| 27 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: নারকেলের কুসুম । মৃত্তিকা মাইতি

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

ফোনটা ধরেছিল পিয়ালী।“হ্যালো দাদা? হয়ে গেছে? কী টকা হল রে দাদা?”

পিয়ালী যখন ফোন নিয়ে লাফালাফি করছে, ঘরের বাকিদের তখনও অস্থির দশা। সকাল থেকেই ছটফট ছটফট করছিল তারা। এখন কী খবর এল তাও বলছে না মেয়েটা। ছেলে হল?নাকি মেয়ে?কারও আর তর সইছে না। আরও অপেক্ষা করতে হলে পাকা ফুটির মতো ছড়িয়ে পড়বে মাধবী আর পবিত্র— পিয়ালীর ঠাকুমা ও বাবা।

পিয়ালী-র বউদি সঞ্চিতার নয়মাস চলছিল। শেষ যেবার ডাক্তার দেখাতে যায়,ডাক্তার দেখে বলে দিয়েছিল,আর দিন পনেরো বাকি।তারপরেও কেটে গেল সপ্তাহ খানেক।আজ সকালে রাঁধাশালে গিয়েছিল সঞ্চিতা।সেখানেই ব্যথা ওঠে। আশাদিদিকে ফোন করতেই সে অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দেয়।

গ্রামে এখন নিয়ম হয়েছে, কোনও বউ পোয়াতি হলে আশাকর্মীকে জানাতে হয়। সে একটা কার্ড করে দেয়। কবে কবে কীসের ভ্যাকসিন নিতে হবে, ডাক্তার দেখাতে হবে, খোঁজখবর রাখে। প্রসব বেদনা উঠলে তাকেই আগে খবর দিতে হবে।অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে দেওয়া,ঘর থেকে নিয়ে যাওয়া, বাচ্চা হয়ে গেলে আবার ঘরে পৌঁছে দেওয়া—সবই করে আশাদিদি। গাড়ির টাকা দিতে হয় না। সরকার থেকে পাওয়া যায়। সঞ্চিতাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নন্দীগ্রাম হাসপাতালে। সেখান থেকেই ফোন এসেছে সন্ধেবেলা।

পিয়ালীর আজ আনন্দ ধরে না। কানে ফোন চেপে রেখেই ঝরঝর করে হেসে চলে সে। এমনিতেই তার একবার হাসি শুরু হলে আর থামতে চায় না। সেই নিয়ে হামেশাই বকা খেতে হয় বাবা,দাদা,মা,ঠাকুমার কাছ থেকে। আজ তো পিয়ালীর খুশি হওয়ারই দিন। এতবড় একটা ঘটনা ঘটেছে!

পিয়ালীর থেকে খবর শুনে বাকিদের মুখ অন্ধকার হয়ে গেছে।টিউবলাইটের আলোতেও সেই অন্ধকার কাটছে না।

মাধবী ছোঁ মেরে নাতনির থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। ‘হ্যালো হ্যালো’ করতে থাকে।

গ্রামের বুড়োবুড়িরা ফোন ব্যবহারে সড়গড় নয়। ঠাকুমার রকম দেখে পিয়ালীর হাসির জোর আরও বেড়ে যায়। উল্টো করে ফোন ধরেছে ঠাকুমা। ঠিক করে দেয় সে।

বিরক্ত হয় মাধবী। “আঃ, থাম না মাগি। সবসময় খালি দাঁত বেরিয়েই আছে। হ্যা হ্যা করলেই হল।”

ধমক খেয়ে পিয়ালী মুখে হাত চাপা দেয় বটে কিন্তু তার খুকখুকানি থামেনা।

“হ্যালো,কে রাহুল?দাদু, তুই আমাদের মিছা কথা কইছিস?”নাতনির মুখে শুনেও বিশ্বাস করতে পারেনি মাধবী। এখনও যেন অন্য খবরের আশা আছে। নাতির মুখে ঠিক খবরটা পাওয়া যাবে বলে ভাবছে বুড়ি।

ফোনের ওপাশের কথাগুলো শোনার পরেও মাধবী বলে, “কই, তুই আমার কিরা খেয়ে বলতো দাদু,ষষ্ঠীবুড়ির সত্যিই মেয়ে হয়েছে?”

সঞ্চিতা নামটা খটমট লাগে মাধবীর। তাই সে নাতবউকে ষষ্ঠীবুড়ি বলে ডাকে।

ঠাকুমার কথায় ফোনের ওপাশে আর ধৈর্য রাখতে পারে না রাহুল। বাচ্চা জন্মানোর পর খবর দেওয়ার জন্য এখনও পর্যন্ত সে ফোন করেছে পাঁচ পিসি,দুই মাসি আর মেজবোন প্রিয়াঙ্কাকে। সবার এক কথা—“হতেই পারে না মেয়ে হয়েছে! সব লক্ষণ ছিল ছেলে হওয়ার দিকে। তুই রহস্য করছিস?”

একই কথা শুনতে শুনতে নিজের মনের চাপা আক্ষেপটা আর বাঁধ মানতে চাইছে না রাহুলের। সেও তো চেয়েছিল প্রথমে ছেলেই হোক। ছেলে হলে ডান্স হাঙ্গামার গ্রুপ এনে অনুষ্ঠান করবে। তার আনন্দে গ্রামের লোকও যাতে আনন্দ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করবে। সে আর হল কই? কিন্তু তার কষ্টটা কেউ বুঝছেই না। ঠাকুমার ওপর খিঁচিয়ে ওঠে রাহুল, “এতে কিরা খাওয়ার কী আছে বুড়ি?বাড়ি গেলে তো দেখতেই পাবে। মিছা কথা বলে লাভ হবে কোনও?”ফোন ছেড়ে দেয় রাহুল।

পাড়ায় আরও দু-তিন ঘরে দিনমাসিয়া পোয়াতি বউ আছে। তাদের শাউড়িরা এসে বসেছিল পবিত্রর দুয়ারে। এই ন-দশ মাস অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষায় ঝুলে কাটছে তাদেরও। কার ঘরে কী হয়। লাইনের প্রথমে ছিল পবিত্র। তার বউমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে শুনে তারা খবর নিতে এসেছে।

অমাবস্যার অন্ধকারে বাচ্চা পেটে রয়ে গেলে নাকি ছেলে হয়। বলেছিল পবিত্রর বউ ফাল্গুনী। তার বউমা মাস ডিঙিয়েছে। তাও সেটা অমাবস্যার সময়। ফাল্গুনীর আনন্দের সীমা নেই। রাহুল যখন পেটে আসে তখনও অমাবস্যার অন্ধকারই ছিল। বউমার প্রথম সন্তান তাহলে নাতিই আসছে। জনে জনে গল্প করেছিল ফাল্গুনী। তাছাড়া বউমা পোয়াতি হওয়ার পরপরই তো সে কচ্ছপ পেয়েছিল।

সঞ্চিতার তখন তিন মাস চলছে। অঘ্রাণ গিয়ে সবে পৌষ পড়েছে। ঠান্ডা পড়লে ঘনঘন জল সারতে যেতে হয় ফাল্গুনীকে। সেদিন তখনও ঝিঁঝকা রাইত আছে। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েই চমকে উঠেছিল! দেওয়াল ঘেঁষে একটা কচ্ছপ বসে আছে! আধসের কী ছ’শোহবে। আশপাশের জলাজমি, পুকুরে কচ্ছপ আছে শুনেছে। নিজে কখনও পায়নি। সেখান থেকেই উঠে এসেছে বোধহয়। কিন্তু এখন কেন এল? বউমার কথা মনে পড়তেই আনন্দে দুলে ওঠে ফাল্গুনী। তাহলে কি কূর্মদেবতা নিজে থেকেই ঘরে এসেছে! বাকিদের জাগিয়ে, কচ্ছপটা ধরে মেচলায় রাখে। দিন ফুটতে,দুয়ারে যে আসে তাকেই দেখায়।

পাড়ার মহিলা মহলে আলোচনা হতে লাগল। ষষ্ঠীর ব্যাটাই হবে। কারণ তারাও বিশ্বাস করে, কারও ঘরে পোয়াতি থাকা অবস্থায় তাদেরই কেউ যদি কচ্ছপ পায় তাহলে ছেলে অনিবার্য।

বউমা হাসপাতালে যাওয়া থেকে সেসবই মাথায় তালগোল পাকাচ্ছিল পবিত্রর।সেও যেন দিনমাসিয়া পোয়াতির মতোই ছটফট করছিল। এখন রাহুলের ফোন ছেড়ে দিয়ে মা কেমন গুম মেরে গেছে। বুক ঢিপঢিপ করছে তার।

“কী বলল কী রাহুল?”

“নাতি হবে নিশ্চিন্তি হয়ে বসে ছিলি? আগেভাগে বলছিলি,আমার দাদু যেমন আমাকে লিখে দিয়ে গেছে, আমার দাদুভাই হলে আমিও সম্পত্তির একটা অংশ লিখে দেব। এবার লে। দে সব লিখে কন্যা মাউগকে। মাইঝি হচে, মাইঝি…”মাধবী দুই হাত সামনে ধরে চিত করে দেখায় ছেলেকে।

“যাঃ! এবার আমার স্যারখাচকের গৌরাঙ্গ আনার কী হবে তাহলে?”হেলে পড়া চিচিঙ্গের মতো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় পবিত্রর।

সেবার পবিত্রর মা বলেছিল, “নাতির ঘরে নাতি আসছে, আমি ইঙ্গিত পেয়ে গেছি।”

জানার জন্য উৎসুক ছিল পবিত্র। “কী ইঙ্গিত পাইছু মা? বলো না।”

“কইতে নেই,তাহলে ফল ফলে না। তবে সাত মাস পেরিয়ে গেছে,বাচ্চার হাত-পা,নাক-মুখ সব হয়ে গেছে,এখন বললে কিছু হবে না,তাই দেখাচ্ছি। এই দ্যাখ—”ডান হাতের মুঠো খুলে দেখায় মাধবী। তালুতে শুয়ে আছে একটা ঝিনুক।খালে বা গাঙের ধারে এই ধরনের ঝিনুক দেখা যায়। পাকানো পাকানো চোঙা মতো দেখতে।

হাসিতে ভরে যায় পবিত্রর মুখ। “তুই একে কোথায় পেলি?”

“আসার পথে। ঘাস জঙ্গলে পেয়েছি।”মাধবীর মুখও আহ্লাদি মেয়েদের মতোই দেখাচ্ছে।

দুই ভাইয়ের বাড়ি আলাদা। মাধবী থাকে ছোট ছেলে অংশুর কাছে। পৃথক হওয়ার সময় অংশু বলেছিল, “বাবা নেই। মাকে আমার কাছে রাখব।”সেই থেকে মাধবী সেখানেই থাকে, খায়। অংশুর ঘরটা পবিত্রর ঘরের ঠিক পিছনে। ঢালাই রাস্তা দিয়ে ঘুরে সামনে আসতে হয়। বড় ছেলে পবিত্রর ঘরে টিভি আছে। তাই দেখতেই আসে মাধবী। সন্ধে ছ’টা থেকে রাত দশটা। বীজধান পোঁতার মতো নিজেকে বসিয়ে নেয়। সিরিয়াল চলার মাঝে বিরতির সময়েও কেউ কথা বললে বিরক্ত হয় সে।

এরমধ্যে সন্ধে ছাড়াও বড়ছেলের ঘরে যাওয়া-আসা বেড়ে গিয়েছিল মাধবীর। নাতবউ কোনওদিন গিমাশাক খেতে চায় তো কোনওদিন সাউর-ল—কচুলতি। যেদিন যেটা ইচ্ছে করে,ষষ্ঠীবুড়িকে এনে দেয় মাধুরী। জলাজমি,কাঁটাজঙ্গল পরোয়া করে না। একদিন তো জোঁকে ভরা জঙ্গল থেকে ভুঁই-আমরুল শাক এনে দিয়েছিল। টক টক খেতে। পাড়াগাঁয়ে পোয়াতি বউদের খুব সাধের জিনিস। বাগানের পিছন দিকটায় জোঁকের উপদ্রব। শাকটা আবার ওইদিকেই হয়। নাতবউয়ের সাধ মেটাতে কোনও কিছুর তোয়াক্কা করেনি মাধবী। তার ওপর যদি বোঝা যায় তার ছেলে হবে।


আরো পড়ুন: তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: মেসিন মেসিন । অমর মিত্র


পবিত্রকে সে বলে, “এসব জিনিস পাওয়া মানে লক্ষণ, বুঝলি?”

