| 26 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-৫) । বল্লরী সেন

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

 

ফুলো ঝানো জুরওয়া জন্ম॥

 

“শুন ভাই বলি তাই সভাজনের কাছে।

শুভবাবুর হুকুম পেয়ে সাঁওতাল ঝুঁকেছে।।

বেটারা কুক ছাড়িল জড় হৈল হাজারে হাজারে।

কখন আসে কখন লুটে থাকা হৈল ভার।।…

হাজার দুই সাঁওতাল তারা রাজবাড়ী সান্ধ্যায়।

লুটি ঘর সব কলরব করিয়া বেড়ায়।।…

বার শ’ বাষট্টি সাল, বর্ষাকাল বানের বড় বৃদ্ধি।

আব্দারপুরের মানুষ কেটে করল গাদাগাদি।।”

(‘পূর্ববঙ্গ-গীতিকা’, ৩য় খণ্ড, ২য় সংখ্যা।)

এর উত্তরে কথা কাটলেন মুণ্ডারি ভাষার কবি ভিডি বাস্কে, সুর দিলেন মুর্মু ঠাকুর। এখন এই গান উৎসবের শুরুতে গাওয়াই দস্তুর। এ গান মুণ্ডারি জীবনের যাপনের চিৎকার, সপ্তাহভর ধান কাটা সারা হলে তারা দলে দল গাইতে গাইতে গম ভাঙে, মুড়ির চাল জড়ো করে, গোড়ালি দিয়ে মাটি ছোঁয় আর পরস্পরকে আঁকশির মতো জড়িয়ে রাখে।

“স্ত্রী-পুত্রের জন্য,

জমি-জায়গা বাস্তু-ভিটার জন্য, হায়! হায়!

এ মারামারি, এ কাটাকাটি গো-মহিষ লাঙল ধন-সম্পত্তির জন্য,

পূর্বের মত আবার ফিরে পাবার জন্য আমরা বিদ্রোহ করব।”

এই গান যেখানে শেষ হল, সেখানেই জন্ম হল ফুলির। এক ঝলকে বসনের চোখে মনে হয়েছিল, স্বপ্নে দেখা নগ্নিকা মায়ের আবক্ষ মূর্তি, শিশু যেন স্বাভাবিক না। কেমন যেন আলাদা, মাথায় শামুক গোটানো চুল, কপাল এক ফালি চাঁদ। ঐটুকু উজ্জ্বল, আর বাকি মুখে কত শতাব্দীর ঘৃণা পাথর কেটে লিখেছে কেউ। জোড়া ভ্রূ পাখির ডানার মতো খুলে রেখেছে তার দিনান্তকাল।কিন্তু তমিজ খুব গোঁ ধরে মেয়েকে দিকু স্কুলে না দিয়ে বর্শা শেখায়, তরোয়াল চালানোর ক্লাসে ভর্তি করে দেয়। দুপুরে পাঠশাল থেকে ফিরে বাচ্চারা ঘুমোলে, ফুলি অস্ত্র শেখে।

সবে দশ বছর তার, গেরামে একা হয়ে যায় মেয়ে, কিন্তু হাল ছাড়ে না। দিকুদের কোনও শ্যাষ নাই দ্যাশে, তারা নবগ্রামের ভেতরে সেঁধিয়ে থাকে বটের ঝুরিতে,

লম্বা মানুষ সমান উঁচু ঘাসের মধ্যে। খাজনার অঙ্ক সমানে বাড়িয়ে যায় জমিদার আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধায় দিকু সৈন্যরা গেরামে ঠাঁই নিচ্ছে প্রতিদিন, শিকারী সিংহের পেছনের থাবার গতিতে। ইস্কুলে ঠাকুর মুর্মুর কাছে দিকুদের গতিবিধির গল্প শুনেই ফুলির কান গরম হৈল।

গ্রীবার হাড় টং করতে লাগল, “আমি ফিরিঙ্গিবিলের পচ্চিমে যাব। না যেয়ে দেখতে বুঝতে লারবো। কালই যাব লিচ্চয় বাপজি, তুমি আমায় বাধা দিবা না কিন্তুক, তুমার কাছেই যে আমি অনুমতি চেয়া যাব, মাকে বলিলে নাও দিতে পারে যে।” বিহান হলেই বের হবো। হাঁটবো ঝাঁটাগাছের জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে নয়ানজলি পেরিয়ে।


আরো পড়ুন:  ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-৪)


ওখানে ঝাঁটাগাছের পাকা হলুদ শিসের মধ্যে শঙ্খচূড়ের বাস। ওদের জাগাতে লাই। হ। তাই বরং ওর গা দিয়া বের দিব নতুন পাকা রাস্তায়, নগরার খামারপাড়া, রায়চৌধুরীদের ইস্কুলবাড়ি দিয়ে কুর্মিদের ওলাবিবির থান হয়ে চল্যে যাব। ভৈরবের বিরাট যে মূর্তি, তারই উত্তরের ধনিয়ামুণ্ডিতে পৌঁছিয়াতে কিছু দূর যেয়া দিকুচত্বর পাবো। ওদের শয়তান সৈন্যরা ওখানে জমি পাহারা দিতে লাগছস? এত্ত দেমাক তুদের হৈল কীভাবে! দূর থেকা দেখি, নতুন অঙ্কুরের উপর পা দিয়া চেপ্যা দাঁড়িয়া চারজন মহল্লা ভেদ করিয়া মস্করা মারছে। জরিপ করতেছে নাকি? 

বেশি দূর না এগিয়ে এবার চলে আসা স্থির করলো ফুলি। কানের পাশে কে যেন বললো, যাও আর লয়। মা যে নাওয়া নেই খাওয়া নেই বইসে আছে তুমার জন্য। দূর হৈতে ফুলিকে দেখে তমিজ পাগলের মতো ছুট্টে এসে তাকে কোল্যে লিলে।

“ খুউব চিন্তায় ফেলেছিলি বাপ্ আমার। তুর মা তো কানছে আর মটুক মটুক বলতে লেগেছে। যা বিটি যা …”

 “ মা— আম্মো কি হারিয়ে যইছি, এই তো আমি। মা ,আর কাইন্দ না । থাম তুই, এত কাঁচা মেয়ার মা তুই নোস্ রে। তুই ফুলো মুর্মু র মা হচিস, তুকে একদিন লোগে চিনবেক।” তারপর ফুলিও মায়ের পাশে বসে হাঁড়ির গুগলি তুলে সাফ করতে লাগলো। ভাতও চড়েনি তাদের। ফুলি জলদি আলু সহ চাল আখায় চাপালে আর কাঁদতে কাঁদতে বাতাস দিতে লাগলো ক্রমাগত, অক্লান্ত পাখা করতে করতে। বাপজি আঁশ ছাড়া খাইতে লারে, তাই গুগলি বেছে তেল নুন হলুদ মাখিয়ে রাখা। তারপর শেষকালে রসুন পেঁয়াজ দিয়ে কষে করলেই বাপজি খুশি। পুরোটা ভাবার মধ্যেই দিকু সেনাদের শিবিরের ঘটার ছবি মনে এল, তখন সে নিজেকে অন্যমনে রান্নায় ডুবিয়ে দিতে লাগল বাসন মাজার কাজে। গুগলিতে কাঁচা সর্ষে বাটা মাখিয়ে রাখার ভেতরে। খুব জানতে ইচ্ছে হল ঝানো, তার যমজ বোন কেমন আছে, সুস্থ কিনা, কী করছে উ এখন এই মুহূর্তে ? বাপজী মা কেমন লুকিয়ে রাখে পেটে, সব বলবেক নাই। তাই এখন আর পুছি না উহার ব্যাপারে। জানি উহাকে বুরুডিতে বাপজি পাচার করে দেছে, মামার কাছে। লোক জানাজানি পর্যন্ত করে নাই। রাত্রি গাঢ়, কিন্তুক জম্ম দিয়েই মা তাকে কুথাকার কে মামা, সিখানে সরালে? 

কেন? এহার ভিতরে নিচ্চয় অন্য গল্প রহস্য আছে। নিচ্চিত। একদিন দোরে থেকা শুনি, মা বইলছে, ‘ ঝানোকে ওরা সাঁতার শেখালে, কাবাডি, আরও কি সব খেলা। পুরুষদের নাকি সে টক্কর দেছে কয়েকবার, বুঝলা। একটিবার নে যাবে আমারে, একটিবার তাকে দেখে আসতাম, কারোকে কিছুটি বইলতাম না গো—! বাপজি কিচ্ছুটি বুইল্ল না, কেবল চুপ করে শুনলা।

সেই বুঝলাম হ, বুন আমার। জুরওয়া বুন। দৈববাণী হৈছেল, ‘এ মেয়াকে না সরালে বাঁচাতি লারবি তুরা।’ তারপর হ্যাড়াহেড়ি মায়ের জ্ঞাতি ভাইয়ের কাছে নিয়ে যায় বাপজি, সেই রাতে রাস্তা পুরা সুনসান, গম্ভীর। তাহার মধ্যে ঝাঁপি মাথায় দিয়া তিন ক্রোশ পেরিয়ে পলসণ্ডা মোড় থেকা বাস। আমি আমার পিঠোপিঠি সহোদরাকে কুনোদিন দেখতে লারলাম। “সেহ তুর ই জুড়ি, কাজল চক্ষু, ভ্রূরোমে কপালের কিছুটা ঘাঁসে ভেজা শেওলা, শ্যামা মেইয়ার রং আষাঢ়ের আসমান যেন।”

বাজুর ঢাল যে তিমিরে কনুই ধইরল, সে স্থানটি সাদা অশ্বের চামড়ার মতো গুঁড়া গুঁড়া রাঙাবেলিয়ার লাল ধুলার মতো, বর্ষা নামলে গাভীর পিঠের মতো নতজানু হয়। সদ্য বিয়োনো মেয়ে, কতটুক বা দেখা, তবু এই তুয়ার মুখে আমি তার না দেখা মুখের আরশি বসিয়ে তাকে য্যান দেইখ্যা লি। 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত