গত পর্বের পরে…
প্রথম পর্বঃ
দ্বিতীয় পর্বঃ
https://irabotee.com/story-10/
সার্টিফিকেটগুলো কুড়িয়ে নেই। মনে মনে বলি, সাহস নয় দুঃসাহস। এই দুঃসাহস আমার বেঁচে থাকার অন্য নাম। গর্ভধারিণী মাকে যে রক্ষা করতে পারে না, প্রেমিকার সম্মান যে ধুলায় মেশাতে ভাবে না ক্ষনকাল বেঁচে থাকার সাধ তার দুঃসাহসই বটে! পথে নামি ঠা ঠা রোদে, পথ আমাকে নেয় তার মতোই অসহায় বলে, পাপী তাপী হেঁটে যায় নিশ্চুপ কেবল নামের দাবি মেটানোর স্বার্থে শুয়ে থাকে সে। তেমন আমার অর্থহীন বেঁচে থাকার নাম অসহায় দুঃসাহস বটে!
এই শহরে একজন মানুষের খেয়ে পরে টিকে থাকতে কতো টাকা লাগে? কতো টাকা লাগে? কতো টাকা লাগে? হিসাব তো করিনি কোনোদিন! কেমন ভাবে থাকা এই থাকা? এই শহরের জ্যামে ফসিল হয়ে থাকা সার বাঁধা গাড়ি কী হিসাবে ধরবো? নাকি রেলগাড়ি দিয়ে আসতে আসতে নাক চেপে ধরা দুর্গন্ধময় বস্তির দিন, নাকি সোহানা যে বায়না ধরে, চলেন বসুন্ধরার ফুড কোর্টে যাই, সেই জীবনের হিসাব করবো? খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে কতো টাকা লাগে? টিকে থাকতে কতো টাকা লাগে? লাখ টাকার এক প্রশ্ন নিয়ে ব্যর্থ আমি বের হয়ে আসি। আবার হাঁটি…….হাঁটতে হাঁটতে পৌছে যাই সোহানার ঠিকানায়।
সে তখন নবম শ্রেণি, সে তখন ষোল। আমার পলাতক ছায়া ছুঁয়ে তার স্বপ্ন শুরু হলো…….।সপ্তাহে পাঁচদিন পড়াতে আসি বিনিময়ে সোহানার চাকরিজীবী বাবা .হাজার দুয়েক টাকা দেয়। সেই টাকায় আপাতত খাওয়া–পরার বেশ খানিকটা যোগান হয় আমার। ত্রিভুজের তিন কোনের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান বুঝতে বুঝতে বুঝতে কন্যা কখন যে মোবাইলের নাম্বার মুখস্থ করে নিলো আমি সুবোধ পারি নাই বুঝতে!
–এই যে দেখো ত্রিভূজের তিন কোনের সমষ্টি দুই সমকোন।
–স্যার আপনার মোবাইল নাম্বারটা হলো ০১৭…..
–তুমি পড়, খাতাটা কই? কম্পাসটা দেখি।
–স্যার, ধানমন্ডি সাতাশে দারুন একটা কফি শপ হয়েছে চলেন একদিন খেতে যাই।
–কাল ভয়েস চেঞ্জ পড়া দিয়ে গিয়েছিলাম। শেখা হয়েছে? বলতোইম্পারেটিভ সেনটেন্সে ভয়েস চেঞ্জ করার সময় কি দিয়ে শুরু করতে হয়?
–স্যার কারিনা কাপুরের ছেলে তৈমুরের চোখ দুটো একেবারে কারিশমা কাপুরের মতো। দেখছেন ইউটিউব এ?
–ইম্পারেটিভ সেনটেন্সে ভয়েস চেঞ্জ করার সময় লেট দিয়ে শুরু করতে হয়, যেমন…….।
–স্যার এবার জন্মদিনে আপনাকে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দেবো। ফেসবুক হোয়াটস আ্যপ ভাইভার একাউন্ট খুলে দেবো। তারপর ভিডিও কল দিয়ে কথা বলবো!
—সোহানা? সোহানা!!
আমি তারে সম্পাদ্য বুঝাই, হায় খোদা! কে তৈমুর কে কারিশমা! আমি কী তার খবর জানি? না জানার প্রয়োজন রাখি? কেমনে বুঝাই এই মেয়েরে! মেয়ে জ্যামিতিটা বুঝ,ভয়েস চেঞ্জ বুঝ। নইলে টিউশনি টা যাবে আমার!এই মেয়ে এসব বুঝেনা।
হায় সুবোধ আমি, মাটি কোপাতে কোপাতে যে পিতা জন্ম দিয়েছে আমাকে, সে মাটিতে ঠাঁই হয় নাই আমার। শেকড় ছিঁড়ে ঠাঁই হয় যেখানে, সে মাটি ঠাঁই দেয় না আমারে। কিংবা আমিই গাঁথিনা শেকড় তার গভীরে। পালিয়ে যাওয়ার নিয়তি যার তারে তুমি ডাকো কোন সর্বনাশের অতলে?
বলে কী? বলে কী মেয়ে, বয়সের রঙীন চশমা চোখে দেখে না,দেখতে শেখে নি রূঢ় বন্ধুর ক্ষমাহীন বাস্তবতা জীবনের, চশমায় কেবল তার ছাদবাগানে ফোটা রঙীন গ্লাডিওলাস আর বাহারী পাখা মেলা প্রজাপতি! ভালোবাসা……. ভালোবাসা……..আমার মতো শেকড় ছেঁড়া উত্তুঙ্গু পাতার কাছে এ বড় বিলাসী বর্ণগুচ্ছ তবু প্রলোভিত করে আকর্ষনের প্রাকৃতিক অপ্রতিরোধ্য আহবান।
আমি এক দ্বিধাযুক্ত কদমে সাড়া দেই আহবানে তার, সে দ্বিগুন আকর্ষনে কাছে টানে আমাকে। আমি প্রথমবারের মতো পুরুষ হই, ছুঁয়ে দেখি নারীর প্রেম, স্বর্গ হতে আসে প্রেম, স্বর্গে যায় চলে। এই পিঠ উপচানো কেশগুচ্ছ যেনো দূর পাহাড়ের দেশ থেকে ভেসে আসা মেঘপুঞ্জ আমাকে ডাক দিয়ে উড়ে যায় আবার অজানা রাজ্যে। চলে যায় আমার আকাশ খালি করে। আমি চৈত্রের ঊষর ভূমি, চাতকের মতো ধেয়ে যায় তার পানে জলাশয় সন্ধানে। নবযৌবনের উচ্ছ্বাস তার আবেদনে। কপোলের ভাঁজে ভাঁজে নিজেকে সপে দেয়ার বাসনা। আমি দেখি আঁখি পল্লবে তার সমূলে পুরুষ হবার সর্বনাশের আহবান, আহবান ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে……….আমি তীব্র তাড়িত হই, আমি পোঁছাতে চাই স্বর্গের সিঁড়িতে।
– স্যার, আমি এখানে। স্যার, আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনার সাথে গাছতলায় ভাত রেঁধে খাবো তবু আপনার সাথেই থাকবো স্যার……।
একদল নেশাখোর যুবক এসে ঘিরে ধরে চারদিকে
–কুত্তার বাচ্চা, আমরারমহল্লায় থাইকা আমরার উপরে বাটপারি, মাইয়া নিয়া ফূর্তি! সাহস কত!
আমি নত হই, পায়ে ধরি, কাপুরষজনোচিত, ঘৃণ্য জীবের মতো পায়ে পড়ি তাদের।
ভাই ভাই আমি কিচ্ছু করি নাই, আমি কিচ্ছু করি নাই ভাই… মেয়েটা নিজেই নিজে নিজেই চলে এসেছে, আপনারা নিয়ে যান, আমারে মাফ করে দেন স্যার……..। আমি বাপ মা হীন এতিম গরীব ভাই……..আমার প্রতি যুবকদের দয়া হয়, লালা ঝরা জিভ ঝুলিয়ে ক্ষুধার্ত হায়েনারা তুলে নেয়, সোহানার কাতর অবিশ্বাসের দৃষ্টি থেকে আমি পালাই আবার, পালাই………।
বাকী অংশ পরের পর্বে…

১৯৭০ সনের ০৭ মে হবিগঞ্জে জন্ম। জেলা শহর থেকে প্রকাশিত সংকলনগুলোতে লেখালেখির মাধ্যমেই হাতেখড়ি। শুরুটা আরো অনেকের মতোই কবিতা দিয়ে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বিশঙ্ক অভিলাষ’। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মঞ্চনাটকে। রচনা করেন কমলাবতীর পালা, বিভাজন, জ্যোতি সংহিতা ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক। অভিনয়ও করেন। মঞ্চে নাটক রচনার পাশাপাশি নিরব অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো বহমান থেকেছে গল্প লেখার ধারাটি। জীবন ও জগতকে দেখা ও দেখানোর বহুস্তরা এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার উৎসারণ ঘটেছে ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন ‘ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি’তে। ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’ প্রন্থভুক্ত গল্পগুলোতে সে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে আরও নির্মোহ, একবগগা, খরখরে কিন্তু অতলস্পর্শী ও মমতাস্নিগ্ধ। গল্প লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ ইতোমধ্যে পেয়েছেন বৈশাখী টেলিভিশনের পক্ষ থেকে সেরা গল্পকারের পুরস্কার, ফেয়ার এন্ড লাভলী সেরা ভালোবাসার গল্প পুরস্কার। ২০১৪ সাথে মঞ্চনাটকে অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘তনুশ্রী পদক’। বর্তমানে সক্রিয় রয়েছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পত্র-পত্রিকা, লিটলম্যাগ এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত অন্তর্জাল সাহিত্য পোর্টালে লেখালেখিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ সম্পন্ন করে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী অনিরুদ্ধ কুমার ধর ও যমজ সন্তান অদ্বিতীয়া অভীন্সা পদ্য ও অদ্বৈত অভিপ্রায় কাব্যকে নিয়ে হবিগঞ্জে বসবাস করছেন।
মঞ্চে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ঢাকা থিয়েটার প্রবর্তিত, ফওজিয়া ইয়াসমিন স্মৃতি পদক,থিয়েটার প্রবর্তিত জাকারিয়া পদক।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ৫টি। নাটক ২ টি ও মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস সহ প্রকাশিত গ্রন্থ ৯টি।