মায়ের কথায় ভরসা পেয়ে পবিত্রর বুকও ফুলে ওঠে। সে বলে বসে, “আজ তাহলে আমিও বলি। যদি নাতি হয়,সম্পত্তি তো দেবই,স্যারখাচকের বড় গৌরাঙ্গ ঠাকুর আনব। গোটা গ্রাম খাওয়াব।”

নন্দীগ্রাম থেকে বাসে বা টোটো করে যেতে হয় স্যারখাচক গ্রামে। সেখানে এক সেবায়েতের বাড়ি বড় গৌরাঙ্গ ঠাকুর আছে। তার নাকি প্রচুর মহিমা। আশপাশের জেলার মানুষও মানে। তারা ঘরে বসে ঠাকুরের দুয়ারে মানত করে। মানত পূরণ হলে ঠাকুর নিয়ে গিয়ে সেবা করে। পবিত্রও নাতির আশায় মানত করেছিল।

মেয়ে হওয়ার খবরে ছেলের হাল দেখে কিছুটা দোষ যেন নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেওয়ার মতো করে মাধবী বলে, “সাত-সাতটা বাচ্চা বিয়াইছি। পাঁচ মেয়ে, দুই ছেলে। তাছাড়া বড়বউয়ের তিনটে,ছোটর একটা। মোট চারবার আঁতুড় ঘরে ঢুকতে হয়েছে। তারপরেও পোয়াতি দেখে বুঝতে ভুল হল!”

মাধবীর সত্তর বছরের সাংসারিক জ্ঞান যেন পুকুরের জলে সাঁতার কাটছে—এমনভাবে তাকায় সে বাকিদের দিকে।

মাধবীর ছোটবউমা মৌ এতক্ষণ শুনছিল। সে আর চুপ থাকতে পারল না। তার জা ফাল্গুনীর কথা টেনে এনে বলল, “আমি তো বলেই ছিলাম। ওইভাবে হয় না। মেয়ে হোক বা ছেলে, সেটা বাবার জন্য হয়। তোমরা আবার যুক্তি মান না। দিদি বলেছিল, সে নাকি সঞ্চিতার নাভি দেখেছে। পিয়ালীর দিদি প্রিয়াঙ্কার পেটে বাচ্চা রওয়ার সময় তার নাভি যেভাবে ফুটেছিল, সঞ্চিতার নাভি নাকি সেভাবে ফোটেনি। ঘোমটার মতো হয়েছিল। দিদি বলল ছেলে না হয়ে যায় না। এসব মেলে নাকি!”

“তোমার তো যত যুক্তির কথা। যে কথা কেউ জম্মেও শোনেনি, তাই। একটু কলেজে নাকি পড়েছিলে, সব জেনে ফেলেছ। সে তো আমাদের রাহুলও পড়েছে। তাই তো বাইক শোরুমে কাজ পেয়েছে। কই, তার কাছে একথা কখনও শুনিনি তো।“মাধবী তার এই ছোট বউমাটিকে নিয়ে আর পারে না। বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক শাউড়ির একটা কথাও মানল না। তার ওপর নিজেও তো পেটে মেয়েই ধরেছে।

“তোমার বড় নাতনি প্রিয়াঙ্কার মেয়ে হয়েছে, পাঁচ ননদের ঘরেও দু-তিনটে করে মেয়ে সন্তান। তাদের নিয়ে তো তোমাদের এত মুচড়ে পড়তে দেখি না।”মৌয়ের রাগ বাড়তেই থাকে।

“পরের ঘরে কী হবে, তারা ভাববে। আমরা মাথা ঘামাতে যাব কেন?”

কাকিমাকে ঠাকুমা আরও কিছু বলার আগেই পিয়ালী চেঁচিয়ে ওঠে,“কাকিমা যা বলে ঠিকই হয়। তোমরাই মানতে চাও না। যত ছেলে ছেলে বাই। মেয়ে হয়েছে তো কী?”

কাকিমাকে পছন্দ করে পিয়ালী। তাকে কেউ কিছু বললে সে সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া এসব মোটেই ভাল লাগছিল না তার। একজন নতুন মানুষ আসছে ঘরে। বাপ,ঠাকুমার যেন একটুও আনন্দ নেই।

“তুই চুপ করবি?কালিয়াপুড়ি। মেয়ে যার হয় হোক। আমার ছেলেই চাই।”

“তোমাদের না বোঝা যায় না। ঘরে গাইগরুর বেলায় বলো ম্যায়া বাছুর হোক। আর বউয়ের বেলায় চাও ব্যাটা। সবাই যদি ছেলে চায়, একটাও মেয়ে থাকবে না পাড়ায়। ঠিক হয়েছে মেয়ে হয়েছে।”বাবার কথায় এখন আর চুপ করে থাকে না পিয়ালী। কালো বলে বাড়ির লোক কথায় কথায় কালিয়াপুড়ি বলে ধমক দেয়। আরও বলে, রঙের জন্য বিয়ের সময় বেশ খরচ করতে হবে। নাহলে কেউ নিয়ে যাবে না। মাধ্যমিক পাশ করার পরেও তাকে উঁচু ক্লাসে ভর্তি করে দেয়নি বাবা। বিয়ে দিয়ে দেবে বলে ছেলে খুঁজছে।

পাড়ার বউগুলোর উঠি উঠি ভাব। পরের ঘরে মেয়ে হয়েছে জেনে মনে মনে খুশিই হয়েছে তারা। তবু যাওয়ার আগে দু-চারটে সান্ত্বনার কথা বলে একজন।“দ্যাখ পবিত্র, এ তো গাছের ফল নয় যে পছন্দমতো পেড়ে নিবি!যা হয়েছে, নিতে হবে।”

পবিত্র গুম ধরা গলায় বলে, “বউমাটা যদি শ্বশুরবাড়ির খুঁট পেত। মায়ের প্রথম বাচ্চা আমি। ফাল্গুনীরও পয়লা হল ব্যাটা। তা নয়, গর্ভধারিণীর ধাত পেয়েছে বউমা। আমার বিয়ানেরও তো প্রথম মেয়ে।”

“ও কিছু করার নেই। এই তো সেদিন শুনলাম, গাঙ ধারের দিকে কোন গেরামে এক বউয়ের জোড়া মেয়ে হয়েছে, বর এসে এমন পিটিয়েছে, বউটা একেবারে শয্যাসাই। ভগবান যাকে যা দেওয়ার তাই দেয়। আমরা তো নিমিত্ত।”পাড়ার মহিলারা উঠে যায়।

পবিত্র বিড়বিড় করতে করতে টিভি চালিয়ে দেয়। তার কথা বোঝা যায় না। বাক্সের মধ্যে বানানো সংসারের গল্প দেখেমন ঘুরিয়ে নিতেই যেন মা, ছেলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পিয়ালী উঠে যায় ঘরের কাজ করতে। মা হাসপাতালে গেছে বউদির সঙ্গে। তাকেই সামলাতে হচ্ছে সব।

ভরা শ্রাবণ। জলভরা আকাশের পেটের ভেতর ঢুকে গেছে গ্রামগুলো। পবিত্রর মনে হয় তার দুঃখে যেন দেবতারাও কাঁদছে। উঠোনের মাঝখানে বড় ঝাঁকড়া চালতা গাছটা ঠায় ভিজছে। বৃষ্টির ফোঁটা পাতা ছুঁয়ে হড়কে পড়ছে মাটিতে। ক’মাস আগেও একেবারে নেড়া ছিল। একটা পাতারও নামগন্ধ ছিল না। ফেটে ফেটে ছাল উঠে যাচ্ছিল। আর এখন ডালে ডালে ফল ভরে গেছে। পাড়ার কাকিদের কথা মনে পড়ে পবিত্রর। “এ কি গাছের ফল যে পছন্দ মতো পেড়ে নিবি?”আচ্ছা, ওই চালতাগুলোর ছেলে-মেয়ে আছে? তাহলে কোনটা ছেলে? কোনটা মেয়ে? দূর, এসব ভেবে আর হবে কী!

দাওয়ায় বসে শাক বাছ ছিল পিয়ালী। এগারোটা বাজতে চলল। সে রাঁধতে যাবে। চৌকিতে পবিত্র। পা নাচাচ্ছে। “বাবা, বউদি বাচ্চা নিয়ে কবে আসবে?”

“বউদি আসবে না। বাচ্চা নিয়ে কাত্তিকখালি যাবে। বাপের বাড়ি। তোর মা একা ফিরবে।”

“কেন? বউদি বাড়ি এসে যাবে না কেন? আমি বাচ্চা দেখিনি… কত কিছু করব ভেবেছিলাম।”কাঁইকুঁই করতে থাকে পিয়ালী।

“এক বছর যায়নি। বাপের বাড়ি ঘুরে আসুক।”

হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে ফাল্গুনী। আলুথালু চুল। চোখে-মুখে ক্লান্তি। হাতের ব্যাগ ফেলে বসে পড়ে সে।

“মা এসেছে…”লাফিয়ে ওঠে পিয়ালী।

“কাল যখন কথা হল, বললে না তো আজ ছেড়ে দেবে?”বউকে শুধোয় পবিত্র।

‘দাঁড়াও বাপু, একটু জিরিয়ে নিতে দাও। আমিও কি জানতাম? পেট কাটতে হয়নি, নরমালে হয়েছে। তাই তিন দিনে ছেড়ে দিল।”

“কাঁথা, কাপড়চোপড় নিয়ে চলে এলে, বউমা নিয়ে যায়নি?”

“গেলে তবে তো নিয়ে যাবে।”

“মানে?”

“মানে আর কিছু না। এই এক বছরে তার মা-বাবা কতবার আনতে এসেছে। যেতে দেওয়া হয়নি। তখন বলেছিলাম সেখানে গিয়ে লাগাম ছাড়া হয়ে যাবে। ঠিকঠাক যত্ন হবে না। তাতে বংশধরের ক্ষতি হবে। এখন মেয়ে হয়েছে বলে পাঠিয়ে দিতে চাইলেই তো দেওয়া যায় না।”

পিয়ালী হইহই করে ওঠে। “বউদি এখানে এসেছে? দেখি দেখি কেমন দেখতে হয়েছে পুচকুকে।”

সঞ্চিতা ছামুদুয়ারে দাঁড়িয়ে।কাঁথায় মোড়া বাচ্চাটাকে বুকের কাছে ধরে রেখেছে। পিয়ালী ঝুঁকে পড়ে। “বাবা দেখবে এসো। কত ছোট মুখ! মাথায় গিরিগিরি চুলও আছে। ঘুমোচ্ছে গো বাবা!”পিয়ালী কী করবে, কী না করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

পবিত্র চৌকি ছেড়ে ওঠে না। বউকে বলে, “রাহুল কোথায়?”

“রাহুল মানা আনতে গেছে। নাপিত এসে ক্ষুর ছোঁয়ালে, গা ধুয়ে তবেই তো ঘরে ঢুকবে। ভুলে গেলে সব নাকি?”

“এই তো, ঠাকুমাও এসে গেছে। দেখবে এসো বুড়ি।” পিয়ালী বলে ওঠে।

“আরে বাবা রে। ও মাগিকে দেখার কী আছে রে।”ছেলের পাশে বসে পড়ে মাধবী।

পবিত্রর ছোট ভাই অংশুর বউ আসেনি। পিয়ালী জানতে চায়, “কাকিমা এল না?”

“দক্ষিণ দিকে চাষ শুরু হয়ে গেছে না? তোর কাকু লোকের বাড়ি রোয়ার কাজে গেছে। সাড়ে বারোটায় খেতে চলে আসবে। কাকি রাঁধা বসিয়েছে। হাতের কাজ সেরে আসবে।” পবিত্র জবাব দিয়ে দেয়।

সঞ্চিতা বাচ্চা নিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়েই থাকে। মেয়ে হয়েছে বলে কারও দেখারও গা নেই। একা পিয়ালী যা আনন্দ করছে।

রাহুল এসে পড়ে নাপিত নিয়ে। নাপিত তার ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করতে থাকে। রাহুল চলে যায় নিজের কুঠিতে।

পিয়ালী বলে, “মা, বাচ্চা বরণ হবে না?”

খরখর করে ওঠে ফাল্গুনী। “সে আবার কী! ওসব আমাদের হয় না। একুশ দিনে আবার নাপিত এনে একুশিয়া না হওয়া অব্দি মন্দিরে ওঠা যাবে না। সে ক’দিন ঘরেও সন্ধে পড়বে না। এটাই নিয়ম।”

“যাঃ, তাহলে কী হবে?”

“ভাবতে বোস।”ফাল্গুনী বউ-বাচ্চা নিয়ে পুকুরঘাটে চলে যায়।

দমে না পিয়ালী। সে ছুটে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। বউদির সাধের সময় পিঠা বানানোর জন্য অনেকগুলো নারকেল ছাড়ানো হয়েছিল। তার কয়েকটা খাটের নীচে আছে। একটা নিয়ে বেরিয়ে আসে। বরণ হবে না তো কী হয়েছে। নারকেল ফাটাবে সে।

ঘাটের কাজ সেরে ওরা ফিরে এলে বাচ্চা সমেত বউদিকে ছামুদুয়ারে দাঁড় করায় পিয়ালী।তবে খোসা ছাড়ানো নারকেলটাকে মাটিতে ঠুকতে গিয়ে আটকে যায়। “আরে! এতে তো কল বেরিয়েছে! তার মানে ভেতরে কুসুম আছে। গাছ হবে। এটা তো তাহালে মেয়ে নারকেল! দ্যাখো বাবা… নারকেলে কল বেরিয়েছে, গাছ হবে। বাগানে পুঁতে দিয়ে আসি?”

সাড়া দেয় না পবিত্র। সে এই দিনের বেলাতেও টিভি চালিয়ে বসেছে।

“ও বাবা, কিছু বলছ না কেন?”

“নাঃ, ও আমাদের অনেক আছে। আর লাগবে না। ওটাকেই ফাটা।”

সঞ্চিতা নিভু গলায় বলতে চায়, “ছেড়ে দাও। কিছু লাগবে না।”

ফাল্গুনী মেয়েকে আটকাতে পারে না। পিয়ালী বাবাকে বলে, “অ্যাঃ, তুমি বললেই যেন এটাকে আমি ফাটাব।”উঠে যায় সে। অন্য একটা নারকেল এনে ফাটায়। জল বেরিয়ে সেটা দু’টুকরো হয়ে গেলে বলে, “এই, বরণ হয়ে গেল। এবার তোমরা ঘরে এসো।”

সঞ্চিতা ঘরে ঢুকে পড়ে। ফাটা নারকেল রান্নাঘরে রেখে আগেরটা নিয়ে পিয়ালী চলে যায় কাকিমার কাছে।

মৌ উঠোনের একপাশে বসে দু’পাখি চুলায় রান্না করছে। চুলাটার একদিকে হাঁড়ি বসে, একদিকে কড়াই। মাঝে মুয়া করা। মাটি ঘেঁষে গোল গর্ত, জ্বাল দেওয়ার জন্য। মৌয়ের দু’বছরের মেয়ে পিউ আলু, ঝিঙের খোসা নিয়ে পাশে বসে খেলছে।

পিয়ালী রাস্তা থেকেই ডেকে-হেঁকে হাঁফাতে হাঁফাতে পৌঁছয়। “দ্যাখো কাকিমা, নারকেলে কল বেরিয়েছে। ভেতরে তাহলে কুসুম আছে? না? বাবাকে বললাম আমাদের বাগানে লাগাই। বলল, অনেক আছে,আর লাগবে না। এখন এটা নিয়ে কী করি?”নারকেলটা কাকিমার চোখের সামনে ধরে ঘোরাতে লাগল পিয়ালী।

মুখ তুলে পিয়ালীর দিকে তাকিয়ে হাসল মৌ। “মনখারাপ করছিস? আমাদের বাড়ির পিছনে দেখবি যা, কয়েকটা চারাগাছ হচ্ছে। ওখানে লাগিয়ে দে গিয়ে।”

“ঠিক বলছ? কেউ কিছু বলবে না?”

“হ্যাঁ রে বাবা, ঠিক বলছি।”

আনন্দে ছুটে চলে যায় পিয়ালী। পিউও ঠটঠরে পা ফেলে ফেলে দিদির পিছনে যেতে থাকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত