| 26 এপ্রিল 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-৯) । বল্লরী সেন

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

কলিয়ান হাড়াম ও সারি ধরমকথা

।। ক ।।

মূর্ছা ভাঙার পর চেনার উপায় লাই কুথা, কুন সে আজব তিমির। চুনির বুক ঢিপ্ ঢিপ্ করতে লাগে, কাকে বুইলবে, কাহাকে উজিয়ে আওয়াজ দিবে। খিদা লাগছে বড়। ফ্যাসা গলায় সে আচমকা ডাকলে, মা…, বাপজী…। আর সঙ্গে সঙ্গে টেবিল সরানোর পর কেউ এগিয়ে এল।

“বেটুয়া, ভয় লাই। আগে কিছু মুখে দাও। কি নাম মা তুমহার? আমি তুমহার মায়ের মতো।এটা রঘুনাথ পণ্ডিতের ভিটা।” শুনা কি শুনা চুনি থরবড়িয়া বিছনা থেকা উঠতে যায়। “উঠিবে, দুধ, রুটি খাও। তারপরে শৌচ করে বাড়ি যাবা লয়। তুমার ঘরে সংবাদ পাঠানো হৈছে। কাল থেকা গেরামে ফেরোনি তো। মা বাপ না জানি কত কাঁইদছ। আমি সরহকে বলে দিছি, দিকুর পোশাকে লয়, উ এমনি যাবে। খাও বিটোয়া, খাও। কিছু ফেইলবা না।আর একটো রুটি খাবে তুমি।”

-খেয়ে কিছুটা সুস্থ, চুপ করে চতুর্দিক হাঁ করে গিলছে চুনি। কী মনোরম কারুশিল্পে প্রতি দেয়ালে চালগুঁড়ির আইলপনা। যেন মন্দিরের ফটক, গৃহদেবতার বিগ্রহ রইবেন ভিতরে। স্বয়ং মা কিরীটেশ্বরীর জরি ফুলকি সমস্ত দিয়া পোয়াল সাজানো। চোখ ফেরাতে লাচার, কিন্তুক এবার সে শৌচাবাসে যাবে বলে উঠলো, সাবধানে। ওঠামাত্র মনে হল, দেহ নিষেক হল, ভেঙে পড়ল শ্যাওলার সব ধাপ, আড়াল , প্যাঁটরা, সনদ, পায়ের গোছ, তালু, জিহ্বা। সে দাঁড়াতে না পেরে ছুটলো। নিজেকে যে অনেক ধুতে হবে এ সময়ে। মা, মা গো…

“দোর ঠেকানো থাক বিটোয়া, দোরে খিল দিওনি, আমি আছি, ডর কইরো না মা”

– “আমোর যে কাপড় চাই গো, দিবা? বড় বেপদ গো আমার।”

সুনারাম সোরেনের সঙ্গে সেদিন বেলায় বাড়ি ফিরলো চুনি। মটুককে একবার হারিয়ে ফেলে যে ভয় পেয়েছিলেন ফুলকুমারী, আবার বহু বছর পরে সেই কোল খালি হয়ে যাবার ত্রাস তাঁকে ধরে রেখেছিল। বসনের বহু তৎপরতায় তিনি মেয়ের সংবাদ পেয়ে কাল দু’ মুঠো মুখে দিয়েছেন। তমিজ ঘরে নেই, কবে ফিরবে বলেনি। সে দু রাত রাস্তায়, বাথানে চড়কি পাক খাচ্ছে। চেরাগ আলির কারখানায় পৌঁছে সে একটা নামহীন মহিষের মতো খাটছে, ওভারটাইম চলছে রাতভর। কাউকে বলেনি, উপোষ চলছে তার রোজ। চোদ্দ বচ্ছরের জোয়ান মেয়ে তার কার পিশাচদৃষ্টিতে পড়লো, কে খেদালো, কে লষ্ট করিল! ভাবলে আর রুচি থাকে না। ঘর ছেড়্যা, আহার ছেড়্যা, ভবঘুরে হৈল সে। এদিকে রঘুনাথ পণ্ডিতের টোলে ভাগ্যক্রমে পৌঁছে এ যাত্রা রক্ষে পেলে চুনি, প্রচণ্ড খিদে, তেষ্টা, জড় শরীরে তখন একটাই বোধ, তা হল দুর্বিনীত যন্ত্রণা, তলপেটে অস্বস্তি, অনিয়মিত ক্ষরণ— যা আসলে স্বাভাবিক , প্রচলিত এ অবস্থায়। চুনির দুর্বলতার কারণও এই অত্যধিক রজঃ নিঃসরণ, যা তাকে প্রায় নিস্তেজ ও রক্তাল্পতায় সাদা করে দিয়েছে এখন। একটানা চারদিন শুয়ে থাকার পর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলো চুনি। কিন্তু এর মধ্যেই সুনারাম সোরেন যখন রঘুনাথ স্যরের কাছ থেকে কুশল জানতে এল, ফুলি শান্ত হল কিছুটা। তমিজের কারখানায় রঘুনাথ স্যরের লোক গিয়ে তাকে সত্বর বাড়ি আসার সন্দেশ পাঠানো হল, যাতে সে মেয়ের দুশ্চিন্তা ত্যাগ করতে পারে। আর বসনের সঙ্গে হাতে হাতে নিজের দেহের ডাবরে পাকে পাকে চুনি ঢুকিয়ে দিচ্ছে কাপড়ের মশলা, তুলোর বিনুনি। ধোওয়া কাচা শুকানোর অমোঘ তিনটে ধাপ উত্তীর্ণ হয়ে তবেই শান্তি। বেমালুম গা গুলিয়ে ওঠে, মনে হয় আর কখনো আমিষ খেতে লারব সে। কিন্তুক দিদামা চায়, মাংস খাবে সে, জোয়ান পাতা দিয়ে লেম্বু দিয়ে মজবে পাকশাল। আর এর কিছুকাল পর, একদিন টোলের গর্ব হল সে। রঘুনাথ স্যর তাঁর নিজের হাতে তৈরি হরফের ছাঁচের গড়ন তাকে দিলেক। সেদিন রেজাল্ট বেরোলো; গেরামের সবচেয়ে মেধাবীর ফলক সে পেল। এবার আরও বড় পরিসরের স্বপ্ন, কলেজের ফটক পেরোনোর পালা। বসনের হাতের কাসুন্দির বয়াম রোদে দিতে দিতে ভাবছিল, আর সুনারামের মুখটা কেবল চোখের সামনে ভেসে উঠছেল, কতবার ইয়ত্তা নাই। রাস্তায় দুবার তার মূর্ছায় জল দিয়ে তাকে জাগানো আর আস্থা যুগিয়ে নিয়ে আসা, সহজ ছেল না। কিন্তক, পেরেছিল শ্যাষে। সুনারামের জন্য তার কলিজা কেমন য্যান কাঁদে। কিন্তু সুনারাম নিরুত্তর। সামনে তার গোল বেদি, ধানের পাশে সদরের পথ, ওপাশে পুবের দিকে পুরানো আস্তাবল, বাবুদের শিবমন্দির।


আরো পড়ুন:  ফুলো মুর্মুর সন্তান সন্ততি (পর্ব-৮)


হেঁটে এতটা আসার সময়ে যখনই চুনি হাঁপ নিতে বসেছে, সুনারাম তাকে আলের ধারে বসিয়ে নিজে চুপ করে অপেক্ষা করেছে অদূরে। জল খেতে দিয়েছে, মাইল পেরিয়ে জল ভরে এনেছে। ঝুপ্ করে সন্ধ্যা নামলে সাঁজোয়া জোনাকিগুলান হাতে নিয়ে আসমানে রব তুলে দিয়েছে। ছোট ভরসা ধামার ভেতরে, রুটি, সব্জি, আচারের ঘটা। নিজের পিঠের ঝোলায় বেঁধে এনেছে। শুধু এই নয়, স্পষ্ট ভাষায় জানতে চেয়েছে,  চুনির আর কোনও প্রয়োজন আছে কি না, গাড়ু লাগবে কি না। কিন্তু চুনি তখন গহীন একটা কাহিনির মাঝ বরাবর কথা বলে যাচ্ছে, কত কী বলার আছে সুনারামকে, বিশেষ করে যখন দিদামা আর তার মাতামহ একই পাঠশালের সুজন হৈত। দিদামা এক ডাকে চিনেছিল তার বাল্যকালের সুহৃদ   পরান  বাস্কে-কে। কিন্তু সুনারামের এতে কুনো হকচক্ লাই। একমনে নিরুত্তর পা চালিয়ে যাচ্ছে, ওদের দুজনার পা চালানোর স্পন্দে মাটির ফসলে  কাঁপ ধইরছে, যেন সুই চালাচ্ছে অন্ধ মেয়েটা। তরাস জাগে চুনির, তবু সে পিছোবা না, পণ কর্যছে কুনোদিন ডরাইবে না। আজ, এখন বহু দূর থিকা তমিজের মুখটা যে তাকে দেখছে, “বাপজি, কুথা গেলা রে? যেন তমিজের কাছে সে সুনারাম সম্পর্কে সে কত অভিযোগ করতো।

শ্যাষে মা কিরীটেশ্বরীর কাছে হত্যে দিয়া বলতো, “রঘুনাথ স্যর আমাকে বাড়ি পাঠাও গো, আর যে বেথা রাইখবার জগহ্ নাই।” কালবোশেখির পেরথম বারিশ ঝাপটে আমের সব মুকুল পড়ে রাস্তার রং হল তেলাকুচো আর তার নিষ্কম্প যোনিলম্ফে  ফিবারের মতো সূর্যমুখি তেলের সলতে কাটিয়ে নিতে হয়। রোমগুছির তলায় যখন প্রথমবারের বেথা কাঁথাকানির মতো নেস্ কে যায়, দ্বিতীয় আর তেমন মোহিত করে না। সেই ভাপে মুখ পুড়িয়ে গুঙিয়ে মোচন করা শিখছে মেয়া। রাত্রের ঝাঁজে তার গোটা শরীলটা পাকা গুটির মতো ঢোল হৈয়া রঘুনাথ পণ্ডিতের টোল পানে ছোটে। পায়ে বল নেই, তবু…।

পরের সপ্তাহ বিরামহীন খামারকাজে বিকিয়ে গেল। মটুক বাপজীর পাশে ঘোরে আর আউশের বুকের আঠা ছুঁয়ে দ্যাখে, কেমন তার অন্তরে এই রোঁয়া গজানোর সোয়াদ বড় ধুম্ জাগায়, কেমন হিড়িক য্যান্। আহ্লাদ হল। কেমন রাঈবেশে নেচে নিলে সে আলপথে, যতটা পথ সুড়কি নেই, কেবল মোলাম এঁটেল মাটি ছোপানো, য্যান গঙ্গার ধারে এই এক টুকরি ঘেষো ফুলের চৌপাটি, তার আদাড়ে শামুক, খোরশোলার ছানা ফোটে। যে পাঁকুড়ের শাখায় খরগোশ লাফায়, সেখানেই সর্ষে, ধান আর গমের মিশ্র এক আঘ্রাণ লেগে আছে। এখানডা পাখালির শব্দে পুটুশের বীজ উড়ে আসে, ভোরে এলে দেখা যায় দূরের বিলে সাদা সন্নেসি বক, এক পায়ে সূর্য আরতি করছে। চুলের উকুন ফেলতে দেরি, হুশ্ করে বাজ এসে ছোঁ মারে ব্যাঙ বা ছোট পাখির দু’ দিনের ছানা। জমির পাড়ির পশ্চিমে গদাধর সরেনের অংশে নতুন টিউকল বসলো, এখন আর গলা শুকোলে কষ্ট নেই। গোসাপের চামড়ার মতো মাটি কুঁচকে আছে, কিন্তক কু দিতেছে কাঠবিড়ালি দঙ্গল, সুখি পেট ভরলে সে আহ্লাদ জ্ঞাপন করে পুনর্বার ডেকে ডেকে। দূর থেকা পাখি লাগে, উহার ডাক একটো চলমান তাল রেখে লেজে কাঁপন ধরায়। তার সেই স্ফূর্তিতে ঐ আঁক কাটা মাটির দেয়ালে প্রথম আলোর চুটকি এসে লাগে। সেই কাকভোরে গেরাম চোহদ্দির বাঁকে গান পৌঁছে দেন কলিয়ান হড়াম; মটুক তো এঁকেই নাগকেশরের বাকলে দেখেছেল, সেই বিলের জলের উপর এনার ছায়া আসে যায়। নিজের তৈরি একতারায় সেই গান বাপজীকেও এট্টুর জন্যি তফাত করে দ্যাল। নিকটে আইলে বাপজী এগয়ে যান।

বেটি হমার, সাধুজী উ য্যান কালেজে যেত্যে পারে, আপুনি বির বোংগাকে বইলবেন।অবাক হয়ে মটুক দেখলে, গান থামিয়ে উনে হাসি মুখে চেয়্যাছেন। “বেটি, কলিয়ানকথা শুনো, মনে শকতি পাবেক। কলিয়ান হড়াম  আমাদের আদি গুরু। সিধু কানুর  শহীদ হবার গপ্পো কেবল কলিয়ান বুলতে পারে। সে এক কঠিন সময় আছেল, মানিকপাড়ার  পুবের দিকে যে বিরাট ঝিল টো, পাশটো কলিয়ান হাড়ামের আমকাঠের ছাউই, মহানিম গাছের ফুল ধরলেই সেখানে বুলবুলির ওড়াউড়ি সারা দুপুর। তাদের যুগল পায়ের ডিমে কত গণ্ডা পরাগরেণুর দানা মিলে তৈয়ের হয়েছে সাওঁতালদের শহীদ ইতিহাস।”

-বাপজি, একদিন আমায় পুরা গল্প টো বইলবেক্? কলিয়ানের গল্প? সারি ধরমের আগমের কথা বড্ডো শুনতি মন চায়…।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত