উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে পৃথিবীর কোন জাত কখন কী খায়, কত বার খায় এবং তাদের সুখাসনটি কীরকম সে বিষয়ে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের থেকে বেশি খোঁজখবর কোনো ভারতীয় কস্মিনকালেও করেছেন বলে মনে হয় না।
একটু নমুনা চেখে দেখি।
“ফরাসী চাল–সকালবেলা কফি এবং এক-আধটুকরো রুটি-মাখন; দুপুরবেলা মাছ-মাংস ইত্যাদি মধ্যবিৎ; রাত্রে লম্বা খাওয়া। ইতালি, স্পেন প্রভৃতি জাতিদের ঐ একরকম; জার্মানরা ক্রমাগতই খাচ্ছে–পাঁচবার, ছ বার, প্রত্যেকবারেই অল্পবিস্তরতখন স্বামীজির কবিরাজি চিকিৎসা চলছে। জলখাওয়া বন্ধ, শুধু দুধ পান করে পাঁচসাতদিন চলছে।
মঠে এক শিষ্য একটি রুইমাছ ঠাকুরের ভোগের জন্য এনেছে।
“মাছ কাটা হলে ঠাকুরের ভোগের জন্য অগ্রভাগ রাখিয়া দিয়া স্বামীজি ইংরেজি ধরনে রাঁধিবেন বলিয়া কতকটা মাছ নিজে চাহিয়া লইলেন। আগুনের তাতে পিপাসার বৃদ্ধি হইবে বলিয়া মঠের সকলে তাহাকে রাঁধিবার সঙ্কল্প ত্যাগ করিতে অনুরোধ করিলেও কোন কথা না শুনিয়া দুধ, ভারমিসেলি, দধি প্রভৃতি দিয়া চার-পাঁচ প্রকারে ওই মাছ রাঁধিয়া ফেলিলেন। …কিছুক্ষণ পরে স্বামীজি জিজ্ঞেস করিলেন, “কেমন হয়েছে? শিষ্য বলিল, এমন কখনও খাই নাই।…ভারমিসেলি শিষ্য ইহজন্মে খায় নাই। ইহা কি পদার্থ জানিবার জন্য জিজ্ঞাসা করায় স্বামীজি রসিকতা করিলেন, “ওগুলি বিলিতি কেঁচো। আমি লন্ডন থেকে শুকিয়ে এনেছি।”
এই শিষ্যই আরও পরে স্বামীজির মহাসমাধির অতি সামান্য আগে আহিরিটোলার ঘাটে গঙ্গাতীরে গুরুকে আবার দেখেছিল। স্বামীজির বাঁ হাতে শালপাতার ঠোঙায় চানাচুর ভাজা, বালকের মতো খেতে খেতে আনন্দে পথ ধরে এগোচ্ছেন।
আরো পড়ুন: বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব-২)
স্বামীজি বললেন, “চারটি চানাচুর ভাজা খা না? বেশ নুন-ঝাল আছে।” শিষ্য হাসতে হাসতে প্রসাদ গ্রহণ করলেন।
ছোটবেলার স্মৃতিতে উদ্বেলিত হয়ে স্বামীজি একদিন বেলুড় মঠে বসে প্রকাশ্যে পাড়ার ফুলুরিওয়ালা হতে চাইলেন। উনুন জ্বললো, কড়া বসলো, তেল ঢালা হলো। ফাটানো বেসন গরম তেলে ছেড়ে, পিঁড়িতে বসে বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দ হয়ে উঠলেন ফুলুরিওয়ালা নরেন। ছোটবেলায় সিমলা পাড়ায় যেমন দেখেছেন ফুলুরিওয়ালাকে। বেলুড়ের মাঠে হাঁক ছেড়ে খদ্দের ডেকে স্বামীজি মহানন্দ পেতে লাগলেন।রান্না ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম প্যাশন।
এসব দৃশ্য কিন্তু স্বদেশ কিংবা কলকাতায় সীমাবদ্ধ নয়। সেবার ট্রেনে যেতে যেতে একজন মুসলমান ফেরিওয়ালাকে ফার্স্ট ক্লাসের সামনে ছোলা সেদ্ধ হাঁকতে দেখে সেবককে স্বামীজি বললেন, “ছোলা সেদ্ধ খেলে বেশ হয়, বেশ স্বাস্থ্যকর জিনিস”.. ছোলাওয়ালাকে একটা সিকি দেওয়ায় স্বামীজি তার সেবককে বললেন, “ওরে ওতে ওর কি হবে? দে একটা টাকা দে।” স্বামীজি ছোলা কিনলেন, কিন্তু খেলেন না। মনে হয় ফেরিওয়ালাটিকে কিছু দেবার জন্যেই এই ছোলা কিনেছিলেন সেদিন।
কিন্তু লস এঞ্জেলেসে একের পর এক জগৎ-কাঁপানো বক্তৃতা করে সাড়া ফেলছেন তিনি। আয়োজকদের একজন কিছু আলোচনার জন্য স্বামীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে দেখলেন, তিনি আপনমনে চিনেবাদাম ভাজা চিবোচ্ছেন। মানুষটির সরলতা দেখে সায়েবটি মুগ্ধ।
স্বামী বিরজানন্দ সহ দলবল নিয়ে মায়াবতী থেকে বেরিয়ে পড়েছেন স্বামীজি। প্রথমে চম্পাবত, সেখান থেকে ডিউরির ডাক বাংলো।
রান্নার দায়িত্বে রয়েছেন স্বামী বিরজানন্দ। হাঁড়ির আকারের তুলনায় চাল বেশি হওয়ায়, ভাত আধসিদ্ধ হয়ে উথলে পড়ছে, আর ক্ষিদে পাওয়ায় স্বামীজি লোক পাঠিয়ে খবর নিচ্ছেন, রান্নার কত দেরি।
বিরজানন্দ ভাবছেন, খানিকটা ভাত নামিয়ে নিয়ে বাকি ভাত আরও জল দিয়ে ফুটোবেন। এমন সময় স্বামীজি রান্নার জায়গায় ঢুকে অবস্থা পর্যালোচনা করে প্রিয় শিষ্য বিরজানন্দকে বললেন, “ওরে ওসব কিছু করতে হবে না। আমার কথা শোন–ভাতে খানিকটা ঘি ঢেলে দে, আর হাঁড়ির মুখের সরাখানা উলটে দে, এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে, আর খেতেও খুব ভাল হবে।”
রন্ধনবিদ গুরুর ম্যাজিকে সেদিনকার সেই ঘি ভাত সবার উপাদেয় লেগেছিল।
অনেকের সবিনয় অনুসন্ধান, “খাওয়ার জন্যে অযথা দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হলে স্বামী বিবেকানন্দ কি একটু অধৈর্য হয়ে উঠতেন?”
সময়ানুবর্তিতার প্রতি স্বামীজির প্রবল আকর্ষণ–শুধু নিজের জন্য নয়, সকলের জন্য।
সুদূর আমেরিকা থেকে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে (১৮৯৫) স্বামীজি নির্দেশ দিচ্ছেন : “ভোগের নামে সকলকে পিত্তি পড়িয়ে বাসি কড়কড়ে ভাত খাওয়াবে না।”
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।