবের মন্দির থেকে মন্ত্র জানা সর্প এসে আলাপ জমায়
আঙ্গুল পড়ায়, পড়তে শেখায় প্রত্নকলা মেসোপটেমিয়া

প্রথম সবক দেয়া তাম্র ও খরোষ্টীলিপি, সারারাত পিপাসার্ত
সন্ধ্যার রেঁস্তোরা, ঘন হট্টগোলে ডুবে থাকা বোঁভোয়া ও সার্ত্র

কৃষ্ণরাজ সেচকাজে শেখায় দক্ষতা, যেন প্রেমের পুরুত
ব্ল্যাকবোর্ড থেকে উড়ে আসে চক আর মন খারাপের গুঁড়ো

শরীরে সঙ্গীত বাজে, ধক ধক বয় রক্ত টিচার্স ক্যাফেতে
টাটকা বারবিকিউ, বহুপদে ছাত্রীগণ সাজিয়েছে ব্যুফে

বালিকারা মনোযোগী, ঢেলে দেয় মেধা, মন, সময় ও স্বত্ব
কলাবিদ উড়ে যায়, দেহজুড়ে নিরিবিলি কাঁদে ভাষাতত্ত্ব

শিক্ষকমণ্ডলী ভালো, ছাত্রীরা নিখাদ বোকা গলে শোনে স্তব
ক্লাসরুম ঢেকে দেয় বৃতি আর বৃন্তচ্যুত ফুলের স্তবক

 

 

উত্তম পুরুষ

তোমার বাঁদিকে এক বেশ্যালয়, ডানে ধর্মসঙ্গীত, মন্দির
পিপাসার পাকদণ্ডি বেয়ে তুমি মাঝামাঝি, আছ প্রথাবন্দি

মাস্তুলে তুফান এসে অশনি-সংকেতভরা মেঘকে পাঠাক
চুম্বক দুদিকে টানে, সমুদ্রবণিক জানে কম্পাস কাঁটাকে

সামাজিক মানুষেরা পর্দাঘেরা, টালিছাদে টেনে রাখে আব্রু
মধ্যপন্থী পায় গন্ধবহ সঙ্গম-তাড়না ; বীর্য আর ভ্রুণ
বাঁদিকে রহস্য-বন, নরক দরজা আর ডাইনীর সভা
মায়াগৃহ খুলে মধ্যবর্তিণী পেতেছে গোলাপি বেডকভার

গির্জার চুড়োকে ছোঁও, মাংসের পলল স্তরে দূর্গ গেড়ে বস
ডানের সন্ন্যাস আসে, রুদ্রাক্ষের মালা হাতে গেরুয়া বসন

তোমারই দেবালয়, বেশ্যাপাড়া, মসজিদ… শেষ আর শুরু
নারী অধঃস্থিত, রুদ্ধ; সর্বত্র প্রবেশ্য তুমি উত্তম পুরুষ!

 

 

আগুনপরিখা

এইসব নীল শাড়ি পুষে রাখে সতত আগুন
এসো পুত্রস্নেহ দেব, প্রেমিকারতিও, রাত্রিতীরে,
তাঁবু ফেলো দেহমন্দিরে আর আনো শ্বাসের গুঞ্জন
নরম কণ্ঠার হাড়ে গেঁথে দাও তোমার নখর

ধীরে ধ্যানে ধীবর ছড়াও জটিল জাল, বোঝ জলের জোয়ার
মৎস্য তোলার আগে শোন নদীটির গোঙানো ও কান্না
জেলেনৌকোর ওঠানামা, হাওয়ার শীৎকার
অপমানখচিত দেহ ঘিরে জেগে ওঠা ক্লেদ, সাজানো পান্নার

কলঙ্ক, কামনা গিলে এত ফুলে গেছে কোষ, সেই কোষাগারে
অভ্রমঞ্জরি খনিতে, ধীরে নামো, নাও তার অধিকার
আর দেখ অপমানবীর্যে ভরা কতোটা ক্ষুধার্ত এই আগুনপরিখা

 

 

লকডাউন

বিবাহ বিচ্ছেদের জীবাণু সংক্রমণের পর
এগার বছর ধরে বাড়িটি লকডাউনে, বাহিরে উড়ছে লাল ফ্ল্যাগ
ধুকপুক বুকে কতটা মধু ও ধুতুরার বিষ, কতোটা অসুখ
দেখতে বাড়িটি ঘিরে জমে ওঠে উৎসুক, বিবাহিতের উদ্বেগ
পুরুষের ভিড়, গনগনে লোভ, আমাকে আরও বেশি
অচ্ছুৎ, অসতী আর একা করে তুলতে তারা
গলিতে বসায় রাত্রিচর কামুকের পাহারা

তোমাদের ধর্ষকাম প্রেমের জীবাণু থেকে বাঁচতে
হৃদয়ও গেছে জরুরি লকডাউনে, বহুদিন জ্বর
আছি গর্তে মৃতবৎ, শিরদাঁড়া দুহাতে কুড়িয়ে, নিঝুম
ভাঙা দেহে ফিরি, নিচু ছাদ, লৌহগরাদ, তাতে ফুটে থাকে
বিবাহউদ্যান থেকে বিচ্যুত নগ্নতাশোভিত কুসুম
আত্মঅবদমনের আংরাখা পরে হাসি, চৌদ্দশিকের ভেতর
একাকী স্বৈরিণী, তার সোনালি মুখোশ ভেঙে দেয় তোমাদের যৌথঘুম

মেঘের পাথর ফেটে বৃষ্টি এলে আড়ষ্ট গন্দম ফাটে, একা লাগে
দেহভর্তি দাহ্যকাঠ, তাতে ধূপগন্ধে জড়ানো গাউন
একার সিংহাসনে বসে দেখি, তোমরাও একা হচ্ছ খুব, পরস্পর
আর তোমাদের শহরে অচেনা অসুখ, লকডাউন!

 

 

দরজা
 
পরেছি ধাতুর পাত, বিরক্ত করো না
আমাকে সইতে বলো না, ঠক ঠক বাতাসের কান্না!

মন্দির চাতালে সমস্ত ময়ূর বুক খুলে নামছে ঝর্নায়
বিরক্ত করো না

রুপোর সিন্দুক থেকে বেরোলো সর্পিল মল
পরেছে বিষাদ তার পাণ্ডুর দু’পায়ে
অশ্রুঝলমল রুমালগুলি পাঠিয়েছি ধোপাবাড়ি
যেসব পুরুষ প্রেমের ঘূর্ণিতে
অন্ধভিখিরী বানিয়ে ফেলে গেছে শ্মশান-রাস্তায়
তারাই কবন্ধ হয়ে পড়ে আছে
অনিদ্রিত সরাইখানায়, জাদুর তবক দেয়া পুষ্পের স্তবক হাতে

দরজা নিজেই আজ ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে ইস্পাত শহরে
রোমে রোমে জাগছে কেশর, রোমে রোমে সাতশ বল্লম
ঘড়ির কাঁটায় জেগে উঠছে মৃত মুহূর্তের নদী
প্রেমের সমস্ত শব আর কড়ানাড়া হাতগুলি ভেসে যাচ্ছে দূরে

ও তক্ষক পুরুষ সকল দরজাকে বিরক্ত করো না!

 

জন্তু

তোমার জন্তুকে বলো, আচমকা এভাবে সে যেন দাঁত না বসায়
ওটা কতদিন পর এভাবে ছিঁড়লো প্রেইরীর ঘাস?
বিদ্যুতের লতাজালভর্তি অবগুণ্ঠিত ঝরোকা,
তাদের সময় দিতে বলো উন্মীলনের, ক্ষতচিহ্ন পেতে
এইতো সাজানো ফল উন্মোচিত, একা

সে কি নিতে পারবে সৌরচুল্লীতে জন্মানো ধাতুমঞ্জরী,
শূন্যে তোলা দু’পা, প্রাচীন মহেঞ্জোদারো অথবা হরপ্পা
খুঁড়ে বের করে আনো চাঁদ, ধারালো চোয়ালে
তোমার জন্তু কি যেতে পারে অতটা পাতালে,
যেখানে তৃষ্ণার্ত চিতা উন্মুক্ত করেছে বুক?
তোমার জন্তুকে বলো খুবলে রক্তাক্ত করবার আগে
আরো একটু ধ্যানী হতে, জ্ঞানী হতে
এমন গতি ও তাড়নায় ভয় পায় আধবোঁজা ছোট সে ঝিনুক!

 

 


আরো পড়ুন: শামীম রেজার একগুচ্ছ কবিতা

রাগ

তুমি কি কামশীতল? প্রশ্ন করে বৃদ্ধ ঝাউ, এক প্ল্যাটোনিক
দেহেরও রাগ হয়, তখন অগ্ন্যুৎপাত লাগে
বিশাল সমুদ্র থেকে উঠে জানালো ভেনাস, কাম পৌরণিক

পঞ্চশর কামদেবতার, বিঁধে নাভিমণ্ডলের ক্ষারগাত্রে,
নরোম জেলিতে আর মাংসাশী চাঁদের রোঁয়ায়
কিছ মাত্র না বুঝে বালিকা দেহাগ্নি রাখলো প্রেমে, কুরুক্ষেত্রে

কতটা গভীর তুমি? ডুবো জাহাজের খোলে মাছ সাঁতরায়
খোলস ছেড়েছে মঞ্চারোহণের পূর্বে, গ্রিনরুমে
উপর্যুপরি সমুদ্র ঝড়, বিষহরা লাভা কাঞ্চানজঙ্ঘায়

বৃষ্টি ফুসলে এনেছে চিরহরিৎ জঙ্গলে, ছুঁয়েছে সে ঘাস
অর্ধভ্রমণের পর ফুরিয়েছে বাষ্প ও ডিজেল
জাহাজ ভুলেছে রুটম্যাপ, কেবিনেও থেমে গেছে জলোচ্ছ্বাস

বালিকা উদ্যানে শেষ হলো গুরুভার নিশ্বাস ও নিষ্পেষণ
সাধক নয় সে, কাঁদে অতৃপ্তিতে সাধনসঙ্গিনী
পুরুষ চিনে না রাগ, অগ্নিচূড়ো ছুঁয়ে জানে না রাগমোচন!

 

 

অসুখের প্রেমে পড়ে

অসুখের প্রেমে পড়ে থেকে গেছি তোমার সাথেই
আগুনের ফোয়ারায় স্নান, স্পর্শ করি পোড়া ত্বক
কোথাও ফোটেনি ফুল, ভ্রমরের মন গেছে উড়ে
দূরে, জানি বিভাবরী সাজিয়েছে মরণসড়ক

অসুখেরও এত বর্ণ, চেয়ে দেখি উজ্জ্বল মুকুর
তাতে আবছায়া ভেসে ওঠে রাত্রিপ্রদাহের জলা
প্রেম ছাড়া আর কোন আশ্রয় ও আহার্য চাই না
জীবাণুপরাগমাখা ওই ওষ্ঠ তৃষ্ণার পেয়ালা

লকডাউন শহরে খুলে রেখে হৃদয়ের তালা
করোনা ছোঁয়ার আগে, মৃত্যুপ্রেম তোমাকে ছুঁয়েছি
পাঁজরে কুজ্ঝটিকা, ডুবে গেছে তারার কাফেলা
শবযাত্রা শেষে, ভস্মে জল ঢেলে মেখেছি কাজল

শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যাথা এইসব ভাল লাগে খুব
প্রেমের কফিনে তুমি-আমি শুয়ে, নিরালা, নিশ্চুপ!

 

 

আফ্রিকা

একদনি দেখা হলো, কালো হীরে, তোমার উদগ্র বিষ
শিরা ভরে নিই দাহ, আমারই কালিদহ, কালিন্দিতে
মৃত্যুপ্রেমে সারারাত্রি চলে এক ইঞ্জনি, র্মমরে
দেখি আফ্রোএশিয়ান দুর্ঘটনা, হাওড়ের ভাঙছে পাঁজর
তার খুব জ্বর, ঝিঁঝিঁমুখর রাত্রিতে তোমার জঙ্গলে
খুঁজি টারজান, আমার সকল গান জেনে গেছে একান্ত হাঙর

শ্বেতাঙ্গপ্রধান দেশে কি নিয়তি, হাবশি রাত্রিতে ঢুকে যাচ্ছি
তোমার গভীর গ্রহে, কৃষ্ণপ্রদেশে, হে তরুণ আফ্রিকা!
অন্ধ এ গ্যালাক্সি, জ্বলে ক্ষুধার্ত নক্ষত্ররাজি, জাফরানি কাজ
কি সুন্দর তমসার জলে সারারাত্রি ভাসছে মান্দাস
স্পর্শমাত্রই ভাঙছে জার, গমখেত জাগে নাইজারের কুলে
সন্ধ্যার শরীরে অযুত ইয়েলো ট্রাম্পেট, আমার ভূগোল
তোমার পেশির নিচে কম্পমান, ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো
একটা উদাস করতোয়া গিলে খেল কিলিমাঞ্জারো

কালো অগ্নি, এই দেখো নাভিমূলে বসানো ফোয়ারা
তার একশ প্রশাখা খুলে বসে আছি মরুতীরে
আমি নদীমাতৃক, তাতে যদি স্নান করে তোমার সাহারা!

 

 

প্রতিশোধ

তোমার বুটের তলে পৃথিবীর দমবন্ধ গ্রীবা

নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে, ছটফট করছে অরণ্য

জলে স্থলে অন্তরীক্ষে দর্পভরা কুচকাওয়াজে

স্তব্ধ পাখোয়াজ, মাঠে মৃত তৃণ, শস্যের দাক্ষিণ্য

ভুলে আজ তোমার বন্দুক তাক করা বনদেবীর মস্তকে

রাত্রির পশম ঢাকা কুমারীপ্রকৃতির স্তনে,

                     ছুটছে ফিনকি দিয়ে রক্ত আর দুধ

তাতে তৃপ্ত হচ্ছে তোমাদের জঠর ও তৃষ্ণা,

                     কুসুমমঞ্জরী পায়ে দলে চলে গেছ

ধর্ষিতা অরণ্যযোনি ধুয়ে দিয়ে গেছে রাতভর বৃষ্টি

 

তোমার রাক্ষুসে ক্ষুধা, জন্মাবধি খেয়েই চলেছ

বিল, ঝিল, গ্রাম, পক্ষিণীর মাংস, নদীর পাঁজর

ঢেউ মুছে গেছে, জেগে আছে জলে ঘর্ঘর ইঞ্জিন

পানকৌড়ির বুক ভেদ করে চলে গেছে তোমাদের গুলি

নিজেরই খুলি ভরে পান কর রক্তমাখা জল, তোমার কুঠার

চিরে ফেলেছে পুষ্পসম্ভবা গাছ আর বসন্তের মন,

কারখানার বর্জ্যে, তেলে ও গরমে মরে যাচ্ছে মাছ

                                     তুমি লোভী, খুনি

তোমাদের লুণ্ঠনের নিচে তবু দুয়েকটি জোনাকি

জ্বেলে রেখেছে লণ্ঠন

 

তোমার বুটের তলে নিঃশ্বাস আটকে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত

মনে আছে হরিণীর, নিসর্গ রেখেছে মনে তার ফুসফুসে

                                         আগুন লাগানো

বুটের তলায় পিষ্ট হতে হতে প্রতিশোধ স্পৃহায় জেগেছে

                                         সবুজাভ বনভূমি

ছড়িয়েছে পৃথিবীর প্রতিপ্রান্তে জীবানুপুষ্পের রেণু, বেণুবনে

ক্ষমতার চূড়োয় বসেও আজ শ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছ তুমি!

 

 

copy righted by irabotee.com,shelly naz er kobita

 

শেলী নাজ

জন্ম : ১১ মার্চ ১৯৬৯, হবিগঞ্জ।

প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর , চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। মাস্টার্স অফ ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া। ডক্টরাল স্টুডেন্ট, সুইনবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া।

প্রকাশিত বই
নক্ষত্র খচিত ডানায় উড্ডীন হারেমের বাঁদি : অপরাজিতা : ২০০৪
বিষাদ ফুঁড়ে জন্মেছি বিদ্যুৎলতা : ম্যাগনাম ওপাস : ২০০৬
শেকলে সমুদ্র বাজে : অনন্যা : ২০০৭
মমি ও মাধুরী : ম্যাগনাম ওপাস : ২০০৯
চর্যার অবাধ্য হরিণী : পাঠসূত্র : ২০০৯
সব চাবি মিথ্যে বলে : ম্যাগনাম ওপাস : ২০১১
সূচের ওপর হাঁটি : বেঙ্গল পাবলিকেশন : ২০১৩
পুরুষসমগ্র : অ্যাডরন পাব্লিকেশন : ২০১৫

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত