| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ সাহিত্য

বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব-৯ ) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

স্থানঃ ডেট্রয়েট, সময়কালঃ ১৮ মার্চ ১৮৯৬

এক ভক্তের বাড়িতে গিয়ে স্বামীজি রান্না করার অনুমতি চাইলেন। পকেট থেকে কয়েক ডজন গুঁড়ো মশলা ও ফোড়ন, আচার চাটনি ইত্যাদি ঝটপট বেরিয়ে এল। এসব ইন্ডিয়া থেকে সযত্নে পাঠানো। স্বামীজি যেখানেই যেতেন নানারকম মশলাপাতি সঙ্গে নিতেন। সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ এক বোতল চাটনি যা এক ভদ্রলোক মাদ্রাজ থেকে পাঠিয়েছেন। ভীষণ ঝাল থাকতো রান্নায়, সময়ও লেগে যেতো অনেক। কোন কোন ভক্তের ধারণা, এসব রান্না তার লিভারের পক্ষে ভাল নয়। কিন্তু তিনি ওসব বিশ্বাস করতেন না।

সন্ন্যাসী শুধু আটলান্টিকের ওপারে বেদান্ত ও বিরিয়ানিই প্রচার করেননি, এক্সপোর্ট প্রমোশনের কর্তাব্যক্তিরা জেনে রাখুন সেই ১৮৯৬ সালে স্বামীজি নিউইয়র্কে বসে ভারতীয় মশলার রপ্তানি সম্ভাবনা সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তা করেছেন। গুরুভাই ত্রিগুণাতীতানন্দকে ১৭ জানুয়ারি ১৮৯৬ নিউইয়র্ক থেকে স্বামীজি লিখলেন…

“…দয়ালবাবুকে বলবে, যে মুগের দাল, অড়র দাল প্রভৃতিতে ইংলন্ডে ও আমেরিকায় একটা খুব ব্যবসা চলতে পারে। ডাল-সুপ উইল হ্যাভ এ গাগা ইফ প্রপারলি ইনট্রোডিউসড । (ঠিকমত শুরু করাতে পারলে দালের স্যুপের বেশ কদর হবে।) যদি ছোট ছোট প্যাকেট করে তার গায়ে রাঁধবার ডিরেকশন দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে পাঠানো যায়–আর একটা ডিপো করে কতকগুলো মাল পাঠানো যায়, তো খুব চলতে পারে। ঐ প্রকার বড়িও খুব চলবে। উদ্যম চাই–ঘরে বসে ঘোড়ার ডিম হয়। যদি কেউ একটা কোম্পানি ফর্ম করে ভারতের মালপত্র এদেশে ও ইংলন্ডে আনে তো খুব একটা ব্যবসা হয়।”

বুঝতেই পারা যাচ্ছে, বেদান্তর সঙ্গে ভারতীয় রান্নার বিশ্বব্যাপি প্রচারকে স্বামীজি কতটা সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন।

প্রবাসের পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছে তাঁকে। একেবারে গোড়া থেকে ধরা যাক। শিকাগো বক্তৃতার কালে এক দয়াময়ীর আশ্রয়ে ছিলেন বিবেকানন্দ। তার নাতনির লেখা স্মৃতিকথায় রয়েছে, “দিদিমা ট্যাবাসকো সস দিয়ে স্যালাড ড্রেসিং করতেন। প্রচণ্ড ঝাল এই ট্যাবাসকো সসের শিশিটি দিদিমা স্বামীজির হাতে দিলেন কয়েক ফোঁটা নেবার জন্য–স্বামীজিকে হুড়মুড় করে খাবারে ট্যাবাসকো সস ছড়াতে দেখে দিদিমা আঁতকে উঠলেন, ‘কোরো না, ভীষণ ঝাল। হেসে বিবেকানন্দ এমনভাবে ঝাল উপভোগ করতে লাগলেন যে এরপরে দিদিমা পুরো শিশিটাই স্বামীজির পাশে রেখে দিতেন!”

আরেকবার পারিবারিক ভ্রমণে বেরিয়ে আদিম পদ্ধতিতে স্বামীজির ক্ল্যাম বা ঝিনুক ভক্ষণ। গরম ঝিনুক থেকে আঙুল দিয়ে মাংস বার করে নিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়, কিন্তু গেঁড়িগুগলির দেশ থেকে আমেরিকায় গিয়ে এসব শিখে নিতে স্বামীজির একটুও সময় লাগেনি।

মার্কিন মুলুকে দ্বিতীয়বার গিয়ে প্যাসাডেনায় (দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায়) যাঁদের বাড়িতে স্বামীজি থাকতেন তাঁদের ব্রেকফাস্ট টেবিলের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে স্বামীজির পছন্দ-ফল, ডবল ডিমের পোচ, দু পিস টোস্ট, চিনি ও ক্রিম সহ দু’কাপ কফি।


আরো পড়ুন: বেদান্ত-বিরিয়ানির অভিনব ককটেল (পর্ব-৮ ) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


দেখা যাচ্ছে এই পর্যায়ে স্বামীজি চুরুট খাওয়া হয় বর্জন করেছেন, না হয় কমিয়ে দিয়েছেন। ওই পরিবারেই স্বামীজির মধ্যাহ্নভোজনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ : মাটন (বীফ কখনই নয়) এবং নানারকমের শাকসবজি। ওঁর বিশেষ প্রিয় কড়াইশুটি। এই পর্যায়ে ডেসার্ট হিসেবে মিষ্টির পরিবর্তে ফল, বিশেষ করে আঙুর।

“আর একটা জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যাঁদের বাড়িতেই স্বামীজি আতিথ্য নিতেন, তাঁদের এক-আধটা পদ রান্না করে তিনি খাওয়াতে চাইতেন। আমাদের মতন নুলো জগন্নাথ হয়ে অতিথিসেবা উপভোগ তার ধাতে সইতো না! একজন মার্কিন মহিলা মিসেস উইকফ জানাচ্ছেন, স্বামীজি তাঁকে শুধু ডিনার তৈরিতে সাহায্য করতেন না, মাঝে মাঝে পরিবারের সব কটা পদই তিনি রেঁধে ফেলতেন।

আর একজন মহিলার মন্তব্য; “নিক্রন পার্কে আমাদের বাড়িতে যখন থাকতেন তখন একটা মিল তিনি রাঁধবেনই।” আরেক মহিলা (মিসেস হ্যাঁনসবরো) জানাচ্ছেন, “তিনি চাপাটি ও কারি রাঁধতে উৎসাহী হয়ে উঠতেন, অনেক মশলা তাকে গুঁড়োতে হতো, তার জন্যে মেঝেতে বসে পড়া পছন্দ করতেন।” মশলা গুঁড়ো করে, মাখনে ভেজে, ফোড়ন দেবার সময় রান্নাঘর থেকে এমন ধোঁয়া উঠতো যে উপস্থিত মহিলাদের চোখে জল এসে যেতো। সমস্ত পরিবারের জন্যে রাঁধতে হলে তার আনন্দের সীমা থাকতো না। স্বামীজির এই রান্না সম্বন্ধে মার্কিনি গৃহবধূ পরম বিস্ময়ে বলেছেন–ইলাবোরেট ও অ্যালার্মিং-এলাহি এবং বিপজ্জনক!

একবার খাওয়াদাওয়ার শেষে বিবেকানন্দ জানতে চাইলেন, “পদটি ভাল লেগেছে তো?” মিসেস ওয়াইকফ উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ”। স্বামীজির প্রশ্ন : “সত্যি কথা? না স্রেফ বন্ধুত্ব রাখার জন্য বলছো?” মিসেস উইকফের মধুর স্বীকারোক্তি : “বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য বলেছি!”

আর একটা পারিবারিক ডিনারের বিবরণে রয়েছে মোক্ষম ডিনার-স্যুপ, মাছ অথবা মাংস, সবজি এবং মিষ্টি বলতে আমেরিকান পাইয়ের কথা। তবে সেখানে প্রায়ই স্বামীজির সংযোজন চাপাটি ও কারি!

বলা যেতে পারে, উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার রান্নাঘরে শেফ বিবেকানন্দ এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য রাঁধতে রাঁধতে স্বামীজি দর্শন আলোচনা করছেন, গীতার অষ্টাদশ অধ্যায় থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন! যারা সেসব শুনতে পেরেছে তারা সারাজীবন সেই সৌভাগ্যকে মনে রেখেছে।

সাধারণত পাবলিক বক্তৃতার আগে বিবেকানন্দ কিছু খেতে চাইতেন না। ভরাপেটে বোধ হয় চিন্তাস্রোতে বাধা আসে। তবে মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম হতে বাধ্য। একবার সন্ধ্যায় স্বামীজিকে বক্তৃতার আগে মিসেস স্টিলের বাড়িতে ডিনার সেরে নিতে হলো। সেদিন ডিনারের শেষপদে ছিল খেজুর। খুব ভাল লাগলো তার। তারপর মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক স্মরণীয় প্রাণকাঁপানো বক্তৃতা। ফেরার পথে অভিভূত মিসেস স্টিল স্বামীজিকে অভিনন্দন জানালেন। বিবেকানন্দর মুখে হাসি!তার সহাস্য উত্তর :”ম্যাডাম, সবই আপনার খেজুরের মাহাত্ম্য!”

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত