| 26 এপ্রিল 2024
Categories
রান্নাঘর

মুমের বাহারী আহার

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
শিক্ষকতা, বিজ্ঞাপন কর্মকর্তা, সাংবাদিকতা ছেড়ে বর্তমানে পূর্ণকালীন লেখক। তথ্যচিত্র নির্মাতা, কবি, গল্পকার, চলচ্চিত্র সমালোচক, গদ্যকার ও অনুবাদক বলেই সকলে তাঁকে জানেন কিন্তু তাঁরা কী জানেন তিনি একজন রন্ধন শিল্পীও! ইরাবতীর পাঠকদের জন্য তিনি লিখেছেন বাহারী আহার নিয়ে আজ সেই সিরিজের পর্ব-২।


 

প্রিয় কুসুম,
তোমারে আজ ইলিশ মাছের গল্প বলি। জগতে মাংস আছে কয়েক প্রকাশ, তারমধ্য আমরা খাই হাঁস, মুরগি, গরু, খাসির মাংসই বেশি। মানে পাঁচ-সাত রকমের মাংসই আমাদের আয়ত্বে আছে। আর মাছ? জগতে হাজার হাজার পদের মাছ। তারমধ্যে আমরা নিত্য খাই এমন মাছও কম নয়। রুই, কই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, শোল, পাঙ্গাস, পাবদা, তেলাপিয়া, পুটি, ট্যাংরা, খলিসা, চিংড়ি (যদিও জাতে মাছ নয়), বাইম, কাচকি, চাপিলা, তোপসে, ভেটকি, শিং, মাগুর… আহা একেকটা নামের মধ্যে কতো মায়া আর স্বাদ। এতো সব মাছের ভিড়ে ইলিশ একাই একশ। এমন তেলতেলে মাছ, এমন মন মাতানো ঘ্রাণ যে স্বর্গীয়।

ইলিশ মাছ ভালোবাসেন না এমন বেরসিক লোক কি বাংলাদেশে আছে? শুনেছি, কারো কারো ইলিশে এলার্জি হয়। তারা তো হতভাগা! এমন একজনকেও একবার পেয়েছি যে কাটার ভয়ে ইলিশ খায় না। সেও তো অপদার্থ লোক। খাঁটি বাঙালি মালি, ইলিশ আর কোলবালিশ প্রমি। তা কুবের মাঝিই হোক আর কলকাতার বাবু মশায়ই হোক আর এই অধম মুম রহমানই হোক পদ্মা নদীর ইলিশের জন্য জান কোরবান দিতে পারে। ইলিশ শুধু আমাদের জাতীয় মাছই নয়, পুরো বাঙালি জাতিরই প্রিয়। জাতীয় ফল কাঠাল নিয়ে কিন্তু জাতি দুভাগে বিভক্ত। একভাগ কাঠাল মুগ্ধ, আরেকবার কাঠাল বিদ্বেষী। তো ইলিশের ক্ষেত্রে কোন বিদ্বেষ নাই। ইলিশ যেন মৎসকুলের মাধুরি দীক্ষিত। ছেলে, বুড়ো সবাই তার প্রেমে পড়ে।

বিশ্বের অনেক কিছুতেই আমরা পিছিয়ে আছি। কিন্তু ইলিশ আমাদের বিজয়ী করেছে। ভাবতে ভালো লাগে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের ইলিশ সারা বিশ্বে রাজত্ব করে। সারাবিশ্বের চারভাগের তিনভাগ অর্থাৎ গণিতের হিসাবে ৭৫% ইলিশ বাংলাদেশেই উৎপন্ন হয়। অন্তত পক্ষে সাড়ে চার লক্ষ লোক সরাসরি ইলিশ ধরার সঙ্গে জড়িত আর ইলিশের কেনা-বেচা, সংরক্ষণ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ লোক ইলিশ নির্ভর। বাংলাদেশের জিডিপি’র ১.১৫ অংশ ইলিশ থেকে আসে। আর আমাদের মৎস চাহিদার ১২% পূরণ করে ইলিশ। তো এই ইলিশ আর বাঙালি যে একাকার হয়ে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই কোন। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান আর মিয়ানমারে ইলিশ হয়। পাকিস্তানে সিন্ধু নদ অববাহিকায় ইলিশ হয়। সেখানে সমুদ্রবর্তী এলাকায়ও ইলিশ হয়। কিন্তু সে ইলিশের স্বাদ, গন্ধ কম, কাটা শক্ত। বাঙালির সাথে বদমাইশি করার জন্য একটা বগ শাস্তি আমরা পাকিস্তানকে দিয়েছি। তারা চাইলেও আর যখন তখন আমাদের ইলিশ নিয়ে যেতে পারে না।

মিয়ানমারের ইলিশকে আমরা বার্মিজ ইলিশ বলি। বার্মার ইলিশ, রুই এগুলো আসল খাদ্য রসিকরা খায় না। কোন ইলিশে স্বাদ না থাকলেই আমরা বলি, বার্মিজ ইলিশ গছিয়ে দিয়েছে। আদতে স্বাদে, গন্ধে পদ্মার ইলিশের ধারে কাছে সে নেই। পারস্য আর মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলেও ইলিশ পাওয়া যায়, টাইগ্রিস ও ইউফ্রিতিস নদীর মোহনায়। কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া আর থাইল্যান্ডেও ইলিশ হয়। তবে দুনিয়ার যেখানে যাই হোক আদতে, চাঁদপুরের ইলিশ পৃথিবী সেরা। ভারতে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসাম, গুজরাট আর অন্ধপ্রদেশে ইলিশ বিশেষ আদরণীয়। ভারতের গঙ্গা নদী অববাহিকা ছাড়াও রূপনারায়ন, নর্মদা, গোদাবেড়ি, হুগলি আর মহানদে ইলিশ পাওয়া যায়। এমনকি বিখ্যাত চিলকাহ্রদেও ইলিশ হয়। তবে ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের ইলিশই বেশি প্রিয়। গঙ্গা আর পদ্মা একই অববাহিকা হলেও দুটোর ইলিশের স্বাদে অনেক ফারাক। গঙ্গার পানি দূষনের কারণে সেখানাকার ইলিশ তেমন সরস নয়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


অন্ধপ্রেদেশে একটা প্রবাদ আছে যে, তেমন পোলাসা পেলে মঙ্গলসূত্র বেঁচতেও ক্ষতি নেই। পোলাসা হলো ইলিশ। এমন কথা তারা বলতেই পারেন, কারণ গোদাবরী নদীতে খুব কম সময়ের জন্য ইলিশ ওঠে (জুলাই-সেপ্টেম্বরে)। সে সময় বড় আকারের একটা ইলিশের কেজি পাঁচ ছয় হাজার রুপীও হতে পারে। অন্ধ্র প্রদেশের লোকের বিবেচনায় গোদাবরী ইলিশ গঙ্গার ইলিশের চেয়ে বহুগুণ সেরা। সেখানে গঙ্গার ইলিশ ৭০০ থেকে ৯০০ রুপিতে পাওয়া যায়। আমার ইচ্ছা আছে গোদাবরীর ইলিশ চেখে দেখার। হিন্দু সংস্কৃতিতে জোড়া ইলিশের বিশেষ মর্যাদা আছে। স্বরস্বতী পূজা কিংবা লক্ষ্মী পূজায় দেবীর সামনে জোড়া ইলিশ দেয়ার রেওয়াজ আছে। আগে তো ইলিশ ছাড়া কলকাতার সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে বিয়েই হতো না। বিশেষ করে গায়ে হলুদে কনের বাড়িতে ইলিশ পাঠানো জরুরি ছিলো। ইলিশের সরবরাহ কমে যাওয়ায় এখন রুই মাছ পাঠানো হয়। অন্য যতো মাছের কথাই বলি, দুই বাংলাতেই ইলিশ হলো মাছের রাণী। ইলিশ পাতুরি, ভাপা ইলিশ, ইলিশ ভুনা, আলু- বেগুন-পটেলের ইলিশ ঝোল, ইলিশ ভাজা, সর্ষে ইলিশ, ইলিশ পোলাও, ইলিশ ভর্তা — কতো রকমের পদই না হয় ইলিশের! ভাত, পোলা, খিচুরি সব কিছুর সাথেই ইলিশ অনবদ্য।

