আর একদিন স্বামীজির নিরামিষ লাঞ্চের মেনু, ভাত ও ওলন্দা কড়ায়ের মটর ডাল। ডালেতে একটু কারি পাউডার ও নুন দিয়ে সেদ্ধ করে খানিকটা মাখন দেওয়া ছিল। খেতে বসে স্বামী সারদানন্দের দুঃখ, “হায় কপাল! এখানেও মটর ডাল সিদ্ধ।”
তবে মাঝেমধ্যেই স্বাদকোরক হাতড়ে বেড়াত বৈচিত্র্যময়তা। নয়ত বিদেশে একদিন রাত দেড়টার সময় স্বামীজি তাঁর অনুরাগী মিস্টার ফক্সকে বললেন, “দূর, রোজ রোজ একঘেয়ে খাওয়া যায় না। চল দু’জনে গিয়ে একটা হোটেলে খেয়ে আসি।”
আর একদিন সন্ধ্যার আহারে মাছ দিয়ে কপির তরকারি রান্না হয়েছে, সঙ্গে ছিলেন অনুরাগী এবং বক্তৃতার ক্ষিপ্রগতি লেখক গুডউইন। গুডউইন খেলো না, জিজ্ঞেস করলো, “মাছ খেলেন কেন?”
স্বামীজি হাসতে হাসতে বললেন, “আরে বুড়ি ঝিটা মাছ এনেছে, সেটা না খেলে নর্দমাতে ফেলতো, ওটা না হয় পেটে ফেলেছি।”
লন্ডনে জনৈকা মিসেস টার্নার একটি ছোট্ট ঘরোয়া ভোজনাগার চালাতেন। তিনি ইন্ডিয়ানদের পছন্দমতন কিছু রান্না শিখেছিলেন, সেইজন্য ভারতীয়রা মাঝে মাঝে তার বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসতো।
একদিন বিবেকানন্দ তার ভাই মহেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, আজ কোথায় গিয়েছিলি? ভাই উত্তর দিলেন, “মিসেস টার্নারের বাড়িতে খেতে গিয়েছিলাম।” স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন “কি রেঁধেছিল।” উত্তর : “চাপাটি রুটি, মাংসের একটা তরকারি, আরও দুটো তরকারি, পুদিনার চাটনি, আর চালের পায়েস।”
স্বামীজি সেই শুনে বললেন “একদিন সে এখানে এসে রেঁধে দিয়ে যায় না? তা হলে একটু খেয়ে বাঁচি, একটু মুখ তরাই।”
মহেন্দ্রনাথ জানালেন, “তা বোধহয় সম্ভব নয়। গৃহস্থ মহিলা, ঝি চাকরানি নন, অপরের বাড়িতে রাঁধতে আসবেন কেন?”
স্বামীজি তখন মিসেস টার্নারের বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তা আর সম্ভব হয়নি।
তাঁর লেখা পত্রাবলীতে রয়েছে, ৩০ মে ১৮৯৬ সালে স্বামীজি লন্ডনে বসে নিজেই এলাহি রান্না করেছিলেন। সারদানন্দ বোধ হয় স্বদেশ থেকে নানারকম মশলা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরের দিন সেন্ট জর্জেস রোড থেকে স্বামীজি হেলভগ্নি মেরিকে মুখরোচক কারি তৈরির বিবরণ দিচ্ছেন। সেই কারিতে ছিল জাফরান, ল্যাভেন্ডার, জৈত্রী, জায়ফল, কাবাবচিনি, দারচিনি, লবঙ্গ, ছোট এলাচ, ক্রিম, লেবুর রস, পিঁয়াজ, কিসমিস, অ্যামন্ড, লঙ্কা এবং চাল! এতো মিশিয়েও মনের সাধ পূর্ণ হয়নি একটি মশলার অভাবে, যার ইংরিজি নাম অ্যাসাফিটিডা অর্থাৎ হিং।
অচেনা মিসেস টার্নারকে দিয়ে হয়ত বাড়ি এসে রেঁধে দিতে অনুরোধ করতে সাহস পেলেন না বিবেকানন্দ। কিন্তু আমেরিকায় বিখ্যাত সব মহিলারা স্বামীজিকে রেঁধে খাইয়ে ধন্য হয়েছেন। তিনিও কখনও কখনও প্রচণ্ড বিদুষীদের অনুরোধ করেছেন, এখানে খাবার-দাবার বড্ড নোংরা, আমার জন্যে একটু রান্না করতে পারো? এমন এক ভাগ্যবতী মহিলার নাম মিস্ ওয়ালডো। দুর্লভ সুযোগ পেয়ে মিস্ ওয়ালডো ধন্য। নিউইয়র্কে এই বিদুষীকে সস্নেহে নতুন নাম দিয়েছিলেন স্বামীজি—’হরিদাসী’। এই মহিলা ছিলেন প্রকৃত অর্থেই দশভুজা। সম্পাদিকা, প্রুফ রিডার, স্টেনোগ্রাফার, ভক্তিময়ী এবং দার্শনিক।
নিউ ইয়র্কের চিঠি। মিসেস ওলি বুলকে বিবেকানন্দ লিখছেন : মিস্ হ্যামলিন দয়াপরবশ হয়ে একটা গ্যাস স্টোভ পাঠিয়েছেন–বেড রুমেই রাঁধতে হবে। আমাদের বাড়ির নিচে একটা সার্বজনীন রান্নাঘরেরও ইঙ্গিত রয়েছে।
সেখানেও স্বপাক অন্নের জন্য বিবেকানন্দ পিছপা হননি। বিশেষত্ব এই যে তিনি কখনও সব নিজে খেতেন না, জানা-অজানা সবাইকে দেদার খাওয়ানোটা তার আজন্ম দুর্বলতা।
স্টোভ পাওয়ার কয়েকদিন পরেই স্বামীজির আর এক চিঠি : কৃপানন্দ ও তিনি মিলে “কিছু ডাল ও বার্লি ফুটিয়ে নিচ্ছি…আমেরিকায় এমন সন্ন্যাসকঠোর জীবন আগে কাটাইনি।”
আরো পড়ুন: বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব- ৭) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
কলকাতায় এর কিছুদিন আগে গুরুভাইদের বিবেকানন্দ জানিয়েছেন, “কলায়ের দাল কি, কোনও দাল নেই, এরা জানেও না। একরকম শাক আছে, স্পিনাচ–যা রাঁধলে আমাদের নটে শাকের মত লাগে, আর যেগুলোকে এরা এস্পারেগাস বলে, তা ঠিক যেন কচি ডেঙ্গোর ভঁটা, তবে গোপালের মার চচ্চড়ি নেই বাবা।”
আরও খবর : “এখানে ইলিস মাছ অপর্যাপ্ত আজকাল। ভরপেট খাও, সব হজম। ফল অনেক। কলা, নেবু, পেয়ারা, আপেল, বাদাম, কিসমিস, আঙ্গুর যথেষ্ট, আরও অনেক ফল ক্যালিফোর্নিয়া হতে আসে। আনারস ঢের, তবে আম, লিচু ইত্যাদি নাই!”
নিউইয়র্ক নিবাসে এক বিখ্যাত হোটেলে বিবেকানন্দর সান্ধ্য নিমন্ত্রণ। গন্তব্যস্থান জগদ্বিখ্যাত এসটোরিয়া হোটেল, কিংবা শোয়েল, কিংবা ডালমনিকো! যিনি তিনদিন পর্যন্ত পথের ধারে অনাহারে কাটিয়েছেন তাকেই যেতে হচ্ছে অন্তহীন ডিনার পার্টিতে যা সন্ধ্যায় শুরু হয়ে ভোর দুটোর আগে কিছুতেই শেষ হতে চায় না। এইসব বিখ্যাত রেস্তোরাঁকে প্রায়শই প্রাধান্য দিলে শরীর অসুস্থ হবার আশঙ্কা যথেষ্ট, তাই একসময় স্বামীজি “নিঃশব্দে” ভেজিটারিয়ানে রূপান্তরিত হয়েছেন এবং নেমন্তন্ন এড়িয়ে চলেছেন। ১৮৯৫ সালের মার্চ মাসে স্বামীজি লিখছেন, “আজ একটা ডিনারে যাচ্ছি, এইটাই শেষ।”
এর পরে থাউজেন্ড আইল্যান্ড পার্কে নিরামিষাশী বিবেকানন্দ ঘন ঘন উপবাস করেন। জায়গাটা ছাড়বার আগে তিনি তিরিশ-চল্লিশ পাউন্ড ওজন কমাবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
নিউইয়র্ক পর্ব সম্পর্কে আরও খবর আছে। মিস ওয়ালডো যেমন বহু দূরত্ব পেরিয়ে মূল শহরে এসে স্বামীজিকে রেঁধে দিতেন, তেমন সুযোগ পেলেই বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে স্বয়ং বিবেকানন্দ চলে যেতেন মিস ওয়ালডোর বাড়িতে, সেখানে তিনি সোজা উঠে যেতেন টঙে এবং শুরু করতেন রান্না।
তিনি সাধারণ রাঁধিয়ে নন। রীতিমত গবেষক রাঁধুনি। তাই চলতো নব নব পদের পরীক্ষা এবং আবিষ্কার। সেইসঙ্গে কিভাবে পশ্চিমী মশলা দিয়ে পূর্বদেশের রান্নার মেলবন্ধন ঘটানো যায়।
কলকাতায় গুরুভ্রাতাকে স্বামীজি একবার লিখছেন “যোগেনভায়া, অড়হর ডাল, মুগের ডাল, আমসত্ত্ব, আমসি, আমতেল, আমের মোরব্বা, বড়ি, মসলা সমস্ত ঠিকানায় পৌঁছিয়াছে।…এক্ষণে যদি ইংলন্ডে স্টার্ডির ঠিকানায়…ঐ প্রকার ডাল ও কিঞ্চিৎ আমলে পাঠাও তো আমি ইংলন্ডে পৌঁছিলেই পাইব।”
এই সব মশলাপাতিতে সমৃদ্ধ হয়ে স্বামীজি মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন শহর দাপিয়ে বেড়ালেন!
হিন্দু ধর্মের অনেক গ্রন্থেই গরু বলির ও গোমাংস খাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু বিশ্বাসী উগ্র হিন্দুরা সাধারণত তা মানতে চান না। The Complete Works of Swami Vivekananda গ্রন্থে ভক্তিযোগে রয়েছে গোমাংস সম্বন্ধে তার বেশ কিছু উক্তি। প্রাচীন হিন্দুরা যে গোমাংস খেত তার কথায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
“ If we did not eat beef and mutton, there would be no butchers” এভাবেও কজন ভাবতে পারে?
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।