তোমার সঙ্গে ছিল ব্যক্তিগত রমণীয় আলোছায়াময় টানা দিনগুলি
গোল বারান্দার দিকে চেয়ে থেকে চোখে জল আসে
উদ্ভিদের, বটপাকুড়ের তলে অপর্যাপ্ত দিন ছিল, রাত্রি ছিল আমাদের
সকালে পায়ের কাছে অ্যাসিডের মতো তীব্র রোদ এসে নামত তখন
জৈষ্ঠে আমাদের ছিল ব্যক্তিগত রমনীয় আলোছায়াময় টানা দিনগুলি
গোশালায় সে-সময়ে কখনো-বা ঝলসে যেত গোরু ও গোয়ালা
বাতাসে নরম মাংস পোড়ার গন্ধে আমাদের বিষণ্নতা লেগেছিল
দূরে আধো-অন্ধকারে, আগুনে ও সন্ধ্যার মেঘে
ডুবে যেত তোমাদের লাল বড়ো বাড়ি।
২.
জামের বনের মধ্যে আমি এক চিরস্মরণীয়
বাঘের হলুদ ছোপে সাথীহারা সন্তান বাঘের
ঘোরাফেরা দেখি। পুরনো জামের বনে আমি শুধু মানুষের
শোভাযাত্রা দেখেছি শৈশবে। সে-সব জামের বন আজ আর
উপদ্রবহীন নয়।
৩.
নগরে নগরে তুমি গান গাও রমণীবিজয়ে।
ওদিকে পোকার স্তুপ জমে ওঠে–তারা আজ যাযাবর
স্ত্রী-পাখিদের দলে মিশে গিয়ে বাতাসনির্ভর
প্রাণবন্তের মতো শুয়ে আছে।
যদিও লাম্পট্য নয় ঔপনিষদিক তবু, সাথি, মহার্ঘ রেশম
রেখেছ কাঁধের পরে এবং বৃদ্ধের দলে
আধোভাঙা জীবদ্দশায় তুমি ডুবে গেছ। আমি বা কী কম?
যুবার পেশির তলে সদ্যজন্ম, ক্ষুধার্ত ইঁদুর
কবির মনীষা বলো, ছন্দোময়–লক্ষ্য সে-রেশম।
৪.
কিছু কিছু ঘোড়া আজ নেই
এবং সহিস একা প্রাসঙ্গিক নয়
এজন্যই ফিরে আসে ঘাস আর ঘাসের জন্ম হয়
শরতকালীন
আবহাওয়ায় আমাদের ক্লান্তিবোধ হতে থাকে।
প্রগলভতা
ঝাঁকাও যে-ডাল ইচ্ছে, গাছ তার চেনা ফলগুলি
উপহার দিতে থাকে, আমরা লাফিয়ে উঠি, দৌড়ে যাই,
যা-কিছু প্রত্যক্ষ তাকে পিছু ফেলে হেঁটে যাই দ্বিধার ভিতর–
সেখানেও ফল পড়ে, ফাটা ত্বক, আঁকশি অনন্ত
আকাশে দুলছে দ্যাখো, এ তো বল্লভপুরের সেই কালবৃক্ষ নয়
যার ফলগুলি স্বতন্তর, বিদ্যুৎপাতিত।
সুখ-দুঃখের সাথী / ভূমিকা
সুখ-দুঃখের সাথী, তুমি আমার সঙ্গে চলো।
বাতাস বইছে বেরিয়ে-পড়ার বাতাস, গাছের কাছে বলো
আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ুক, পথের কাছে বলো
আমার ফিরতে অনেক রাত্রি হবে–যেন অপেক্ষা না ক’রে
সদর দরজা বন্ধ করে।
তুমি গাইতে পারো গান
কিন্তু সে গান মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবে। তুমি অনেক রূপকথা
মাথার মধ্যে বয়ে বেড়াও–কাকে বলবে? শুনবে কারা?
শোয়ার আগেই ঘুমে ঢুলছে মানুষ-জন, পশু ও পাখি, চন্দ্র, তারা।
এমনি করেই জীবনভর কত সময় নষ্ট হল।
এবার সুখ-দুঃখের সাথী, তুমি অন্য কোথাও চলো।
সুখ-দুঃখের সাথী / ৩৭
শীত এসেছিল। শীত চলে গেছে।
একটি অতীত। আরেকটি সে যথার্থ সুদূর।
দু-দেশেই লেপতোষকের গল্প। তাই ভাবি। রোদে বসে।
তাপ বেশি হলে দেয়ালের কোণে সরে যাই।
ছোটোরাও ঘোরে-ফেরে। সঙ্গে থাকে।
দুই অতীতচারিতার মাঝে আছে এক হানাবাড়ি।
সেইখানে আমগাছ। রাতারাতি মুকুল ধরেছে।
যব
কবিতায়, মেঘের ভিতরে, আমি পেতে ধরি করপুট, জল পড়ে, জলে
হাড় অব্দি ভিজে যায়, পান করি, আরো চাই, খাও খাও ; এমন শুনেছি–
এর নাম জলসত্র, অথবা কবিতা, অথবা আতুর
মানুষের পিত্ত-কফ-নিবারণ–আমার কিছুই নয়–আমি অনেক দূরের যাত্রী,
সহজাত তেষ্টা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি পথে,
এই তৃষ্ণা, এই হারামজাদী, কিছুতেই সঙ্গ ছাড়ে না।
আকাশযান
তুমি সম্রাট, প্রভু ও যাতায়াতকারী পথিকের দেবতা
তুমি এক কাঠা মদ দাও আর আমাদের
দাই-মাকে ফিরে দাও
দু’চারবার আলোছায়া মেলে ধরো পথে তুমি
তোমারই প্রস্তাব
কুরুক্ষেত্র গ্রাম থেকে সিপাহীর হাঁক শোনা যায়
‘সাধ ছিল’ বলে আজ কাগজসন্ন্যাসী
তার মানে এই নয় বৃষ ও মানুষ
দু’চার বছর শুধু স্তন ও স্তন্য নিয়ে খেলেছিল
তাকে ফিরে পেতে হয়েছিল ‘মদ’ যাকে বলে
অর্থাৎ আদর তাকে পেতে হয়েছিল
কুকুরের ল্যাজ নাড়া দেখে তাকে প্রীত হতে হয়েছিল
বনের ভিতরে গিয়ে মনিব হারায় আর
নিশ্চেতন পড়ে থাকে বৃষ ও মানুষ
তুমি সম্রাট, প্রভু ও যাতায়াতকারী পথিকের দেবতা
ঝুড়ি থেকে তুলে নাও শুল্ক ঠিক
তুলে নাপ বজ্রসেগুন পাতা
মুখে বলো ‘দেখহ বিচারি’
দুঃখী মানুষ
দুঃখী মানুষই বোঝে দুঃখিত মানুষের কথা, তারা
আপন ভাষায় বাক্যালাপ করে, হাসে, কাঁদে, পরস্পরে
সাহস যোগায়, মেঘলা আজ সকালবেলায় তেমনই এক
ব্যক্তির দেখা পাই, অফিস যাওয়ার পথে, সে আমাকে
কিছু যেন বলবার চেষ্টা করে, আমি না-বুঝেই সব কিছু
বুঝলাম এ-রকম ভান করি, দু-একটা উপদেশও না দিয়ে
পারি না, সে-ও শোনে, ম্লান হয়ে থাকে, জানি আমার
ভাষাই তাকে জব্দ করে, প্রতারণা করে।
সতর্কবার্তা
সমুদ্রসাঁতার মেয়েদের ক্লান্ত করে। শুধু একজন
ভাসছে সহজ নীল জলের ভিতর। তার জামাখোলা স্তন
ঢেকে যায় বুদবুদে। আমার পায়ের নীচে সরে যাক বালি :
তার এই কথা ফুরোতেই আরেক বিশাল ঢেউ বলে : এসো, চালি
নতুন পাশার দান। তুমি নাকি ভালো খেলোয়াড়?
ঢেউ অটুট দাঁড়িয়ে থাকে। ভাঙে শুধু বালির পাহাড়।
সমুদ্রসাঁতারে নৌকার ক্লান্তি কত–আমি একদিন
ওর কাছে জেনে নিতে যাই। আমারো তো কিছুটা প্রবীণ,
কিছুটা গভীর সত্য শোনবার ইচ্ছা হয়।
আমার স্তনের দিকে চেয়ে থাকো, এর চেয়ে বেশি সত্যময়
খুঁজো না অন্য কিছু : হেন উক্তি তার।
আমি অটুট দাঁড়িয়ে থাকি। ভাঙে শুধু বালির পাহাড়।
সমুদ্রসাঁতারে শ্মশানের কালো কাঠ ক্লান্ত হয় নাকি?
প্রশ্নের মতো জেনো উত্তরেও যথেষ্ট চালাকি
লুকানো থাকতে পারে। আমাদের কৌতূহল তত কালো নয়
যতটা আগুনে পোড়া। আজ খোলা-গিট হাঙরের ভয়
উপকূল স্তব্ধ রাখে। সম্ভবত আর
সমুদ্রে নামো না যারা, জাপ্টে ধরো বালির পাহাড়।
সলমা-জরির কাজ / ৭
বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা, ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে, মেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, আজ যা-বলার আছে তুমি আমাকেই বলো, স্ত্রীর মুখরতার কথা বলো, সহকর্মীদের শঠতার কথা বলো, রাতে ঘুম হয় না সেই কথা বলো, আর যদি কাঁদতেই হয় তবে এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো, বন্ধু।
সৌরলতা / ৬
হায়, আজ কবিতা লিখতে গিয়ে দেখি
হাত কাঁপছে
অক্ষরগুলি ছিটকে-ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে
আর লেখার খাতার সব ক’টি পাতা
এমন হেনস্থা দেখে হেসেই আকুল
তাই সেই মেয়েটির কথা ভাবি
যে আমাদের একতলার ঘরের জানালা দিয়ে
হাত গলিয়ে
দু-দুটো বাঁধানো বই তুলে নিয়ে গিয়েছিল
শীতের ভোরে সে যেন এসেছে ফিরে–
সবকিছু একদিন চুরি হয়ে যাবে
এই বিশ্বাসে ও অনাস্থায় এলোমেলো লিখে রাখি–
‘আমাদের গ্রহ-তারাগুলি বৈধ নয়।’
চৈত্রে রচিত কবিতা / ১
নিঃসঙ্গ দাঁড়ের শব্দে চলে যায় তিনটি তরণী।
শিরিষের রাজ্য ছিল কূলে কূলে অপ্রতিহত
যেদিন অস্ফুট শব্দে তারা যাবে দূর লোকালয়ে
আমি পাবো অনুপম, জনহীন, উর্বর মৃত্তিকা
তখন অদেখা ঋতু বলে দেবে এই সংসার
দুঃখ বয় কৃষকের। যদিও সফল
প্রতিটি মানুষ জানে তন্দ্রাহীনতায়
কেন বা এসেছো সব নিষ্ফলতা, কবিতা তুমিও,
নাহয় দীর্ঘ দিন কেটেছিল তোমার অপ্রেমে–
তবুও ফোটে না ফুল। বুঝি সূর্য
যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়। বুঝি চিরজাগরুক
আকাশশিখরে আমি ধাতুফলকের শব্দ শুনে–
সূর্যের ঘড়ির দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি
এখনি বিমুক্ত হবে মেঘে মেঘে বসন্ত-আলোর
