| 26 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: আমিই হব বার-বার । জয়া জাদবানী [Jaya Jadwani]

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

অনুবাদক-মিতা দাস

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Jaya Jadwani


জয়া জাদবানীর  জন্ম ১লা মে ১৯৫৯। জন্মস্থান কোতমাজেলা শাহডোল, মধ্যপ্রদেশ। তিনি হিন্দী ভাষা সাহিত্য ও মনোবিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর। হিন্দী ও সিন্ধি ভাষায় সমান সাবলীল জয়া জাদবানী একইসঙ্গে দুটি ভাষায় সৃজন করেছেন কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণসাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য। সাহিত্যচর্চার জন্য তিনি অর্জন করেছেন কথাক্রম সম্মান, কুসুমাঞ্জলি সম্মান এবং মুক্তিবোধ সম্মান।


আমি, সেই সমুদ্রে প্রথম বার ডুব দিলাম, সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ গুলি আমায় হাত তুলে-তুলে বার-বার নিজের কাছে ডাক ছিল ওদের সম্মোহন, ভয়ংকর! আমি চারিদিক চোখ তুলে তাকালাম…কোথাও এমন কিছুই ছিলোনা, যারা আমার পা দুটি শিকলে জড়িয়ে আমায় আটকে রাখে…দূর বহু দূর দু চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম শুধু রোদে পোড়া পাষাণ যার ফাঁক- ফোঁকরের নিচু জায়গা গুলিতে জল জমে – জমে শাওলা হয়ে গেছে। মাটিতে যতদূর চোখ যায় শুধু মেঠো রঙ, এর পাথর গুলিতে জলের স্রোতের বেগে কোথাও-কোথাও গর্ত তৈরী হয়ে গেছে আর সেই গর্তে এখনো ঘোলাটে জল জমে রয়েছে। আমি রোমান্চ খোঁজার লোভেই চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম। ভাবলাম এই ধুসর পাথর গুলি যদি এক সঙ্গে ফেটে যায়? গোটা সমুদ্রের জল যদি এই পাথর গুলি শুষে নেয়? আমরা কোন ও দিন পাথরের তৃষ্ণার কথা ভাবিনি…আমরা কোন ও দিন বালি দের পিপাশার কথাও ভাবিনি…কখনো জলের পিপাশার ও চিন্তা করিনি…আর আমরা সমুদ্রের তৃষ্ণার কথাও ভাবিনি, সমুদ্র হাথ দুটো ছড়িয়ে নদীদের নিজের কাছে ডাকে। আমাদের সীমা রেখা দেখিয়ে বলে দেয়া হয় এটা ভারত এর সীমা রেখা, অন্য জায়গায় যে সব দাগ দেয়া ওটা ভারতের নয় অন্য কোন দেশের সীমা রেখা। এটা এই দেশের–ওটা ওই দেশের মানচিত্রও ওটা ওই দেশের সীমা রেখা। সীমা রেখার কাছে কিন্তু ভয় আছে , কিন্তু আমি কি করে বলি যে আমার মন টা সীমা রেখা কে ছুঁয়ে দেখতে চায়। আমি কিন্তু মানা বা বাঁধন , নিয়ম ভাঙতে বিশ্বাসী। তাই আমি প্রন করেছি যে সীমা রেখা কে ছোঁবোই–ছোঁবোই। সীমা রেখার কাছে যদি নাই বা যেতে পারি তাহলে এই সীমা রেখা কেন? জানি না কেন যেই বস্তুটি কে ধরা ছোঁওয়া বারণ আমার কিন্তু ওই বস্তুটিকে আর বেশ করে ছুঁতে ইচ্ছে করে। মানুষের লালসার দ্বার কোথায় গিয়ে খোলে আর কোথায় গিয়ে বন্ধ হয় আমি আজো সঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।
তাই আমি সেই সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে নিজের দেহ কে হাল্কা করে ভাসিয়ে দিলাম, তরঙ্গ গুলি নিজের আক্রমক রুপেই ছিল। ওরা আমায় চারিদিক থেকে জাপটে ধরল , আর নিজেদের সঙ্গে আমায় নিয়ে চলল, অতল গভীরে, যেখানে সমুদ্রের সব জীব–জন্তু গুলি আমার দেহে নিজেদের নাম, গন্ধ ও আঁচড়ের দাগ ফেলার জন্য ভয়াভহ রুপ নিয়ে এগিয়ে আসছে। বাইরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা সব অরুচি, যার কাঁটাতার গুলি দিয়ে নিজেকে নিজে ক্ষত–বিক্ষত করে নিয়ে ছিলাম…। আর তার পর এখন আমি নিজের রক্ত নিজের জীভ দিয়ে নিজেই লেহন করতে – করতে আগামি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। আমি ও কিন্তু সেই জন্তু গুলি কে রেহাই দিলাম না, নিজের শরীরের সম্পূর্ণ জোর দিয়ে ওদের দেয়া আঁচড় হতে রক্ত ঝরাতে লাগলাম…আমি আমার শরীরের সবই অঙ্গ দিয়ে কাজ নিতে শুরু করলাম। যে অঙ্গ গুলি জানি না কত বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে ছিল। আমি লামার্ক এবং ডারর্ভিন এর বিকাশের কথাও ভাবিনি, আমি কিন্তু এক্কেবারেই ওই রকম কিছুই হতে দেবনা। আমার শরীরের লোম গুলি ছড়িয়ে – ছিটিয়ে পড়ল…এই সীমানা থেকে ওই সীমানা অব্ধি।
সমুদ্রের সমস্ত জল এখন লাল। আমার ভাবনা – চিন্তার কণা গুলি গভীর জলে মিলে – মিশে যেতে লা​গলো, নিঃশব্দে আমি নিজের বুকে একটি গান লিখলাম তারপর সবাই কে আওহান জানালাম। ওরা যারা আমায় ক্ষত – বিক্ষত করেছিল, আর সেই ক্ষত – বিক্ষত হয়ে যাওয়ার চরম আনন্দ কে উপভোগ করেছিলাম অতি আনন্দেই।
এখন এসো আমার সঙ্গে গাও, সেই হিংসক গান, যেই গানটি গাওয়ার পর যে কোনই মানুষ কিছুও করতে প্রস্তুত। এসো – এসো দেখ আমার ভেতরের হিংস জানোয়ার (জন্তু) টা চিৎকার করে কাঁদছে, ওকে সান্তনা দিও না,ও এই ধরনের ভাষা ও ​বোঝেনা। ওকে চাবুক দিয়ে কসে মারো, ওকে আর ই হিংস করে দাও। যত ক্ষণ ওর ভেতর একটুও রক্তের কণা বাকি , ওরা চুপ করে থাকবেনা। কিন্তু ওকে মরতেও দিয়ো না। ওরই জখমে পা রেখে মানুষ আজ সোজা দাঁড়ানো।
​​
এই সব ছাড়া তো কোনই মানবের কল্পনাও করা যায়না। আমি ওটাকে সবাইকার চোখএর আড়ালে লুকিয়ে লালন করেছি। সর্বক্ষণ ওকে আশ্রয় দিয়েছি , এবং ওর কাছে আশ্রয় ও ছেয়েছি। আজ আমি ওকে বেশ ভালো করে দেখতে চাই। ওর ধারালো নখে রক্ত লাগা , আর ঠোঁটে আটকানো মাংসের কণা…। ও নিজের লম্বা জিভ দিয়ে নিজের গায়ে মাখানো রক্ত চাটছে। ​রক্তের​ গন্ধটা ওর বেশ​ ভাল লাগে। কখনো-কখনো কোনো এক বিশেষ গন্ধের খোঁজ ওকে বহু কাল ধরে তাড়া করে বেড়ায়। যদি ওর খোঁজ কখোনো পূর্ণ হয় তবে ও ওকে ফুসলে-ফাসলে এতো আদিম যুগের রীতিতে কাটা -ছেরা করে যে ও আর নিজের গন্ধ বাতাসে ছড়ানোর জন্য ওর ভেতর কিছুই শেষ রয়না। নিঃশেষ হয়ে যায় পুরোপুরি। আমি ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। যদি চোখ না ফেরাই তাহলে সে জোর করে বেশ ভয়ংকর ভাবে নিজের কাছে টান​বে,​ওর চোখ দুটো যেন যাদুকরের চোখ। চোখ দুটো যেন জাদুর চমকে জলজল করছে। যদি এক বার ওর ফাঁদে পড়েছ, তাহলে আর রেহাই নেই। তার মোহজাল আমাদের ঘিরে ধর​বে। আমি সেও করে দেখে নিয়েছি। কিছু দিনের ক্লান্তির সুখ আর সন্তুষ্টি​…। আবার কোনো নতুন গন্ধের খোঁজ…।আমার গান এখন শেষের পর্যায়। আমি এখন সমুদ্রের অতল গভীরে, ওরা আমায় ঠেলে ফেলে দিয়েছে, আমি নিশ্বাস নিতে পারছিনা, আমায় নিশ্বাস নয় আস্ফালন চাই। আমায় আমার জখম গুলি নিজের দেহ থেকে আলাদা মনে হয়েছে। সমুদ্রের তীব্র তরঙ্গে ওরা এদিক-ওদিক ​ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমি ওদের ধরার চেষ্টা তে মত্ত, কিন্তু ওরা আমার হাত থেকে ফসকে- ছিটকে দূরে ছড়িয়ে পড়ছিল। আমি দেখলাম ওরা সাগরের তটের বালিতে ছড়িয়ে রইলো। ছোট-বড় জখম গুলি পুরানো শামুক ও শঙ্খের মতো সাগরের কিনারায় বালিতে বয়সের তীব্র রোদে ঝলসাচ্ছে। সন্ধ্যে নেমে এলে রোদ পড়ে যাবে আর এরাও কালো হয়ে যাবে। হঠাৎ আবার কোনো বিকেলে আমি সাগরের কিনারায় একলা বসে ওদের ছাল ছাড়াব নিজের নখের আচড়ে, আর ওদের উপর জমা দুঃখ গুলো কে পরিস্কার করব।

আরো পড়ুন: সেই সব দিনগুলোর একটা ।। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ


জলের স্রোত গুলি আমায় রীতিমতো বেশ জোরে-জোরে পাথরে আঁছাড় মারছিল। আমার হাতে যেই কোনো ও শামুক আসতো, আমি জোর করে ওর মুখ খুলে দিতাম! আমি সেই একাকী শামুকের খোঁজে ছিলাম যার ভেতর সত্যিকারের মুক্তো রয়েছে। আমার শরীর কে জানিনা কত রকমের সমুদ্রের জীবেরা ঠোঁক্কর দিচ্ছিল ও আমায় চেটেও চলছিল। ” আমি কিন্তু তোমাদেরই মত একজন …আমি ওদের বললাম “…ওরা ভুক্ষেপ ও করলোনা। পাথর গুলো আহত হয়ে ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগলো। পাথরের বালি আমার ধাক্কায় ছড়িয়ে যাচ্ছিল। গুড়ো-গুড়ো হয়ে যাচ্ছিল। বহু বছর ধরে নিজেকে ওরা সংযত করে রেখেছিল, আজ সংযম এর বাঁধ ভেঙে চুরমার করে একটি আকৃতি তৈরী হয়েছে সেই পাথরের বালি চালনি দিয়ে চেলে-চেলে, আমার দেহের মার খেয়ে-খেয়ে। আর এখন আমার দেহ বলতে আর কিছুই নেই, না রূপ, না রং,না স্বাদ, না গন্ধ, শুধু ইচ্ছার-লালসার একটি মাত্র শুকনো কাঠি।
জল আমার দেহের সঙ্গে খেলা করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো , তরঙ্গরা আমায় ছেড়ে দিল। বলল…” তুমি একা নও, “তারপর ওরা অন্য কারো তল্লাসে এগিয়ে গেল। কোনো ব্যাপারই না, শুধু আমিই তোমাকে খুঁজছিলাম তাই নয় তুমিও আমায় খুঁজছিলে তাই না? এখন আমাদের দুজনার ই অন্য আর এক জনের তল্লাস। এখন আমরা বুঝতে পারছি যে , নিজের-নিজের জখম যদি নিজেরই জীভ দিয়ে চাটা হয় এর ভেতর মারাত্মক ব্যাপার টা কী! মজা তো তখন , যখন অন্য কেউ আমাদের জখম গুলো কে চাটুক ও আমরা পা দুটি আরামে ছড়িয়ে সারাটা দুপুর রোদের আলতো তাপে রোদ পোহাই, আর শুয়ে-শুয়ে দেখি … নিজের-নিজের বিষের প্রভাব…কতটা!
আমি জল থেকে নিজের মাথা তুললাম আর চাঁদ এর কিরণ গুলো কে গিলতে লাগলাম আর ডাকলাম এসো- এসো আমার ভেতর একাকার হয়ে যাও। আমি সৃষ্টির একরূপ, একাকারোতার রহস্য এর সন্ধান পেয়ে গেছি, বুঝে নিয়েছি। আমি যা, তুমিও তাই। যা তুমি-আমিও তাই হতে পারি। আমায় রূপ দাও, রহস্য দাও, গন্ধ দাও। আমার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে নামো…আমি দেখলাম, আমার ভেতর শুধু চাঁদের কিরণ ই নয়…তারারা ও ঝরে পড়ছে…আকাশ থেকে টুকরো-টুকরো হয়ে…তারপর দেখলাম আমার গোটা দেহ টা তারায়-তারায় খচিত হয়ে উঠলো। একটা সুন্দর ঝলমল করা দেহ…আমি আহল্লাদে ভরে উঠলাম…
” দেখো আমায় দেখো …” আমি দস দিশা কে ইঙ্গিত করে বললাম…আছে কেউ …? আমার মতো। শুধু আমি ই হতে পেরেছি, শুধু আমাকেই হতে হবে। আমাকেই ভেঙ্গে টুকরো-টুকরো হতে হবে, আবার আমাকেই তৈরী হতে হবে। সৃষ্টির শেষেও সৃষ্টির অদ্ভ্যুদয় আমি ই হব…বার বার…বার বার…
আমি আমার মানচিত্রের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমি আমার সীমারেখা কে দূর থেকেই দেখলাম, দেখলাম কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা…ও চারিদিক অন্ধকার…কিছু তারারা মিটমিট করে জ্বলছে। যার টুকরো গুলি ওর উপর ঝরে পড়ছে…আর নিঃসীম অন্ধকার এ হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু মিটমিট করে এমন আলোর জন্য আমরা লক্ষ- লক্ষ বছর ধরে অপেক্ষা করে বসে রয়েছি। আর যখন ওই টুকরো গুলি ঝরে পড়ছে আমরা সবাই ক্ষুধার্থ শিয়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছি। আর খামচে-খামচে মাংসের কণাগুলি বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছি। আর তারপর সেও সেই অন্ধকারে মিশে গেল।
আমি বেরিয়ে এসে সেই পাথরটা কে দেখলাম…যাকে আমার দেহ তৈরী করেছিল…তারপর আমি নিজের দেহ কে দেখলাম…সেটা তারা দিয়ে খচিত…ওটা ঝলমল করছে। আমি একটা তারা তুললাম আর সেই আকৃতির মাথায় সেঁটে দিলাম…
“এখন তুমি খুবই সুন্দর, আমারই প্রতিরূপ।” আমি ওকে একটা চুমু খেলাম।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত