Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,story_detail/laugh-pandemic-before-60-years

৬০ বছর আগের অজানা এক মহামারি । অরিত্র দাশ

Reading Time: 3 minutes

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘প্রভাত সংগীত’ কবিতায় লিখেছিলেন, “মেঘেতে হাসি জড়ায়ে যায়/ বাতাসে হাসি গড়ায়ে যায়/ ঊষার হাসি, ফুলের হাসি/ কানন মাঝে ছড়ায়ে যায়/ হৃদয় মোর আকাশে উঠে/ ঊষার মতো হাসিতে চায়”। চারদিকের অস্থির সময়ের চক্করে পড়ে মানুষ হাসতে ভুলে যাচ্ছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠছে লাফিং ক্লাব। হাসলে যেমন মন ভালো থাকে, তেমন আবার মুখে ট্যান পড়ে না- এরম কত কিছুই তো বলে থাকি। কিন্তু হাসি যে কী মারাত্মক রোগ হতে পারে, তার ইতিহাস কি জানি?

২০২০ সালের মার্চ মাসে এ দেশে শুরু হয়েছিল কড়া লকডাউন। কোভিড পরিস্থিতিতে কার্যত স্তব্ধ ছিল গোটা বিশ্ব। এমন মহামারি পরিস্থিতি মানুষ শেষ কবে দেখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এমনই এক মহামারির সাক্ষী ছিল উগান্ডার সীমান্তে অবস্থিত তানজানিয়ার কাশাশা গ্রাম। সাল ১৯৬২। সদ্য স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল তানজানিয়া। স্বাধীনতা মানে নিজেকে উজার করে দেওয়া দেশের সংগ্রামে। একইসঙ্গে মুক্তির, আনন্দের, অসীমের। কিন্তু সেবার সেই দেশে এর ফল হয়েছিল সম্পূর্ণ উল্টো। দেশের পড়ুয়াদের উপর মানসিক অস্থিরতা বেড়ে গিয়েছিল সাংঘাতিক। তার একটা কারণ অনুমান করা হয় দেশ স্বাধীনতার পর ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সে বিষয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল পরিবার এবং ছেলে-মেয়েদের উপর। ওইটুকু বয়সেই তারা বুঝতে পেরেছিল অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সংকট। তার ফলস্বরূপ মাথা বিগড়ে গিয়েছিল অনেকের। কান্না নয়, হাসিই হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানকার অন্যতম বড়ো রোগ।

এ প্রসঙ্গে আরও একটা মত রয়েছে গবেষকদের। যাঁরা মনে করছেন, দেশ স্বাধীন হবার পর পড়ুয়াদের প্রতি আশা-প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল শিক্ষক এবং অভিভাবকদের। সেই চাপ পড়েছিল স্কুলের বাচ্চাদের উপর। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরা যাকে বলে, তেমনই অবস্থা হয়েছিল সেখানকার শিশুদের। যার ফল হয়েছিল ভয়ানক।

১৯৬২ সালের কাশাশা গ্রাম হেসেই খুন। হাসি হয়ে গিয়েছিল অসুখ। যার চিকিৎসা করানো ছিল অসম্ভব। গত দেড় বছর আমরা সকলেই পরিচিত হয়েছি অতিমারি, মহামারি, লকডাউন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, শারীরিক দূরত্ব এই জাতীয় শব্দগুলির সঙ্গে। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগেই এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল উগান্ডার একাংশ। এমন হাসি, যে থামাতে পারছিলেন না কেউই। সামনের জনকে হাসতে দেখে উপস্থিত সবাই হাসতে শুরু করছিলেন। এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা – হাসি থামানো যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি-র পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মহামারি বিশ্ব জুড়ে পরিচিত হয়েছিল ‘টানগানইকা লাফটার এপিডেমিক’ নামে। কারণ তানজানিয়ার আগে নাম ছিল টানগানইকা। সে সময় জাঞ্জিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল এই দেশ। পরে স্বাধীন হয়।

সেই গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ১৯৬২ সালের ৩১ জানুয়ারি কাশাশার একটি বোর্ডিং স্কুলের তিন ছাত্রীর মধ্যে প্রথম এই সংক্রমণ দেখা যায়। বিনা কারণে তাঁরা হাসতে শুরু করেন। তাঁদের থেকে দ্রুত স্কুলের বাকি পড়ুয়াদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ। স্কুলের মোট ৯৫ জন পড়ুয়া, যাঁদের গড় বয়স ১২ থেকে ২০ বছর। সকলেই সংক্রামিত হয়ে পড়েন এই রোগে। তবে রোগ ছড়ায়নি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে। শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। কাশাশা থেকে রোগ ছড়িয়ে পড়ে নসাম্বা নামে একটি গ্রামে। মোটামুটি ৪-৫ মাসের মধ্যে কমপক্ষে ২১৭ জন আক্রান্ত হন। মে মাসে স্কুল চালু হয় আবার। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হওয়ায় ফের বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে আরও একটি গ্রাম বুকোবাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এইভাবে মোট ১৪টি স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ।

রোগের উপসর্গ ছিল টানা ১৬ দিন হাসতে থাকা। সেইসঙ্গে ত্বকে র‍্যাশ বেরনো, শ্বাসকষ্ট, হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া, হাসতে হাসতে কঁকিয়ে কেঁদে ওঠা ইত্যাদি তো ছিলই। প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় হাসি রোগে আক্রান্ত ছিল দেশের অধিকাংশ গ্রাম।

আনন্দে সামান্য কেউ হেসে উঠলেই পাশের মানুষটি সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করতেন। ফলে হাসি হয়ে গিয়েছিল কান্নার দোসর। যদিও বিশ্বের অন্য কোনো প্রান্তে এমন রোগ আর কখনও দেখা যায়নি। আমরা আজ যখন পাশের মানুষটিকে বলি, “এত দুঃখ কীসের? হাসতে থাকো।” সদা হাস্যমান সেই মানুষটি যদি জানতেন হাসিও সংক্রামক হতে পারে। এবং তার ভয়াবহতা মানুষকে শেষ করে দিতে পারে।

না, আমরা হাসি থামাব না। এমন বিক্ষিপ্ত উদাহরণে আমরা বিচলিত হব না। বরং কঠিন সময়ে একে অপরের পাশে থেকে মনে মনে সংকল্প নেব, হাসিই জীবন, বন্ধু। হাসিমুখে কখনও জল শুকোবে না। একটা হাসিমুখের সমার্থক হয়ে উঠবে হাজার হাজার হাসিমুখ। জানতে বিস্ময় লাগে, আজ কেমন আছে উগান্ডার গ্রামগুলি! আজও কি হাসিমুখ দেখলেই তাঁরা ভয় পান? নাকি সব ভুলে হাসি-খুশির দিকে ভাব জমিয়েছেন? গোমড়া মুখ কারই বা ভাল্লাগে! বিশ্বকে যিনি নতুনভাবে হাসতে শিখিয়েছিলেন, সেই চার্লি চ্যাপলিন একসময় বলেছিলন, “যদি তুমি হাসতে পারো, তবেই বুঝতে পারবে তোমার জীবন সার্থক।” কারণ হাসিই আমাদের প্রেমে পড়তে শেখায়, লড়তে শেখায়।

 

 

কৃতজ্ঞতা: বঙ্গদর্শন

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>