নির্ভার কৃপাকণা। সমস্তই ঝরেছিল–ঝরে যাবে–
যদি না আমার
যদি না আমার মৃত্যু ফুটে থাকো অসংখ্য কাঁটায়।
অন্নদাতা যোসেফ / ১২
তুমি বৃদ্ধ কুকুরের মতো আমার অন্তঃকরণে প্রবেশ করো–
ওখানেই গুটিসুটি মেরে নির্বিঘ্নে ঘুমাও।
আমি অবাক হয়ে শুনব
তোমাদের শুকসারীর দ্বন্দ্ব–
তুমি যদি সারী হও আর শুক পাখির সঙ্গে বাসা বাঁধো
এই হৃদয়পিঞ্জরে।
তুমি আমার মনের নিভৃতে ভাসমান শালতি হয়ে
বন্যাপীড়িত গ্রামবাসীদের উদ্ধার করো,
তাদের শুকনো খাদ্য পৌঁছে দাও–জল দাও–
কিন্নর লাফিয়ে নামে গাড়ির দরজা যেই খোলা হল।
অর্ধছাগ নেমেছিল ধীরেসুস্থে–সে তো বনের দেবতা,
অতিরূপ, রমণীলাঞ্ছন
এরাও আশ্রয় চায়, মনোবাসী হতে চায়।
এত জায়গা আমার কোথায়?
চেনা-অচেনা
এত ভোর-ভোর। কাউকে কি টেলিফোনে পাব?
ভাবতেই যন্ত্রটা বেজে ওঠে। ওদিকের কণ্ঠস্বর
সরাসরি প্রশ্ন করে : ‘ঘুম ভাঙালাম নাকি?’ কার গলা?
খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। ‘আমি বাঘের ঈশ্বর—
হরিদেবপুরে দেখা হয়েছিল।’ চট করে মনে পড়ে
গোসাবা যাওয়ার পথে, ঐ গ্রামে, চা-বিস্কুক্ট খেয়েছিলাম,
দোকানের লোকটিকে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ এবং আমরাও
অল্পবিস্তর হেথা নয় হেথা নয় অবস্থায় টলমল করছিলাম।
তাহলে তিনিই সেই।
সলমা-জরির কাজ -১০শ্বাসকষ্ট উঠলেই বুঝতে পারি ফুলডুঙরি পাহাড় আর বেশি দূরে নয়নইলে এমন হাঁপাচ্ছি কেন? কেন ওসুধে সারে না?ঐ পাহাড়ের মাথায় উঠলে এ-বছর কী দেখব কে জানে-যে-পাথরে আমরা সবাই নাম লিখিয়েছিলাম সেটি হয়তনিচে গড়িয়ে পড়ে গেছে,যে-জলস্রোত লাফিয়ে পার হয়েছিলাম তাকে ঘুরিচাষজমির দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল-যদি তাই হয়ে থাকে তবেআর তাকে আমি খুঁজে পাবো না,এইসব ভাবি আর হাসপাতালের বিছানা শুকনো ডালপালায়,ছেঁড়া কাগজে আর পরিত্যক্ত সাপের খোলসে ভরে োঠে-এত জঞ্জাল সরাবে কে? আমি কি সময় করে উঠতে পারবো?আমি তো ফুলডুঙরি পাহাড়ে প্রায় পৌঁছে গেছি।চেপারামের ঘরটাএখান থেকে দেখা যাচ্ছে। আরেকটু পা চালিয়েউঠে গেলেই হয়।
কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা-১গাছে উঠে বসে থাকি। ফল খাই। ব্যক্তিমানুষের দিকেআটি ছুঁড়ে মারি। নিচে হাহাকার পড়ে যায়। বেশ লাগে।মাঝে মাঝে ধ্রুপদী সংগীত গাই। ওরা শোনে। বাদ্যযন্ত্রনিয়ে আসে। তাল দেয়। বোধ হয় ছবিও তুলেছে। সেদিনএক গবেষক বাণী চাইল। ভাবলাম বলি : আমার জীবনইআমার বাণী। কিন্তু এটিও নাকি বলা হয়ে গেছে। অতএবনিজস্ব ভঙ্গিতে, কিছুটা বিকৃত ভাবে, বিড় বিড় করি-“দেখেছি পাহাড়। দেখে জটিল হয়েছি।”
কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা-২চলো মর্মরসাথী, চলো ভ্রমণে, কান্তারে,চলো বিদেশীর বেশে কেউ যেন কাউকে না চিনি-ফলিত জ্যোতিষরূপী, তুমি গানের দেবতা, তুমি জানোআমার লেখার খাতা অজ্ঞান অনিশ্চয়তায় ভরে গেছে,এসো নতুন প্রজন্ম হয়ে, এই ভুলভ্রান্তিময়লেখাগুলি পাঠ করো, অর্থ করো, পর্বতবাসীদের মতোবিশাল প্রান্তর প্রথম দেখায় অভিভূত হও।এ-অববাহিকা, বস্তুত জমির ঢাল, ধীরে ধীরে নদীতে নেমেছে।
কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা-৩ভোরবেলা পার্কে বেড়াতে গিয়ে কী দেখব কে জানে, এই ভয়েরাত থেকে কাঁপি, ভুল পায়ে জুতো পরি, ছাতা নিতে মনেইথাকে না, হায় সেই দুর্ঘটনার জীপ-গাড়ি থানার সামনে তেমনইপড়ে আছে, মরচে ধরেছে, চাকায় বাতাস নেই, গাছ থেকেঝুলন্ত দড়িটা ওখানে কীভাবে এল, ফাঁস নাকি, লকআপ-য়েরজানলা থেকে উড়ে আসে দুটো পাখি, ভাঙাচোরা এঞ্জিনে ওদেরবাসা, আপাতত ডিমহীন, নীড়ে শাবক আসে নি, আজ ঝড়েরআঁধার মেঘে দিন শুরু, এলোমেলো বৃষ্টি নামছে।
কয়েকটি সাম্প্রতিক কবিতা-৫কত-না রুদ্ধ ক্রোধ বাক্সে লুকানো থাকে, বাঁধা থাকে বিছানায়।চেকিঙে পড়েনি ধরা, বৈদ্যুতিক কৌশল এড়িয়ে গিয়েছে,বিমানবন্দর তারা অকাতরে পার হয়, এমনকি দেহরক্ষীদেরবেষ্টনী এড়িয়ে বহু হতবাক প্রেসিডেন্ট-মুখ্যমন্ত্রী-নগরপালেরসামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, বলে-‘অ্যাই, তোরা ভেবেছিসটা কী?’সৈন্যরা বৃথাই বন্দুক ছোঁড়ে, কৃপাণ নিজেরা লড়াই করে।ক্রোধ অদৃশ্যই থেকে যায়।
রাক্ষসসেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল।তাকে বলি : এই তো তোমারই ঠিকানা-লেখা চিঠি, ডাকে দেব, তুমিমন-পড়া জানো নাকি? এলে কোন ট্রেনে?আসলে ও নির্জনতা নয়। ফুটপাথে কেনা শান্ত চিরুনি।দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ কালো চুল লেগে আছে।
পুরী সিরিজের শেষ কবিতাতারপর ঘাসের জঙ্গলে পড়ে আছে তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি ।এবংআকাশ আজ দেবতার ছেলেমেয়েদের নীল শার্টপাজামার মতো বাস্তবিক ।একা ময়ূর ঘুরছে খালি দোতলায় । ঐ ঘরে সজল থাকতো।সজলের বৌ আর মেয়েটি থাকতো। অরা ধানকল পার হয়ে চলে গেছে।এবার বসন্ত আসছে সম্ভবনাহীন পাহাড়ে জঙ্গলে এবার বসন্ত আসছেপ্রতিশ্রুতিহীন নদীর খাঁড়ির ভিতরে নেমে দু’জন মানুষ তামা ও অভ্র খুঁজছে।তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি হারিয়েছ বাদামপাহাড়ে।আমার ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা আমি হারিয়েছ বাদামপাহাড়ে।
চেয়ে দেখোপ্রত্যক্ষ করেছ? সেই ভোর থেকে হাত পেতে আছি। ভরে গেছিদানে ও অবজ্ঞায়। পেয়েছি ক্ষুধার শস্য, প্রেমকণা, দাতার ধিক্কার,কিছু যেন স্বততই এসেছে – কিছু রাস্তায় কুড়িয়ে পেলাম। সহজ হয়নি।দৌড়ে গেছি রুষ্ট শ্বাপদের অত্যাচারে। বসে গেছি বিবাহের ভোজে।এ-মুহূর্তে সন্ধ্যার সানাইটুকু উদ্বৃত্ত। যাকে বলে না-চাইতে পাওয়া।
কহবতীর নাচ ১একাধিকবার এই সৈকতে এসেবলেছি আমার মতো পুরুষকে তো কিছুকলঙ্কের ভাগ তুমি দিতে পারো। হয়নি,শোননি কেউ, শুধু বালিয়াড়ি ধসেপড়েছে সাগরজলে।স্তব্ধতা থেকে কোলাহলেআবার যাত্রা শুরু, পাপ থেকেপাপের স্খালনে। ঝাউবনে উড্ডীনপতাকাবিদ্রোহ থেকে রঞ্জনরশ্মির অনলে–চলেছি সকলে।এই মদ কিভাবে করব পান–বলে দাও। দাঁড়িয়ে জলের ধারে?ছিঁড়ে-আনা এই ফুলগুলিঘুমন্ত খ্রিস্টগাছে ফুটেছিল–কীভাবে ভাসবে তারা মাতৃসমা জলে?
কহবতীর নাচ ২যে তমসা নদীর তীরে আমি আজ বসে আছি তার বালুকণাগুলি আমাকেজানাতে চাইছে আমি জল থেকে কতটা পৃথক–তার ঢেউগুলি আমাকেবোঝাতে চাইছে আমি গাছ নই, আর গাছের আড়ালে ঐ ধাঙরবস্তির একমদ্যপানরত যুবক আমাকে বলতে চাইছে আমি পক্ষীরাজ, মেঘ থেকে নামলাম,এইমাত্র, সাক্ষাৎ তারই চোখের সামনে–হবেও-বা। তাহলে বর্ষার আঁধার সকালে আমি ডানা গুঁজে বসে থাকি। রোদউঠলে উড়ে যাব।
কহবতীর নাচ ৩দু-হাত শূন্যে তুলে কেঁদে উঠি, ‘প্রভু, ওটা আমাকেই দিতে হবে।’লোকে প্রচণ্ড আমোদ পায়–বলে, ‘তোর আমড়াগাছির যেন শেষ নাই,আবার দেখা তো দিকি ঐ খেলা’, আমি আবারো দেখাইমাঝে-মধ্যে অতিরিক্ত কিছু হাঁপ জুড়ে দিই, যথা, ‘ এসেছিনু ভবে’অথবা ‘নিঠুর’, এ-সব গৌণ গান তুমিও গাইতে পারো;লোক হাসে–এর চেয়ে বড় কথা আর আছে নাকি?দিনের প্রখর রৌদ্রে বনতলে পড়ে রয় অজস্র জোনাকিমূক ও মৃত্যুমুখী, শরীরের নীল আলো জ্বলে কারো কারো।
কহবতীর নাচ ৫হাড় ও কঙ্কাল শুধু, আমি তাকে পাঁজাকোলে করেচেয়ারে বসিয়ে দিই, অম্নিই বসে থাকে,ঝঞ্চাট করে না, কখনো হেলান দিয়ে দেয়ালেসাজিয়ে রাখি–বেশ থাকে কোনাভাঙা, চাটগাঁ-র ভাষায়এটা-সেটা বলে, তবে কোনো দাবিদাওয়া নেই,যেসব পুরুষদের বৌ-রা চাকরি করে তাদের মুখের দিকেঅপলক চেয়ে থাকে–ভয় পায় বিসর্জনেরঢাক শুনে, ভাবে বুঝি তাকেও নদীর জলে ফেলে দেওয়া হবে।
কহবতীর নাচ ৭এবার যদি আমি ফিরে আসি তবে আমি নীল রঙ হয়ে ফিরে আসব।বৃষ্টিশেষে মেঘের ফাঁক দিয়ে বাংলার আকাশে যে নীল রঙটুকু দেখা যায়আমি তারই মতো হাল্কা কিছু বলার চেষ্টা করব–যে-কথায় কোনও জড়তা নেই–যাকে না বুঝলেকারো ভাতকাপড়ে টান পড়বে না–কেউ বলতে পারবে নাতোমাকে বুঝলুম না হে, তোমাকে একেবারেই বোঝা গেল না।তখন তুমিও সাদা রঙ হয়ে ফিরে এসো।হাতে-বোনা খদ্দরের হিংসাহীনতা হয়ে তুমি যেন আমাদেরসবার চৈতন্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকো–যে সাদা রঙ দাবি করে‘আমাকে বুলেটবিদ্ধ করো, আমাকে রক্তছাপে ভরিয়ে তোলো,আমাকে স্বাধীনতা দাও।’
জন্ম ৩ আগস্ট ১৯৩৯, মৃত্যু ৩ অক্টোবর ২০১৫। বাংলা সাহিত্যে হাংরি আন্দোলন-এর একজন খ্যাতনামা কবি । ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবি হিসাবে পরিচিত ছিলেন । সমীর রায়চৌধুরীর কলেজ – জীবনের বন্ধু উৎপল ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলন এর সূত্রপাত ঘটতেই তাতে যোগ দেন, এবং তার কবিতা রচনার ধারায় বাঁকবদল ঘটে । হাংরি আন্দোলন এর কারণে ১৯৬৪ সালে তার বিরুদ্ধেও গ্রেপতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল । সেকারণে তিনি যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপনা থেকে বরখাস্ত হন । ১৯৬৫ সালে অভিমানাহত উৎপল লন্ডনে গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন । সেখানে তিনি শিক্ষকতা করতেন । লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বিবাহ করেন এবং কবিতা লেখা থেকে সাময়িক বিরতি নেন। দুই দশক পর কলকাতায় ফিরে উৎপলকুমার বসু পুনরায় কবিতা লেখা আরম্ভ করেন । তার সমসাময়িক, এমনকি তরুণতর কবিদের তুলনায় তার কবিতা ছিল সম্পূর্ণ নূতন ।নিরাসক্ত ও নির্লিপ্তভাবে বস্তুস্বভাবের যথাযথ বর্ণনা তার কবিতার মুখ্য বৈশিষ্ট্য । বস্তুর অভ্যন্তর সত্যের অভিমুখে কবিতাকে চালনা করেছেন উৎপল । তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জীবন প্রকৃতি কোনো রহস্যভূমি রচনা না করেই তার কবিতে মেলে ধরে বর্তমান সমাজবাস্তবতা । উৎপলকুমার বসু বহুলব্যবহৃত শব্দগুলোকে কবিতার শরীরে এমনভাবে স্হাপন করেছেন যে তার ফলে তৈরি হয়েছে বাক্যের নূতন মাত্রা । অনেকে অবশ্য বলেন তার কবিতা ‘আকারসর্বস্ব’।