আমাদের বরিশাল এবং সমুদ্রবর্তী টেকনাফ অঞ্চলে ইলিশ হয়। আমি সেন্টমার্টিনে সামুদ্রিক ইলিশ খেয়েছিলাম। যথাবিহিত ভালো লাগেনি। সমুদ্রের লবণ পানির কারণে নাকি, নাকি উত্তাল ঢেউয়ের কারণেই সেই সব ইলিশ তাদের কোমলতা হারায়। সামুদ্রিক ইলিশ যথার্থই কঠোর টাইপ। শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের নানা দেশে বাংলাদেশের ইলিশ যায়। ইউরোপ আমেরিকার প্রবাসীরা আসল ইলিশ খায়। দেশের সেরা ইলিশগুলো বিদেশে চলে যায়, যেমন দেশের সেরা সন্তানগুলো বিদেশে চলে যায়। আমাদের বড় বড় ইলিশ ডলারে বিক্রি হয়। শুনেছি, ইলিশ মাছ তিন কেজি পর্যন্ত হতে পারে। আমি একবার চাঁদপুরে দুকেজির ইলিশ দেখেই আহাউহু করেছি। তিন কেজি পেলেও কেনার সামর্থ নেই। কিন্তু দেখতে নিশ্চয়ই টিকেট লাগতো না।

আমি ইলিশের খোঁজে আগে নিয়মিত মাওয়া যেতাম। সপ্তাহ গেলেই বন্ধুদের ফোন দিতাম, মাওয়া হবে কি যাওয়া? আমরা তিনচার বন্ধু নিলামে ইলিশ কিনে গাড়ি ভরে নিয়ে আসতাম। নিজেরা খেতাম আত্মীয় স্বজনদেরও দিতাম। আমি সেইসব বন্ধুরা সবাই প্রবাসী, তারা এখন ডলারে কিনে ইলিশ খায়। আর আমি তো স্বজনপ্রীতি বাদ দিয়েছি। এখনও আমি তাজা আর ভাজা ইলিশ খেতে চাইলেই মাওয়া ঘাটে চলে যায়। ঢাকা থেকে বেশি দূরে নয়। ঘাটে গিয়ে নিজে দেখে ইলিশ কিনে হোটেলে দিলেই ভেজে দেয়। ভাজা ইলিশের সাথে শুকনো মরিচ ভাজা ও পেঁয়াজ মাখানো, কোন কোন হোটেলে আচারও আছে সাথে। ইলিশের লেজটিকে বেশ ভর্তা করে দেয় কড়া ঝাল দিয়ে। হোটেলের স্টকেও ইলিশ থাকে পর্যাপ্ত। যারা আরেকটু এডভেঞ্চার প্রিয় আর হাতে সারাদিন সময় আছে তারা যেতে পারেন চাঁদপুরে। লঞ্চে নদী ভ্রমণ হবে। সকালে গেলে ইলিশ কিনে, ইলিশ খেয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন রাতের মধ্যেই। লঞ্চের হাওয়ায় ইলিশ খাওয়ার ক্ষুধা আরো বেড়ে যায়। বন্ধু বা প্রেমিক যুগলের জন্য চাঁদপুর যাওয়া নদী দেখা আর ইলিশ কেনার দারুণ যুগলবন্দী।

