শিকাগো ডায়েরি (পর্ব-৪)
[গত পর্বের পরে…]
প্যাকিংট্র্যাকিং
প্রতিবারের মত এবারেও আমেরিকা যাবার আগে মায়ের সঙ্গে বাবার তোলঘোল হয় প্যাকিং নিয়ে। কি কি খাবার সঙ্গে যাচ্ছে তার একদফা লিস্ট বানায় মায়ের মন। বাবা সেগুলিকে ইচ্ছেমত সেন্সরবোর্ডের কাঁচি দিয়ে কুচকুচ করে কেটে ফেলে। হয় উত্তপ্ত বচসা। আবার বিরতি। আবার চুপিচুপি মা ভর্তি করে স্ট্রলি ব্যাগ। বাবা সেই মাল খালাস করেন অবলীলায়। যুক্তি কাস্টমসে ধরলে আঠারো ঘা। অতএব মা সিঁটিয়ে যায় ভয়ে। আর মায়ের দুই মা, মানে এক গর্ভধারিণী অন্যজন শ্বশ্রুমাতা নাতি, নাতবৌয়ের স্বাদকোরক ভালো বোঝেন। মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী, মনে মনে বলে উঠি। এটা নে, সেটা নে, না পারিস তো আমার মাথা নে টাইপ অবস্থা তাদের।
এতকিছু না গোছালে চলে? সেখানে গিয়ে একা হাতে মা’কে রান্নাবাটি সারতে হবে। গোছ থাকলে রান্না বসাতে কতক্ষণ? অবিশ্যি গবেষক বৌ বেশ গুছিয়েছে তার সংসার। রান্নাবান্নায় তার খুব ইন্টারেস্ট। তবুও মায়ের মন।
লাস্ট মোমেন্টে পোলভল্ট দিলেন আমার গর্ভধারিণী, ছেলের দিদা। আমার নাতির বড্ড প্রিয় ধোঁকার ডালনা। কতদিন খায়না বাছা। শোন্ ছোলার ডাল, মটরডাল বেটে নিয়ে হিং, আদা-লঙ্কা দিয়ে নুন মিষ্টি দিয়ে যেমন ধোঁকা বানাস, তেমনি করে শুধু পিস করে ভেজে নিয়ে যাস, লক্ষী মা আমার। গিয়েই ছেলেটাকে আদা-ঘি-গরমমশলা দিয়ে ডালনা বানিয়ে দিস্।
কি মুশকিল!
আরে মুশকিলের কি আছে? প্লাসটিকের কতরকমের কৌটো আছে তোর। ভরে নিয়ে চেকড ইন লাগেজে সোজা চালান করে দে।
ওরা যদি বাক্স খোলে মা?
এক পিস খাইয়ে দিস। সর্ষের তেলে ভাজা ধোঁকা খেয়ে সাদাচামড়ার সিকিউরিটি ভিরমি যাবে। স্মার্টলি বলবি, লেন্টিল কেক। চেখে দেখ, নয়ত পস্তাবে।
বিল পাশ হল। কর্তা সায় দিলেন।
মায়ের মেসেজ… এবার আবার কিছু মনে পড়লে বলব। বাক্স যেন বন্ধ করিস নি এখনো।
আরেক্টা অনুরোধ। টাটকা মৌরলা এনে সর্ষের তেলে মুচমুচে করে ভেজে নিয়ে যাস্। এয়ারটাইট কৌটোর মধ্যে নিবি। সাতদিন থাকবে। গিয়ে ঐ আমের চাটনিতে ফেলে এক মিনিট মাইক্রো করে দিস। আম-মৌরলা খেতে বড্ড ভালোবাসে ছেলেটা। ওপর থেকে একটু সর্ষে আর শুকনোলঙ্কার ছঁক দিস। ঠিক বাড়ি বাড়ি গন্ধ পাবে ও। সেবার সেই টিভিতে তুই আম-মৌরলা রাঁধলি আর ও দেখতে দেখতে বলেছিল, দিদা, এটা তোমার শেখানো মায়ের বেষ্ট চাটনীর রেসিপি।
স্ট্রলি ব্যাগের ঢাকনা খোলা হয় আর বন্ধ হয়। স্ট্রলি ব্যাগ শুধু ভরবার জন্যে। স্ট্রলির অন্দর কভু খালি নাহি রয়।
এবার হাতের পাঁচ হল গা মাখা মাখা কুলচুর, এ দোকানের খাস্তা গজা, ও দোকানের প্যাঁড়া, নীলাঞ্জনার মায়ের হাতের নারকেল নাড়ু, আমের চাটনী, আর ছানাভাজা । মুখোরোচকের ঝাল পাপড়ি-গাঁটিয়া দেওয়া চানাচুর আর বাড়ীতে বানানো মুচমুচে কুচো নিমকি। সব যাবে। দরকার হয় গিন্নী থেকে যাবেন। তাঁর টিকিটের খরচায় জিনিষ বিমানে উঠে পড়লেই হল। আরো বাকী আছে সে দেশে আমসত্ত্ব মেলে না । মাথা খুঁড়েও না। তাই কিলোখানেক আমসত্ত্ব যাবে। ঠান্ডায় বাড়ীবন্দী ছেলেবৌ আমসত্ত্ব দুধে ফেলে, তার মধ্যে কলা গুলে দুটো গরম ভাত তো খেয়ে নিতে পারবে। এর চেয়ে আর সাত্ত্বিক আহার আর কি ই বা হয়? অতএব চলো পান্সি! আর বাকী রইল আমিষাদি নৈবেদ্য।
কর্তামশায় অবশেষে রায় দিলেন মাছ যাবেই না, যেতে পারেনা। কোনোভাবেই নয়। বিশেষভাবে বারণ কাস্টমস-ইমিগ্রেশনের। কাঁচা সব্জী, শুকনো পাতাও নয়।
মনে পড়ছিল পশ্চিম যাত্রার সে কাল আর একালের কথা।
কি বললে পশ্চিম ? হ্যাঁ, সুদূর প্রাচ্য থেকে পশ্চিমই তো ।
এ যেন ঠাম্মা-দিদা-দাদুর মধুপুর-দেওঘরে যাত্রার সমান। দীর্ঘদিন রোগভোগান্তির পর হাওয়া বদল। পশ্চিমে বায়ু পরিবর্তনে শরীর সুস্থ হয়। শীতকাল হলে কাশী অথবা পুরীর ভাড়া নেওয়া বাড়িতে। সঙ্গে যাবে সহকারী, ভৃত্য-অনুচর, পাচক-ঠাকুর অথবা বামুনদিদি। রেলকামরায় তাস খেলা হবে শতরঞ্চি বিছিয়ে। মেয়েরা বিন্তি, ছেলেরা টোয়েন্টিনাইন, ছোটোরা গাধা পেটাপিটি। তুখোড় আঁতেল হলে ব্রিজ। ছোটওরা লুডো অথবা দাবা।
ইকমিক কুকারে ম্যারিনেটেড দই মাংস, দমে বসবে মিষ্টি ঘি-ভাত। যথাসময়ে বেতের বাক্স থেকে বেরিয়ে এল উগরে ওঠা গুড় আম অথবা তেঁতুল-আমসত্ত্ব-খেঁজুর-টমেটো। পাঁপর ভেজে এয়ারটাইট স্টিলের কন্টেনারেও বন্দী। অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই। চায়ের সরঞ্জামও দিব্য ছিল মজুত। এলুমিনিয়ামের ঢাউস কেটলিতে জল আনবে একজন প্যান্ট্রিকার থেকে অথবা স্টেশনে ট্রেন থামলে চা ওয়ালাকে দুটো টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে। ন্যাকড়ার মধ্যে চায়ের পুঁটুলি। সঙ্গে কনডেন্সড মিল্ক অথবা গ্ল্যাক্সো গুঁড়ো। আর সাথে থাকত বিশাল ফ্লাস্ক। একটু গরম জল থাকবে, বাচ্চাদের দুধ গোলবার জন্যে।
ঠিক তেমনি অবস্থা আধুনিকা শহুরে এক মায়ের । স্থান-কাল-পাত্র বদলে গেছে কিন্তু অনেক কিছুই এক রকম রয়ে গেছে আজো। তা শহুরে গিন্নীটি সব যোগাড়যন্ত্র করতে লাগলেন। কোথায় শিশি ভরে খেঁজুর গুড়ের পাটালী (শীতকাল থেকে তাঁর ফ্রিজে বন্দী আছে) , লঙ্কার আচার, ভাজা বড়ি এক হল বিউলির ডালের, হিং দেওয়া, শুকনো লঙ্কার কুচি ছড়ানো (যেটি দিয়ে উত্তম বড়ি-বেগুণের চচ্চড়ি খাওয়া যায়) । দু’নম্বর বড়ি হল হলদে রঙয়ের মটরডালের কুড়মুড়ে বড়ি ( সেগুলো ঘন্টের ওপর ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া হয় অথবা সুক্তো তে দেওয়া হয় )। আর তিন হল ছোট্ট ছোট্ট ভাজা বড়ি, মানে পোস্তদানা, কালোজিরে দেওয়া বড়ি, যা ডালের সাথে অতি উত্তম ভাজার কাজ করে।
মা বললেন, আচার, বড়ি অযাত্রা । তাই বলে ছেলেটা খাবে না? বললাম আপনারাও তো ট্রেনে নিতেন। তেমন কিছু অঘটন ঘটেছে বলে তো মনে নেই। শাশুড়ি মা এক গাল হেসে সায় দিলেন।
[ক্রমশ]
.

উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।