উৎপলকুমার বসু’র কবিতাগুচ্ছ














সলমা-জরির কাজ -১০
শ্বাসকষ্ট উঠলেই বুঝতে পারি ফুলডুঙরি পাহাড় আর বেশি দূরে নয়
নইলে এমন হাঁপাচ্ছি কেন? কেন ওসুধে সারে না?
ঐ পাহাড়ের মাথায় উঠলে এ-বছর কী দেখব কে জানে-
যে-পাথরে আমরা সবাই নাম লিখিয়েছিলাম সেটি হয়ত
নিচে গড়িয়ে পড়ে গেছে,
যে-জলস্রোত লাফিয়ে পার হয়েছিলাম তাকে ঘুরি
চাষজমির দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল-
যদি তাই হয়ে থাকে তবেআর তাকে আমি খুঁজে পাবো না,
এইসব ভাবি আর হাসপাতালের বিছানা শুকনো ডালপালায়,
ছেঁড়া কাগজে আর পরিত্যক্ত সাপের খোলসে ভরে োঠে-
এত জঞ্জাল সরাবে কে? আমি কি সময় করে উঠতে পারবো?
আমি তো ফুলডুঙরি পাহাড়ে প্রায় পৌঁছে গেছি।
চেপারামের ঘরটা
এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। আরেকটু পা চালিয়ে
উঠে গেলেই হয়।
কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা-১
গাছে উঠে বসে থাকি। ফল খাই। ব্যক্তিমানুষের দিকে
আটি ছুঁড়ে মারি। নিচে হাহাকার পড়ে যায়। বেশ লাগে।
মাঝে মাঝে ধ্রুপদী সংগীত গাই। ওরা শোনে। বাদ্যযন্ত্র
নিয়ে আসে। তাল দেয়। বোধ হয় ছবিও তুলেছে। সেদিন
এক গবেষক বাণী চাইল। ভাবলাম বলি : আমার জীবনই
আমার বাণী। কিন্তু এটিও নাকি বলা হয়ে গেছে। অতএব
নিজস্ব ভঙ্গিতে, কিছুটা বিকৃত ভাবে, বিড় বিড় করি-
“দেখেছি পাহাড়। দেখে জটিল হয়েছি।”
কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা-২
চলো মর্মরসাথী, চলো ভ্রমণে, কান্তারে,
চলো বিদেশীর বেশে কেউ যেন কাউকে না চিনি-
ফলিত জ্যোতিষরূপী, তুমি গানের দেবতা, তুমি জানো
আমার লেখার খাতা অজ্ঞান অনিশ্চয়তায় ভরে গেছে,
এসো নতুন প্রজন্ম হয়ে, এই ভুলভ্রান্তিময়
লেখাগুলি পাঠ করো, অর্থ করো, পর্বতবাসীদের মতো
বিশাল প্রান্তর প্রথম দেখায় অভিভূত হও।
এ-অববাহিকা, বস্তুত জমির ঢাল, ধীরে ধীরে নদীতে নেমেছে।
কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা-৩
ভোরবেলা পার্কে বেড়াতে গিয়ে কী দেখব কে জানে, এই ভয়ে
রাত থেকে কাঁপি, ভুল পায়ে জুতো পরি, ছাতা নিতে মনেই
থাকে না, হায় সেই দুর্ঘটনার জীপ-গাড়ি থানার সামনে তেমনই
পড়ে আছে, মরচে ধরেছে, চাকায় বাতাস নেই, গাছ থেকে
ঝুলন্ত দড়িটা ওখানে কীভাবে এল, ফাঁস নাকি, লকআপ-য়ের
জানলা থেকে উড়ে আসে দুটো পাখি, ভাঙাচোরা এঞ্জিনে ওদের
বাসা, আপাতত ডিমহীন, নীড়ে শাবক আসে নি, আজ ঝড়ের
আঁধার মেঘে দিন শুরু, এলোমেলো বৃষ্টি নামছে।
কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা-৫
কত-না রুদ্ধ ক্রোধ বাক্সে লুকানো থাকে, বাঁধা থাকে বিছানায়।
চেকিঙে পড়েনি ধরা, বৈদ্যুতিক কৌশল এড়িয়ে গিয়েছে,
বিমানবন্দর তারা অকাতরে পার হয়, এমনকি দেহরক্ষীদের
বেষ্টনী এড়িয়ে বহু হতবাক প্রেসিডেন্ট-মুখ্যমন্ত্রী-নগরপালের
সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, বলে-‘অ্যাই, তোরা ভেবেছিসটা কী?’
সৈন্যরা বৃথাই বন্দুক ছোঁড়ে, কৃপাণ নিজেরা লড়াই করে।
ক্রোধ অদৃশ্যই থেকে যায়।
রাক্ষস
সেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল।
তাকে বলি : এই তো তোমারই ঠিকানা-লেখা চিঠি, ডাকে দেব, তুমি
মন-পড়া জানো নাকি? এলে কোন ট্রেনে?
আসলে ও নির্জনতা নয়। ফুটপাথে কেনা শান্ত চিরুনি।
দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ কালো চুল লেগে আছে।
পুরী সিরিজের শেষ কবিতা
তারপর ঘাসের জঙ্গলে পড়ে আছে তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি ।এবং
আকাশ আজ দেবতার ছেলেমেয়েদের নীল শার্টপাজামার মতো বাস্তবিক ।
একা ময়ূর ঘুরছে খালি দোতলায় । ঐ ঘরে সজল থাকতো।
সজলের বৌ আর মেয়েটি থাকতো। অরা ধানকল পার হয়ে চলে গেছে।
এবার বসন্ত আসছে সম্ভবনাহীন পাহাড়ে জঙ্গলে এবার বসন্ত আসছে
প্রতিশ্রুতিহীন নদীর খাঁড়ির ভিতরে নেমে দু’জন মানুষ তামা ও অভ্র খুঁজছে।
তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি হারিয়েছ বাদামপাহাড়ে।
আমার ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা আমি হারিয়েছ বাদামপাহাড়ে।
চেয়ে দেখো
প্রত্যক্ষ করেছ? সেই ভোর থেকে হাত পেতে আছি। ভরে গেছি
দানে ও অবজ্ঞায়। পেয়েছি ক্ষুধার শস্য, প্রেমকণা, দাতার ধিক্কার,
কিছু যেন স্বততই এসেছে – কিছু রাস্তায় কুড়িয়ে পেলাম। সহজ হয়নি।
দৌড়ে গেছি রুষ্ট শ্বাপদের অত্যাচারে। বসে গেছি বিবাহের ভোজে।
এ-মুহূর্তে সন্ধ্যার সানাইটুকু উদ্বৃত্ত। যাকে বলে না-চাইতে পাওয়া।
কহবতীর নাচ ১
একাধিকবার এই সৈকতে এসে
বলেছি আমার মতো পুরুষকে তো কিছু
কলঙ্কের ভাগ তুমি দিতে পারো। হয়নি,
শোননি কেউ, শুধু বালিয়াড়ি ধসে
পড়েছে সাগরজলে।
স্তব্ধতা থেকে কোলাহলে
আবার যাত্রা শুরু, পাপ থেকে
পাপের স্খালনে। ঝাউবনে উড্ডীন
পতাকাবিদ্রোহ থেকে রঞ্জনরশ্মির অনলে–
চলেছি সকলে।
এই মদ কিভাবে করব পান–
বলে দাও। দাঁড়িয়ে জলের ধারে?
ছিঁড়ে-আনা এই ফুলগুলি
ঘুমন্ত খ্রিস্টগাছে ফুটেছিল–
কীভাবে ভাসবে তারা মাতৃসমা জলে?
কহবতীর নাচ ২
যে তমসা নদীর তীরে আমি আজ বসে আছি তার বালুকণাগুলি আমাকে
জানাতে চাইছে আমি জল থেকে কতটা পৃথক–তার ঢেউগুলি আমাকে
বোঝাতে চাইছে আমি গাছ নই, আর গাছের আড়ালে ঐ ধাঙরবস্তির এক
মদ্যপানরত যুবক আমাকে বলতে চাইছে আমি পক্ষীরাজ, মেঘ থেকে নামলাম,
এইমাত্র, সাক্ষাৎ তারই চোখের সামনে–
হবেও-বা। তাহলে বর্ষার আঁধার সকালে আমি ডানা গুঁজে বসে থাকি। রোদ
উঠলে উড়ে যাব।
কহবতীর নাচ ৩
দু-হাত শূন্যে তুলে কেঁদে উঠি, ‘প্রভু, ওটা আমাকেই দিতে হবে।’
লোকে প্রচণ্ড আমোদ পায়–বলে, ‘তোর আমড়াগাছির যেন শেষ নাই,
আবার দেখা তো দিকি ঐ খেলা’, আমি আবারো দেখাই
মাঝে-মধ্যে অতিরিক্ত কিছু হাঁপ জুড়ে দিই, যথা, ‘ এসেছিনু ভবে’
অথবা ‘নিঠুর’, এ-সব গৌণ গান তুমিও গাইতে পারো;
লোক হাসে–এর চেয়ে বড় কথা আর আছে নাকি?
