আজ ০৩ সেপ্টেম্বর ডাক্তার ও কথাসাহিত্যিক তানজিনা হোসেনের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
এক.
মে মাসের মাঝামাঝি এক তপ্ত গুমোট অন্ধকার রাতে টেকনাফ হেলথ কমপ্লেক্সের কম্পাউন্ডে অন্ধকার চিরে এক জোড়া উজ্জ্বল সাদা গোল আলো জ্বলতে দেখা গেলে ওয়ার্ডবয় তাহির ছুটতে ছুটতে এসে আরএমও তপন বড়ুয়ার ঘুম ভাঙালো। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে তপন তখন কাঠের টেবিলটার ওপর মাথা রেখে মাত্রই চোখ দুটো মুজেছিল। চোখের পাতা দুটো লেগে আসতে না আসতেই নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছিল তার, মাথার ভেতর সেন্ট মার্টিনের আকাশে ভাসতে থাকা মেঘের মত জমে উঠতে শুরু করেছিল ছেঁড়া ছেঁড়া কতগুলো সাদাস্বপ্ন। সেই স্বপ্নে কখনো বাঁশের মাচার ওপর বসে পা নাচাচ্ছিল তার ছোট বোন উপমা, পায়ের তালে তালে উপমার মোটা বেণী দুটো দুলছিল ক্রমাগত, স্বপ্নের ভেতরও তার পায়ের কমলা ফিতেওলা স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা চোখে পড়ছিল তপনের, কখনো নীল-কমলা জল রঙের পোঁচ দেয়া পরিস্কার আকাশে গোত্তা মেরে উড়ে যাচ্ছিল একটা রঙিন ঘুড়ি, আবার পর মুহুর্তেই কে যেন চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠছিল টেবিলের অপর প্রান্তে-এই সামান্য ফাইন্ডিংটাও ধরতে পারলে না? এট্রিয়াল ফিব্রিলেশন! ছি ছি, এ জীবনে আর পোস্ট গ্রাজুয়েশন হবে না দেখছি! তো ওয়ার্ডবয় তাহির যখন বিদ্যুতবেগে লাফাতে লাফাতে ‘স্যার, আইগিয়ে গুই, তাড়াতাড়ি উট্টেক’ বলে তপনের ভ্যাপসা গুমোট ঘরে প্রবেশ করে, যেখানে মাথার ওপর লম্বা ডান্ডা ওলা সিলিংফ্যান ঘটর ঘটর শব্দে ঘুরতে ঘুরতেগরম বাতাস চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আর জায়গায় জায়গায় পলেস্তরা ওঠা দেয়াল জুড়ে একটা মোটা বাদামি টিকটিকি আরেকটা মেয়ে টিকটিকিকে তাড়া করে ছুটে যাচ্ছে অনেকক্ষণ থেকে, তখনো তপন তন্দ্রার মধ্যে ইসিজির আঁকা বাঁকা ইররেগুলার দাগগুলো চেনার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রাণপণে। তাহিরের চাপা উত্তেজিত কন্ঠ তাই প্রথমে তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। ইতোমধ্যে হেলথ কমপ্লেক্সের বারান্দায় ভারি বুটের আওয়াজ শোনা যায়,আরও শোনা যায় জিপ গাড়ির পেছনের দরজা ঠাস করে বন্ধ হবার শব্দ, কোন কিছু টেনে ঘষে এনে বারান্দায় তোলে কেউ, ধপ করে পতনের শব্দ হয় বারান্দায়, আর তারপর কম্পাউন্ডের জোড়া সাদা আলো দপ করে নিভে গেলে চারদিক জুড়ে আবার নেমে আসে ঘন কালো নিকষ এক অন্ধকার; কেবল হেলথ কমপ্লেক্সের অনতিদূরে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে জ¦লতে থাকা স্ট্রিটলাইটগুলো থেকে একটা বিষন্ন হলদেটে আলোর হালকা রেখা গুমোট বাতাস ভেদ করে এসে পরিবেশটাকে আরও বিভীষিকাময় করে তোলে এই রাতে। তপনের তন্দ্রা এতক্ষণে ছুটে গেছে। কেননা ওয়ার্ডবয় তাহির আর সে এরই মধ্যে বুঝে গেছে কী ঘটেছে এত রাতে। সত্যি বলতে কি, আজকাল এই সব প্রায় নিত্যদিনেরই ঘটনা। রোজ রোজ না হলেও অন্তত সপ্তাহে তিন চারদিন তো এমনটা ঘটেই। গভীর রাতে হেলথ কমপ্লেক্সের বাইরে জোড়া হেডলাইট, বুটের আওয়াজ, ধপ করে কোন কিছু ফেলার শব্দ মানে কি তা আর তাদের নতুন করে বুঝিয়ে দেবার প্রয়োজন হয় না আজকাল। অতএব তারা তাদের পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে খুব শিগগিরই সচেতন ও তৎপর হয়ে ওঠে। এসব সময় তারা চেষ্টা করে যত দ্রুত সম্ভব গোটা ব্যাপারটা রাতের অন্ধকারে সেরে ফেলতে, যাতে ভোরের আলো দৃশ্যমান হবার আগেই হেডলাইট জে¦লে হেলথ কমপ্লেক্সের চত্বর থেকে জিপগাড়িটা জলদি স্থান ত্যাগ করতে পারে সকলের অগোচরে। তপন বড়–য়া জানে না যে ৫০ বেডের হাসপাতালে এই মুহুর্তে ভর্তি বত্রিশ জন রোগি এই গভীর রাতে ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে, এই সাদা গোল আলোর আগমন ও প্রস্থান তাদের মনে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে বা আদৌ কোন প্রভাব ফেলবে কিনা, তবু সে যথাসম্ভব গোপনীয়তা ও দ্রুততার সাথে কাজটা সেরে ফেলতেই বেশি আগ্রহী থাকে এই সব রাতে। তার একটা বড় কারণ এই যে ঘটনার কার্যকারণে তার নিজের তেমন কোন হাত না থাকলেও কেন যেন প্রতিবারই একটা অস্বস্তি আর অপরাধবোধ তাকে কুরে খেতে শুরু করে এরকম প্রতিটি হেডলাইট জ্বলা জিপের রাতের অন্ধকারে আগমন ও প্রস্থানের পর।আর সেজন্যই তারা প্রত্যেকবারদ্রুত কাগজপত্রের নিষ্পত্তি করে এই সব অস্বস্তির হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়।
তো বারান্দার আওয়াজ থেমে যাবার পর পুলিশের পোশাক পরা তরুণ কনস্টেবল এই মুহুর্তে তপনের ভ্যাপসা গুমোটঘরে এসে ঢুকলে তার ঘর্মাক্ত অল্পবয়স্ক ফরসা মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তপন কেন যেন চোখ নামিয়ে নেয়। আপাত সরল আর নরম মুখের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে তার মনের মধ্যেজমতে থাকা অস্বস্তি যেন আরও বাড়ে। সে অস্ফুট স্বরে কনস্টেবলের দিকে প্রায় না তাকিয়ে বলে-লাশ কোডে?
কনস্টেবল ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে চোখের ইশারা দিলে জিপের ড্রাইভার হেলথ কমপ্লেক্সের দারোয়ান কাশেম আলির সহায়তায় একটা মুখ বন্ধ চটের বস্তা ধরাধরি করে এনে ইমার্জেন্সি রুমের ছেঁড়া ও ইতস্তত ফোম বের হয়ে আসা র্যাক্সিনের সবুজ পেশেন্ট বেডের ওপর ফেলে। তপন এগিয়ে এসে বস্তার মুখ টেনে নামিয়ে ফেললে বাদামি রক্ত মাখা চটের বস্তার ভেতর থেকে উঁকি মারে একটা শ্যামলামতমুখ, গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কালো ঠোঁটের ওপর বেশ পুরু আর ভারিক্কি এক জোড়া গোঁফ।তপন আরও লক্ষ করে যে লোকটির চুলগুলো লম্বা, অনেকদিন মনে হয় কাটা হয় নি, আর মাথার পেছনটা ভেজা, কাদামাখা; মনে হয় এতক্ষণ কোন ডোবার ধারে বা ড্রেনে চিত হয়ে পড়েছিল শরিরটা। তার পরনের শার্টটা ছিঁড়ে গেছে, বোতামগুলো খোলা, খোলা শার্টের ভেতর একটা রক্ত আর কাদা মাখা সাদা গেনজি দেখা যায়, গেনজির গোল বড় গলার ওপর দিয়ে লোকটার বুকের ঘন কোঁকড়া কালো লোমগুলোর ওপর কেন যেন দৃষ্টি আটকে যায় তপনের। পরমুহুর্তেই সে সম্বিত ফিরে পেয়ে ওয়ার্ডবয় তাহিরকে চোখের ইশারায় বস্তাটা আরও নামাতে বলে। তাহির অসম্ভব তৎপরতায় বস্তাটা পায়ের পাতা পর্যন্ত টেনে নামিয়ে ফেলার সাথে একটা ছোট কাঁচি দিয়ে গেনজিটা মাঝ বরাবর কেটে ফেলে যাতে দেহের পুরো সম্মুখভাগ উন্মোচিত হয়।এখন লোকটার পরনে কেবল একটা ময়লা কাদামাখা হাঁটু পর্যন্ত গুটানো প্যান্ট। তপন আঘাতের চিহ্নগুলো নোট করার জন্য একটা মোটা ছাপানো প্যাডের কাগজ টেনে নেয় টেবিলের ওপর থেকে, নীল মুখওলা বলপয়েন্ট কলম তার বুক পকেটেই ছিল। মুশকিল হল যে কলমটা বের করে মুখ খুলতে গিয়ে কেন যেন হঠাৎ প্লাস্টিকের নীল মুখ তার হাত ছিটকে নীচে পড়ে গিয়ে পেশেন্টের বেডের তলা দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কনস্টেবল এরসামনে এ ঘটনা ঘটায় অকারণেই তপন একটু বিব্রত বোধ করে, যেন এমন অসতর্ক ভাবে কলমের মুখ খোলা তার উচিত হয় নি, পরমুহুর্তেই অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে মৃতের শরিরে আঘাত আর গুলির চিহ্নগুলো খুঁজতে থাকে সে নিবিষ্ট মনে। সে দেখতে পায় যে লোকটারবাম কাঁধের একটু নীচে একটা ছিদ্র দিয়ে রক্তের ক্ষীণ ধারা বেরিয়ে এসে কালো হয়ে জমে আছে বাহু আর পাঁজরের কাছটাতে। ডান হাঁটুর পাশে একটা বড় কালশিরে দাগ, কয়েক জায়গায় ছড়ে গেছে। তলপেটের ডানদিকে একটা জায়গা রক্ত জমে নীল হয়ে আছে, মনে হয় ওখানটাতে বুটের আঘাত লেগেছিল। এছাড়া সারা শরিরে তপন তেমন কোন বড় আঘাত বা গোলাগুলির চিহ্ন খুঁজে পায় না। শরিরের পাশ আর পেছন দিকটা ভাল করে পর্যবেক্ষণ করার আশায় সে এর পর লোকটার ডান হাতের কবজি ধরে দেহটা ওলটানোর চেষ্টা করতে গিয়েহঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে যায়। কেননা সে এবার আবিস্কার করে যে গুলিবিদ্ধশরিরটাতে এখনো ওম আছে, এক ফোঁটা ধিকি ধিকি প্রাণের ওম, তার চাইতে বড় কথা লোকটার নাড়িরমৃদু প্রায় নিঃশব্দ টিক টিক বহমানতা নির্লজ্জের মত এই নিস্তব্ধ রাত্রির আওয়াজ ভেদ করে তার কবজি ধরা হাতের নিচে ক্রমাগত জানান দিয়ে যাচ্ছে! বিষয়টা আঁচ করতে পেরে টেকনাফ হেলথ কমেপ্লক্সের আরএমও তপন বড়ুয়া একেবারে বিমুঢ় হয়ে যায় এই মে মাসের গরম ভ্যাপসা রাত দুইটার সময়। তার কপাল ঘামতে শুরু করে, গলা শুকিয়ে যায়।ক্লান্ত আর ঘুমার্ত তরুণকনস্টেবলের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে সে গলার স্টেথোস্কোপটা কানে লাগিয়ে ডায়াফ্রাম চেপে ধরে লোকটার লোমশ বুকের বাঁ দিকে, ঠিক হৃদপিন্ডের ওপর। নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলও চরম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে এতক্ষণে, ঘুম টুম পালিয়ে গেছে তার চোখ থেকে, বরং তার চোখে এখন ভীষণ রকমের সন্দেহ আর উৎকন্ঠা। এমনকি ওয়ার্ডবয় তাহিরও চটের বস্তার কোণা ছেড়ে দিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে তপনের গম্ভীর হতচকিত মুখের দিকে। যে কয়েক সেকেন্ড তপন স্টেথোস্কোপটা লোকটার লোমশ বুকে চেপে ধরে রাখে সেই মুহুর্তগুলো যেন শেষ হতেই চায় না। পলেস্তারা খসা দেয়াল জুড়ে প্রেমলীলা করতে থাকা টিকটিকি দম্পতিকেও কোথাও দেখা যায় না আর। কেবল পুরনো রং ওঠা সিঙ্গার সিলিং ফ্যানের ঘটর ঘটর আওয়াজ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে তখনও। নীল পোশাক পরা কনস্টেবল আর ওয়ার্ডবয় তাহির ক্রমশ অধৈর্য হয়ে ওঠে তপনের চোখ বন্ধ নিবিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে। তারা দেখে যে কোন কথা না বলে তপন বরং নিজের বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙুলি লোকটার গলার পাশে ক্যারোটিড আর্টারির ওপর টিপে ধরে রেখে আরও কিছুক্ষণ সময় নষ্ট করে। শুধু তাই নয়, তপন বড়ুয়া যখন টেবিলের ড্রয়ার খুলে আঁতিপাতি করে খুঁজে একটা পুরনো টর্চ বের করে মৃত সাব্যস্ত লোকটির চোখের পাতা টেনে ধরে চোখের মণিতে টর্চের আলো ফেলতে শুরু করে তখন যেন কনস্টেবল আর তাহিরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবার উপক্রম হয়। অবশেষে তাদের প্রতীক্ষার অবসান হয়। তপন চোখ খোলে, বৃদ্ধাঙুলি সরিয়ে নেয় গলা থেকে, টর্চটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে, স্টেথোস্কোপটাও স্থানচ্যুত হয়। কিন্তু তারপর সে যে কথাটি উচ্চারণ করে তা যেন এই গুমোট মে মাসের গরমে হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটায় এই ভ্যাপসাগরম ঘরের ভেতর। সে অস্পষ্ট ভাঙা গলায় বলে-এ তো মরে নাই! বেঁচে আছে!
দুই.
এই ঘটনার সতেরো দিন আগে, যেদিন স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয় আর র্যাব-পুলিশ বাহিনী ইয়াবার বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল এই দেশেএবং সরকারের উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ প্রেস কনফারেন্স করে বলেছিলেন যে কোন ইয়াবা কারবারি বা চোরাচালানকারীর এবার আর রেহাই নেই, একজন একজন করে সবাইকেই ধরা হবে, সেই ঘোষণার পরদিন দুপুর বারোটায় চট্টগ্রাম শহরের গরিবুল্লাহ শাহ বাস স্টেশনের হানিফ বাস কাউন্টারে বসে সেলফোনে রশিদার সাথে কথা বলছিল সফিকুল। রশিদার তীক্ষœ কন্ঠের চিৎকার এতখানি দূরত্ব ভেদ করে তার আশপাশের মানুষদের কানে প্রবেশ করছিল বলে সফিকুল খুবই বিব্রত বোধ করছিল। রশিদা চিৎকার করে বলছিল-আঁর কনো কতা তুঁই নফুনো। যেদিনা এক্ষান বিফদত ফরিবা, হেইদিনা ফস্তান ফরিবু। আলফনা কালুয়া রাতিয়াঅ দেরি গরিএরে আইসশে। রাইতর সারে নয়টা ফইরযন্ত আঁই ধরফরাই। ফোন গড়িরজি¦ ফোন বন্দ। এ্যাঁত্বে ফৌনে দশটা। দেইজি¦, কোডেত্তুন আইয়ের রিকশাত গড়ি। কবাররোর দর জিজ্ঞাই। গালোদি কনো শব্দ বাইর নর হারামজাদির।
সফিকুল বিব্রত কন্ঠে অন্যদের কান বাঁচিয়ে উত্তর দেয়-আইচ্চা, আইচ্চা। আঁই আইরগুই। তারফরে ইয়ান লইয়েরে ইথির অঙ্গে কতা কইয়ুম। তামিম্মা কোডে?
তামিমের নাম শুনে রশিদার কন্ঠ আরও ওপরের তারে ওঠে। টেকনাফের কাঠের ব্যবসায়ী সফিকুল পাটওয়ারি ক্রিকেটের ভীষণ ভক্ত, চট্টগ্রামের গর্ব জাতীয় দলের ক্রিকেটার তামিম ইকবালের নামে একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিল তামিম, তাতে কি, এই ছেলের না মন আছে পড়াশোনায়, না খেলাধূলায়। দিনমান সে ইয়ার দোমÍদের সাথে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। আজকাল পলিটিকসও নাকি করে। স্থানীয় নেতার চামচা হবার কারণে ইদানীং তার ভারি ব্যস্ততা। সভা সমাবেশ মিটিং মিছিল এ শো ডাউন করতে এলাকার পোলাপান আর মটরসাইকেল বহর জোগাড় করা, গলা ফুলিয়ে নেতার নামে শ্লোগান দেয়া, বিভিন্ন দিবসে দিনরাত রাস্তার মোড়ে উচ্চস্বরে মাইক বসিয়ে গান বাজানো থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত পার্টি অফিসে ঘোরাফেরা করাই যেন তার একমাত্র কাজ। মা বোনের খবর নেবার তার সময় কোথায়? আর এতে তারই বা দোষ কি? বাপই বা কত যেন খোঁজখবর নিয়েছে বউ ছেলেমেয়ের? পার্টি অফিসের এই রাস্তাটা কি বাপই ছেলেকে চিনিয়ে দেয় নি একদিন? রশিদার এই সব নানা অভিযোগ আর চেঁচামেচির ফাঁকে সফিকুল ইতোমধ্যে আরেকটি সেলফোন পকেট থেকে বের করে চোখের সামনে ধরে। এলাকা থেকে নেতাররাজনৈতিক কর্মকর্তার ফোন। সফিকুল চলমান ফোনে রশিদাকে বলে-‘ এখন রাখির, ফরোদি অনে কল করির’, তারপর এটা কেটে দিয়ে অন্য ফোনটা কানে ধরে-‘স্যার, স্লামালাইকুম স্যার। বলেন স্যার কেন স্মরণ করছেন এই গরিবরে।’
ফোনের ওপার থেকে কর্মকর্তা গম্ভীর স্বরে বলে ওঠেন-‘শুনছেন তো সরকারের ঘোষণা। সরকারের সাথে তাল মিলায়া আমরাও জিরো টলারেন্স শো করতেছি। কারো কোন ছাড় নাই। আপনাদের মত কর্মীদের তো এখন এলাকায় দরকার। আপনে চট্টগ্রামে কি করতেছেন?’
সফিকুল দ্রুত বলে-‘আমি দুই একদিনের মধ্যেই চলে আসতেছি স্যার। ব্যবসার কাজে চট্টগ্রাম আসছিলাম। ক্লায়েন্টের সাথে একটা মিটিং আছে আজকে, গেস্ট ঢাকা থেকে আসতেছে। ওনার জন্য হানিফের কাউন্টারে অপেক্ষা করতেছি স্যার। কথাবার্তা শেষ হইলেই রওনা দিব ইনশাল্লাহ।’
‘আচ্ছা তাইলে ফ্রি হয়ে রাতে একটা কল দিয়েন। আপনারে একটা কাজ করতে হইব চট্টগ্রামে। জরুরি কাজ।’ এই কথা বলে নেতার রাজনৈতিক কর্মকর্তা ফোনের লাইন কেটে দেন। এরই মধ্যে ঢাকা থেকে হানিফের বাস এসে থামে। ফলে সফিকুলের আর রশিদাকে ফোন দেয়া হয় না। বাস থেকে নানান কিসিমের মানুষ নেমে আসতে থাকলে সে একটু এগিয়ে যায় তার কাংখিত মানুষটির খোঁজে। প্রথমে একটি ছয়জনের পরিবার নামে, বাবা-মা, তিনটি বিভিন্ন বয়সের সন্তান আর একজন গৃহকর্মী, তাদের লটবহরের শেষ নেই। তারা নেমেই বান্দরবানের টিকিটের খোঁজ করতে থাকে, তার মানে সপরিবারে বান্দরবান বেড়াতে এসেছে। কয়েকজন পুরুষ ব্যাগ ট্যাগ হাতে দ্রুত নেমে এদিক ওদিক চলে যায়, এরা নিশ্চয় কোন কাজে ঢাকা চট্টগ্রামনিয়মিত আসা যাওয়া করে। তিন তরুণ বন্ধু পিঠে ব্যাগপ্যাক নিয়ে বাস থেকে নামে এর পর, নেমে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য সিএনজি খুঁজতে থাকে-এরা হয়তো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তাদের পিছু পিছু এসে নামে সফিকুলের কাংখিত ব্যক্তিটি-ঢাকার নামকরা ফার্নিচার ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম সাহেব। সফিকুল পাটওয়ারি এগিয়ে গিয়ে তাকে সালাম দেয়, নিজের পরিচয় দেয়, জবাবে তিনি একটু হাসেন। তারপর কপাল কুঁচকে রোদের দিকে চেয়ে বলেন-বেশ গরম পড়ছে দেখছি।
-জি ভাইসাহেব-বিগলিত স্বরে সফিকুল বলে-চলেন আমরা একটা ভাল হোটেলে গিয়া আগে খাওয়া দাওয়া করি। তারপর আপনে ফ্রেশ হয়ে নিলে সন্ধ্যায় কথাবার্তা বলা যাবে।
এরপর গেস্টকে নিয়ে সিএনজি করে সফিকুল সিডিএ এভিনিউতে বাসমতি রেস্তোরায় গিয়ে বসে। ভাত, কলমি শাক, দু রকমের ভর্তা, রূপচাঁদা মাছ আর ডাল অর্ডার দেয় দুজনের জন্য। এদের ভর্তাভাজিগুলো বেশ স্বাদের, আর রূপচাঁদা মাছ একেবারে ফ্রেশ, সেন্টমার্টিন থেকে আসে-এ কথা সে জানায় আবদুল হাকিম সাহেবকে। হাকিম সাহেব ব্রিফকেসের আদলের ছোট স্যুটকেসটা চেয়ারের পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে বাথরুমে গেলে সফিকুল একবার ভাবে রশিদাকে ফোন করা উচিত কিনা, মাঝপথে কথা থামিয়ে ফোন রেখে দেয়ায় সে নিশ্চয় এতক্ষণে রণচন্ডী হয়ে আছে, পরমুহুর্তেই ভাবনাটা বাতিল করে দেয় সে। কেননা রশিদা একবার কথা শুরু করলে আর থামবে না, আর তার কন্ঠস্বরের উঁচু পর্দা হাকিম সাহেবকে পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে ফেলতে সক্ষম। সে বরং আবদুল হাকিম সাহেব বাথরুম থেকে আসার আগে নিজের ফোনটা সাইলেন্ট করে ফেলে। এখন তার গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস আলাপের সময়।
টেকনাফ শহরে কাঠের ব্যবসা সফিকুল পাটওয়ারির। ফার্নিচারের জন্য সেগুন, গজারি কাঠ নিয়মিত সাপ্লাই দেয় চট্টগ্রামের নানা দোকানে। এই প্রথম রাজধানী ঢাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ এসেছে। ঢাকার মিরপুরের বিখ্যাত এক ফার্নিচারের শোরুমের সাথে কথাবার্তা হচ্ছে গত দুই মাস ধরে। অবশেষে তারা ফাইনাল চুক্তি সম্পাদনের জন্য পাঠিয়েছে এই লোকটিকে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আর নিজের দিনরাত পরিশ্রমে সফিকুলের ব্যবসার ক্রমান্বতি ঘটছে বিগত বছরগুলোতে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার ব্যস্ততা। ইদানীং পরিবারে সময় দেয়া যেমন কঠিন হয়ে উঠছে, তেমনি অভিযোগ আসছে বড় ভাইদের কাছ থেকেও-সফিকুলের আর রাজনীতিতে তেমন মনোযোগ নাই। এলাকার অবিসম্বাদিত নেতার সুদৃষ্টির কারণেই না তার এমন লাফ দিয়ে দিয়ে সিঁড়ি ডিঙানো গত কয়েক বছরে, তো তাকেই ভুলে গেলে কেমন করে হবে? দরকারে অদরকারে পার্টির খোঁজ খবর রাখা তো তার উচিত, নাকি? তা এত কিছু ভাবতে সফিকুলের ভাল লাগে না। বরাবরই সে একরৈখিক মানুষ, যখন যেটা করে সেটা মনপ্রাণ দিয়েই করে। একসঙ্গে একাধিক কাজে মনোযোগ দেবার মত বুদ্ধিমত্তা বা প্রতিভা কোনটাই তার নেই। যখন রাজনীতি করত, তখন খেয়ে না খেয়ে বনের মোষের মত ওটাই করে বেড়াত। আশি আর নব্বই এর দশকের পুলিশ বাহিনীর প্রচুর লাঠিচার্জের স্মৃতি পিঠে বয়ে বেড়াচ্ছে সে এখনো। তিন তিনবার জেল খেটেছে, রাজপথে বেশুমার মার খেয়েছে আর ফেরার হয়ে টেকনাফ-বান্দরবানের বনজঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে বহুদিন। চট্টগ্রামের সেসময়কার প্রবল ক্ষমতাশালী কুখ্যাত রাজাকারের বিরুদ্ধে পথে নামার কারণে রাঙুনিয়ায় তার বিভীষিকাময় দুর্গে চিরতরে গুম হয়ে যাবার আশংকাও তৈরি হয়েছিল এক সময়। সেই সময়টাতে সফিকুলের মা ধরেই নিয়েছিল যে তার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয়টি এভাবেই একদিন নাই হয়ে যাবে, কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না আর, বিশেষ করে যখন গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ানো রাজাকার মন্ত্রির বিরাগভাজন হবার পর তার ব্যক্তিগত বিচারে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের লিস্টে সফিকুলের নাম উঠে গেছে বলে হুমকি এসেছিল। পুত্রের বেঁচে থাকার সব সম্ভাবনাই যেন মুছে গিয়েছিল মায়ের সামনে থেকে। আবদুল হাকিম সাহেবকে হোটেলে উঠিয়ে দিয়ে এসে সেসব দিনের কথা ভেবে এখন হাসি পায় সফিকুলের। এক জীবনে দিন কেমন বদলে যায়! এর কয়েক বছর পরই ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কুৎসিত হাসি আর গালাগাল করেছে সেই প্রতাপশালীলোকটা, যে কিনা নিজেই অন্যের জীবন মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিত একদিন এই শহরে। আদালতে দাঁড়িয়েও দেশবাসীকে বিদ্রুপ করতে ছাড়ে নি সে। আহা, লোকটা কি কোনদিন ভেবেছিল তার সমস্ত ক্ষমতা, দর্প, আস্ফালন এভাবে একদিন এই দেশের সব মানুষের চোখের সামনে চূর্ণ০বিচূর্ণ হয়ে যাবে? তার লাশে ঘৃণায় থু থু ছড়াবে এই চট্টগ্রামেরই মানুষ যারা কিনা একদিন তাকে যমের মত ভয় পেত? এই সফিকুলের মত তরুণ কর্মীরা সেদিন রাস্তায় মার খেয়ে, পুলিশের কাছে পিঠ পেতে দিয়ে, ফেরারী আসামী হয়ে, খুনি মন্ত্রির হিট লিস্টে নাম লিখিয়ে তবেই না এই পরিবর্তন আনতে পেরেছে! সফিকুল তখন মাঝে মাঝে লুকিয়ে বাড়ি এলে মা বলত-‘এগিন ছাড়ি দেগুই বাজি, সংসারোত মন দেগুই’, তখন সে গলা ফুলিয়ে আর দশটা রাজনৈতিক কর্মীর মত ভাষণ শোনাতো মাকে। বলতো যে তার নেত্রী তো সমস্ত পরিবার হারাবার পরও বিশ্বাস হারান নাই দেশের ওপর থেকে, একজীবনে তিনি কত কিছু হারিয়েছেন আর কতবার তার নিজের জীবনের ওপরও হামলা হয়েছে, ওনার তুলনায় সফিকুলের মত একটা ফালতু জীবনের দাম আর কত? মা তখন আরও দুই দশক আগেকার সময়ের কথা ভাবত, যখন কিনা সফিকুলের বাপের নামখানাও উঠেছিল লিস্টে, যে লিস্ট তৈরি করেছিল তখন এই রাজাকাররাই, আর লিস্ট ধরে ধরে পাকিস্তানী বাহিনী তান্ডব চালিয়েছিল গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে। টেকনাফ ডাকবাংলোয় পাকিস্তানিদের ক্যাম্প বসেছিল তখন, ওখানেই ছিল তাদের টর্চার সেল। গ্রামগুলো থেকে খুঁজে খুঁজে এনে জয় বাংলার লোকেদের সেখানে পোরা হত, আর করা হত অমানুষিক নির্যাতন। তখনও অল্পের জন্যই বেঁচে গিয়েছিল সফিকুলের বাপ জিয়াউল পাটওয়ারি। কিন্তু ছেলের প্রাণ কি রক্ষা পাবে? এই স্বাধীন দেশে? যেখানে বিশ্বাসঘাতকরা পতাকা উড়িয়ে সদর্পে ঘুরে বেড়ায়?
আবদুল হাকিমের সাথে ফাইনাল কথা সেরে এবার সফিকুল একটা পরিচিত ফোন ফ্যাক্সের দোকানে বসে দুপুরের সেই কর্মকর্তাকে ফোন করে। বেশ কয়েকবার রিং হবার পরও কেউ ফোন না ধরলে সে এবার একটা সিগারেট ধরায় বেশ আয়েশ করে। ঢাকায় ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারলে তামিমকে ঢাকায় একটা বাসা ভাড়া করে দেবে এরপর। সফিকুলের খুব শখ ছেলেকে ঢাকার কোন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে। যত যাই হোক, রাজধানীর বাতাস না লাগলে পুরোপুরি স্মার্ট হওয়া যায় না। এই তো সফিকুলেরই কথা বলার ধরণ শুনে যে কেউ বুঝে ফেলবে যে সে খাঁটি চাটগাঁইয়া,এখনও ‘প’ উচ্চারণ করতে গিয়ে ‘ফ’ বেরিয়ে যায় মুখ দিয়ে। ছেলেটা রাজনীতিতে বেশি সময় দিচ্ছে আজকাল, এটা তার মার পছন্দ না। সফিকুলের নিজের মায়েরও পছন্দ ছিল না এই সব। কিন্তু সফিকুল বোঝে, এই বয়সে এভাবে কাউকে এ পথ থেকে ফেরানো যায় না। এ এক দারুণ মোহ,ভয়ংকর এক আকর্ষণ! সময়ে আপনাতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। রশিদাকে বোঝাতে হবে যে এ মোহ কাটতে সময় লাগবে ছেলের। ভাবতে ভাবতেই কর্মকর্তার ফোন এল-‘সফিকুল, ফ্রি হইছেন তো? ক্লায়েন্টের সাথে কথা হইছে?’
-জি স্যার, কাজ শেষ আপাতত।
-খবর ভাল তো?
-জি স্যার, আলহামদুলিল্লাহ। আপনাদের দোয়া।
-আইচ্ছা, তাইলে শুনেন। রাত আটটার দিকে পেনিনসুলার লেগুনা রেস্টুরেন্টে গিয়া একজনের লগে দেখা করবেন। ভদ্রলোকের নাম জানতে চাইবেন না। আমি উনার ফোন নম্বর টেক্সট করতেছি। ফোন দিলে উনি নিজেই ডেকে নিবেন। উনি একটা জিনিস দিবেন আপনাকে। খুব গোপন আর গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা। মনে রাইখেন সফিকুল, জিনিসটা আপনের জানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
সফিকুল হাসে-স্যার, কোন চিন্তা কইরেন না। জানের মায়া করি না। আপনের জিনিস ঠিকঠাক বুঝায়া দিব সময়মত। আমার উপর হান্ড্রেড পারসেন্ট ভরসা রাখেন।
ফোন রেখে সফিকুলের মনটা ফুরফুর করতে থাকে। আজকের দিনটা খুব ভাল গেল। আবদুল হাকিমের সাথে কাজটা ফাইনাল হল। বহুদিন পর পার্টির ওপর লেভেল থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বও পাওয়া গেল। ইদানীং পার্টির কাজে বেশি সময় দিতে না পারলেও বিশ^স্ত কর্মী হিসেবে নেতারা যে তার ওপর এখনো ভরসা রাখেন সেটা ভেবে বেশ আত্মশ্লাঘা হল সফিকুলের। জিইসি মোড়ে তার এক বন্ধুর বাসা আছে, চট্টগ্রামে এলে তার বাসায়ই সব সময় ওঠা হয়। পেনিনসুলা যেতে হলে এই ময়লা ঘামে ভেজা জামাকাপড় পালটাতে হবে। ঘড়িতে এখন প্রায় সাড়ে ছয়টা। আটটার মধ্যে গোসল সেরে জামাকাপড় পালটে পেনিনসুলায় পৌঁছানো যাবে তো? সন্ধ্যাবেলা ওই রাস্তায় যে ভয়াবহ জ্যাম থাকে! সফিকুল দ্রুত বেরিয়ে এসে একটা সিএনজি নেয়।
তিন.
মে মাসের গুমোট রাত্রিতে টেকনাফ হেলথ কমপ্লেক্সে সেদিন সকলের মনে হয় যেন শেষ রাতে অনেক ঝড় বৃষ্টি হবে। সাধারণত লন্ডভন্ড ঝড়ের আগেই সমুদ্র তীরবর্তী জেলাগুলোতে এমন গুমোট ভ্যাপসা গরম পড়ে। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে টেকনাফে কেবল গুমোট ভাবটাই বাড়তে থাকে, কাংখিত ঝড় বা বৃষ্টি কিছ্ইু আসে না।হতবিহ্বল কয়েকটি মানুষ এই বিশ্রি গরম আর বাতাসহীন রাতে কী করবে বুঝতে না পেরে শুধু একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে। আরএমও তপন বড়ুয়ার যে কথাবজ্রপাতের মত এ ঘরে নেমে এসেছিল তা প্রথমে বিশ্বাস হতে চায় নিউপস্থিত কারোর। ওয়ার্ডবয় তাহির বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে মৃত অথবা জীবিত দেহটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল-‘কী হন?’আর পুলিশের পোশাক পরা কনস্টেবলটি, যার বয়স বাইশ কি তেইশের বেশি হতেই পারে না, কচিমুখ, চেহারায় সারল্য, চোয়ালের ধার শক্ত হয় নি এখনো ছেলেটার, তার মুখ হঠাৎ রক্তশুন্য হয়ে পড়েছিল আতংকে। সে নিজে কোন সমাধান খুঁজে না পেয়ে উল্টো বোকার মত তপনকেই জিজ্ঞেস করে বসেছিল-কি বলতেছেন? এটা নিয়ে কী করব তাহলে?
তপন অসহায়ের মত একবার নিশ্চল রক্তাক্ত দেহটির দিকে তাকায়, তারপর আবার কনস্টেবলের দিকে, তারপর বিড়বিড় করে বলে-জেতা মানুষের ডেথ সার্টিফিকেট কেমনে দিব?
কনস্টেবলটি এবার কাঠের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে। তার নীল পুলিশের পোশাক ঘামে ভিজে কালো হয়ে উঠেছে এতক্ষণে। তার মনে পড়ে যে ঘটনাস্থল থেকে বডিটা তুলে এনে একটা নামমাত্র ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আর ডেথ সার্টিফিকেট দ্রুততম সময়ের মধ্যে যোগাড় করে আবার থানায় ফিরে যাওয়া পর্যন্তই তার দায়িত্ব। অপারেশনে সে নিজে উপস্থিত ছিল না, কে বা কারা নিয়োজিত ছিল তাও তার জানা নেই। অপটু হাতে কোন বেকুব যে এই কাজ করে তাকে এই গভীর রাতে এমন বিপদের মধ্যে ফাঁসিয়ে দিল সেটা ভেবে সে খুবই বিচলিত হয়ে ওঠে। তার মনে পড়ে যে তার নিজেরও একখানা অস্ত্র আছে বটে, কিন্তু সেটা ব্যবহার করার কোন নির্দেশ বা অনুমতি তো তার নেই, আর এই হাসপাতাল সেটা ব্যবহার করার মত কোন উপযুক্ত স্থানও নয়। সবচেয়ে বড় কথা কোন মানবশরিরের ওপর অস্ত্র ব্যবহারের কোন অভিজ্ঞতাই তার নেই, এ কাজ তাকে দিয়ে হবে বলে তার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। মাত্র তিন চার বছর আগেও এই তরুণ কনস্টেবল বাড়িতে মুরগি জবাই দেখতে পারত না, কোরবানীর সময় চোখ বন্ধ করে রাখত, আরও কয়েক বছর আগে বাড়ির বাইরে বাথরুমে গেলে মাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। তার পক্ষে এ ধরণের অসমাপ্ত অপারেশন সম্পাদন করা, সে যে কোন স্থানেই হোক, আদৌ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এই অদ্ভুত বিড়ম্বনা আর সংকটের মুখোমুখি হয়ে তরুণ কনস্টেবল একেবারে বিমুঢ় হয়ে পড়ে। তো কনস্টেবলের বিমুঢ়তার সুযোগে ইতোমধ্যে আরএমও তপন বড়ুয়া ওয়ার্ডবয় তাহিরকে দিয়ে রুমের চলটা ওঠা স্টিলের আলমারি থেকে ক্যানুলা, স্যালাইন সেট, মাইক্রোপোর ইত্যাদি বের করে ফেলেছে। তারপর নিশ্চল কিন্তু প্রাণস্পন্দন আছে এমন দেহটির বাম হাতের মাঝামাঝি স্পিরিট দিয়ে পরিস্কার করে ঘষে ফট করে ফুলে ওঠা কালচে শিরায় ঢুকিয়ে দিয়েছে ক্যানুলাখানা। অসীম তৎপরতার সাথে ওয়ার্ডবয় তাহির সেই ক্যানুলার সাথে চট করে স্যালাইন ব্যাগটা যুক্ত করে ফেলে সাথে সাথেই। তারপর আঠালো কাগজ দিয়ে সেটা হাতের কাদামাখা কালো ত্বকের সাথে এঁটে দিতে না দিতেই ফোঁটায় ফোঁটায় সেই সঞ্জিবনী তরল স্যালাইন ব্যাগের নল বেয়ে নিস্পন্দ দেহটির হাতের শিরা দিয়েলোকটারসারা শরিরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। গোটা ব্যাপারটা চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখেও কনস্টেবল কোন কথা বলে না, কেননা এ বিষয়ে কোন মতামত দেবার এখতিয়ার এই মুহুর্তে তার নেই। উর্ধ্বতন অফিসারকে একবার ফোনে বিষয়টা জানাবার তাগিদ অনুভব করলেও কী কারণে যেন সে নিজের মধ্যে কোন কর্মতৎপরতার লক্ষণ জাগিয়ে তুলতে পারে না। সে কেবল নিষ্পলক দৃষ্টিতে লোকটার নিথর দেহ আর তার হাতে লাগানো স্যালাইনের টলটলে ফোঁটাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
ওদিকে দেড় বছর আগে নানা বাড়ি থেকে ইজিবাইকে ফেরার সময় একটা মালবাহী ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে তপন বড়–য়ার ছোট বোন উপমা যখন ছিটকে টেকনাফ সড়কের পাশে ডোবায় পড়ে গড়াতে গড়াতে একটা পাথর আর আগাছার মাঝামাঝি জায়গায় লটকে ছিল, সেই দিনটার স্মৃতি কেন যেন এই মুহুর্তে তপন বড়ুয়াকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলে। উপমাকে উদ্ধার করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনতে আনতে তার ছোট্ট ফ্যাকাশে শরিরটা আরও রক্তশুন্য হয়ে পড়েছিল সেদিন, বাম পাঁজর গিয়েছিল ভেঙে, আর বাম পায়ের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া চাকায় থেঁতলানো মাংস-রক্ত-কাদাপানি মিলে মিশে উপমাকে দেখাচ্ছিল একটা কাদা মাখা ফুটবলের মত। কিন্তু তখনও তার ছোট্ট বুকের ধুকপুকানি থামে নি। সেদিন দুর্ভাগ্যবশত তপন বড়–য়ার ডিউটি ছিল না। ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার বহু কষ্টে উপমার থেঁতলানো হাতে একটা শিরা খুঁজে পেয়ে ক্যানুলা করতে পেরেছিল কেবল। খবর পেয়ে তপন বড়ুয়া ছুটতে ছুটতে হেলথ কমপ্লেক্সে আসার পর মেডিকেল অফিসার হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল-‘অনেক রক্ত বাইর হয়ে গেছে তপনদা, রক্ত যোগাড় করেন। জলদি।’ উপমার রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ, তপনেরও তাই, তপন বড়–য়া একথা শুনে ঝট করে শুয়ে পড়েছিল মেঝেতে। কিন্তু আধ লিটার ঘন কালো তরল তার শরির থেকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ হয়ে যখন তারই রক্তসম্পর্কের সহোদরার হাতের কনুই পর্যন্ত পৌঁছায় ততক্ষণে উপমা নিস্পন্দ হয়ে গেছে। সেই রক্ত তার আর কোন কাজেই আসে নি। এখন এই মে মাসের গুমোট রাত্রিতে হেলথ কমপ্লেক্সের র্যাক্সিনের কভার ছেঁড়া ফোম বের হওয়া বেডে শুয়ে থাকা মৃত অথবা জীবিত লোকটির কাঁধের পাশের ছিদ্রটা ভাল করে লক্ষ করতে করতে তপন বড়–য়া মাথা থেকে দেড় বছর আগের সেই স্মৃতি ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। গুলিটা কাঁধের বাম পাশ দিয়ে ঢুকে পিঠের ওপর দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে বোধ হয়, দুদিকেই দুটো ছিদ্র দৃশ্যমান, আর সেই ছিদ্র থেকে গল গল করে বেরিয়ে আসা রক্ত এখন কালো আর জমাট হয়ে পিঠের নিচে জমে আছে কলমের কালির মত। ভাগ্যিসফুসফুস ছিদ্র হয় নি লোকটার, কপাল বটে, তাহলে আর দেখতে হত না। আহত স্থান থেকে রক্তপাত কমে এলেও চুঁইয়ে চুঁইয়ে সামান্য কিছু রক্ত পড়ছে এখনও। তারপরও রক্ত দরকার, রক্ত! তপন বড়ুয়া তরুণ কনস্টেবলের দিকে তাকায়-‘এই লোকের রক্তের গ্রুপ জানেন? আইডিকার্ড আছে ওর?’
কনস্টেবল প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তারপর কী মনে করে নিজেই উঠে এসে লোকটার ছিঁড়ে ফেলা শার্টখানা তুলে নেয় মেঝে থেকে,কিন্তু শার্টের পকেটে কিছুই পাওয়া যায় না। সে এবার দেহটির পরনের কাদামাখা প্যান্টের পকেটে তল্লাশি চালিয়ে একটা চাবির রিং, একটা মোবাইল সেট আর মানিব্যাগ উদ্ধার করে। মানিব্যাগ হাতড়ে কাংখিত জিনিসটা পেয়ে গিয়ে তার চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ‘এই যে, পাইছি, রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ!’ তার কথা শুনে আজকে রাতে দ্বিতীয়বারের মত লাফিয়ে ওঠে ওয়ার্ডবয় তাহির-‘স্যার, কাশেম আলির তো ও ফজিটিভ। ইবারে ডাকিয়া আনি?’
এই বলে ওয়ার্ডবয় তাহির হেলথ কমপ্লেক্সের দারোয়ান কাশেম আলিকে ডাকতে চলে গেলে তরুণ কনস্টেবল এবার অচেনা লোকটির সেলফোন আর মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে কাঠের রং ওঠা চেয়ারে বসে পড়ে। সে মনোযোগ দিয়ে মানিব্যাগটার প্লাস্টিকের পকেটের মধ্যে একটা ভিজিটিং কার্ড পড়ে দেখে, রক্ত লেগে বাদামি হয়ে গেছে কার্ডটা। মানিব্যাগের ভেতর কতগুলো খুচরো টাকা, দুটা লন্ড্রির রশিদ আর একটা ফার্নিচারের দোকানের কার্ড খুঁজে পায় সে। তারপর সে সেলফোনটা অন করে স্ক্রিনের কভারফটোটা দেখে, স্ক্রিনটা একটু ফেটে গেলেও কভারফটোটা জ্বলজ্বল করছে ওতে, তাতেমাঝবয়েসি গোঁফওলা লোকটার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ভীষণ হাসছেএকটি সদ্য গোঁফ ওঠা তরুণ।সেলফিটা তরুণটির হাতেই তোলা, কেননা তার হাত উঁচু হয়ে আছে ফটো তুলতে গিয়ে, আর লোকটা তখন খুশিতে ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তরুণটিকে। দুজনের চেহারার মিল দেখে তাদেরকে বাপ ছেলে বলে সনাক্ত করে ফেলে কনস্টেবল, কেননা দুজনেরই হাসির ভঙ্গি এক রকম- উদাত্ত, প্রাণখোলা আর বাঙময়, আর দুজনেরই কপালের কাছটা এক রকম দেখতে, একটু চাপা, চোয়াল একটু ভাঙা। বাপ ছেলের এই হাসির ঝলকানি দেখে তরুণ কনস্টেবল কেন যেন আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে এত রাতে, এই হেলথ কমপ্লেক্সের গুমোট ভ্যাপসা গরমে, একটা জীবিত অথবা মৃত শরিরের সামনে বসে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি থানার গোলাপপুর গ্রামে ফেলে আসা নিজের পিতার হাসিমাখা মুখটা এই সময় হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার। প্রথম পুলিশের চাকরি হবার পর আব্বাজান এরকমই এক হাসি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে দুই হাত বাড়িয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিন। এইচএসসি পাশ ছেলের একটা নিশ্চিন্ত আর নির্ভার জীবনের স্বপ্ন বুনছিল তখন তার বাবা।সরকারি চাকরি, নিশ্চিত বেতন বোনাস, রেশনের চাল ডাল নুন চিনি, পুলিশ লাইনে ফ্রি থাকার ব্যবস্থা, আর কি চাই? যদিও তরুণ কনস্টেবলের মা উৎকন্ঠিত কন্ঠে বলেছিল-‘ওগগা টেরেনিং ওত বলে ম্যালা কষ্ট দেয়, হুনচোস নি? আমার ফুতে ফাইরব নি?’ মায়ের এই কথা শুনেই তারা বাপ ছেলে সেদিন পরস্পরের কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে এভাবে জোরে হেসে উঠেছিল সেদিন, এখন বেশ মনে পড়ে যায় তরুণ কনস্টেবলের। এখন প্রায় জীবন্মৃত একটি দেহের কাদামাখা প্যান্টের পকেট থেকে আবিস্কৃত মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে এই বাপ-ছেলের হাসির ছবি দেখে বিভ্রান্ত ও কিংকর্তব্যবিমুঢ় কনস্টেবল ভুলে যায় যে তার একটি ডেথ সার্টিফিকেট সমেত ডেডবডি সহ থানায় ফিরে যাবার কথা ছিল। নাইট ডিউটি শেষ হলে পুলিশ লাইনে ফিরে গিয়ে গোসল করে একটা ঘুম দেবে বলে ভাবছিল সে, অথচ কী একটা গ্যাঁড়াকলে আটকে গেল এখানে। আজকাল নাইট ডিউটিগুলো হয়ে উঠেছে খুবই ব্যস্ততায় ভরা, প্রায় রোজ রাতেই কোথাও না কোথাও অপারেশন চলছে, র্যাব পুলিশের সাথে এনকাউন্টারে মারা পড়ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। তরুণ-যুবক-মাঝবয়েসী নানা কিসিমের নানা বয়সের মাদক ব্যবসায়ী মরে পড়ে থাকছে এখানে ওখানে, ডোবার পাশে, বিস্তৃত মাঠে, সমুদ্রের পাড়ে কি জঙ্গলের ভেতর। দেশটা এবার ইয়াবামুক্ত না হয়েই যায় না। তাই নাইট ডিউটি মানেই সেই সব অকুস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ ডেডবডিগুলোকে টেনে হিঁচড়ে এনে বস্তায় ভরে রাতের অন্ধকারে হেলথ কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা আর ডেথ সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার থানায় সোপর্দ করা। তো কাজটা মোটামুটি নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হয়ে আসছিল এত দিন। হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তাররাও এই রুটিন কাজে বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে আজকাল, বেশি বাক্যব্যয় বা সময় নষ্ট না করে যথাসম্ভব দ্রুত কাজ শেষে কাগজপত্র বুঝিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছে তারা। কিন্তু আজকে রাতের মত এমন অদ্ভুত সংকটময় পরিস্থিতি আর কখনো তৈরি হয় নি। কেন যে সে ড্রেনের পাশে পড়ে থাকা বডিটা উঠিয়ে বস্তায় ভরার সময়ই বুঝতে পারল না যে লোকটির মৃত্যু তখনও নিশ্চিত হয় নি, সেক্ষেত্রে উপস্থিত অফিসারদের ঘাড়ে এই দুশ্চিন্তার বোঝাটি অতি সহজেই চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হত। এখন এত রাতে এই আধা জীবিত-আধা মৃত লোকটিকে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে হত না তার। তরুণ কনস্টেবল এবার সংকটের সাথে একটু বিরিক্তও বোধ করতে থাকে। এই লোকটাই বা কেন এমন যমের অরুচি! দু দুটো গুলির শব্দ শুনেছে কনস্টেবল আজ রাতেখুব কাছ থেকে, যার অন্তত একটা তো একে এফোঁড় ও ফোঁড় করে দিয়ে চলে গেছে, তারপরও এই লোক কীসের আশায় বেঁচে আছে যেখানে তার মরে যাওয়াই উচিত বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে? এই পর্যন্ত ভেবে কনস্টেবল হঠাৎ এক ভিন্ন ধরণের অনুচিত ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে আজ রাতে দ্বিতীয়বার জটিল সংকটের মুখোমুখি হয়। ভাবনাটি হল এই যে-এই বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার সিদ্ধান্তগুলো আসলে কোথা থেকে আসে? তার এখন মনে পড়ে যে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির গোলাপপুর গাঁয়ে তিন বছর আগে পুকুরের পানিতে ডুবে মরে গিয়েছিল তার চার বছর বয়সী ছোট্ট ভাতিজা সুমন, ফুটফুটে যে ভাতিজাটা খুবই প্রিয় আর আদরের ছিল কনস্টেবলের। তাদের বংশের প্রথম পুত্রসন্তান ছিল সে, তার বাপ মানে কনস্টেবলের বড় ভাই সৌদি আরবে শ্রমিকের কাজ নিয়ে চলে যাবার পর ছোট্ট সুমন প্রায় রাতে তার বিছানায়ই ঘুমাতো, কেননা তার মা অর্থাৎ কনস্টেবলের ভাবি এর মধ্যে গত বছর ভাই এক মাসের জন্য দেশে আসার কারণে সম্প্রতি আরও একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে ফেলেছে, আর সেই নবজাতকটি প্রায় সারা রাতই জেগে থাকে। সুমন ঠিকমত ঘুমাতে পারে না মায়ের কাছে। তো প্রিয় এই ভাতিজা যেদিন বিকেলে উঠানে ফুটবল খেলতে নেমে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে গেল আর তার পর প্রায় তিন ঘন্টা ধরে খোঁজাখুজির পর তার ছোট্ট নীল ফুলে ওঠা শরিরটা ভেসে উঠতে দেখা গেল তাদেরই বাড়ির পেছনের নারকেল গাছ ঘেরা পুকুরের পানিতে, তখন তরুণ কনস্টেবল শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। তখনও লাশ দেখতে সে এখনকার মত এতটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে নি, মৃত্যু তাকে বিচলিত করত তখন খুব, অস্বস্তি হত তাজা রক্ত দেখলে, এমনকি সেটা সামান্য মুরগি বা কোরবানীর গরুর মৃত্যু হলেও। তো সব সময় চাচার সাথে লেগে থাকা চার বছরের ভাতিজার লাশটা দেখার পর প্রায় এক সপ্তাহ কনস্টেবল কারো সাথে কথা বলে নি, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে নি, গোসল করে নি, দাড়ি কামায় নি। তার অবস্থা দেখে শোক সামলে ওঠা তার বাবা মানে মৃত নাতির দাদা মৌলানা কুরবান আলি একদিন মাগরেবের পর তার কাঁধে হাত দিয়ে বলেছিলেন-আমাদের মৃত্যু কখন কোথায়,কীভাবে হবে তার সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া হয়ে গেছে বাবা, এইটা পরিবর্তনের এখতিয়ার মানুষের হাতে নাই! এখন তিন বছর পরে কনস্টেবলের তার আব্বাজানের সেই অমোঘ বাক্যের কথা হঠাৎ মনে পড়ে যায়। মানুষের মৃত্যু বিষয়ক সিদ্ধান্ত, যা কিনা বহু আগেই সাত আসমানের ওপর নির্ধারিত হয়ে যাবার কথা, সেই সিদ্ধান্তের গুরুভার আবার মর্ত্যের মানুষের হাতেই কীভাবে বর্তায় তা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। তার চেয়ে বড় কথা এখন এই হেলথ কমপ্লেক্সের ছেঁড়া র্যাক্সিনের কভার ওলা বেডে শুয়ে থাকা লোকটির ব্যাপারে সিদ্ধান্তটি অপরিকল্পিত বা অসমাপ্ত রয়ে গেল কার ভুলে, সৃষ্টিকর্তার না মানুষের, সেই প্রশ্ন তার সামনে একটি নতুন সংকটের সৃষ্টি করে। তার মানে কি আসলে এই লোকটার মৃত্যুর সময় এখনো আসে নাই? সাত আসমানের ওপর ফেরেশতা আজরাইল কি এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মোটেও অবগত ছিলেন না ? এই মারাতœক ভুলটা তবে কার? গোটা ব্যাপারটা একটা হেঁয়ালির মত মনে হয় তরুণ কনস্টেবলের কাছে। তিন বছর আগে ভাতিজা সুমনের ফুলে ওঠা নীল চকচকে লাশ যখন উঠানে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন তার ভাবি, মানে সুমনের মা সেই দৃশ্যটি দেখে কেমন প্রস্তরের মত কঠিন আর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, ক্রন্দন বা আহাজারি কোনটাই তার মুখ দিয়ে বের হয় নি, সে কেবল অপলক দৃষ্টিতে সন্তানের নিথর মুখের দিকে চেয়েছিল সারাটা ক্ষণ। এই সব দৃশ্য একের পর এক এখন কনস্টেবলের চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। তারপর সে এই রাতে তার তৃতীয় অনুচিত ভাবনাটি ভেবে ফেলে আরও বিব্রত আর বিচলিত হয়ে ওঠে-এই লোকটির মা-ও সন্তানের মৃতদেহ দেখে এই মে মাসের অসহ্য গুমোট রাত্রে কি ওরকমই প্রতিক্রিয়া দেখাতো? পাথর হয়ে যেত কি তার ভাবির মত, যে কিনা গত তিন বছরে আর স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারল না, মাঝ রাতে কি ভর সন্ধ্যায় যে এখনও বাড়ির পেছনের পানা পুকুরের পাড়ে গিয়ে ভুতের মত দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা, পেছনে পড়ে থাকে বাড়া খাবার, এক গাদা সংসারের কাজ, চিৎকার করে কাঁদতে থাকা ছোট মেয়েটা-তবু তার হুঁশ হয় না! যদি সকল মৃত্যু আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তবে তার জন্য এত শোক করা কেন?
চার.
হোটেল পেনিনসুলার পঞ্চমতলায় ল্যাগুনা রেস্তোঁরায় ঢোকা মাত্র সুন্দরি অভ্যর্থনাকারী মিষ্টি হেসে সালাম দিয়ে সফিকুলের কাছে জানতে চায়-‘ স্যার কি কাউকে খুঁজছেন, না একাই এসেছেন? ’সফিকুল এই কথার উত্তর দিতে একটু বিলম্ব করে। বিশাল রেস্তোঁরার এদিক ওদিকে টেবিলের ওপর সাজানো নানান দেশি বিদেশি বিচিত্র খাবারের বহরের দিকে তাকিয়ে তার প্রথমে আশ্চর্য লাগে-এত খাবার কীভাবে একজন মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব? দূরে দূরে দু একটি টেবিলে বিচিত্র পোশাক পরা নারী পুরুষ জাপানি, মেক্সিকান, থাই বা ভারতীয় খাবারের নাম না জানা বিভিন্ন আইটেম প্লেটে নিয়ে গুজ গুজ করে গল্প করছে, হাসিতামাশা করছে, চামচ দিয়ে মুখে তুলছে।এদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশি লোককেও দেখতে পায় সফিকুল। নিজেকে কেন যেন এখানে একটু বেমানানই লাগে সফিকুলের। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা আর রাস্তার রাজনীতি করা সফিকুল পাটওয়ারি কখনো এই সব অভিজাত মহলে চলাফেরা করে নি আগে। এমনকি তার নিজের দল সরকার গঠন করার পরও না। অথচ তার চোখের সামনেই কত পথের ফকির রাতারাতি বিশাল বড়লোক হয়ে গেল সরকার পালটানোর পর এই কয়েক বছরে। এখন এই ঝা চকচকে হোটেল আর এর আধুনিক সব ক্লায়েন্টদের দেখে তার আবারও আফসোস হয়-নাহ, সে আসলে সত্যিকারের স্মার্ট হয়ে উঠতে পারল না এখনো, ‘ফ’ বলা চাটগাঁইয়াই রয়ে গেল আজীবন! কিছুক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকার পর অপেক্ষমান এক সুবেশী ওয়েটার তাকে সাদরে নিয়ে গিয়ে কোণের দিকে একটা ছোট টেবিলে বসায়, ন্যাপকিন খুলে দেয়, তারপর আদবের সাথে জিজ্ঞেস করে-স্যার, কী ধরণের কুইজিন আপনার পছন্দ?
ঠিক এই সময় সফিকুলের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। সে দ্রুত পকেট থেকে মোবাইল বের করে কানে চেপে ধরে চাপা কন্ঠে বলে-হ্যালো। ওপাশ থেকে একটা অপরিচিত কন্ঠ জবাবে বলে ওঠে-সফিকুল সাহেব, আপনি লিফটের পনেরোতে রুফটপ রেস্তোঁরায় চলে আসেন।
অগত্যা এখানকার লোভনীয় সব খাবারের আহ্বান উপেক্ষা করে সফিকুলকে উঠে যেতে হয়। সে সুবেশী ওয়েটারকে ‘সরি’ বলে ল্যাগুনা থেকে বের হয়ে আবার লিফটে উঠেসবচেয়ে ওপরের সংখ্যাটিতে টিপে দেয়। লিফটের মধ্যে একজন থাই লোক কারো সঙ্গে অদ্ভুত ভাষায় ফোনে কথা বলতে থাকে, মনে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে লোকটি খুব বিরক্ত, সফিকুল আগ্রহ ভরে তার অচেনা ভাষা আর ভাবভঙ্গি দেখতে থাকে। একটু বিরক্ত হয়ে লোকটা এগারোতে নেমে গেলে সফিকুল এবার লিফটে একা হয়ে যায়। কাঁচ ঘেরা লিফট থেকে চট্টগ্রাম শহরের নতুন ফ্লাইওভার আর আলো ঝলমল রাস্তা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় সে, কী সুন্দর এগিয়ে যাচ্ছে দেশটা, তার যৌবনের চট্টগ্রামের সাথে এখনকার চট্টগ্রামের কোন মিলই নেই!কেবল ট্রাফিক জ্যাম আর বর্ষায় রাস্তায় পানি জমার সমস্যাটা না থাকলে চট্টগ্রাম এখন আধুনিক আর অভিজাত নগরী। তো লিফটের পনোরোতে নেমে সে দেখে রুফটপ রেস্তোরাঁয় যত্রতত্র বিভিন্ন বয়সী লোকেরা মূলত নানা রঙের পানীয় নিয়ে বসেছে, এদের মধ্যে বিদেশিই বেশি, এখানে মেয়ে প্রায় নেই বললেই চলে। হালকা সূরের মিউজিক বাজছে চারদিকে, রেলিং এর গায়ে জ¦লছে নানা রঙের মরিচ বাতি। রুফটপের অস্পষ্ট আলোয় চোখ মানিয়ে নেবার পর একজন অচেনা লোক তার কাছে এসে প্রায় কানে কানে বলে-ওই শেষ টেবিলটাতে বসেন স্যার, এনি ড্রিংকস?
সফিকুল দেখে শেষ টেবিলটাতে একজন মাঝবয়েসী দীর্ঘদেহী সুঠাম লোক বসে আছে, পরনে ধূসর রঙের সাফারি। লোকটা খোলা আকাশের পশ্চিম প্রান্তে একটা জ্বলজ্বলে তারার দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে আছে, যেন সে একজন কবি, মরিচবাতির আলোয় তাকে কেমন ঝাপসা আর রহস্যময় লাগে। সফিকুলের বিশ্বাস হয় না যে এই ব্যক্তিটিই সেই মহা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, যার কথা রাজনৈতিক কর্মকর্তা বলেছিলেন, যার পরিচয়টাও জানতে চাওয়া নিষেধ! সে এগিয়ে টেবিলটার সামনে গিয়েআদবের সাথে বলে-‘স্লামালেকুম স্যার।’ লোকটা কোন উত্তর দেয় না, কেবল দূর আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে এনে আনমনা ভঙ্গিতে চোখের ইশারায় তাকে বসতে বলে।
চট্টগ্রামের প্রবল প্রতাপশালী রাজাকারের বিরুদ্ধে পথে নামার পর বিগত দশকে যখন হিটলিস্টে নাম উঠেছিল সফিকুলের, সে সময় খুনি মন্ত্রীর পোষা গুন্ডা আর পুলিশ এর হাত থেকে বাঁচার জন্য সফিকুলকে বনে বাদাড়ে পালিয়ে বেড়াতে হত সারাক্ষণ। তার মা বিলাপ করে বলত যে একাত্তরে ঠিক এইভাবে খুনিদের লিস্টে নাম ওঠা সফিকুলের বাপ জিয়াউদ্দিন পাটওয়ারি গোটা নয়টা মাস কীভাবে সর্বক্ষণ আতংকে অস্থির করে রেখেছিল তার মাকে আর গোটা পরিবারকে, সেই পোড়া কপাল আর আতংকের জিন্দেগি তার এখনো গেল না। হঠাৎ করে কেন যেন সেই দুঃসময়ের কথা এখন এই নয়নাভিরাম পাঁচতারা হোটেলের রুফটপ রেস্তোঁরায় বসে মনে পড়ে যায় সফিকুলের। গত বছর নিউমোনিয়া হয়ে মা মারা গেছেন একটা ক্লিনিকের আইসিইউ তে। ডায়াবেটিস আর কিডনি রোগ তাকে কাবু করে ফেলেছিল। যে মা সারাটা জীবন স্বামী আর সন্তানের নিরাপত্তার জন্য লড়াই করেছেন, চরম দুঃসময়েও পরিবার নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রাম করেছেন, শেষ পর্যন্ত একটা সামান্য ব্যাকটেরিয়ার কাছে হার মেনে চলে যেতে হয়েছে তাকে। মা বেঁচে থাকলে সে একবার নিশ্চয় তাকে এই হোটেলে খেতে নিয়ে আসত একদিন, মনে মনে ভাবে সফিকুল, আহা, মায়ের জন্য তেমন কিছুই করতে পারল না সে এই জীবনে। জীবনসায়াহ্নে এসে মা খানিকটা নিশ্চিন্ত নির্ভরতা পেয়েছিলেন এই ভেবে যে দিন বদল হয়ে গেছে, স্বামী ও সন্তানের পক্ষের সরকার এখন ক্ষমতায়। তার চেয়ে বড় কথা স্বাধীনতার বহু বছর পর একাত্তরের ঘৃণ্য রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল পুরো দেশ কয়েক বছর আগে, আর যা কেউ কোনদিন এই চট্টগ্রামে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে নি তাও সম্ভব হয়েছে তার জীবদ্দশায়-প্রবল প্রতাপশালী রাজাকারেরও বিচারে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়ে গেছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। এখন আর তাদের পরিবারের পেছনে ছুরি হাতে কোন নিষ্ঠুর ঘাতক দাঁড়িয়ে নেই। তার উড়নচন্ডী পুত্র সফিকুলও শেষ পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্য আর সংসারে মন দিয়েছে, রাজনীতির প্রয়োজন ফুরিয়েছে তার কাছে, কেননা রাজপথে নামার মত কোন ইস্যু আর অবশিষ্ট নেই। দেশ জুড়ে শান্তি ফিরে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউদ্দিন পাটওয়ারিও এতদিন পর রাজাকারমুক্ত দেশ ফিরে পেয়ে মনের শান্তিতে আর ছেলেকে স্থিতু হতে দেখে সব ছেড়েছুড়ে জীবনকাহিনী রচনায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। কারণ মাঝে মাঝে সভা সেমিনার বা স্বাধীনতা দিবস বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়া ছাড়া তার তেমন কোন কাজ ছিল নাঅবশেষে। কিন্তু স্ত্রীর মুত্যুর পর তিনিও কেমন যেন নরম হয়ে পড়লেন, পরের বছরই স্ট্রোক করল তার, একপাশ অবশ হয়ে রইল কিছুদিন। ফিজিওথেরাপি আর সার্বক্ষণিক সেবাযত্নে সেই পাশটির শক্তি কিছুটা ফিরে পেলেও স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেল জিয়াউদ্দিন পাটওয়ারির।তার জীবনী লেখা অসমাপ্ত রয়ে গেল। নাইট্যংপাড়া বধ্যভ’মিতে পাকবাহিনীর হাতে আড়াইশ নীরিহ লোকের মৃত্যু, কিংবা টেকনাফ ডাকবাংলোয় পাকিস্তানী ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে অমানবিক সব নির্যাতনের কাহিনী, আর তখনও নাফ নদীর ওপার থেকে পরিচালিত গেরিলাযুদ্ধ-এ নিয়ে যে ধারাবাহিক স্মৃতিকথা তিনি লিখছিলেন টেকনাফ নিউজ পত্রিকায় তা বন্ধ হয়ে গেল মাঝপথে।জিয়াউদ্দিন পাটওয়ারিএকেবারে আনকোরা নতুন এক জীবনে প্রবেশ করলেন যে জীবনে অতীতের আর কোন হাতছানি নেই, কোন কষ্টকর বেদনাদায়ক স্মৃতি আর তাকে বিরক্ত করে না এখন, তিনি কেবল খাওয়া-ঘুম-বাহ্য কর্মে ব্যস্ত এক অর্থহীন বর্তমানে বন্দি হয়ে পড়লেনঅবশেষে।সফিকুল আফসোস করে-সুদিন এল বটে, কিন্তু মা বাবা সেটা উপভোগ করতে পারলেন না পুরোপুরি। এই যে চট্টগ্রামের সবচেয়ে অভিজাত হোটেলের ছাদে বসে সে দলের খুবই উচ্চপর্যায়ের নিদের্শে রহস্যময় ব্যক্তিটির সামনে বসে আছে কোন মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পেয়ে, এই গল্পটা যদি বাবাকে বলে বোঝানো যেত!
ধূসর সাফারি পরা লোকটি এবার একটা সিগারেট ধরায়। লোকটার চুল ছোট করে ছাঁটা, আর্মি অফিসারদের মত, চোয়ালের ধার দুটি শক্ত, আর চোখ দুটো ভীষণ ভীষণ ঠান্ডা। সফিকুল মনে মনে ভাবে লোকটি হয়তো কোন বিশেষ বাহিনীর সদস্য, অথবা কোন গোয়েন্দা। নিজেকে এই প্রবল ব্যক্তিত্বশালী ও স্মার্ট লোকটির সামনে খুবই ক্ষুদ্র আর অসহায় মনে হতে থাকে সফিকুলের। আবারও নিজের স্মার্টনেস আর সপ্রতভিতা নিয়ে হীনমন্যতা দেখা দেয় তার মধ্যে। সে সোজা হয়ে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। আশ্চর্য ব্যাপার, লোকটাও মনে হয় অপেক্ষাই করে কোন কিছুর জন্য, নাকি সফিকুলকে নীরবে পর্যবেক্ষণ করে কে জানে। সিগারেটটা শেষ হয়ে গেলে এবার লোকটা নড়েচড়ে বসে এবং আজকে রাতে প্রথম কথাটি উচ্চারণ করে-আপনিই সফিকুল পাটওয়ারি?
সফিকুল হাসতে চেষ্টা করে-জি¦ স্যার।
লোকটা অবাক হয়ে বলে-স্যার কেন? আমি তো আপনার বস নই। আপনি আমার চাকরি করেন না।
সফিকুল ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে যায়-না, মানে-
-আমার নাম সরাফতউল্লাহ। -লোকটা হাত বাড়িয়ে দেয় আন্তরিকতার সাথে। সফিকুল হাত মেলায় তার সাথে। ঠান্ডা শক্ত নিষ্ঠুর হাত। কেন যেন তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোতে নেমে যায়। এই লোকটা, দারুণ ভদ্রলোক আর বিনয়ী হলে কী হবে, আদতে ভয়াবহ রকমের নিষ্ঠুর, মনে মনে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় সে। একটা শীতলকরমর্দন শেষে লোকটা বলে-আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হ্যান্ডওভার করতে হবে।
-আমি শুনেছি স্যার-বলে ‘স্যার’ কথাটা আবার উচ্চারণ করে লজ্জায় জিভ কাটে সফিকুল।
-জিনিসটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয় শুনেছেন।
-আন্দাজ করতে পারছি।
-কাক পক্ষী কেন, পিঁপড়াও এ বিষয়ে কিছু জানবে না। বুঝলেন তো?
-এই সফিকুলের জান থাকতে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। একশ পার্সেন্ট।
-গুড।-এই বলে লোকটা হাসে। তারপর বলে-আপনি কোন ড্রিংকস নেবেন? বিয়ার, বা হুইস্কি?
সফিকুল অপ্রতিভ ভঙ্গিতে দুদিকে মাথা নাড়ে। এ জীবনে সে মদ্যপান করে নি। ছাত্রজীবনে মায়ের মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল কখনো হারাম খাবে না। সফিকুল মায়ের কথা রেখেছে। সিগারেট অবশ্য খেত খুব, হাই প্রেশার ধরা পড়ার পর সেটাও ছেড়েছে। যৌবনে ধর্মকর্মে মন ছিল না, মা মারা যাবার পর ধর্মেও মতি ফিরেছে একটু। শুক্রবার ছাড়াও আজকাল সময় পেলে মসজিদে নামাজ পড়তে যায়, এলাকায় দান খয়রাত করে, একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় হাত দিয়েছে সম্প্রতি। নিয়ত করেছে ব্যবসাটা গুছিয়ে এনে দু এক বছরের মধ্যেই রশিদাকে নিয়ে পবিত্র হজ¦ পালন করতে সৌদি আরব যাবে। মেয়েটার বিয়ে দিয়ে যেতে পারলে একটা শান্তি। মেয়ের কথা মনে পড়ায় এই মুহুর্তে সকালের অস্বস্তিটা ফিরে আসে সফিকুলের মনে। রশিদা কী যেন অভিযোগ করছিল মেয়ের নামে, মেয়ে আজকাল প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফিরে, জিজ্ঞেস করলে কিছু উত্তর দেয় না-এই রকম কিছু একটা। রশিদাকে আর ফোন দেয়া হয় নি সারা দিনে। নিশ্চয় রেগে মেগে কাঁই হয়ে আছে। পেনিনসুলা থেকে বেরিয়েই একটা ফোন করতে হবে তাকে, সে মনে মনে ভাবে।
ধুসর সাফারি সন্তুষ্ট হয়ে ধীরে সুস্থে পকেট থেকে একটা ছোট নকিয়া ফোন বের করে। ছোট্ট নীল রঙের সেট। স্ক্রিনটা বন্ধ। ফোনটা সে সামনে টেবিলে দুজনের মাঝখানে রাখে। তারপর বলে-সফিকুল সাহেব, আপনার ফোনটা দিন।
সফিকুল আশ্চর্য হয়ে নিজের ফোন বের করে। ওর সেটটা দামী, স্যামসাং গ্যালাক্সি সেভেন। টাচ স্ক্রিন। ডুয়েল ক্যামেরা আছে। গত বছর ঈদের সময় তামিমকে নিয়ে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের অত্যাধুনিক শপিং মল আফমি প্লাজা থেকে শখ করে কিনেছিল। নতুন ফোনটা কেনার ব্যাপারে তামিমের উৎসাহই ছিল প্রবল।স্মার্ট ফোনের নানা অপশন নিয়ে সারা দিনই গবেষণা করত প্রথম প্রথম। ফোন কেনার পর দোকানে বসেই সে আর তামিম একটা হাস্যোজ্জ্বল সেলফি তুলেছিল ফোনটা দিয়ে। সেই সেলফিটাই তার মোবাইলের কভারফটো। এখন ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে সফিকুল একটু নার্ভাস বোধ করে। লোকটির কাজকর্মের মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না সে। এই সব ফোন চালাচালির অর্থ কি? সহজ একটা ব্যাপারকে এত প্যাঁচানো কেন? লোকটা আড়চোখে সফিকুলের মোবাইলের আলো জ¦লা স্ক্রিনে কভারফটোটা দেখে, তারপর তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে-আপনার ছেলে?
-জি¦।
-বেশ কিউট। কী পড়ে?
-বিকম। মইনউদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজে। টেকনাফে ওইটাই ভাল কলেজ ভাই। তবে ও ছাত্র ভাল না। তার চেয়ে আমার মেয়েটা পড়াশোনায় বেশি ভাল। এইবার এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পাইছে। -এতগুলো অপ্রয়োজনীয় কথা বলে ফেলে সফিকুল একটু লজ্জিতই বোধ করে। কিন্তু ধূসর সাফারি সব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। তারপর একটু হেসে বলে–বাহ, বেশ।
লোকটা এবার সফিকুলের মোবাইল ফোনটা নিজের পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে-আপনার ফোনটা আজকে আমার কাছে থাকবে। চিন্তা করবেন না, ফোনটা আপনি কালই ফেরত পাবেন। আপনি এখন এই নতুন ফোনটা নিয়ে ফিরে যাবেন টেকনাফে। আজ এখনই রওনা দেবেন। ফোনটা বন্ধ আছে, অন করবেন না। ঠিক জায়গামত পৌঁছে দেবেন রাত শেষ হবার আগেই। কার কাছে পৌঁছাতে হবে তা নিশ্চয় জানেন?
সফিকুল এবার একটু একটু ভয় পেতে শুরু করেছে। সে ঢোক গিলে বলল-জি¦।
-ওনার হাতে সেটটা পৌঁছে দেবার পর প্রথম উনিই ফোনটা অন করবেন। তারপর কথা বলবেন আমার সাথে। আমি তাহলে বুঝব যে ওটা জায়গামত পৌঁছেছে। ব্যস, আপনার কাজ সেখানেই শেষ। এর পর আপনি আপনার ফোন ফেরত পাবেন। মনে থাকবে?
সফিকুলের আত্মা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ঘটনাটা কিছুই বুঝতে পারছে না সে। এত সাবধানতা, এত গোপনীয়তা কেন? কী আছে ওই ফোনের মধ্যে? সে আতংকিত দৃষ্টিতে নীরিহ নীল রঙের কমদামি নকিয়া সেটটার দিকে চেয়ে থাকে। তবে আর কিছু ভাববার আগেই সে দেখে ধূসর সাফারি পরা ঠান্ডা চোখের সরাফতউল্লাহ সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছেন। সে দেখতে পায় যে ভদ্রলোক বেশ লম্বা, সুঠাম হ্যান্ডসাম শরির, শ্রদ্ধা জাগানোর মত পেশীবহুল হাত তার। সফিকুলের কাঁধে ডান হাত রেখে তিনি বলেন-আপনার মনে অনেক প্রশ্ন, তাই না? সফিকুল সাহেব, আনুগত্যের আরেক নাম হল প্রশ্নহীনতা। তারপরও আমি একটা প্রশ্নের উত্তর বলে দিতে পারি। এই ফোনটা হল একটা লিস্ট। যে লিস্টটা দেখার অনুমতি নেই আপনার। বুঝেছেন তো! আসি তাহলে সফিকুল সাহেব। ইউ আর আ গুড ম্যান। আই লাইক ইউ।
সরাফতউল্লাহ সাহেব লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলে সফিকুল কেন যেন বিমর্ষ হয়ে চুপচাপ বসে থাকে। খোলা ছাদে হালকা ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাস বইছে। রুফটপ রেস্তোঁরায় বিদেশি মিউজিক জোরালো হয়েছে একটু। মাথার ওপর তারা জ¦লা এক বিশাল আকাশ। ছাদের রেলিং এর ওপারে আলো ছড়ায় ঝলমলে চট্টগ্রাম শহর।ফ্লাইওভারের ওপর আলো জ্বলা শত গাড়ির সারি। ওয়েটার এসে তার সামনে খাবার রেখে যায়। সফিকুল অকারণেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ‘লিস্ট’ নামের এই অভিশাপ জীবন থেকে আর মুছে ফেলা গেল না। এই ‘লিস্ট’ বংশ পরম্পরায় তার পরিবারকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে এখনও। একাত্তরে, নব্বইয়ে, এখন এই দুই হাজার আঠারোতেও।সফিকুল মন খারাপ করে নীল নকিয়া ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে। রশিদাকে ফোন করা হল না। কি করে করবে, তার তো এখন কোন ফোনই নাই!
পাঁচ.
শেষ রাতের দিকে সমুদ্রের দিক থেকে একটা দমকা বাতাস টেকনাফ হেলথ কমপ্লেক্সের কম্পাউন্ডে সামান্য একটুখানি শীতলতা বয়ে আনে। দূরে টেকনাফ-কক্সবাজার মহসড়কে হেডলাইট জে¦লে কিছুক্ষণ পর পর ট্রাক আর ভারি গাড়ি ছুটে যায় শব্দ করে, পূবের আকাশে একটা হালকা কমলা রেখা ফুটে উঠতে শুরু করে একটু পর, আর তার কিছুক্ষণ পর মসজিদে মসজিদে একসাথে ধ্বনিত হতে শুরু করে আজান। হেলথ কমপ্লেক্সের ভেতর আরএমও র ভ্যাপসা গরম আর দেয়ালের চলটা ওঠা কক্ষে তখনও আহত এবং জীবন্মৃত লোকটি বাদে বাকি চারজন প্রস্তরমূর্তির মত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। দারোয়ান কাশেম আলির তাজা কালো রক্ত ভরা ব্যাগ এই মুহুর্তে ঝুলে আছে স্যালাইন স্ট্যান্ডের হুকে, আর ফোঁটা ফোঁটা কালো তরল টুপটাপ ঝরে পড়ছে নলের ভেতর। নলটা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেই কালো নোংরা বাহুর পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার বুক সামান্য ওঠানামা করতে শুরু করেছে এখন-সেদিকে মোহগ্রস্থের মত তাকিয়ে থাকে তারা চারজন। জিপের ড্রাইভার কয়েকবার এসে ঘুরে গেছে ঘরের ভেতর, একবার কনস্টেবলকে জিজ্ঞেসও করেছে যে এখন কী করণীয়, তারা বডিটা এখানেই ফেলে রেখে চলে যাবে না পরিণতির জন্য অপেক্ষা করবে? তরুণ কনস্টেবল কোন উত্তর দেয় নি। ওয়ার্ডবয় তাহির আর আরএমও তপন বড়ুয়া অবশ্য এরই মধ্যে লোকটার কাঁধের কাছে গুলির ছিদ্রটা সেলাই করে ফেলেছে, ফলে রক্ত আর ওখান থেকে চুঁইয়ে পড়ছে না এখন, যে চুঁইয়ে পড়ার দৃশ্যটা এতক্ষণ কনস্টেবলের মনে ছেলেবেলার মত তীব্র অস্বস্তির জন্ম দিয়ে যাচ্ছিল।সময় কাটানোর জন্য আরএমও তপন বড়ুয়া রুমের এক কোণে একটা টুলের ওপর রাখা চব্বিশ ইঞ্চি টেলিভিশনটা ছেড়ে দেয়। টেলিভিশনে তখন ফজরের আজান শেষে হামদ নাত হচ্ছে। রিমোট খুঁজে না পাবার কারণে তপন বড়–য়া বিরস মুখে সেটাই মন দিয়ে দেখতে শুরু করে।
দারোয়ান কাশেম আলি জীবনে এই প্রথম কাউকে রক্ত দিল। হাসপাতালে কাজ করলে কী হবে, লোকটা আসলে ভীতু কিসিমের, রক্ত দেয়া নেয়া তার ধাতে নেই। গত মাসে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তপন বড়ুয়া বলেছিল-‘অনো হয়েজ্ঞো রক্ত ফলিক্ষা গরি ফেলন কাশেম বদ্দা, বয়স অয়্যিত, এহন ডায়াবিটিস কোলেস্টেরল এগিন টেস্ট গরন ফরিবু তো।’ তো সুই ফোটানোর ভয়ে কাশেম আলি আর ওমুখো হয় নি। তাছাড়া পরীক্ষা নীরিক্ষা করতে গিয়ে কী না কি ধরা পড়ে যায়, তার চেয়ে এই তো বেশ ভাল চলছে। সে বরং তপন স্যারকে দিয়ে দুটা ভিটামিন আর একটা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ লিখিয়ে নিয়েছিল তারপর। এখন এই আধ লিটার রক্ত নিজের শরির থেকে বের করে দেবার পর তার কেমন যেন শরির মাথা হালকা বোধ হতে থাকে, গলার কাছে কী যেন বার বার আটকে যাবার উপক্রম হয়, দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। তার মনে পড়ে গতরাতে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধটা খাওয়া হয় নি। স্যালাইন স্ট্যান্ডে ঝুলতে থাকা নিজেরই কালচে রক্তের দিকে তাকিয়ে কাশেম আলির মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলে সে তপন বড়–য়ার টেবিলের সামনের চেয়ারটাতে ধপ করে বসে পড়ে। বিষয়টা লক্ষ করে এবার তপন বলে ওঠে-কাশেম বদ্দা, বেশি গরি ফানি হাইবেন। তরল হাইবেন বেশি বেশি। এহন মনে সাইলি রেস্ট লইত্তারিবেন।
তপন বড়ুয়ার কথা শুনে তরুণ কনস্টেবলেরও কেন যেন ভীষণ পানির পিপাসা পেয়ে যায়। সে পানি খেতে চাইলে ওয়ার্ডবয় তাহির ঘরের কোণে রাখা ময়লা ফিল্টার থেকে পানি ঢেলে তাকে এগিয়ে দেয়। তরুণ কনস্টেবল ঢক ঢক করে পানি পান করে। গরমে ঘেমে মোটা পুলিশের পোশাক ভিজে একসা। এই অদ্ভুত সংকটময় রাত কখন শেষ হবে কে জানে! ব্যারাকে ফিরে এক বালতি ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে ইচ্ছে করছে তার খুব। চার বছরের ভাতিজা সুমনকে নিয়ে এক সময় প্রায়ই পুকুরে ঝাঁপ দিত তরুণ কনস্টেবল। কলাগাছ কেটে তাতে ভর দিয়ে পা দাবড়ে সাঁতার শেখাতো সুমনকে। পানি ছেলেটার বড় প্রিয় ছিল। সেই পানিই তার শেষ ঠিকানা হল। অনেকদিন পর ছোট্ট ভাতিজার কথা মনে করে বুকটা খালি হয়ে যায় তরুণ কনস্টেবলের। আব্বাজানকে ফোন করা হয় না কয়েক দিন, এদিকে যা ব্যস্ততা যাচ্ছে, ফোন করার সময় কই! গত এক সপ্তাহে র্যাব পুলিশের সাথে এনকাউন্টারে শুধু এই এলাকাতেই মারা গেছে কমপক্ষে ১৬ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। সরকার ইয়াবা আর মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেছে, কিছুতেই আর কারো রক্ষা নাই। এনকাউন্টারে যারা মারা যাচ্ছে, তাদের সবাই কি আদতে ইয়াা ব্যবসায়ী, নাকি তার মধ্যে দু একটা সাধারণ নীরিহ জনগণও আছে-তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে মিডিয়ায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এখন সামনে নিষ্পন্দ পড়ে থাকা ‘নীরিহ’ বা ‘দোষী’ মানুষটার দেহের সামনে বসেতরুণ কনস্টেবল মনে করতে চেষ্টা করে গত সপ্তাহে আব্বাজান টেলিফোনে কার কথা যেন বলতে শুরু করেছিল, মসজিদের ইমাম সাহেবের মেয়ে সেতারার কথাই কি? আব্বাজান কি একথা জিজ্ঞেস করছিল যে সে কবে ছুটি পাবে, বাড়ি যাবে, বিয়া শাদী তো করা দরকার এখন, বংশের একমাত্র নাতিটা চলে গেল, আরেকটা নাতি দেখে যেতে চাই? তাড়াহুড়ায় আব্বার কথার কোন জবাব দিতে পারে নাই কনস্টেবল। সেতারা তাহলে অনেক বড় হয়ে গেছে এখন? বিয়ের উপযুক্ত? আব্বাকে স্পষ্ট বলে দিতে হবে যে মেয়ের বয়স আঠারো না হলে সে বিয়ে করবে না। আঠারোর নিচে বিয়ে বেআইনী।
টেলিভিশনে তখন সরকারের একজন উর্ধ্বতন প্রতিনিধি সাংবাদিকদের বলছেন-‘কোন ভাল কাজ, বৃহৎ কাজ, মহৎ কাজ করতে গেলে দু একটি ভুল তো হতেই পারে!’ আর তা শুনে সাংবাদিকেরা হট্টগোল শুরু করে দিয়েছে সেখানেই। তপন বড়–য়া কেন যেন এ কথায় বিব্রত হয়ে তখন টেলিভিশনটাই বন্ধ করে দেয়। ওয়ার্ডবয় তাহির মাথায় টুপি বসিয়ে বলে-‘স্যার, আই নমাজ ফইত্তাম যাইঁর। দরহার অইলি ডাইবাক।’ এই বলে সে তরুণ কনসেবটবলের দিকে তাকায়। তরুণ কনস্টেবল আজ পর্যন্ত বিনা কারণে কখনো নামাজ কা¡জা করে নি, কিন্তু আজ কেন যেন সে কাঠের চেয়ার ছেড়ে ওঠার কোন আগ্রহ পায় না। এই মুহুর্তে সে র্যাক্সিন ওঠা বেডে শুয়ে থাকা কই মাছের প্রাণ লোকটার রক্ত মাখা স্যামসাং গ্যালাক্সি মোবাইল ফোনটা নাড়াচাড়া করতে থাকে। তারপরই সে এই বিশ্রি রাতের শেষ সংকটের মুখোমুখি হয় যখন ফোনটা হঠাৎ সূরেলা ধ্বনিতে বেজে ওঠে তার হাতের ভেতর। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা মিষ্টি কিশোরীর ছবি, যার নাম স্ক্রিনে দেখা যায় আলপনা। ছবিতে কিশোরীটি নীল সাদা স্কুল ড্রেস পরে আছে, মুখে হাসি, দুই আঙুলে ভি চিহ্ন। ফোনের শব্দ এই ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে দিলে আরএমও তপন বড়–য়া আর তরুণ কনস্টেবল পাংশু মুখে একে অপরের দিকে তাকায়। তারা কেউই ফোন ধরার সাহস দেখায় না। অনেকক্ষণ বেজে বেজে ফোনটা থেমে যাবার পর তারা অবশেষে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ততক্ষণে ওয়ার্ডবয় তাহিরও ফিরে আসে নামাজ সেরে।
ফজরের আজান শেষ হয়ে গেলে আকাশটা ধীরে ধীরে ফরসা হতে শুরু করে এই বার। যাক বাবা, এই বিভীষিকাময় রাত্রি শেষ পর্যন্ত শেষ হতে চলেছে! কিন্তু রাতভর যে নাটক অভিনীত হল এই টেকনাফ হেলথ কমপ্লেক্সে, তা তখনো অমীমাংসিতই রয়ে যায়। শ্যামলা মত গোঁফওলা লোকটা জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি লটকে থেকে তাদের চারজনকেই বিপর্যস্ত করে রাখে। রাত জাগার ক্লান্তি চোখে নিয়ে আরএমও তপন বড়ুয়া আরেকবার লোকটার হাতে কাফ লাগিয়ে রক্তচাপ মাপে, হৃদস্পন্দন দেখে, চোখের মণি পরীক্ষা করে। না, মরে নি। তবে বাঁচার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। যার মরে যাওয়াই উচিত ছিল তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে সে ভুল করেছে কিনা-এই প্রশ্ন তপন বড়–য়াকে বিচলিত করতে শুরু করে এখন। এনকাউন্টারে ‘নিহত’ ব্যক্তির বেঁচে যাওয়া সকলের জন্যই বিপজ্জনক ও অপমানজনক, সে ‘নীরিহ’ই হোক, কি ‘দোষী’। শেষ পর্যন্ত এই উপসংহারে পৌঁছায় সে। এখন লোকটা মরে গিয়ে যদি তাদের সবাইকে বাঁচিয়ে দেয় তবেই রক্ষা। মে মাসের এক গুমোট ভ্যাপসা রাত্রি শেষে নতুন ভোর যখন সমাগত, তখন এই হেলথ কমপ্লেক্সের চলটা ওঠা ঘরে তারা চারজন অধীর আগ্রহে লোকটির একটা পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আর মিনিট কয়েক পর পর অস্থির স্যামসাং মোবাইল ফোনটা বার বার বেজে উঠতে থাকে, যার স্ক্রিনে বার বার ভেসে উঠতে থাকে একটি দুই বেণী করা নীল কামিজ পরা হাস্যজ্জ্বোল কিশোরীর মুখ, যে মেয়েটির নাম আলপনা বলে জানতে পারে তারা। তারা চারজন নীরবে সেই ফোনে ভেসে ওঠা ছবিটা দেখে কেবল, ফোন ধরার সাহস কারোর হয় না।
জন্ম ১৯৭৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর।
শুরুটা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখার ঝোঁক থেকে। এ পর্যন্ত বিজ্ঞান কল্পকাহিনিনির্ভর তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর—আকাশ কত দূর (২০০১), ছায়াপৃথিবী (২০০৩) ও শ্যাওলা পৃথিবী (২০১১)। পাশাপাশি ছোট গল্প লেখেন। ২০০৬ সালে বেরিয়েছে গল্পগ্রন্থ অগ্নিপায়ী। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ আমাদের গ্রামে রাজকন্যা আসার কথা ছিল। নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে লিখছেন। সমসাময়িক ঘটনাবলী আর ছোট ছোট আবেগ, অপাংক্তেয় মানুষের গভীর মমতা আর ভালবাসা তার গল্পের প্রধান উপজীব্য। সহজ সাধারণ ভাষায় সাধারণ মানুষের সাধারণ গল্প বলতে চান তিনি। পড়াশোনা করেছেন চিকিৎসাশাস্ত্রে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করার পর বারডেম একাডেমি থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম বিষয়ে। বর্তমানে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।