শিশুতোষ গল্প : রোহান আসবেই । মানিক বৈরাগী
দাদি অ দাদি আমার আর ভালো লাগছে না
দিদি কই, দিদিকে অনেক দিন দেখি না
আমরা কখন বাড়ি যাবো
বলো না দাদি, মা কেন আসেনা
আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো
মা এতো দিন বাড়িতে কি করছে?
বাবা কেন আদর করে না, আগের মতো হাসে না কেন দাদি?
শুনো আমরা তখনই বাড়ি যাবো, এখানকার সবাইকে নিয়েই বাড়ি ফিরবো
যখন রোহান ফিরে আসবে।
রোহান কে
সে কোথায়?
শোনো, তোমাকে রোহানের গল্পটা বলি।
সেই দুর্যোগের সময় নাফের চরে দোলপূর্ণিমা রাতে ভিনগ্রহ থেকে লিলিথ ও তার পুত্রকন্যারা বেড়াতে আসে। ওরা প্রতিবছর দোলপূর্ণিমা সময় এখানে এসে সময় কাটায়, নাচে, আনন্দ করে, কখনো রাতের পূর্ণিমা বিদীর্ণ করে শুনা যায় অদ্ভুত সুরে তাদের গান। সেই সময় লিলিথের এক কন্যা জুড়িথ রোহানকে খোঁজে পায় নাফের চরে।
আমরা তখন দুর্যোগে তান্ডবের ভয়ে এই পাহাড়ের ঢালে আশ্রয় নিয়ে ছিলাম, রোহানকে তার মা হারিয়ে ফেলে, নাফের চরে কেয়া বনে কোথাও আর রোহানকে পাওয়া যায়নি। জুড়িথ তাকে উদ্ধার করে তার ডানায় চড়িয়ে নিয়ে যায় ভিনগ্রহে তাদের দেশে।
যাবার সময় জুড়িথ আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, রোহানকে শিক্ষা-দিক্ষায় পরিপূর্ণ মানুষের মতো মানুষ করে আবার আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিবে।
লিলিথ ও তার পুত্রকন্যারা প্রতি বছর দোলপূর্ণিমা রাতে নাফের চরে আসে। তখন তাদের সাথে রোহানও ফিরবে। আমরা রোহানকে নিয়ে উৎসব করবো, উৎসব শেষে সে আমাদের সবাইকে নিয়ে একসাথে দেশে ফিরবে। তার আগে তোমাদেরও শিক্ষা-দিক্ষায় পরিপূর্ণ মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। কিন্তু হায়, পরের বছর জুড়িথরা আর এলো না, তার পরের বছরও না, এভাবে কেটে গেল অনেকগুলো বছর। আমরা প্রতীক্ষায় অস্থির হয়ে আছি। রোহানের মায়ের কান্নার রোল ওঠে নাফের ঢেউয়ে, যেন থামতে চাইছে না।
এখন তোমার কান্না থামাও দাদাভাই
হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করে পড়তে বসো।
জুড়িথ লিলিথের মানবপ্রেমিক কন্যা । কোনো এক দেশের রাজপুত্রের সাথে লিলিথের প্রেম হয়েছিল। সেই প্রেমিকের ঔরসে জুড়িথের জন্ম। তাই মানুষের প্রতি জুড়িতের একটা টান আছে। আর এই টান থেকেই হয়ত জুড়িথ রোহানকে খুঁজে পেয়েছিল। সেদিন দোলপূর্ণিমার রাতে জুড়িথ হাঁটছিল নাফের তীরে কেয়ার বনের ধারে। জুড়িথ কেয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করছে আর মনের আনন্দে গান গাইছে। কিছু দূর যেথেই তার কানে ভেসে এলো করুন কান্নার সুর। জুড়িথ সামনে যতই এগোয় ততোই করুন কান্নার ধ্বনি প্রবল বেগে শুনতে পাচ্ছে । জুড়িথ বুঝতে পারল কাছাকাছি কোথাও এক মানব শিশু কাঁদছে। করুণ কান্নায় তার মনে ভাবাবেগ শুরু হলো।
আরো পড়ুন: হ্যালো আন্টি
সে চারদিকে তাকায় আর খেয়াল করে কোথা হতে আসছে এমন করুন কান্না। সে কান পাতে আর তাকায় কিছুদূর যেতেই দেখতে পায় একদম নদীর কিনারে কেয়াবনের চরে ফুটফুটে জোছনার মতো মানব শিশু হামাগুড়ি দিচ্ছে আর মা মা করে কাঁদছে। জু্ড়িথ দ্রুত শিশুটির কাছে গেলো, কিন্তু আসপাশে সে কাউকে দেখতে পেলোনা, জনমানব শূন্য ধুধু বালু চর। জুড়িথ শিশুটিকে কোলে তুলে নিলো। তখনই শিশুটির কান্না থেমে গেলো।
জুড়িথ মানব শিশুকে নিয়ে দ্রুতবেগে তার মায়ের কাছে গেলো। সে মাকে বল্লো, দেখো দেখো তোমার জন্য কি নিয়ে এসেছি!
লিলিথ রোহানকে দেখে অবাক হলো-এতো মনুষ্য সন্তান!
হ্যাঁ মা, ও খুব অসুস্থ, দেখতেখুবই দুর্বল মনে হচ্ছে।
ওকে আগে খেতে দাও।
ঠিক আছে মা।
ওর কেউ নেই?
জানি না। ওইদিকে চরে নদীর কিনারে কান্নারত অবস্থায় এই শিশু মানবসন্তানকে খোঁজে পেয়েছি।মা ওকে আমাদের সাথে করে নিয়ে যাব।
শুনো জুড়িথ, এ আদম সন্তান আমাদের সমাজ কি মেনে নিবে?
মা এই একটি সুযোগ তোমার, তুমি যদি এই শিশুটির প্রতি দয়া করো তাহলে তোমার নামে যত অপবাদ আছে সব গুছে যাবে।
শুনো কোন কোন আদম সন্তানের গায়ে আমার আশীর্বাদ চিহ্ন থাকে, যদি চিহ্ন দেখো তাহলে সাথে নিয়ে যাওয়া সহজ।
জুড়িথ রোহিতের সারা দেহে লিলিথের আশীর্বাদ চিহ্ন খোঁজতে লাগলো। দেখলো তার গ্রীবায় লিলিথ চিহ্ন খোঁজে পেয়ে ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার দিয়ে বল্লো, রোহানকে আমি নিয়ে যাবো এ আমাদেরও স্বজন।
দীর্ঘ একযুগ পর দোলপূর্ণিমার রাতে লিলিথরা বেড়াতে এলো নাফের চরে। সঙ্গে এলো রোহান। জুড়িথ বিদায় জানাল রোহানকে। তার চোখে জল। চাঁদের আলোয় মুক্তোর মতো চকচক করে ওঠলো জুড়িথের প্রতিটি অশ্রুবিন্দু।
রোহানের আগমনে চারদিকে সাঁজ সাঁজ রব, চলছে উৎসবের আয়োজন। আর দূর থেকে খুশি মনে কিশোর নাতির কাঁধে হাত রেখে দাদি রোহানের ফেরার খুশিতে অশ্রুজল মুচ্ছে।
দেখো দেখো দাদা ভাই, এই সেই রোহান যার কথা তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি! রোহান ফিরেছে মানুষের মতো মানুষ হয়ে।

কবি, শিশুতোষ লেখ, নব্বুইয়ের নির্যাতিত ছাত্রনেতা, কক্সবাজার, বাংলাদেশ।
প্রকাশিত গ্রন্থ
কবিতা
১-গহীনে দ্রোহ নীল
২-শুভ্রতার কলঙ্ক মুখস্ত করেছি
৩-নৈনিতালের দিন
শিশুতোষ গল্প
১-বন বিহঙ্গের কথা
২-ইরাবতী ও কালাদান
সম্পাদক
গরান (ছোট কাগজ)
তড়িৎ বার্তা[email protected]