দিনের প্রখর রৌদ্রে বনতলে পড়ে রয় অজস্র জোনাকি
মূক ও মৃত্যুমুখী, শরীরের নীল আলো জ্বলে কারো কারো।
কহবতীর নাচ ৫
হাড় ও কঙ্কাল শুধু, আমি তাকে পাঁজাকোলে করে
চেয়ারে বসিয়ে দিই, অম্নিই বসে থাকে,
ঝঞ্চাট করে না, কখনো হেলান দিয়ে দেয়ালে
সাজিয়ে রাখি–বেশ থাকে কোনাভাঙা, চাটগাঁ-র ভাষায়
এটা-সেটা বলে, তবে কোনো দাবিদাওয়া নেই,
যেসব পুরুষদের বৌ-রা চাকরি করে তাদের মুখের দিকে
অপলক চেয়ে থাকে–ভয় পায় বিসর্জনের
ঢাক শুনে, ভাবে বুঝি তাকেও নদীর জলে ফেলে দেওয়া হবে।
কহবতীর নাচ ৭
এবার যদি আমি ফিরে আসি তবে আমি নীল রঙ হয়ে ফিরে আসব।
বৃষ্টিশেষে মেঘের ফাঁক দিয়ে বাংলার আকাশে যে নীল রঙটুকু দেখা যায়
আমি তারই মতো হাল্কা কিছু বলার চেষ্টা করব–
যে-কথায় কোনও জড়তা নেই–যাকে না বুঝলে
কারো ভাতকাপড়ে টান পড়বে না–কেউ বলতে পারবে না
তোমাকে বুঝলুম না হে, তোমাকে একেবারেই বোঝা গেল না।
তখন তুমিও সাদা রঙ হয়ে ফিরে এসো।
হাতে-বোনা খদ্দরের হিংসাহীনতা হয়ে তুমি যেন আমাদের
সবার চৈতন্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকো–যে সাদা রঙ দাবি করে
‘আমাকে বুলেটবিদ্ধ করো, আমাকে রক্তছাপে ভরিয়ে তোলো,
আমাকে স্বাধীনতা দাও।’

জন্ম ৩ আগস্ট ১৯৩৯, মৃত্যু ৩ অক্টোবর ২০১৫। বাংলা সাহিত্যে হাংরি আন্দোলন-এর একজন খ্যাতনামা কবি । ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবি হিসাবে পরিচিত ছিলেন । সমীর রায়চৌধুরীর কলেজ – জীবনের বন্ধু উৎপল ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলন এর সূত্রপাত ঘটতেই তাতে যোগ দেন, এবং তার কবিতা রচনার ধারায় বাঁকবদল ঘটে । হাংরি আন্দোলন এর কারণে ১৯৬৪ সালে তার বিরুদ্ধেও গ্রেপতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল । সেকারণে তিনি যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপনা থেকে বরখাস্ত হন । ১৯৬৫ সালে অভিমানাহত উৎপল লন্ডনে গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন । সেখানে তিনি শিক্ষকতা করতেন । লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বিবাহ করেন এবং কবিতা লেখা থেকে সাময়িক বিরতি নেন। দুই দশক পর কলকাতায় ফিরে উৎপলকুমার বসু পুনরায় কবিতা লেখা আরম্ভ করেন । তার সমসাময়িক, এমনকি তরুণতর কবিদের তুলনায় তার কবিতা ছিল সম্পূর্ণ নূতন ।নিরাসক্ত ও নির্লিপ্তভাবে বস্তুস্বভাবের যথাযথ বর্ণনা তার কবিতার মুখ্য বৈশিষ্ট্য । বস্তুর অভ্যন্তর সত্যের অভিমুখে কবিতাকে চালনা করেছেন উৎপল । তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জীবন প্রকৃতি কোনো রহস্যভূমি রচনা না করেই তার কবিতে মেলে ধরে বর্তমান সমাজবাস্তবতা । উৎপলকুমার বসু বহুলব্যবহৃত শব্দগুলোকে কবিতার শরীরে এমনভাবে স্হাপন করেছেন যে তার ফলে তৈরি হয়েছে বাক্যের নূতন মাত্রা । অনেকে অবশ্য বলেন তার কবিতা ‘আকারসর্বস্ব’।
কাব্যগ্রন্থ
- চৈত্রে রচিত কবিতা (১৯৬১)
- পুরী সিরিজ (১৯৬৪)
- আবার পুরী সিরিজ (১৯৭৮)
- লোচনদাস কারিগর (১৯৮২)
- খণ্ডবৈচিত্রের দিন (১৯৮৬)
- শ্রেষ্ঠ কবিতা ( ১৯৯১)
- সলমাজরির কাজ (১৯৯৫)
- পদ্যসংগ্রহ (১৯৯৬ )
- কবিতাসংগ্রহ (১৯৯৬)
- কহবতীর নাচ (১৯৯৭)
- নাইট স্কুল (১৯৯৯)
- টুসু আমার চিন্তামণি (২০০০)