আমার মা, বউ ইলিশে ডিম পছন্দ করেন না। মানে তারা ইলিশের ডিম খেতে পছন্দ করেন কিন্তু পেটে ডিম আছে এমন ইলিশ খেতে পছন্দ করেন না। এ যেন খাঁটি বাঙালি মুসলমান। তারা বেহেশতে যাবেন কিন্তু মরতে চান না। আমি কিন্তু ইলিশের ডিম খুব ভালোবাসি। আমাদের কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন খুব ভালো একজন গবেষক এবং সম্পাদকও বটে। ইলিশের গল্প নিয়ে তার একটা দারুণ বই রয়েছে। অন্য প্রকাশের ইলিশ রান্নার রেসিপির উপরও মনোরম একটা বই আছে। প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ সেই বইয়ের জন্য উপাদেয় ভূমিকা লিখেছিলেন। অন্য প্রকাশের সত্তাধিক মাজহার ভাইয়ের কাছে এ বইয়ের ভুমিকা, হুমায়ূন আহমেদের মৎস্য প্রীতি ইত্যাদি গল্পও শুনেছি। যা রটে কিছু তো বটে। রটনা আছে যে বিরাট প্রকাশক মাজহার ভাই নাকি বিরাট ভালো রান্ধক (হুমায়ূনের গাতক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শব্দটি দিলাম)।

যা হোক ইলিশের একটা পদ আমি আজকে করলাম। সেটার আলাপ দিয়েই আজকে ইতি টানি।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


আমার এই চিকন-চাকন ইলিশখানা আকারে আহামরি নয়। আধা কেজি আর এককেজির মাঝামাঝব। ৭০০/৮০০ গ্রাম হবে হয়তো। কিন্তু আল্লাহ সাক্ষী, ইহা পদ্মার ইলিশ। আমি গরীব মানুষ এই আকালে ছোট কিন্তু পদ্মার খাঁটি ইলিষ মাছ খানা কিনে বড়ই আহ্লাদিত হলাম। নিজেকে আকবার বাদশা ভাবতে শুরু করলাম। আর মনের মধ্যে প্যাঁচ খেলতে লাগলাম এই ইলিশের সাথে কেমনে লক ডাউনের হতাশাকে খেদানো যায়।

বিসমিল্লাহ বলিয়া ইলিশ কুমারীকে কাটলাম সুর ও সঙ্গীত সহযোগে। রান্না করার সময় আমি আবার প্রিয় গান বা পডকাস্ট শুনি। কুমারীকে কেটে, ধুয়ে এবার সাজালাম সামান্য হলুদ, প্রচুর লাল মরিচের গুড়া, লবণ দিয়ে। কুমারীর ভাঁজে ভাঁজে দিয়ে দিলাম আদার চিকন চিকন টুকরা। সেই সব আদা টুকরা আবার লবণ আর লেবুতে মাখানো। তারপর আচ্ছা মতো সরিষার তেল দিয়ে ইলিশ কন্যাকে ম্যাসাজ করলাম।

বড় প্লেটে বেচারির একা একা লাগছিলো মনে করে দিয়ে দিলাম কিছু গাজর, পেপে আর আদার টুকরা। সেগুলোতেও সামান্য সরিষার তেল আর লবণ-লেবু দিলাম। সবশেষে ওভেনে চার মিনিট শেকলাম। চার মিনিট পরই উল্টে দিয়ে আবার চার মিনিট।
লোকে বলে, ওস্তাদের মাইর শেষ রাইতে। শেষ রাতের ফাইনাল টাচ দিতেই এবার বেশ খানিকটা সরিষা বাটা, কাচা মরিচ আর লেবু পাতা ছড়িয়ে দিলাম ইলিশের উপরে এবং থালার আশেপাশে। আবার ওভেনে চার মিনিটের উত্তাপ। ব্যস হয়ে গেলো সরিষা মাখানো আস্ত ইলিশ।
ছবি বা বর্ণনার চেয়ে ইলিশ কুমারী নাকি খেতে বেশি ভালো হয়েছে- এমন দাবী করলো নিজের বউ। বউয়ের কথা কতো যে গুরুত্বপূর্ণ তাতো বিবাহিত মাত্রই মানি। তাই না?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত